মরুর ফুল ৬
জায়েদকে যে যাজক ও তাঁর দল উদ্ধার করেছিল তাঁর না ম্যাথিউস। জায়েদ পুরো সুস্থ হওয়ার পরে একদিন সে ম্যাথিউসকে বলল “আপনি আমাকে নতুন জীবন দান করেছেন। আমি আপনার কাছে চীর কৃতজ্ঞ। আপনাকে কী দিয়ে আমার জীবনের দাম দিব তা হিসাব করে কূল পাচ্ছি না। জীবনের মূল দেয়া তো দূরের কথা আমার কাছে কোন কানাকড়িও নেই। আপনি ইচ্ছা করলে আমাকে আপনার গোলাম হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। অথবা কোন ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দিতে পারেন। আমি ভাল মেষ চড়াতে পারি, ঘোড়ার দেখা শোনাও করতে পারি। আশা করি ভাল দাম পাবেন।”যাজক মুচকি হেসে বললেন “জীবন দান করার ক্ষমতা কোন মানুষের নেই। এই ক্ষমতা একমাত্র ঈশ্বরের। তিনিই তোমাকে সুস্থতা দিয়েছেন। তুমি ঈশ্বরের সেবা কর, তাতেই তোমার মঙ্গল। আমি কোন দাম নেয়ার জন্য তোমাকে মরুভূমি থেকে উদ্ধার করিনি। আমি ঈশ্বরের কাছ থেকে দাম পাব। সেটা ইহকালে নয়, পরকালে। তুমি যদি ঈশ্বরের সেবা কর তাহলে আমার দাম পরিশোধ করা হয়ে যাবে।” জায়েদ বুঝল যাজক জায়েদকে খৃস্ট ধর্ম গ্রহনের জন্য আহবান করছেন। জায়েদ জীবনে এত আঘাত পেয়েছে যে তাঁর এখন আর লাত, মানাত, উজ্জার প্রতি বিশ্বাস আগের মতন নেই। এছাড়া লাত, মানাতের পূজারীরা এই যাজকের মত এত সুন্দর কথা বলে না। যেহেতু যাজক জায়েদের জীবন দান করেছেন (জায়েদের ভাষায়) তাই জায়েদের উচিৎ যাজকের কথা শোনা। তৎকালীন আরবে এইসব প্রতিদান খুব গুরুত্বের সাথে দেখা হত।
জায়েদ বলল “ঈশ্বরের সেবা করতে হলে আমাকে কী করতে হবে? আমি আপনার জন্য আমার জীবন বাজী রাখতে রাজী আছি” জায়েদ আরবের পূজারীদের মত কথা বলল কারণ সেখানে মানুষ বলিদানের নিয়ম রয়েছে।
যাজক বললেন “তুমি তো জান আমাদের পবিত্র ভূমি জেরুজালেম আজ অগ্নি পূজারী ইরানীদের দখলে। জেরুজালেম দখল করার পর ইরানীরা সেখানকার ৯০ হাজার খ্রিস্টানকে হত্যা করে। খ্রিস্টানদের সবচেয়ে পবিত্র আল কিয়ামাহ গীর্জা (Holy Scpulchre) ধ্বংস করে। আসল ক্রুশ দণ্ডটি, যে সম্পর্কে খৃষ্টানদের বিশ্বাস হযরত মসীহকে তাতেই শূলীবিদ্ধ করা হয়েছিল, ইরানীরা ছিনিয়ে নিয়ে ইরানের রাজধানি মাদায়েন পৌঁছিয়ে দেয়। আর্চবিশপ যাকারিয়াকেও পাকড়াও করা হয় এবং শহরের সমস্ত বড় বড় গীর্জা তারা ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। ইরানের সম্রাট নিজেকে খোদা পর্যায়ের ভাবতে থাকে। ইরান সম্রাট খসরু পারভেজ বিজয়ের নেশায় যেভাবে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন তা বায়তুল মাকদিস থেকে মহান রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াসকে তিনি যে পত্রটি লিখেছিলেন তা থেকে আন্দাজ করা যায়। তাতে তিনি বলেনঃ “সকল খোদার বড় খোদা, সমগ্র পৃথিবীর অধিকারী খসরুর পক্ষ থেকে তার নীচ ও মূর্খ অজ্ঞ বান্দা হিরাক্লিয়াসের নামে-
“তুমি বলে থাকো, তোমার খোদার প্রতি তোমার আস্থা আছে। তোমার খোদা আমার হাত থেকে জেরুশালেম রক্ষা করলেন না কেন?” কথা বলতে বলতে যাজকের গলা ধরে এল। জায়েদ বুঝতে পারল খ্রিস্টানরা তাদের খোদাকে অনেক ভালবাসে। খোদা অপমান তারা সহ্য করে না। ঠিক এমন আবে আরবরাও তাদের মূর্তিগুলোকে ভালবাসে।
যাজক বলতে থাকলেন “দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খ্রিস্টানরা যুদ্ধ ক্ষেত্রে আসছে স্বেচ্ছা সেবক হিসেবে যুদ্ধ করার জন্য, আমাদের পবিত্র ভূমি জেরুজালেম রক্ষা করতে। তোমার উপর যেহেতু আমাদের ভরসা আছে তাই তোমার অবগতির জন্য জানাচ্ছি আমরাও এই যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে এসেছি। আমার বয়স বেশি, যুদ্ধ করার মত শারিরীক অবস্থা আমার নেই। আমি আমাদের বংশ থেকে বাছাই করা একশ লোক নিয়ে বের হয়েছি। ছোট এক দল নিয়ে আমি এখানে এসেছি আর বড় দলটা আমাদের পেছনে আছে। তাদের তিন দিন পরে এখানে পৌঁছানোর কথা।”
জায়েদের এখন মনে হল যাজক চাচ্ছেন ওনাদের ধর্ম যুদ্ধে জায়েদও যোগ দিক। জায়েদ এক যুদ্ধ থেকে পালিয়ে এসে আরেক যুদ্ধে পড়েছে। বাড়ীতে হত এক বংশের সাথে আরেক বংশের যুদ্ধ আর এখানে হচ্ছে এক রাজার সাথে আরেক রাজার যুদ্ধ। এখানে এক রাজা পরাজিত হলে পরের যুদ্ধে জেতার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে আর আরবে এক যুদ্ধে পিতা নিহত হলে সেই প্রতিশোধ নেয়ার জন্য আরেক যুদ্ধ সংগঠিত হয়। কোথাও কি শান্তি নেই? তবুও জায়েদ সিদ্ধান্ত নিল সে যাজকের কথা মত কাজ করবে। আরবে ফিরে গিয়ে তাঁর কোন কাজ নেই। ওরা যুদ্ধ করতে করতে মরুক। যেখানেই মায়মুনা নেই সেখানকার কথা ভাবার কী দরকার। জায়েদ যাজককে জিজ্ঞেস করল “আমাকে কী করতে হবে?” জায়েদকে যাজক সব কিছু বুঝিয়ে দিল। সিরিয়ার এক গ্রামে তাকে মাস খানেক প্রশিক্ষন দেয়া হল। এই গ্রাম সহ আরো কিছু গ্রামে এখনো ইরানী সেনা বাহিনী আসেনি। এখানে মূলত রোমানদের গোপন ট্রেনিং হয়। হাজার খানেক ইরানী সৈন্য এলে এখানকার লোকবল তা ঠেকাতে পারবে কিন্তু তারা কাউকে বুঝতে দিচ্ছে না কারণ ইরানীরা টের পেলে ট্রেনিং সেন্টার ধ্বংস করার জন্য বড় বাহিনী নিয়ে আসবে। রোমান গোয়েন্দাদের হিসাব অনুযায়ী এই মুহুর্তে সিরিয়ায় লক্ষাধিক ইরানী সৈন্য রয়েছে। প্রয়োজনে জেরুজালেম থেকে আরো এক লাখ সৈন্য চলে আসবে মাত্র দুই দিনের মধ্যে।
দুই মাস পরে। দামেস্কের একটি বাজার। বাজারের এক পাশে একটা খাবারের দোকান। সেখানে কয়েকজন ইরানী সৈন্য সেখানে বসে জুয়া খেলছে। তাদের আচরণে বোঝা যাচ্ছে আশেপাশে তাদের অফিসার নেই। তাই যা ইচ্ছা বলছে। দোকানের মালিক একজন আরব। জায়েদ দোকান থেকে কিছু খাবার নিয়ে ইরানী সৈন্যদের কাছাকাছি বসল। ওরা জুয়া খেলার পাশাপাশি বিভিন্ন কথা বার্তা বলছে আর উচ্চ স্বরে হাসছে।
এক সৈনিক বলছে “শুনেছি রোমান মেয়েরা অনেক সুন্দর। কনস্টেন্টিপোল জয় করলে আমি দশটা রোমান মেয়ে নিব”
আরেক সৈনিক বলল “তুমি কি সেই সুযোগ পাবে? তোমার অফিসারই তো একা একা সব মেয়ে নিয়ে যায়”
জবাবে প্রথম সৈনিক বলল “তাতে কী হয়েছে। দুই দিন পরে অফিসার মেয়েদেরকে বাইরে ছুঁড়ে মারে, তখন আমরা সৈনিকেরা সেগুলোকে ভাগাভগি করে নেই।” বলেই উচ্চ স্বরে হাসতে লাগল।
মেয়েদের কথা শুনে জায়েদের মনে হল আরবের বাইরেও মেয়েদের শান্তি নেই। আরবে বাবা মেয়েদের জীবন্ত কবর দেয় আর এখানে মেয়েদের পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যাজকের সাথে কথা বলার পরে জায়েদের ইরানীদের প্রতি একটা বিদ্বেষ জমে গিয়েছিল, আজ ইরানী সৈন্যদের নিজের মুখে তাদের কীর্তি কলাপের কথা শুনে জায়েদের বিদ্বেষটা রাগে রুপান্তরিত হল।
সৈন্যদের কাছে এক বৃদ্ধ সিরিয়ান আরব এলেন। ওনার চেহারা দেখে মনে হল তিনি এক সময় অভিজাত শ্রেণির লোক ছিলেন কিন্তু সময়ের কারণে এখন খারাপ অবস্থায় আছেন। বৃদ্ধ টির চুল দাড়ি উষ্কু খুস্ক, মনে হয় পাগল। ইরানী সৈন্যরা লোকটিকে চেনে। তাকে দেখে বলল “কী খবর তোমার সেই নবীর? তিনি কবে তোমাকে উদ্ধার করতে আসবে?”
নবীর কথা শুনে জায়েদ একটু নড়ে চড়ে বসল। সিরিয়ায় ঢোকার মুহুর্তে তারা এক গ্রামে রাত্রি যাপন করেছিল। তারাও মক্কার সেই নবীর কথা বলেছিল যিনি নাকি বলেছেন শীঘ্রই ইরানীদের পরাজয় ঘটবে ও রোমানদের বিজয় হবে।
“তোমাদের সময় ঘনিয়ে আসছে। তিনি আসবেন। সমুদের উত্তাল তরঙ্গের মত তিনি যখন আসবেন তখন তোমরা সবাই বাতাসে উড়ে যাবে” এই বলে পাগল হো হো করে হাসতে লাগল। পাগলের হাসি দেখে প্রথমে কিছুক্ষন চুপ থাকার পরে ইরানী সৈন্যরাও হাসা শুরু করল। পাগল কত কিছুই না বলে। পাগল লাফাতে লাফাতে বাজারে প্রবেশ করল। এই পাগল এই বাজারেই ঘোরা ঘোরি করে। মক্কার এক ব্যবসায়ি একবার এসেছিল। তার কাছ থেকেই বৃদ্ধ লোকটা সেই নবীর কথা শুনেছে। পাগল এখন ইরানী সৈন্যদের দেখলেই সেই নবীর কথা বলে।
জায়েদ এই পাগল সম্মন্ধে যা জানতে পারল- উনি ছিলেন এই শহরের একজন ধনী লোক। ইরানীরা যখন এই শহর জয় করে তখন সৈন্যরা ওনার বাড়ী ঢুকে ওনার ছেলেদের হত্যা করে আর মেয়েদের উঠিয়ে নিয়ে যায়। এর মধ্যে এক মেয়ে ইরানীদের এই এলাকার সেনাপতির বাড়ীতে আছে, আরেক মেয়ে আত্মহত্যা করে। সেই থেকে এই লোক পাগল হয়ে গেছে।
জায়েদ বৃদ্ধের সাথে একান্তে দেখা করতে চাইল এবং সুযোগ পেল।
বৃদ্ধ মাঝে মাঝে ভাল কথা বলে আবার মাঝে মাঝে পাগলামি করে। তবে জায়েদ এটা বুঝল যে বৃদ্ধ তার মেয়েকে খুব ভালবাসেন। তিনি এখনও স্বপ্ন দেখেন ওনার যে মেয়ে ইরানী অফিসারের হেরেমে আছে সে একদিন উদ্ধার পাবে। উদ্ধার হলে সে মেয়েকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবে। জায়েদ বোঝে, রোমান বাহিনী এই এলাকা দখল না করা পর্যন্ত এই মেয়ের মুক্তি নেই। তবুও বৃদ্ধকে আশা দিয়ে সে চলে গেল।
জায়েদকে দিয়ে মুলত গোয়েন্দার কাজ করানো হত। সে যেহেতু ইয়াসরিবের বাসিন্দা তাই ইরানীরা তাকে সহজেই বিশ্বাস করত। একদিন এক ইরানী সৈন্য তাকে বলল “আমাদের কিছু আরব সৈন্য নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। তুমি ইচ্ছা করলে যোগ দিতে পার”
যাজককে এই খবর দিতেই যাজক খুশি মনে বললেন “ঈশ্বর আমাদের সাথে আছেন। তুমি কালই যোগ দেয়ার জন্য বেরিয়ে পড়। আর হা, তোমাকে যা শিখিয়ে দিয়েছি তা করবে। ঘুণাক্ষরে ইরানীরা যাতে টের না পায় যে তুমি তুমি রোমান রাজার অনুগত।”
ইরানী বাহিণীর রিক্রুটমেণ্ট জেরুজালেমে হচ্ছে। এই প্রথম পৃথিবীর অন্যতম বড় শহর দেখল। সে তুলনায় নিজেদের অর্থাৎ ইয়াসরিবকে একটা গলি মনে হচ্ছে। অট্টালিকা, দালান কোঠা সমৃদ্ধ এক নগরী এখন ইরানীদের দখলে। জেরুজালেমে পৌঁছানোর পরের দিনই তার পরীক্ষা হয় এবং তাকে নিয়োগ দেয়া হয়। তাকে আরবদের একটা দলের সাথে ট্রেনিং এ পাঠানো হল। এর আগে জায়েদ দুই বার যুদ্ধের প্রশিক্ষন নিয়েছে- একবার নিজ এলাকা ইয়াসরিবে ও আরেকবার সিরিয়ার সেই গ্রামে, খ্রিস্টানদের গোপন আস্তানায়। তবে দুইটা ট্রেনিং এর চাইতে এই ট্রেনিং তার কাছে ভিন্ন মনে হল। যেহেতু সে আগে থেকেই ট্রেনিং প্রাপ্ত তাই সে দ্রুত যুদ্ধ কৌশল আয়ত্ব করতে পারল। প্রথমে তাকে আজারবাইজানে পাঠানো হল এক সীমানা চৌকিতে, বছর খানেক পরে সেই চৌকির অফিসারকে সিরিয়ার নিকট বর্তী একটা শহরে বদলী করা হল। সেই অফিসার জায়েদকে নিয়েই সিরিয়া চলে আসলেন। অনেকদিন পর জায়েদ আরবের গন্ধ পেল। উল্লেখ্য, এই শহর আরব মরুর কাছাকাছি। এখানে আসার পরে কিছুদিন সেনা ছাউনিতে ডিউটি করল, তারপরে তাকে দেয়া হল দামেস্কের ইরানী সালারের প্রধান দেহরক্ষী হিসেবে। তিনি দামেস্কের কেন্দ্র বিন্দুতে একটা বিশাল প্রাসাদে থাকেন। কয়দিন আগে এখানে রোমান সম্রাজ্যের সিরিয়ান গভর্নর থাকতেন। সেই গভর্নর যুদ্ধে পালিয়ে যেতে পারেন নি। তিনি এই প্রাসাদে ঝাড়ুদারের কাজ করেন। কাজে গাফিলতি করলে ওনাকে বেত্রাঘাত করা হয়।
জায়েদের উপর যাজকের নির্দেশ ছিল যখন রোমান বাহিনীর সাথে জায়েদের বাহিনীর মুখোমুখি যুদ্ধ হবে তখন সে যেন কৌশলে ইরানী সেনাদের মনোবল ভেঙ্গে দেয়। এর মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল ইরানীর সেনাপতিকে হত্যা। সেনাপতিকে হত্যা করা খুব কঠিন কাজ। তার চেয়ে বরং সহজ কাজ হল যুদ্ধের ময়দানে ইরানী অফিসার হত্যা করা। ইরানী সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার পরে জায়েদ এখনো যুদ্ধের ময়দানে যেতে পারেনি। যাজককে তার মূল্য দেয়া হয় নি। একজন ইরানী বড় অফিসার হত্যা করতে পারলেও যাজকের ঋণ কিছুটা শোধ হবে।
যে ইরানী সালারের বাড়ীতে জায়েদ ডিউটি করে তার কাছে বিভিন্ন আরব কাফেলা আসে। আরবের পৌত্তলিকরা যেহেতু ইরানীদের বন্ধু তাই তাদের সাথে ইরানীরা ভাল সম্পর্ক রাখে। এছাড়া যুদ্ধ করতে প্রচুর সৈন্য দরকার। আরবের মরু এলাকা থেকে গরিব শ্রেনির অনেক সৈন্য নিয়মিত ইরানী বাহিনীতে যোগ হচ্ছে। বণু গাফতান গোত্রের এক সম্মানিত গোত্রপতি একদিন মহলে হাজির হলেন। তিনি আসার পথে মক্কা হয়ে এসেছেন। এই লোকের প্রতি জায়েদের আগ্রহ বেড়ে গেল, কারণ মায়মুনার বিয়ে মক্কায় হয়েছে। মক্কার নাম শুনলেই জায়েদের মায়মুনার কথা মনে পড়ে। এছাড়া তিনি সেই নবীর কথা কিছু জানেন কি না!
আরবের সেই গোত্রপতি ইরানী সালারের সাথে কথা বলছে। আরব লোকটি ইরানী ভাষা জানে না আর ইরানী সালারও আরবি জানে না তাই সালার জায়েদকে দোভাষীর দ্বায়িত্ব দিলেন।
ইরানী সালারঃ শুনেছি তুমি মক্কা হয়ে এসেছ। মক্কায় এক লোক নিজেকে নবী হিসেবে দাবী করেছে। তিনি নাকি তোমাদের মুর্তির বিরুদ্ধে কথা বলছে? লোকটির কী অবস্থা? এখনো আছে?
আরব গোত্রপতিঃ মক্কায় বেশ কিছুদিন ব্যবসার কাজে ছিলাম। নবীকে দেখতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমি মক্কায় পৌঁছানোর অনেক আগেই নবী পালিয়ে গেল!
ইরানী সালারঃ নবী পালিয়ে গেল? কোথায় গেল?
আরব গোত্রপতিঃ পালিয়ে আর কোথায় যাবে? তার নানার দিকের এলাকা ইয়াসরিবে পালিয়ে গেল। কুরাইশরা তাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। সেই নবী কুরাইশদের চোখে ফাঁকি দিয়ে ইয়াসরিবে চলে গেল। এবার মুখ হা হয়ে গেল। তার বাড়ীতে মক্কার নবী আশ্রয় নিয়েছেন! এই এলাকা তো মক্কার চাইতে কম খারাপ না। এক ভাই আরেক ভাইয়ের রক্ত খাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে।
গোত্রপতিকে জায়েদ জিজ্ঞেস করল “ইয়াসরিবে উনি কেমন আছেন?”
গোত্রপতি জায়েদের প্রশ্ন শুনে জিজ্ঞেস করল “কেন বাপু? তুমি কি ঐ এলাকা চেন?”
জায়েদ উত্তর দিল “আমার বাড়ী ইয়াসরিব”
গোত্রপতি বললেন “ইয়াসরিবের নাম বদলে গেছে। ওটার নাম এখন মদীনা অর্থাৎ নবীর শহর।”
জায়েদের মুখ হা হয়ে গেল। দুই বছরের মধ্যে এত পরিবর্তন! গোত্রপতি যখন বললেন “শুনেছি মদীনায় তিনি আওস ও খাজরাজ দুই বংশের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন। মক্কা থেকে যেসব মুসলমান মদীনায় পালিয়ে এসেছে তাদের প্রত্যেককে মদীনাবাসী থাকার জন্য জমি দান করেছেন। ওনাদের বিয়ের ব্যবস্থা করেছেন। জায়েদের এসব কথা স্বপ্নের মত মনে হল। ইয়াসরিব অর্থাৎ মদীনাবাসীদের সে ভাল করেই জানে। তারা যদি নিজেরাও ভাল থাকতে চায় সেক্ষেত্রে ইহুদীরা বাঁধা দিবে। তাদের চক্রান্তের কারণেই মূলত ওদের মধ্যে যুদ্ধ লেগে থাকে।
নবীর পালানোর ঘটনা নিয়ে কিছুক্ষন তারা কথা বললেন। নবীকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য মদীনার ইহুদীদের সাথে কুরাইশরা হাত মিলিয়েছে। একদিন নবীকে ধরা দিতেই হবে। এছাড়া কুরাইশরা মদীনার আশে পাশের আরব বসতিতে জানিয়ে দিয়েছে নবীর সাথে যেন কোন রুপ লেনদেন না করেন। সব চেষ্টা ব্যার্থ হলে মক্কাবাসী মদীনায় হামলা চালাবে। তখন এই ভুখা নাঙ্গা মুসলিমরা পরাজিত হবে।
ইরানী সালারের মুখে হাসি ফুটল। যে নবীকে নিজের বাড়ী থেকে পালাতে হয়, যে নবীর পৃথিবী দিন দিন ছোট হয়ে আসছে, যেই নবী আরবদের কাছে দিন দিন এক ঘরে হয়ে পড়ছেন সেই নবী ভবিষ্যত বাণী দিয়েছেন অচিরেই ইরানের পতন হবে আর রোমানদের বিজয় হবে। সাথে আবার সেই সাথে মুসলমানদেরও বিজয় হবে। দুই চার জন মুসলমান বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখে। রোমানরা কীভাবে পরাজিত হবে আর ক’দিন পরে নবীকে দেখানো যাবে।
এদিকে জায়েদ ভাবছে সে সৈনিক জীবন ছেড়ে মদীনায় চলে যাবে। সেই নবীকে দেখবে আর মদীনার পরিবর্তন দেখবে। যদি ভাল লাগে তখন সে সেখানে থেকে যাবে। আবার মায়মুনার কথা মনে পড়লে সেখানে যেতে ইচ্ছে করে না।
এমন সময় এক সৈন্য সেখানে হাজির “বাইরে দূত এসেছে, এডেন বন্দর থেকে”
দূত হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে কথা বলছে, বোঝা যায় সে অনেক পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে- সর্বনাশ হয়ে গেছে। রোমান সৈন্যরা এডেন বন্দরের দখল নিয়েছে। তারা সামনে এগোচ্ছে। সেনাপতি আপনার উদ্দেশ্যে একটা চিঠি দিয়েছেন। চিঠি পড়ে সালার জায়েদকে বললেন “তুমি এখনই প্রস্তুতি নাও। তোমাকে যুদ্ধে যেতে হবে”
যুদ্ধের কথা শুনেই জায়েদের সেই যাজকের কথা মনে পড়ল। ওনার ঋণ শোধ করার সময় হয়েছে। মদীনায় পরে যাওয়া যাবে, আগে যাজকের ইচ্ছা পূরণ করি।