মরুর ফুল ২
রুকাইয়াদের বাড়ীতে দুই জন দাস ছিল। একজনের বয়স হয়ে গেছে। একে দিয়ে কাজ চলে না। জায়েদ রুকাইয়ার সাথে সেই আবিসিনিয়ান দাস যখন বাড়ীতে ঢুকল তখন রুকাইয়ার বাবা হাম্মাদের নজর প্রথমে দাসের উপরে পড়ল। এই দাস পেলে তো তার অনেক কাজে লাগে। জায়েদের কাছ থেকে সেই দোকানের কথা শুনে হাম্মাদ এই দাসকে কিনতে সেখানে লোক পাঠালেন। সে দিনই রুকাইয়াদের বাড়ীতে নতুন এক আবিসিনিয়ান দাস আসল-যার নাম ইউসূফ।ইউসূফকে পেয়ে এই বাড়ীর সবচেয়ে বেশি খুশী হয়েছে রুকাইয়া। দিন আট দশ বার ইউসূফের চেহারা না দেখলে রুকাইয়ার মন ভরে না। ইউসূফের প্রথম কাজ হল হাম্মাদের বাড়ীর ভেড়ার পালের পরিচর্যা। প্রতিদিন সকালে সে ভেড়ার পাল নিয়ে বেরিয়ে যেত। মাঝে মাঝে রুকাইয়া গোপনে গোপনে সেই ভেড়ার পালের পিছু নিত। বিভিন উছিলায় সে ইউসূফের সাথে কথা বলত। ব্যাপারটা জায়েদের চোখে পড়ে। একদিন সে ইউসূফকে শাষায় “দেবী লাতে কসম, তুই যদি রুকাইয়ার সাথে আর একবার কথা বলিস তাহলে তোকে মেরে ফেলব।” ইউসূফ বোঝে রুকাইয়া তাকে ভালবাসে। কিন্তু ইউসূফের কিছু করার নেই। তার ঘর বাড়ী কিছুই নেই। তার বাবা মা আবিসিনিয়ার খৃস্টান ছিল। ইউসূফ যখন খুব ছোট তখন এক সফরে তার বাবা মারা গেল। রাস্তায় একা পেয়ে তার মাকে ডাকাত দল ধরে নিয়ে যায় আর মা ছেলে সহ এক আরবের কাছে বেচে দেয়। ইউসূফ যুবক হলে তার ডিমান্ড বেড়ে যায়। তার মালিক বেশি দামে আরেক আরবের কাছে তাকে বিক্রি করে দেয়। সেই থেকে মা ছেলে আলাদা।
রাত্রি দ্বি প্রহর। ইউসূফ বাড়ীর বাইরে বাগানের শেষ মাথায় বসে আছে। উজ্জ্বল চাঁদের আলোতে সে জোস্না দেখছে। তার দুই চোখে পানি। কত দিন সে তার মাকে দেখেনা। আর কত দিন এ গোলামী জিন্দেগী সইবে? তারও তো স্বাধীণ মানুষের মত বাঁচতে ইচ্ছে করে। পাশে একজনের অস্তিত্ব টের পাওয়া গেল। না তাকিয়েও ইউসূফ বুঝতে পারল পাশে রুকাইয়া বসেছে। সেই ইউসূফের কাঁধে হাত রাখল। এই মেয়েটির জন্যও ইউসূফের সূঃখ হয়। একজন গোলামকে সে ভালবাসে যে গোলামের দুনিয়ার কোথাও সম্পদ নেই। রুকাইয়া একবার তাকে বলেছে তাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে। কিন্তু ইউসূফ যাবে কোথায়?
অনেক ক্ষন চুপ থাকার পরে রুকাইয়া মুখ খুলল “কিছু বলছ না কেন? পালিয়ে যাওয়ার কথা কী ভাবছ?”
ইউসূফ চুপ করে রইল। অনেক ক্ষন পরে আকাশের পানে চাইল “এই দুনিয়া শুধু শক্তিশালীদের জন্য। আমাদের জন্য শুধু অপমান, অপবাদ। আমরা তোমাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখতে পারি না। এটা পাপ। আমার মা আমাকে বলতেন- তিনি আবিসিনিয়ার পাদ্রীদের মুখে শুনেছেন পৃথিবীর দুরাবস্থা দেখে সৃষ্টি কর্তা বসে থাকবেন না। তিনি একজন নবী পাঠাবেন। আমি সেই নবীর অপেক্ষায় আছি। আশা করি উনি আমাদের মুক্তির ব্যবস্থা করবেন।”
রুকাইয়া হেসে বলল “এসব ফালতু কথা আমিও শুনেছি। কেউ আসবে না। এভাবে দুই গোত্র যুদ্ধ করতে করতে শেষ হয়ে যাবে। তার চেয়ে বরং পালিয়ে যাই। এই যুদ্ধ আর ভাল লাগে না। শান্তির সময় শেষ হয়ে গেছে। আগামী চাঁদেই আবার যুদ্ধ শুরু হবে। তখন তোমাকেও যুদ্ধে কাজে লাগানো হবে। সেখানেই হয়তো তোমার কিছু হয়ে যেতে পারে” বলতে বলতে রুকাইয়ার গলা ধরে গেল “কেউ আমাদের বাঁচাতে আসবে না। ছোট বেলায় মেলায় এক গণক এসেছিল। সেই সেই নবীর কথা বলেছে। কিন্তু আমি নবীর কোন লক্ষণই দেখছি না।”
“আমি আশা ছাড়িনি রুকাইয়া” রুইকাইয়ার দিকে তাকিয়ে ইউসূফ বলল “শেষ বার যখন আমার মনীবের সাথে মক্কায় গিয়েছিলাম তখন শুনেছি সেখানে কুরাইশ বংশের এক লোক নিজেকে নবী বলে দাবী করেছে। লোকটি দুনিয়া বদলাবে কী করে? উনি নিজেই থাকেন বিপদে। উনি ওনার আদর্শ প্রচার করতে বের হলে লোকরা পাথর ছুঁড়ে মারে। উনি অনেকটা গৃহ বন্দী।”
“এমন লোক দিয়ে কিছুই হবে না। এমন লোক লাগবে যিনি হবেন রাজা বাদশা পর্যায়ের। উনি চাইলে সমাজ পরিবর্তন করতে পারবেন। রোমে কিংবা পারস্যের সম্রাট ছাড়া এ পরিবর্তন সম্ভব না” রুকাইয়া বলল।
হঠাত আশেপাশে থেকে পাঁচ ছয় জন লোক জড়ো হল। এরা রুকাইয়ার বাবা, চাচা, চাচাতো ভাই। রুকাইয়াকে একজন একটা থাপ্পড় মেরে বলল “বংশের ইজ্জত শেষ করলি। তোকে আজ জীবন্ত কবর দিব।”
ইউসূফকে একজন বেতারঘাত শুরু করল। ব্যাথায় ইউসূফ চিৎকার করতে লাগল। ইউসূফকে একটা গাছের সাথে বেঁধে বেদম প্রহার করা হল। অপর দিকে রুকাইয়াকেও অনেক মারা হল। জায়েদ না আসলে হয়তো রুকাইয়াকে পিটিয়েই মেরে ফেলত। পরিবারে রাতে ছোট খাট সভার আয়জন করা হল। সিদ্ধান্ত হল- দাসের সাথে প্রেম করতে পারে এমন মেয়েকে তারা বাঁচিয়ে রাখবে না। সকালেই তাকে জীবন্ত কব্র দেয়া হবে। রুকাইয়ার বড় দুই বোনকে জন্মের সময়ই জীবন্ত কবর দেয়া হয়েছিল। পর পর দুই কণ্যার পরে যখন জায়েদ হল তখন রুকাইয়ার বাবা শান্ত হল। পরের যখন রুকাইয়ার জন্ম হল তখনও তাদের পরিবারের ইচ্ছা হয়েছিল এই মেয়েকেও জীবন্ত কবর দেয়া হবে। কিন্তু রুকাইয়ার দাদীর কারণে তাকে বাঁচিয়ে রাখা হল। এখন সেই মেয়ে দাসের সাথে প্রেম করে! দাঁড়া, তোর প্রেম বের করছি। সকালেই তোকে মেরে ফেলা হবে। রুকাইয়ার মা বেঁচে নেই। থাকলে তিনি হয়তো রুকাইয়াকে বাঁচানোর একটা ব্যবস্থা করতেন।
চলবে....