ব্যর্থ মানুষের গল্প পর্ব ( ১ )

“তাই বলে একটা সিএনজি ড্রাইভারের বোনকে বিয়ে করবি? আমার মান সম্মান কোথায় থাকবে একটু ভেবে দেখেছিস?” মা খুব রেগে গেছেন। এই মুহূর্তে কথা না বাড়ানোই ভাল। তবুও মিনমিনে গলায় শাহেদ বলল “এই যুগে এমন মেয়ে পাওয়া যায় না মা। তুমি সারা জীবন ছেলের জন্য অসাধারন রূপবতী ভদ্র মেয়ে বৌ হিসেবে চেয়েছ। এই মেয়ের মধ্যে দু’টো গুণই রয়েছে।” বলেই মনে হল শাহেদের ভুল হয়েছে। রূপ তো কোন মেয়ের গুণ হতে পারে না। এটা আল্লাহর দান। মানুষের এতে কোন হাত নেই। তবে মেয়েটা যে ভদ্র সেটা তার গুণ।
মা “শুধু রূপ দেখলেই হবে না, ফ্যামিলি, শিক্ষা সব দেখতে হবে। বিয়েটা ছেলে খেলা না।”
শাহেদ “ওদের ফ্যামিলি, শিক্ষা দীক্ষা সব তুমি জান। ওরা তো আর তোমার অপরিচিত নয়। ছোট কাল থেকেই চেন।”
“চিনি বলেই তো রাজী না। ওর ভাইয়ের পরিচয় সিএনজি ড্রাইভার, বাবা ভূমি অফিসে চাকরি করতেন। আর তোর বাবা একজন ডাক্তার। আশা ছিল তুইও ডাক্তার হবি। তুই ডাক্তার তো হতেই পারলি না এমনকি কোন সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়েও চান্স পেলি না” শাহেদ এই কথা শুনতে শুনতে অভ্যস্থ হয়ে গেছে।
 

 শাহেদের বাবা একজন ডাক্তার। নামকরা ডাক্তার নন তবে ইনকাম খারাপ না। বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে শাহেদ বড় হয়ে ডাক্তার হবে এটাই ছিল বাবা মায়ের লক্ষ্য। কিন্তু ছোটকাল থেকেই শাহেদের লেখাপড়ার প্রতি মনযোগ নেই। এমনকি খেলাধুলার প্রতিও না। ক্লাস নাইনের শুরুতে শাহেদের স্কুল শিক্ষকরা শাহেদকে বিজ্ঞান বিভাগে দিবে না, মানবিক বা কমার্স বিভাগে দিবে তখন শাহেদের বাবা স্কুলে গিয়ে শিক্ষকদের সাথে আলোচনা করেছে “আমি ডাক্তার, ছেলেও ডাক্তার হবে। সরকারী মেডিকেলে চান্স না পেলে প্রাইভেট মেডিকেলে পড়াব। তাও ডাক্তার বানিয়ে ছাড়ব।” শিক্ষকরা ডাক্তার সাহেবকে বোঝালেন “শাহেদ সাইন্সে না পড়ে যদি আর্টস এ পড়ে তাহলে ভাল করবে।” আসলে শিক্ষকরা মনে মনে বলছিল “এই ছেলেকে সাইন্সে দিলে এসএসসিতে ফেইল করবে। আর্টসে দিলে কোন মতে পাশ করতে পারে!” কিন্তু শাহেদের বাবা একজন ডাক্তার, সম্মানিত ব্যক্তি তাই শিক্ষকরা এভাবে বললেন না। জোরাজরি করে ডাক্তার সাহেব তার ছেলেকে সাইন্সেই দিলেন। পরীক্ষাগুলোতে বিজ্ঞানের সাব্জেটগুলোতে ফেইল করতে থাকল। শিক্ষকদের কাছে এটাই স্বাভাবিক। আর ডাক্তার সাহেবের হতাশা বাড়তেই থাকল “ছেলেকে কি ডাক্তার বানানো যাবে না? ফরিদ ভাইয়ের ছেলেটা রংপুর মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। ওনার ক্লাসমেট হেনার ছেলেটাও বরিশাল মেডিকেলে পড়ে। ওনার ছেলে যদি ডাক্তার না হয় তাহলে সমাজে মুখ দেখাবেন কী করে?” ক্লাস টেনে ওঠার পরে ডাক্তার সাহেবের নতুন টেনশন শুরু হল “ছেলে এসএসসি পাশ করবে কি না!” তখন মনে হতে লাগল ‘শিক্ষকরা আসলেই ভাল পরামর্শ দিয়েছিল। ওনাদের কথা মত শাহদেকে আর্টসে দেয়া উচিৎ ছিল। আবার আর্টসের কথা শুনে নাক সিঁটকান। মানুষ আর্টসে পড়ে! কমার্স হলে না হয় একটা কথা ছিল, বিবিএ, এমবিএ পড়া যায়। শাহেদ বাংলা, ইংরেজী, সমাজ বিজ্ঞানে ভালই রেজাল্ট করছে কিন্তু পদার্থ, রসায়ন, বায়োলজীতে ফেইল করছে। তবে ওনার মতে যে ব্যাটা বিজ্ঞান বোঝে না সেই ব্যাটা আস্ত একটা গাধা। অবশ্য ওনার স্ত্রী অর্থাৎ শাহেদের মা আর্টসের ছাত্রী ছিলেন। শাহেদ যখন এসএসসিতে পাশ করল তখন ডাক্তার সাহবে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। স্কুলের সবাই অবাক হল- শাহেদ পাশ করেছে! ইন্টারে শাহেদের বাবা মায়ের ইচ্ছা অনুযায়ী কমার্সে ভর্তি করা হল। যদিও শাহেদের ইচ্ছা ছিল আর্টসে ভর্তি হওয়া। কিন্তু সমাজে মুখ দেখাতে কষ্ট হবে ভেবে শাহেদের বাবা জোর করে শাহেদকে কমার্সে ভর্তি করালেন। যার ফলে ইন্টারের রেজাল্টও ভাল না। বাংলা ইংরেজীতে ভাল নম্বর ছিল কিন্তু কমার্সের অংকের সাব্জেক্টগুলোতে কোন মতে পাশ করল। এরপর শাহেদের প্রতি তার বাবা মা সকল আশা ছেড়ে দিল। ডাক্তার সাহেব টেনশনে শোকে দুঃখে স্ট্রোক করলেন। মায়ের চুলও পাকতে লাগল। শাহেদ বোঝে না বাবা ডাক্তার হলেই কি ছেলে মেয়েকে ডাক্তার হতে হবে? নিজের ইচ্ছা মত বিষয়ে কি পড়া যাবে না? দুনিয়ার সবাই ডাক্তার হলে রোগী হবে কে? বাকী কাজগুলো কারা করবে? শাহেদ অবশ্য ওসব নিয়ে মাথা ঘামাত না। তার সাহিত্য ভাল লাগল। বিভিন্ন ব্লগে ঢুঁ মারা শুরু করল। ব্লগ জিনিসটাই তার কাছে জীবনের সেরা পাওনা মনে হল। ইচ্ছা মত লেখা যায়, লেখার ফিডব্যাকও পাওয়া যায়। লেখককে প্রশ্ন করা যায়। ঝগড়া করা যায়। কী মজা! এই জিনিস কেন আগে পায় নি? বাবার স্ট্রোকের কারনে অনার্স এ ভর্তি এক বছর পিছিয়ে গেল। এছাড়া শাহেদের ভর্তি নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই। সরকারী কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেল না। ওয়েটিং লিস্টেও নেই। ভর্তি হল একটা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজীতে। সাহিত্য শাহেদের প্রিয় সাব্জেক্ট। এই প্রথম শাহেদ লেখাপড়া করে মজা পেল। পছন্দের সকল বিষয় তার সিলেবাসে আছে। প্রথম সেমিস্টারে সবার চেয়ে বেশি নম্বর পেল। শাহেদ কত নম্বর পেল বা কী রেজাল্ট করল সেটা নিয়ে চিন্তা করে না, সে তার প্রিয় বিষয়গুলো পড়তে পারছে এটাই তার কাছে অনেক পাওনা। বাবার মত বলতে ইচ্ছে করে “মানুষ সাইন্স পড়ে!”
 

মঞ্জু শাহেদের স্কুল জীবনের বন্ধু। গল্পের শুরুতে যে অসাধারন রূপবতী মেয়েটির কথা বলা হয়েছে তার নাম সানজিদা, মঞ্জুর ছোট বোন। মঞ্জুর বাবা ভূমি অফিসে চাকরি করতেন। জীবনে অবৈধ উপার্জন করেন নি। তারা একই স্কুলে পড়ত। মঞ্জু ক্লাসের প্রথম দিকে ছাত্র ছিল। শাহেদের সাথে মঞ্জুর সম্পর্ক বেশ ভাল। দু’জন দু’জনের বাসায় যেত। মঞ্জুদের আর্থিক অবস্থা তখনও তেমন একটা ভাল ছিল না। যেহেতু শাহেদের বাবা সরকারী হাসপাতালের ডিউটির বাইরে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতেন তাই শাহেদের ফ্যামিলীর অবস্থা তখনও ভাল ছিল। শাহেদ মঞ্জুর বোনকে পিচ্চি অবস্থায় দেখেছিল, কিন্তু এতবার শাহেদের বাসায় যাওয়ার পরেও মঞ্জুর বোনকে বড় অবস্থায় শাহেদ কখনো দেখেনি। ইন্টারে পড়ার সময় মঞ্জুর বাবা হঠাৎ মারা যায়। তখন থেকে ওদের পরিবার অসহায় হয়ে পড়ে। কোন রকমে ইন্টার পরীক্ষা দিয়ে তিতুমীর কলেজে ভর্তি হয়। পেশা হিসেবে বেছে নিতে হয় সিএনজি অটো রিকশা। মঞ্জুর একার ইনকাম দিয়ে কোন মতে পরিবার চলে। ছোট বোন অনেক মেধাবী ছাত্রী তার লেখাপড়া বন্ধ করা যাবে না।
এক বছর আগে মঞ্জু একবার শাহেদের কাছে কিছু টাকা ধার করেছিল। বলেছিল –বোনের এইচএসসি পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপের টাকা লাগবে কিন্তু এই মুহূর্তে টাকা নেই। শাহেদ বলেছিল “সানজিদা এত বড় হয়ে গেছে! ক’দিন আগে পিচ্চি ছিল” মঞ্জু অবশ্য কিছুদিন পরেই টাকা ফেরত দিয়েছিল।
 

ব্যার্থ মানুষের গল্প পর্ব ( ২ )
রেসিপি দেখুন