মরুর ফুল ১

জায়েদ পূজা করছে। হাটু গেড়ে মাথা মাটিতে লাগিয়ে লাতের মূর্তির সামনে অনেক ক্ষন ধরে রইল। আধা ঘন্টা পরে সে যখন মাথা উঁচু করল তখন তার দু’চোখে পানি। জায়েদের যখনই মন খারাপ হয় তখনই সে এই মন্দীরে চলে আসে। আজ জায়েদের মন বেশি খারাপ। লাতের মূর্তিকে দেখে কিছুটা স্বস্তি পেল। দেবী লাতের কাছে তার একটাই প্রার্থনা- সে যেন তার ভালবাসার মানুষটিকে পায়। কিন্তু জায়েদ ভাল করেই জানে এটা অসম্ভব। মায়মুনাকে সে জীবনেও পাবে না।
আওস বংশের ছেলে ষোল বছর বয়সী জায়েদ বংশের গর্ব। বিশেষ করে তলোয়ার চালানোতে সে বংশের অনেক বড় বড় যোদ্ধার সাথে লড়তে পারে। তার বাবা হাম্মাদ আওস বংশের একজন প্রভাবশালী নেতা। তিনি একজন যোদ্ধা। খাজরাজ গোত্রের সাথে শত বর্ষ মেয়াদী ‘জঙ্গে বুয়াস’ যুদ্ধে তিনি প্রায় পঁচিশ বছর ধরে যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধে উনি ওনার এক হাত হারান। হাত হারালেও কী হবে, মনের শক্তি হারান নি। বংশের বড় অংশের লোকজন ওনাকে নেতা মানে। ওনার চার স্ত্রীর ঘরে বারো ছেলে আর তিন মেয়ে। জায়েদ হাম্মাদের দশম ছেলে।
ইয়াসরীবের (পরবর্তীতে মদীনা) যুদ্ধ বিরতির দিন গুলোতে বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যবসায়ীরা আসতেন। এই উপলক্ষ্যে মেলা হত। সেই মেলার মূল পণ্য ছিল যুদ্ধাস্ত্র। তলোয়ার, বল্লম, তীর, ধনুক, ঘোড়া, উট ইত্যাদি জিনিস ছাড়াও কাপড়, অলংকার, খাবার এসব জিনিস পাওয়া যেত। তবে যুদ্ধাস্ত্র বেচত মূলত ইহুদীরা। দুই পক্ষের লোকজনই এই মেলায় অবাধ যাতায়াত করত। তবে দুই পক্ষের কেউ কারো সাথে ঠিক মত কথা বার্তা বলত না। কারণ জানে, ঐ পক্ষের কারো না কারো হাতে এই পক্ষের কেউ না কেউ, কার বাবা, কারো ভাই নিহত হয়েছেন। এছাড়া আর কিছুদিন পরেই যুদ্ধ শুরু হবে, তখন একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে হাতে অস্ত্র তুলে নিবে। কী দরকার এই সময়ে বন্ধুত্ব করার!
এক দিন মেলায় জায়েদ তার ছোট বোন রুকাইয়াকে নিয়ে গেল। রুকাইয়া ছিল ভাল তীরন্দাজ, তার ইচ্ছা যুদ্ধে গিয়ে সে বাবার হাত হারানোর প্রতিশোধ নিবে। এছাড়া রুকাইয়া জায়েদের দাদার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিবে। রুকাইয়ার খুব ইচ্ছা একটা ঘোড়া কিনবে। এছাড়া নারী সূলভ গহনার প্রতি তার আগ্রহ তো আছেই।
একটা গহনার দোকানের দিকে রুকাইয়া গেল। বিভিন্ন গহনা দেখে একটা পছন্দ করল। কিন্তু তার পাশে ভাই জায়েদ নেই। জায়েদের কাছেই সব টাকা। সে একটু দূরে ঘোড়ার দোকানে গেল। একটা তেজী ঘোড়া তার খুব পছন্দ হয়েছে। কিন্তু এই ঘোড়া রুকাইয়াকে দেয়া যাবে না। মেয়ে মানুষ এত তেজী ঘোড়া সামলাতে পারবে না। রুকাইয়ারও ঘোড়াটা খুব পছন্দ হল। এক আবিসিনিয়ান দাস ঘোড়াটা রুকাইয়াকে দেখাল। এই ঘোড়ার উপকারিতা সম্মন্ধে বর্ণনা করল। কাস্টমার টের পেয়ে মালিক নিজেও সেখানে হাজির। ঘোড়ার চাইতে রুকাইয়ার বেশি আকর্ষণিয় লাগল এই দাসকে। এই ছেলের বয়স আর জায়েদের বয়স একই হবে। শক্ত সামর্থ শরীর, চেহারায় একটা মায়াবী ভাব আছে। রুকাইয়া জায়েদকে অনেকটা জোরে করে সেই গহনার দোকানে নিয়ে গেল। সে মূলত এই দাসের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে চাইছে। এই ছেলেকে যতই দেখছে ততই মনের মধ্যে কেমন যেন অনুভূত হচ্ছে। এ জন্যই সে জায়েদকে দ্রুত গহনার দোকানে নিয়ে গেল। জায়েদ যদি কিছু টের পেয়ে যায়! জায়েদও রুকাইয়ার আচরণে অবাক হল। যে রুকাইয়া ঘোড়ার জন্য পাগল সে ঘোড়া বাদ দিয়ে গহনার দিকে আগ্রহী বোধ করল কেন?
রুকাইয়া যে গহনা পছন্দ করেছে দোকানে এসে দেখে সেই গয়না আরেক মেয়ের হাতে। রুকাইয়া দোকানীকে বলল “আমাকে ঐ গহনা দিন”
দোকানী উত্তর দিল “আমার কাছে এটা একটাই আছে। উনি না নিলে আপনি নিতে পারেন”
পাশে দাঁড়ানো মেয়েটি ইতি মধ্যে গয়নার দাম দেবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে তখনই রুকাইয়ার কথা শুনে সে গহনা দোকানদারকে ফেরত দিয়ে বলল “ঠিক আছে, উনি যখন চাইছে তখন আমি আরেকটা নিব। এটা ওনাকে দিন।”
দোকানী গহনা হাতে নিতেই কোথা থেকে দুই যুবক হাজির হল। একজন দোকানীকে বলল “খাজরাজ বংশের মেয়েরা যে জিনিসে হাত দেয় তা ফেরত দেয় না। গহনাটা ওকে দিন।”
মুখে কাটা দাগওয়ালা এক যুবকের কন্ঠে শোনা গেল এই কথা। সে মেয়েটির ভাই, খাজরাজ গোত্রের অন্যতম সেরা যোদ্ধা সালেহ। একটু দূর থেকে দাঁড়িয়ে সে মায়মুনার (তার চাচাতো বোন) কথা শুনছিল। বোনের পাশে আওস বংশের জায়েদ এসে যাওয়াতে সে দ্রুত বোনের কাছে চলে আসে। ততক্ষনে মায়মুনা দোকানদারকে গয়না ফেরত দিয়েছে। এদিকে দোকানীও গয়না জায়েদের বোন রুকাইয়াকে দিতে যাবে ঠিক এই সময়ে সালেহের এই কথা শুনে দোকানী থমকে দাঁড়ালো। দোকানী জানে, এরা অনেক খারাপ। বর্বর জাতি। সামান্য গয়নার উছিলায় এরা একশ মানুষ খুন করতে পারে। দোকানী তামাশা দেখার জন্য চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
মায়মুনা ভয়ে চুপ করে রইল। সে জানে যে কোন মুহুর্তে একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। সালেহের কথা শুনে জায়েদের রক্ত গরম হয়ে গেল। সালেহের পিতা আজ থেকে দশ বছর আগে জায়েদের দাদাকে যুদ্ধের সময়ে হত্যা করেছিল। জায়েদের বাবার হাত হারানোর পেছনেও এই পরিবারের একজন জড়িত। এরপর থেকেই জায়েদের টার্গেট সালেহের বাবকে নিজ হাতে খুন করা। সালেহের বাবাকে খুন করতে না পারলেও গত পাঁচ বছর আগের যুদ্ধে সালেহের বড় চাচাকে হত্যা করেছে তার বাবা। গয়নাটা হাতে নেয়া এখন একটা প্রেস্টিজের ব্যপার হয়ে দাঁড়াল।
জায়েদ সামনে এগিয়ে গেল “এই গয়না তোমরা কিনেছ? আমরা আগে পছন্দ করে রেখেছি। দাম দেয়ার জন্য এসেছি। এছাড়া সে (মেয়েটার দিকে আঙ্গুল দিকে) গয়নাটা ফেরত দিয়েছে।”
“মায়মুনা বাচ্চা মেয়ে বলে জানে না বলে তার বাবার খুনীর মেয়েকে গয়না ফেরত দিয়েছে” সালেহের কন্ঠে তীব্র ঝাঁজ।
মায়মুনা এবার তীক্ষ্ণ চোখে জায়েদ আর রুকাইয়ার দিকে তাকালো। তাহলে এদের বাবাই তার বাবাকে হত্যা করেছে? ছোট কাল থেকেই মায়মুনার স্বপ্ন একটাই- সুযোগ পেলে সেই হত্যা কারীর পুর পরিবারকে হত্যা করা। কিছুক্ষন আগের অপরূপা সুন্দরী মায়মুনার চেহারা বদলে গেল, সেখানে দেখা গেল প্রতিশোধের নেশা। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে দুই গোত্রের মুরুব্বীরা চলে আসলেন। তারা কোন মতে ঝগড়া মিটিয়ে দুই পক্ষকে দূরে সরে যেতে বললেন।
জায়েদ ও রুকাইয়া ঘোড়ার দোকানে গেল। সেখানে সেই আবিসিনিয়ান সূদর্শন গোলাম নেই। হয়তো আশে পাশে গেছে। রুকাইয়ার ইচ্ছা সেই তেজী ঘোড়ায় চড়বে, পছন্দ হলে নিবে। কিছুক্ষন আগের ঘটনার জন্য তার মনে যুদ্ধ বাসনা জেগে উঠেছে। এই তেজী ঘোড়াটা তার লাগবেই লাগবে। দোকানী তাকে মানা করল এই ঘোড়ায় যাতে না উঠে। রুকাইয়া কারো বারণ না শুনে ঘোড়ায় উঠল। ঘোড়াটা কিছুক্ষন লাফালাফি করে চুপ হয়ে গেল। তার মানে ঘোড়াটা বাগে এসেছে। জায়েদের বুক গর্বে ফুলে উঠল। হঠাত করে ঘোড়াটা লাফাতে শুরু করল। রুকাইয়া চেষ্টা করেও কোন ভাবে ঘোড়ার কন্ট্রোল নিতে পারছিল না। জায়েদ ঘোড়ার লাগাম ধরার চেষ্টা করতেই ঘোড়া মেলার বাইরে দৌড় দিল। জায়েদ ঘোড়ার পিছনে পিছনে দৌড়াল। কিন্তু গেত শক্তিশালী ঘোড়ার পেছনে দৌড়ালে কি ধরা যায়? হঠাত এক ঘোর সওয়ার এসে হাজির। সে রুকাইয়ার ঘোড়ার পাশাপাশি ঘোড়া ছুটাল। অনেক ক্ষন চেষ্টা করে সে ঘোড়ার লাগাম ধরল। কিন্তু ঘোড়া এখনো কন্ট্রোলে নেই। সে তার ঘোড়া কাছে নিয়ে লাফিয়ে রুকাইয়ার ঘোড়ায় চড়ল। রুকাইয়া সামনে আর লোকটা পেছনে ঘোড়ার পিঠে বসে আছে। ধীরে ধীরে ঘোড়াটা থেমে গেল। ততক্ষনে তারা দুই মেইল দূরে চলে গেছে। লোকটা ঘোড়া থেকে নেমে গেল। রুকাইয়া এতক্ষন খেয়াল করেনি কিন্তু এখন লোকটার চেহারা দেখে এতক্ষনের রাগ, উৎকণ্ঠা সব দূর হয়ে গেল। এ যে সেই আবিসিনিয়ান গোলাম যে এই ঘোড়া দেখিয়েছিল। রুকাইয়ার মনে হল ইশ এতক্ষন এই লোকটা তাকে জড়িয়ে ধরেছিল! আরো কিছুক্ষন যদি জড়িয়ে ধরে রাখত! মাথা থেকে দ্রুত চিন্তা দূর করে দিল। কেউ যদি জানতে পারে সে গোলামকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছে তাইলে তাকে জীবন্ত পুঁতে ফেলবে।
জায়েদ গোলামকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাড়ীর পথ ধরল। দোকানদার অবশ্য গোলামকে ঘোড়াটা জায়েদদের বাড়ীতে দিয়ে আসতে বলল- পথে যদি কোন সমস্যা হয়। নতুন ঘোড়া বাড়ী নিয়ে যাচ্ছে, এই আনন্দ যেমন রুকাইয়ার মনে ছিল তেমনি আরেক আনন্দ- দাস ছেলেটা তাদের সাথে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে উঁকি মেরে আড়ালে আড়চোখে সে দাসের দিকে তাকাচ্ছিল। রুকাইয়া ঘোড়ার পিঠে আর দাস ঘড়ার লাগাম ধরে হেঁটে যাচ্ছিল, তাই রুকাইয়ার দেখতে সুবিধা হচ্ছিল। রুকাইয়ার আফসোস- এর সুন্দর একটা ছেলে আজীবন ক্রীতদাস হয়ে থাকবে।
এদিকে জায়েদের মনে আরেক ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। সেই ঝড়ের নাম মায়মুনা। যে পরিবারের লোকজনকে তাদের জন্য হত্যা করার ফরজ সেই পরিবারের মেয়ের চেহারা সে ভুলতে পারছে না। এই মেয়ের চোখ দেখেই সে পাগল হয়েছে। জায়েদ আগে থেকেই মায়মুনাদের পরিবার সম্মন্ধে জানত। ঐ পরিবারের কাকে কাকে হত্যা করতে হবে সেই তালিকার করার সময় চৌদ্দ বছর বয়সী মায়মুনার নামও ছিল। জায়েদ অবশ্য জানে এই পরিবার যেমন মায়মুনার পরিবারের তালিকা নিয়েছিল তেমনি মায়মুনার পরিবারও নিশ্চয়ই জায়দের পরিবারের তালিকা নিয়েছে। জায়েদ জানে না, এভাবে আর কত শতাব্দী যুদ্ধ করে করে চলবে। ইতি মধ্যে দুই বংশের মুরুব্বী সংখ্যা কমে গেছে। আর দুই তিন বছর যুদ্ধ করতে গেলে হয়তো আর কেউ বেচে থাকবে কি না সন্দেহ হচ্ছে।
চলবে....
রেসিপি দেখুন