মরুর ফুল ৩
এদিকে ইউসূফ যেদিন জায়েদদের বাড়ীতে আসল সেদিন ঘটে গেল আরেকটি ঘটনা। জায়েদ বিকালে ভেড়ার পাল ফিরিয়ে আনার জন্য মাঠে গিয়েছিল। মাঠে গিয়ে দেখে ওদের বৃদ্ধ দাস একটা গাছের নিচে ঘুমাচ্ছে। জায়েদ দাসকে না জাগিয়ে নিজেই ভেড়ার পালের কাছে গেল। কিছু কিছু ভেড়া অনেক দূরে চলে গিয়েছিল। যেখানে চলে গিয়েছিল সেটা মূলত খাজরাজদের এলাকা। যদিও যুদ্ধ বন্ধের দিন গুলোতে সব এলাকায় সবাই যেতে পারে কিন্তু আজ যেহেতু একটা ঘটনা ঘটে গেছে তাই জায়েদ একটু সাবধানে এগুলো।ভেড়াগুলো খুব দুষ্টু, সহজে কাছে আসতে চায় না। জায়েদ একটা বাগানের ভিতরে প্রবেশ করল। এই বাগানটা ইহুদী আ’দ এর। উনি অনেক সম্পদের মালিক। উনি জায়েদের পরিবারে অনেক সাহায্য করেছেন। বিশেষ করে তিনি বাকীতে অস্ত্র বিক্রি করে থাকেন। পরে তিনি চড়া সূদে কিস্তিতে দাম নিয়ে থাকেন। জায়েদ এই লোকটাকে একদম দেখতে পারে না। জায়েদের ধারনা এই ইহূদীরাই মূলত বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধ টিকিয়ে রেখেছে। ওদের উদ্দেশ্য দুইটা, এক- ইয়াসরীবের আরব জনগণ যুদ্ধ না করে এক পক্ষ হলে এই ইহুদীদের বেইল থাকবে না আর দুই, বছরের পর বছর ধরে অস্ত্র ব্যবসা করা। এরা মীঊলত পারস্য ও রোম থেকে কম দামে অস্ত্র কিনে এখানে বেশি দামে বিক্রি করে। এমনকি মেলায় যেসব অস্ত্র ব্যবসায়ী আসে তাদের সবাই ই ইহুদী। জায়েদ ভাবে এত অল্প সংখ্যক ইহুদী কীভাবে গোটা ইয়াসরীবের লোকদের কন্ট্রোল করছে।
“আর এক পা এগোলেই আপনার জীবন শেষ হয়ে যাবে” নারী কণ্ঠে এত রূঢ় কথা মানায় না। কিন্তু জায়েদকে শুনতে হল। জায়েদ পেছনে তাকাল, তাকিয়েই তার শরীর হিম হয়ে গেল। এ তো মায়মুনা, সালেহ এর মেয়ে। ধনুকের তীর বসানো আছে, শুধু মাত্র একটু অসাবধান হলেই এই তীর জায়েদকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিবে। জায়েদের মনে হল এই মেয়েকে তীর ধনুক হাতে মানায় না। এর হাতে ফুল মানায়। মেলায় এই মেয়েকে ভাল করে দেখতে পারে নি। এখানে দেখছে, জায়েদের মনে হল এভাবে তীর হাতে বছরের পর বছর ধরে মেয়েটি যদি তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে তাহলে সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে। জায়েদ মুখ খুলল “এত সুন্দর হাতে তীর ধনুক মানায় না। এই হাতে মেহেদীর রঙ থাকবে। ফুল হাতে কারো অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকবে।” জায়েদ কী বলছে তা নিজের কানেই অদ্ভুত শোনাল। জায়েদের কথা শুনে মায়মুনার গাল লজ্জায় লাল হয়ে গেল। পরক্ষনেই আবার চোখ মুখ শক্ত করে বলল “আপনি আমার পিতার হত্যাকারীর ছেলে। আপনাকে হত্যা করলে আপনার পিতা কষ্ট পাবে যেমন কষ্ট আমি পেয়েছিলাম।”
জায়েদ বলল “এখন যুদ্ধ বন্ধের দিন। তুমি আমাকে মারলে সন্ধি ভঙ্গ হবে। এছাড়া এটা ইহুদীদের বাগান। ইহুদীদের সীমানায় কাউকে হত্যা করলে তার পরিণতি নিশ্চয়ই জানা আছে? শুধু শুধু নিজের বিপদ ডেকে এনো না”
মায়মুনা জানে জায়েদ সত্যি কথা বলছে। এই ইহুদী ওদের কাছে বাকীতে অস্ত্র বেচে। উনি অস্ত্র না দিলে এবার যুদ্ধ করবে কীভাবে? আর যুদ্ধ করতে না পারলে ওরা বাপ, দাদার হত্যাকারীদের হত্যা করবে কীভাবে। সে তীর খুলে তুনিরে রেখে দিল।
“আমি ভেড়া খুঁজতে এসেছি। নইলে আমি ইহুদীদের এলাকা এড়িয়ে চলি” বলে জায়েদ এবার নিজেই তীর ধনুক মায়মুনার দিকে তাক করল “এক চুল যদি নড় তাহলে তোমার জীবন শেষ হয়ে যাবে”
মায়মুনা আকাশ থেকে পড়ল। কিছুক্ষন আগে সে যাকে সুযোগ পেয়েও হত্যা করেনি সে এখন বেঈমানী করল! আসলে আরবরা এমনই, বেঈমানীর রক্ত এদের শরীরে বইছে। জায়েদ তীর ছুঁড়ে দিল। তীর মায়মুনার পায়ের কাছে মাটিতে বিঁধল। সেদিকে তাকিয়ে মায়মুনা কাঁপতে লাগল। একটা প্রচন্ড বিষাক্ত সাপের গায়ে তীর বিদ্ধ হয়েছে। এই সাপ মায়মুনার খুব কাছে চলে এসেছিল। আরেকটু হলেও কামড় দিত। এটা কামড়ালে মৃত্যু নিশ্চিত।
সে জায়েকে কোন ভাষায় কৃতজ্ঞতা জানাবে তা বুঝতে পারছিল না। তার মাথায় শুধু সাপের কথা আসছিল। আবার এটাও সে ভেবে পাচ্ছিল না যে শত্রুর ছেলে হয়েও জায়েদ কেন তাকে উদ্ধার করেছে। সাপের কামড়ে শত্রু মারা গেলে চুক্তি ভং হবে না, এটা তো জায়েদের জানার কথা। সে কোন মতে বলল “আপনি আমাকে নতুন জবন দান করেছেন। লাত, মানাতের কসম আপনার মত লোক যদি দুই বংশে থাকত তাইলে আর যুদ্ধ করতে হত না। আপনি কি আমার জীবন বাঁচানোর জন্য কোন দাম চান? আমার নিজের বলতে একটা তলোয়ার আছে।” সেই আমলে তলোয়ারকে অনেক দামী পণ্য হিসেবে ধরা হত।
জায়েদ মুচকি হেসে বলল “একটা উপায়ে তুমি আমাকে দাম দিতে পার। আগামীকাল ঠিক এই সময়ে এখানে আসবে। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব।”
মায়মুনার মনে ঝড় বয়ে গেল। জায়েদ কী বোঝাতে চাইছে সে বুঝেছে। কিন্তু এ তো অসম্ভব! আওস খাজরাজ বংশের মধ্যে আজীবন শত্রুতা। তার নিজেরও জায়েদের প্রতি আকর্ষন বেড়ে যাচ্ছে। আর এই ছেলের সামনে আসলে ........ মায়মুনা কিছু ভাবতে পারল না। সে পেছনে ঘুরে চলে যেতে যেতে বলল “আমাদের বাড়ী খুব কাছে। আপনাকে দেখে ফেললে মেরে ফেলবে। আপনি এখানে ভুলেও কখনো আসবেন না। আমি আপনাকে আমার তলোয়ার উপহার দিব। এরপরে আপনি এখানে আর জীবনেও আসবনে না।”
“তুমি আসবে তো” পেছন থেকে জায়েদের প্রশ্ন।
“তলোয়ার নিয়ে আগামীকাল আসব। আপনাকে মারতে।” মায়মুনার মুখে দুষ্টুমির হাসি।
জায়েদের মনে হল এটাইতো জীবন। খামাখা যুদ্ধ বিগ্রহ করে লাভ আছে?
পর দিন তারা দেখা করল। মায়মুনা তলোয়ার নিয়ে এসেছে। তার মন খারাপ “এই নিন তলোয়ার, এটা আমার নিজে কেনা। ইচ্ছা ছিল এটা দিয়ে আপনাদের গর্দান নেব। কিন্তু আমার এখন মনে হচ্ছে এটা জীবনেও সম্ভব না। আপনাকের দেখলে....” মায়মুনা কথা শেষ করতে পারল না।
জায়েদ বুঝতে পেরেছে মায়মুনার মনের অবস্থা। আসলে কী লাভ এই সম্পর্ক করে? গত এক শতাব্দী ধরে তার শুধু যুদ্ধই করছে। অথচ চার পাঁচ পুরুষ আগে দুই বংশের মধ্যে বিয়ে সাদী হত। যুদ্ধটা কবে শেষ হবে? আর ভাল লাগে না। এই চাঁদ শেষ হয়ে গেলেই যুদ্ধ শুরু হবে। তখন মায়মুনা ও জায়েদ উভয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে যুদ্ধ নিয়ে নিয়ে। কেউ কারো সাথে আর দেখা করতে পারবে না।
জায়েদ মুখ খুলল “বিশ্বাস কর, গতকাল তোমাকে এখানে দেখার পরে গতকাল সারা রাত দুই চোখে শুধু তোমাকেই দেখেছি। তুমি যদি আওস বংশের মেয়ে হতে তাহলে বাবাকে এখনই তোমার কথা বলতাম। তোমাকে বিয়ে করে বাড়ী নিয়ে আসতাম। কিন্তু নিয়তির এ কি পরিহাস! তোমার নাম মুখে নিলেই আমাকে বংশের বাইরে নিক্ষেপ করা হবে। আমি এখন কী করব?”
মায়মুনা চুপ করে রইল।
জায়েদ কথা বলল “আমি যদি গোত্র প্রধান হতাম তাহলে আমি শান্তি চুক্তি করার জন্য তোমাদের গোত্র প্রধানের কাছে যেতাম। আজীবনের জন্য যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যেত।”
“আপনি এখানে বসে যেভাবে কথা বলছেন যুদ্ধের ময়দানে গেলে তা সম্পূর্ণ ভুলে যাবেন” মায়মুনা মুখ খুলল “যখন দেখবেন আপনার পিতার হত্যা কারী আপনার সামনে তখন কি আপনি চোখ বুজে থাকবেন?”
জায়েদ অস্বীকার করল না। আওস বংশের অত্যন্ত শক্তিশালী যোদ্ধা জায়েদের আজ নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে।
পরদিন সকালে সে দেবী লাতের মন্দীরে গেল। এই দেবীর মূর্তি দেখলে জায়েদের মন ভাল হয়ে যায়।
জায়েদ পূজা করছে। হাটু গেড়ে মাথা মাটিতে লাগিয়ে লাতের মূর্তির সামনে অনেক ক্ষন ধরে রইল। আধা ঘন্টা পরে সে যখন মাথা উঁচু করল তখন তার দু’চোখে পানি। জায়েদের যখনই মন খারাপ হয় তখনই সে এই মন্দীরে চলে আসে। আজ জায়েদের মন বেশি খারাপ। লাতের মূর্তিকে দেখে কিছুটা স্বস্তি পেল। দেবী লাতের কাছে তার একটাই প্রার্থনা- সে যেন তার ভালবাসার মানুষটিকে পায়। কিন্তু জায়েদ ভাল করেই জানে এটা অসম্ভব। মায়মুনাকে সে জীবনেও পাবে না।
গতকাল মায়মুনার সাথে দেখা হয়েছিল। মায়মুনা মাত্র একটি কথা বলেছে “আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। যুদ্ধ শুরুর আর দশ দিন বাকী। যুদ্ধ শুরুর দুই দিন আগে আমার বিয়ে হবে। আমার সাথে এখানে দেখা করার চেষ্টা কর না। আমার ভাই ইতিমধ্যে আমাকে সন্দেহ করতে শুরু করেছে আমি এখানে প্রতিদিন একই সময়ে আসি কেন। দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।”
রুকাইয়ার নিষেধ করার সত্বেও জায়েদ পর দিন ঠিক একই সময়ে ইহুদীর বাগানে এল। রুকাইয়া আজ আসেনি। চারিদিকে শুন শান নিরবতা। হঠাত করে চারিদিকে আট দশ জন লোক এসে তাকে ঘেরাও করে ফেলল। জায়েদ এদের সবাইকে চেনে। এরা সবাই মায়মুনার ভাই। জায়েদের হাতে অস্ত্র থাকলে না হয় একটা চেষ্টা করা যেত। চারদিক দিয়ে তারা জায়েদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিল, ঘুষি, লাথি দিয়ে মারল, কেউ অস্ত্র ব্যবহার করল না। কিছুক্ষন মার ধোর করে জায়েদ যখন অচেতন হয়ে পড়ল তখন তারা চলে গেল।
জায়েদের যখন জ্ঞান ফিরল তখন রাত। কতক্ষন সে এভাবে পড়ে ছিল বলতে পারবে না। শরীরে প্রচন্ড ব্যথা নিয়ে সে উঠে দাঁড়াল। কোন মতে হাঁটতে হাঁটতে সে বাড়ীর পথে এগুলো। জায়েদ মার খেয়েছে এটা কোন ব্যপার না। যোদ্ধাদের মার খেতে হয় কিন্তু তার চিন্তা মায়মুনাকে নিয়ে। আর মাত্র সাত দিন পরে মায়মুনার বিয়ে হয়ে যাবে। যার সাথে বিয়ে হবে তার বাড়ী মক্কায়, কুরাইশ বংশের ছেলে। কুরাইশ বংশের সাথে আওস খাজরাজ দুই গোত্রের সম্পর্ক ভাল। তাদের অনেকেরেই আত্মীয় স্বজন মক্কায় আস করেন। জায়েদের এক ফুফুর বিয়েও মক্কায় হয়েছিল।
জায়েদ যখন টলতে টলতে বাড়ী পৌঁছাল তখন বাড়ীতে হুলুস্থুল কান্ড চলছে। একদল লোক তাদের গোলাম ইউসূফকে মারছে আরেকদল লোক রুকাইয়াকে মারছে। জায়েদ শরীরের এই অবস্থা নিয়ে রুকাইয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। যারা মারছে তাদেরকে বাঁধা দিল। তার গায়ে চাবুকের আঘাত লাগল। এমনিতেই জায়েদের শরীর দূর্বল এর উপরে চাবুকের আঘাতে সে আবারো জ্ঞান হারাল।
বিঃদ্রঃ ভাল লাগলে জানাবেন