মরুর ফুল ৪

জায়েদের ভাইরা জায়েদের মুখে পানি ছিটা দিয়ে জায়েদের জ্ঞান ফেরাল। তারাও অবাক, কারণ রুকাইয়াকে মার খাওয়া থেকে বাঁচাতে গিয়ে জায়েদ দুই একটা চাবুকের আঘাত পেয়েছে মাত্র, এতে তো শুধু মাত্র ব্যথা পাওয়ার কথা কিন্তু জ্ঞান হারানোর প্রশ্নই উঠে না। এছাড়া জায়েদ বড় মাপের যোদ্ধা। এর চেয়েও অনেক বেশি মার খাওয়ার ট্রেনিং তার আছে। যার হাতের চাবুকের মার সে খেয়েছে সে নিজে এসে জায়েদকে ব্যাখ্যা করছিল কেন সে রুকাইয়াকে চাবুক দিয়ে মারছিল।
লোকটির হাতের চাবুকে রক্ত লেগে আছে, রুকাইয়ার রক্ত।
জায়েদের বাবা জায়েদকে দেখতে আসল “তোমার মনে হয় শরীর খারাপ। তুমি বিশ্রাম নেও। কাল সকালে রুকাইয়াকে জীবন্ত কবর দেয়া হবে। এই মেয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করছে। বংশের মান ইজ্জত কিছু রাখল না। আমাকে লোকজন আগেই মানা করেছিল- ঘরে মেয়ে থাকলে সেই ঘরে যুবক সুদর্শন দাস আনা যাবে না। আমিই মানুষের কথা শুনি নি।”
জায়েদ বাবাকে জিজ্ঞেস করল “ইউসূফের (গোলামের) ব্যপারে সিদ্ধান্ত কী?”
হাম্মাদ উত্তর দিলেন “দুই একদিন শাস্তি দিয়ে তাকে আগের মত ব্যবহার করা হবে”
জায়েদ মনে মনে ভাবতে লাগল- একটা চাকরকে বাঁচিয়ে রাখবে আর নিজের মেয়েকে জীবন্ত কবর দিবে। বাবা মাত্র দুই বছর আগে তার সৎ বোনকে জন্মের পর পরই জীবন্ত কবর দিয়েছিল।
রুকাইয়াকে একটা ঘরে আটকে রাখা হয়েছে। রুকাইয়া কাঁদছে। জায়েদ সেই ঘরে গেল। রুকাইয়া জায়েদের উপস্থিতি টের পেল।
“তুই দুনিয়ায় এত মানুষ থাকতে একটা গোলামকে পছন্দ করলি কেন?” প্রশ্ন করেই জায়েদের মায়মুনার কথা মনে পড়ে গেল।
রুকাইয়া পালটা প্রশ্ন করল “তুমি কেন মায়মুনার প্রেমে পড়লে? সে তো তোমাদের একমাত্র শত্রুর পরিবারের মেয়ে!”
রুকাইয়ার কথায় জায়েদ হতভম্ভ হয়ে পড়ে। মায়মুনার কথা রুকাইয়ার জানার কথা না। জায়েদের চেহারা দেখে রুকাইয়া নিজেই বলল “দুই দিন আগে রাতে তোমার ঘরে গিয়েছিলাম, তুমি ঘুমের ঘোরে মায়মুয়ান্র নাম নিয়েছিলা। তখনই বুঝেছি তুমি মায়মুনাকে পছন্দ কর। কিন্তু পছন্দ করে কী লাভ? দুই দিন পরে তার পরিবারের লোকদের হত্যা করে তুমি তাদের মাথা নিয়ে উল্লাস করবে আর আমাদের পরিবারের মাথা নিয়ে তারা উল্লাস করবে। তার চাইতে যুদ্ধ করতে করতে মরে যাও। আমাদের পরিবারের বেশিরভাগ মুরুব্বীই যুদ্ধে মারা গেছে। বাকীরাও যুদ্ধে মারা যাবে। তুমিও যুদ্ধে মারা যাবা, মায়মুনা তোমার আশায় না থেকে কাউকে না কাউকে বিয়ে করে ফেলবে....”
রুকাইয়ার কথা শেষ না হতেই জায়েদ বলল “মায়মুনার কয়েকদিন পরেই বিয়ে হবে”
জায়েদের চোখে পানি দেখে রুকাইয়া কিছুক্ষন চুপ থাকল। রুকাইয়ার ঠোঁট দিয়ে রক্ত ঝরছে। জায়েদ এসে সেই রক্ত মুছে দিল “আমার যা হবার হবে, তুই কি ইউসূফকে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারবি?”
জায়েদের কথায় রুকাইয়া যে হুশ ফিরে পেল। কিছুক্ষণ আগেও যে রুকাইয়া নিজের মরণের কথা ভাবছিল সেই রুকাইয়ার মনে জোর পেল। জায়েদ বলল “আমি আস্তাবল থেকে দু’টি শক্তিশালী ঘোড়ার ব্যবস্থা করছি। কিছুক্ষন পরে আমি ঘরের তালা খুলে দিব। তুই উহুদ পাহাড়ের পাশে চলে আসিস। সেখানে মানাতের একটা মূর্তি আছে। আমি ঘোড়া ও ইউসূফকে নিয়ে সেই মূর্তির কাছে অপেক্ষা করব।
রুকাইয়া বলল “সকালে যখন দেখবে আমি আর ইউসূফ নেই তখন সবাই তোমাকে দোষারোপ করবে। পরিবারের মান সম্মান শেষ করার জন্য তোমাকে কতল করা হতে পারে”
জায়েদ বলল “দুই দিন পরে যুদ্ধ শুরু হবে। আমার মত যোদ্ধা তাদের দরকার। আমার কোন ক্ষতি ওরা করবে না। মায়মুনা না থাকলে তোদের সাথে আমিও তোর সাথে যেতাম।”
“কিন্তু কোথায় যাব? মানুষ জন যদি জানতে পারে আমি গোলামের সাথে পালিয়ে এসেছি তাইলে আমাকে ধরিয়ে দিবে। এ পৃথিবী গোলামদের জন্য নয়।” রুকাইয়া অসহায় গলা শোনা গেল।
জায়েদ কিছু বলল না। তার এই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই। সে বাইরে চলে গেল।
গভীর রাত। উহুদ পাহাড়ের পাদ দেশে মানাতে মন্দিরের সামনে জায়েদ, ইউসূফ ও রুকাইয়া দাঁড়িয়ে আছে। জায়েদ ইউসূফের উদ্দেশ্যে বলল “তুমি আরব ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাও” কোথায় যাবে সেটা কিছুই বলতে পারল না।
“আরবের ভূমিতে পূণ্য কাজ কখনোই হবে না। এখানকার মরু ভূমি মানুষের তৃষ্ণা মেটানোর পানি শুষে নেয়। মানবতা এখানে অবান্তর। মেলার এক ব্যবসায়ীর কাছে মক্কারর এক নবীর কথা শুনেছি। সেই নবী নাকি সবাইকে সমান চোখে দেখার কথা বলে। গোলাম মনিবের পার্থক্য তার কাছে নাই। সেই নবীর কাছে যেতে পার কিন্তু মক্কার লোকেরা যেন জানতে না পারে তোমরা এখান থেকে পালিয়েছ। তাহলে তোমাদের ধরিয়ে দিবে।” কথা গুলো সে বলল্ব ঠিকই কিন্তু নিজেই ভরসা পেল না। যে নবী দিন রাত নিজে গোত্রের কাছে বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছে সেই নবী কী করে অন্যদের রক্ষা করবে? আরবে এটা অসম্ভব। তবুও আপনি যেহতু বলেছেন আমি মক্কায় যাব”
মক্কার পথে পালালে আরেকটা সুবিধা হবে সেটা হল জায়েদের পরিবারের কেউ সন্দেহ করবে না। আরবের ভেতরে কেউ না কেউ জানতে পারবে ইউসূফ গোলাম ছিল। গোলামকে ধরতে পারলে হাতে নাতে ধরিয়ে দিবে।
জায়েদ ও রুকাইয়া দুই জনই জানে এটা হয়তো ওদের শেষ দেখা।
“ভাইয়া, তুমি মায়মুনাকে নিয়ে পালিয়ে চলে আস, আমরা তোমার জন্য মক্কায় অপেক্ষা করব” রুকাইয়ার শেষ কথা ছিল এটি। চোখের পানি আড়াল করার জন্য সে মুখ অন্য দিকে সরিয়ে নিল।
জায়েদ অনেক ক্ষন ধরে তাদের পথের দিকে তাকিয়ে রইল।
মায়মুনাদের বাড়ীতে সাজ সাজ রব। তিন দিন পরে মায়মুনার বিয়ে। বাড়ীর সামনে জায়েদ এসে দাঁড়াল। তাকে দেখেই আশেপাশের লোকজন অস্ত্র নিয়ে চলে আসল। সালেহ ইতি মধ্যে জায়েদকে দেখে ফেলেছে। সে সামনে এসে দাঁড়াল “যুদ্ধ শুরু হতে আর মাত্র তিন দিন বাকী। এখনই মরতে এসেছ?”
জায়েদ উত্তর দিল “আমি তোমার বাবার সাথে দেখা করতে চাই”
কিছুক্ষন পরে জায়েদকে ভেতরে নেয়া হল। মায়মুনাদের বাড়ীতে এক বিদেশী মেহামান এসেছেন। তিনি বিভিন্ন গল্প করছেন। আশে পাশের লোকজন সেই গল্প শুনছে। জায়েদকে এক নজর দেখে গল্পের দিক মনযোগ দিল সালেহ এর বাবা। ভাব খানা এমন যে, তাকে চেনে না। আসলে তাকে গুরুত্ব দিতে চায় নি।
বিদেশী মেহামানের বাড়ী তায়েফ। তিনি গল্প করছেন “কয়দিন আগে মক্কার নবী তায়েফে এসে আমন মারটাই না খেল তার শিক্ষা হয়েছে আশা করি। আরে ভাই, সে ভাল ভাল কথা বলে মানলাম কিন্তু লাত, মানাত, উজ্জার পূজা ছাড়তে বলে! এটা একটা কথা হল?”
দেবী লাতের কথা শুনে জায়েদ কান খাড়া করে রইল। লাত জায়েদের প্রিয় দেবী, এই লাতের পূজা বন্ধ করতে বললেন এই নবী? তাহলে তো আরব বাসীরা তাকে মানবেই না।
বাইরে ঘোরার শব্দ শোনা গেল। একজন লোক বললেন “ইয়াহুন্না এসেছে”
ইয়াহুন্না হল ধনী ইহুদী। তার কাজ হল সূদে বাকীতে অস্ত্র বিক্রি করা।
জায়েদের বিষয়টা ধামা চাপা পড়ে গেল। ইয়াহুন্না তার কাজ শেষে জায়েদের দিকে তাকাল, পাশে ছিল সালেহ এর বাবা “তুমি আমার ছোট ভাইয়ের বাগানে কী করতে তা আমি জানি। এটা বংশের ইজ্জতের প্রশ্ন। তুমি যদি রক্ত পান করে শপথ নিয়ে খাজরাজ বংশে যোগ দা তাহলে তোমার বিষয়টা আমরা ভেবে দেখব।” জায়েদের জন্য ফাঁদ পাতা হয়েছে। এতে জায়েদ পা দিবে কি না ভাবছে।
তৎকালীন আরবে একটা নিয়ম ছিল, কেউ নিজের গোত্র থেকে বাইরে এসে আরেক গোত্রে যোগ দিতে চাইলে তার সুযোগ ছিল। সেক্ষেত্রে নিয়ম ছিল নতুন গোত্রের মুরুব্বীদের রক্ত একটা পাত্রে রেখে সেই রক্ত পান করতে হবে। তবেই সে নতুন গোত্রে যোগ দিতে পারবে।
কথাটা জায়েদের গায়ে শুল হয়ে বিঁধল কিন্তু সে কিছু বলল না।
“তুমি আমাদের প্রস্তাব ভেবে দেখতে পার। যদিও রাজী হও তাহলে যা চাইছি তা পাবে। আর রাজী না হলে যুদ্ধের ময়দানে দেখা হবে” সালেহের বাবা প্রস্তাবে সম্মতি দিলেন।
“আওস বংশের ছেলেরা নিজের জীবন দিয়ে দিবে কিন্তু বংশের সাথে বেঈমানী করবে না” জায়েদ কথিন স্বরে জবাব দিল।
“তাহলে এখানে কে আসতে বলেছে?”
“আমি একটা প্রশ্ন করতে এসেছি- যুদ্ধ না করলে হয় না? যুদ্ধ করে আমরা কী পেয়েছি?”
জায়েদের কথা শুনে হাসির রোল পড়ে গেল। পারলে অনেকে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায়। মনে হয় অনেকদিন পরে তারা একটা মজার কৌতুক শুনেছে।
“যুদ্ধ বন্ধ করতে আমি রাজী, তবে একটা শর্তে” সালেহ এর বাবা বললেন “তোমার বাবাকে এলাকার সবার সামনে আমার পা ধরে মাফ চাইতে হবে। সকল হত্যার ক্ষতি পূরণ দিতে হবে…” আরো অনেক কথা বলছে কিন্তু জায়েদের কানে কিছু ঢুকছে না।
জায়েদ জানে এসব কথা বলে লাভ নেই। আজ যদি কেউ তাদের বোঝায় যুদ্ধ করলে উভয় পক্ষের ক্ষতি কাল ইহূদীরা এসে তাদের যুদ্ধে উৎসাহ যোগাবে। আসলে এদেরকে কিছু বলে লাভ নেই।
রেসিপি দেখুন