মরুর ফুল ৫
ইউসূফ রুকাইয়া বদরের কাছাকাছি একটা গ্রামে পৌঁছাল। সেখানে এক কাফেলার সাথে দেখা। তাদের মাধ্যমেই জানতে পারল মক্কার নবী ও তার অনুসারী বনু হাসেম গোত্রকে মক্কার এক উপত্যকায় আটকে রেখেছেন। সেখানকার মহিলা ও বাচ্চারা না খেয়ে, গাছের পাতা খেয়ে কোন মতে বেঁচে আছে। মাত্র কিছু দিন আগে তাদের মুক্তি দেয়া হয়েছে। সুতরাং ইউসূফ যাকে বিশ্ব মানবতার মুক্তি দূত ভাবছে তা এখন আর মনে হচ্ছে না, তিনি নিজেও তো অনেকটা বন্দী অবস্থায় আছে।ইউসূফ ভাবল মক্কায় গিয়ে লাভ নেই। তার চেয়ে বরং সিরিয়ার দিকে যাত্রা শুরু করা যাক। শুরু হল তাদের নতুন পথ চলা। অজানা উদ্দেশ্যে অচেনা গন্তব্যে রওনা হল স্বামী স্ত্রী।
আজ মায়মুনার বিয়ে। বর যাত্রী গত কাল চলে এসেছে। এদিকে ইহুদী ইয়াহুন্না এক কুটিল চাল চালল। সে জায়েদের সাথে দেখা করে বলল “তোমার ভালোবাসার দাম দেয়া আমার জন্য ফরজ। আমি অনেক কষ্টে মায়মুনার চাচাকেকে তোমার সাথে বিয়ে দেবার জন্য রাজী করিয়েছি। কিন্তু ওদের বংশের কেউ রাজী হচ্ছে না, তুমিও জান ওদের কেউ রাজী হবে না। এদিকে বর যাত্রীও চলে এসেছে। মায়মুনার চাচা চাচ্ছে তুমি গোপনে মায়মুনার সাথে চলে যায়। কিছুদিন পরে তোমরা ইয়াসরিবে ফিরে আসবে। আপাতত এই কয়দিন তোমরা তাবুকে থাকবে। সেখানে আমার এক আত্মীয় থাকেন। এছাড়া যুদ্ধ তো সব সময় থাকবে না। একদিন এর শেষ আছে।”
ইয়াহুন্নার কথাগুলি জায়েদের কাছে স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে। কিন্তু সে এখন মায়মুনার জন্য এতই পাগল যে এসব কথার সত্যতা যাচাই করার সুযোগ পেল না। বিশেষ করে কোন বাবা তার শত্রু পক্ষের ছেলের নির্দিষ্ট একটা সময়ে একটা স্থানে তাকে আসতে বলা হল, এই জায়গাটা মায়মুনাদের বাড়ীর পেছনে।
এদিকে সালেহদের কাছে ইয়াহুন্না খবর দিল যে, জায়েদ মায়মুনাকে চুরি করে নিয়ে যাবে। এ জন্য সে বাড়ীর পেছনে একটা নির্দিষ্ট সময়ে আসবে। সালেহ তার ভাইদের নিয়ে অস্ত্র সহ প্রস্তুত হয়ে রইল জায়েদকে মারার জন্য। যেহেতু যুদ্ধের আর মাত্র একদিন বাকী তাই এখন যুদ্ধ করলে তেমন সমস্যা হবে না। সমস্যা হল, এটা বিয়ে বাড়ী। জায়েদের কিছু হলে আওস বংশ এখানে হামলা চালাবে। বিয়ে বাড়ী যুদ্ধ ক্ষেত্রে পরিণত হবে।
আপাতত সবার প্ল্যান হল জায়েদকে হাতে নাতে ধরে কোথাও লুকিয়ে রাখবে। পরে সময় সুযোগ মত তাকে মেরে ফেলা হবে। যুদ্ধ শুরুর দিনে এরকম একটা শত্রু হত্যা করলে শত্রুর মনোবল যেমন নষ্ট হবে তেমনি এই পক্ষের মনোবল বৃদ্ধি পাবে।
মায়মুনা তার ভাইদের আচরণে টের পেল কিছু একটা হচ্ছে। দুই একবার তাদের মুখে জায়েদের নাম শুনল। মায়মুনা জানে, জায়েদ কিছু একটা করবে। সে তার ঘনিষ্ঠ এক দাসীর মাধ্যমে জানতে পারল মায়মুনার ভাইয়ের দল অস্ত্র নিয়ে বাড়ীর পেছন দিকে গিয়েছে। মায়মুনার ভয় হল, জায়েদ কি তবে বাড়ীর পেছনে আসবে? এ ধরনের খবর সেও তো জানে না। নাকি শুধু শুধু সন্দেহের বশে সেখানে পাহারা বসানো হয়েছে। এদিকে বাড়ীর বাইরে ছেলে মেয়েরা বিয়ের গান গাইছে। পুরো একটা উতসবের পরিবেশ। মায়মুনা ঘটনা জানার জন্য বিভিন্ন উপায়ে চেষ্টা করল। মায়মুনা হিসেব করে দেখল বাড়ীর পেছনে জায়েদ আসতে চাইলে কোন দিকে দিয়ে আসবে। মায়মুনা ঠিক করল সে সেই রাস্তায় এগিয়ে যাবে। যদি সত্যিই জায়েদ এসে থাকে তাহলে সে যাতে ধরা না পড়ে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু দিনের বেলায় এত মানুষের ভীড়ে কীভাবে বের হওয়া সম্ভব? এদিকে জায়েদ কাছাকাছি চলে এসেছে। সে এবার খালি হাতে আসেনি। কেউ বাঁধা দিলে ছেড়ে কথা বলবে না। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই জায়েদ সেই স্থানে পৌঁছাল। পৌঁছার পর জায়েদের মনে হল সে ফাঁদে পড়েছে। চারিদিক থেকে ওত পেতে থাকা শত্রু তাকে ঘিরে ধরেছে। সবার হাতে ধারাল অস্ত্র। তাদের নেতৃত্বে রয়েছে মায়মুনার চাচা, সালেহ পাশে আছে। ব্যাপার কী? তাকে কি বলা হল আর এখানে কী হচ্ছে! জায়েদ তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করতেই বুঝল এদের বুঝিয়ে কোন লাভ নেই। এটা নিশ্চয়ই ইহুদীদের চক্রান্ত। কারণ আরবরা আর যাই করুক না কেন কাউকে ধোঁকা দিয়ে বাড়ীতে ঢেকে এনে হত্যা করে না। অন্য সময় হলে আলাদা কথা ছিল, আজ এই বাড়ীতে বিয়ে, বিয়ের সময় এই কাজ করার প্রশ্নই আসে না। চার পাঁচ জন জায়েদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। জায়েদ প্রতিরোধ করল। কিন্তু এত জনের বিরুদ্ধে একা একা লড়াই করা সম্ভব না। হঠাত মায়মুনা সেখানে দৌড়ে চলে এল। সে এসে তার ভাইদেরকে বাঁধা দিতে লাগল। জায়েদ কিছুক্ষনের জন্য হতভম্ভ হয়ে যায়। এই ফাকে জায়েদের হাতে একটা আঘাত লাগে। তার হাত থেকে তলোয়ার পড়ে যায়। তার রক্তাত্ত হাত দেখে মায়মুনা চিৎকার দিয়ে উঠে। জায়েদ ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল। শত্রুর উপুর্যপুরি আঘাতে সে আর উঠে দাঁড়াতে পারল না। জায়েদের দৃষ্টি শেষ পর্যন্ত মায়মুনার দিকেই ছিল। মায়মুনা তার চাচার পা জড়িয়ে ধরল “লাত, মানাত, ওজ্জার দোহাই আপনারা জায়েদকে ছেড়ে দিন, আমি আপনাদের পছন্দের ছেলেকেই বিয়ে করব” মায়মুনার কথা শুনে তার ভাইরা মার ধোর বন্ধ করল। বিয়ে বাড়ীতে মারামারির খবর জানাজানি হলে ঝামেলা হতে পারে। আর বর পক্ষ যদি জায়েদের খবর জানে তাহলে তো বিয়েই ভেঙ্গে যেতে পারে।
সালেহ জায়েদকে বলল “আগামীকাল যুদ্ধ শুরু হবে, সেখানে দেখা হবে। আমার চাচার (মায়মুনার বাবার) মৃত্যুর প্রতিশোধের সাথে তোমার আমার ব্যাক্তিগত হিসাব নিকাশও ঐখানে চুড়ান্ত হবে। জীবনে আর এই বাড়ীর দিকে ফিরেও চাইবে না।”
জায়েদের এই বাড়ীতে আসার প্রয়োজনও আর নেই, কারণ আজ মায়মুনার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। আজই তারা মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা হবে। জায়েদ রক্তাত্ত শরীরি নিয়ে চুপ চাপ পথের দিকে এগুলো।
উহুদের পাশে সেই মন্দিরের সামনে তার ঘোড়া বাঁধা ছিল। সে ঘোড়ায় চড়ল। বাড়ীর পথের দিকে না এগিয়ে সে উলটা দিকে যাত্রা শুরু করল। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইয়াসরিব ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাবে। যেখানে মানুষের কোন মূল্য নেই, যেখানে শুধু যুদ্ধ আর প্রতিশোধ ছাড়া কারো মাথায় কিছু নেই সেখানে সে থাকবে না। সবচেয়ে বড় কথা মায়মুনার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। ইয়াসরিবের অলি গলি মাঠ বাগান দেখলেই তার মায়মুনার কথা মনে পড়বে। সে এটা সহ্য করতে পারবে না। তার চেয়ে বরং সে এলাকা ছেড়ে চলেই যাবে। সবচেয়ে ভাল হত যদি সে আরব ছেড়ে বাইরে চলে যেতে পারত। কিন্তু সেখানে গিয়ে কী লাভ? আরবের বাইরেও প্রচন্ড যুদ্ধ চলছে। ইরানের সাসানী সম্রাজ্য ও রোম সম্রাজ্যের মধ্যে হাজার বছর ধরে চলা যুদ্ধের শেষ কখনো হবে না। কোন অলৌকিক শক্তি যদি এই দুই পক্ষের যুদ্ধ থামাতে পারে তাহলেই সম্ভব, অন্যথায় না। আহত শরীর নিয়ে জায়েদ বেশি দূর যেতে পারেনি। একদিন চলার পর একটা মরুদ্যানে এসে সে জ্ঞান হারাল।
কয়েকদিন পরে জায়েদ নিজেকে এক তাবুতে আবিষ্কার করল। তারা শরীর ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। এই অবস্থায় কেউ বাঁচতে পারে তা তাকে যারা দেখেছে তাদের জানা ছিল না।
সেই মরুদ্যানের পাশ দিয়ে খৃস্টানদের এক কাফেলা যাচ্ছিল। তাদের মধ্যে একজন চিকিৎসক ছিল, যিনি আবার যাজকও। তারা এই আহত ছেলেকে পথে ফেলে যেতে চাইলেন না। তারা জায়েদকে নিয়ে চললেন। দুই তিন দিন চিকিৎসা চালিয়ে যাবার পরে জায়েদের জ্ঞান ফিরল। তবে তার শরীরে কোন শক্তি অবশিষ্ট ছিল না যে কারো সাথে কথা বলবে। পাঁচ ছয় দিন পরে তার উঠে বসার মত অবস্থা হল। এর মধ্যে কাফেলা এগিয়ে চলল। জায়েদ অসুস্থ হওয়ায় তাকে তারা উটের উপর এক কাঠের তৈরি বাহনে বসিয়ে রাখত। কিছু দিন পরে কাফেলা সিরিয়ার নিকটবর্তী একটা ছোট শহরে পৌঁছে গেল। জায়েদ এই প্রথম কোন শহর দেখল। এর আগে তার দৌড় মরুভূমি পর্যন্তই ছিল। জায়েদ কারো সাথে কথা বলত না। সিরিয়ার এই অংশটা তখন ইরানীদের দখলে, বছর দুয়েক আগে তারা রোমানদের কাছ থেকে এই এলাকা দখল করে। তিন বছর আগে তারা রোমান খ্রিস্টানদের কাছ থেকে জেরুজালেমের দখল নেয়। তখন থেকেই মূলত রোমান সম্রাজ্যের পতন শুরু হয়। মক্কা মদীনার আরবরা মূর্তি পূজারী হওয়ায় তারা অগ্নি পূজারী ইরানীদের সমর্থন করত। আবার আরবের বড় একটা অংশ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী হওয়ায় তারা ধর্মীয় কারণে রোমানদের সমর্থন করত। মূলত দুই দলের সেনাবাহিনীতেই আরবদের বড় ভূমিকা ছিল।
তৎকালীন বিশ্বে দুই পরাশক্তি ছিল- রোমান সম্রাজ্য যাদের অধিকারে ছিল পূর্ব ইউরোপ, আফ্রিকার অর্ধেক ও পশ্চিম এশিয়ার ভূমি সাথে আরবের অর্ধেক অংশ। রোমান সম্রাজ্য মূলত খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারীদের দ্বারা গঠিত ছিল। আরেক শক্তিশালী সম্রাজ্য ছিল ইরানী রাজ বংশ, যারা মূলত সাসানী বংশের ছিল। তারা অগ্নি পূজা করত। আরবের অর্ধেক ছাড়াও এশিয়ার বড় একটা ভূখন্ড তাদের দখলে ছিল।
এই দুই পরাশক্তির মধ্যে হাজার বছর ধরে যুদ্ধ চলছিল। অবশ্য মাঝে মধ্যে সন্ধি করে দুই পক্ষ কিছুদিনের জন্য শান্তি পেত। রাসূল (সাঃ) এর হিজরতের কয়েক বছর আগে ইরানীরা প্রচন্ড শক্রিশালী হয়ে ওঠে। তারা একে একে রোমানদের সম্রাজ্য দখল করতে থাকে। আরবের বেশিরভাগ ভুখন্ড দখলের পরে তারা খ্রিস্টানদের পবিত্র ভূমি জেরুজালেরম দখল করে। এরপরে আরমিয়া, সিরিয়া, জর্ডান, পশ্চিম তীর, মিশর একে একে এশিয়া, আফ্রিকার প্রায় সকল ভূমি দখল করতে করতে রোমান সম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টেন্টিপোলের
রোমান সম্রাজ্য তার জন্মের পর থেকে এত কঠিন সংকটে পড়েনি। গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার সৃষ্টি করলে ইউরোপের জঙ্গীরা। এখন আমরা যে সভ্য ইউরোপিয়ানদের দেখছি তখনকার ইউরোপে মূলত জঙ্গীরা বাস করত। তারা মূলত লুটপাট করত। রোমান সম্রাটের দুরাবস্থা দেখে জঙ্গীরা পশ্চিম দিক থেকে রাজধানী আক্রমন করল। আর পূর্ব দিকে ইরানীরা তো আছেই। ভাগ্য ভাল, বাকী দুই পাশে সাগর, তা নাহলে এতক্ষনে রোমান সম্রাজ্যের অস্ত যেত।
অর্থাৎ রোমান সম্রাজ্য পতনের অপেক্ষায়। আর মাত্র ক’টা দিনের অপেক্ষা মাত্র। পুরো দুনিয়া যখন রোমানদের এই অসহায় অবস্থা দেখছিল, সবাই যখন রোমানদের পতনের অপেক্ষা করছিল ঠিক তখনই মক্কার সেই নবীর কাছে আল্লাহ ওহীর মাধ্যমে জানিয়ে দেয় “নিকটবর্তী দেশে রোমানরা পরাজিত হয়েছে কিন্তু এ পরাজয়ের পর কয়েক বছরের মধ্যেই আবার তারা বিজয়ী হবে।”
সূরা রোমের মাধ্যমে আল্লাহ্ তাঁর নবীর কাছে যখন এই আয়াত পৌঁছুল তখন মক্কায় এটা নিয়ে হাসাহাসি শুরু হল। মক্কাবাসীরা যেহেতু পূজারী ছিল তাই তারা ছিল ইরানীদের পক্ষে। এই আয়াতের সাথে আরেকটা সংবাদ ছিল, সেটা হল ‘মুসলমানরাও বিজয়ী হবে’। মূলত মুসলমানদের বিজয় নিয়েই মুশরিকরা বেশি হাসাহাসি করছিল। রোমান সম্রাজ্য অনেক বড়, সারা দুনিয়ার খ্রিস্টানরা একে রক্ষার জন্য লড়াই করে যাবে কিন্তু মক্কার যে অসহায় মুসলমানরা লুকিয়ে লুকিয়ে নামাজ পড়ে, তাদের একটা অংশ আবিসিনিয়ায় হিজরত করে আছে তারা কীভাবে বিজয়ী হবে? উবাই ইবনে খালফ হযরত আবু বকরের (রা.) সাথে বাজী রাখে। সে বলে, যদি তিন বছরের মধ্যে রোমানরা জয়লাভ করে তাহলে আমি তোমাকে দশটা উট দেবো অন্যথায় তুমি আমাকে দশটা উট দেবে। নবী (সা.) এর বাজীর কথা জানতে পেরে বলেন, কুরআনে বলা হয়েছে ‘ফী বিদ্বঈসিনিন’ আর আরবী ভাষায় ‘বিদঈ’ শব্দ বললে দশের কম বুঝায়। কাজেই দশ বছরের শর্ত রাখো এবং উটের সংখ্যা দশ থেকে বাড়িয়ে একশো করে দাও। তাই হযরত আবু বকর (রা.) উবাইর সাথে আবার কথা বলেন এবং নতুনভাবে শর্ত লাগানো হয় যে, দশ বছরের মধ্যে উভয় পক্ষের যার কথা মিথ্যা প্রমাণিত হবে সে অন্যপক্ষকে একশোটি উট দেবে।