মরুর ফুল ৭
যে দূত যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে এসেছে সে আর সামনে যাবে না। সে তার কর্ম স্থলে ফিরে যাবে। যুদ্ধ ক্ষেত্রের পরিস্থিতি ইরানী সেনাপতিকে জানানো দরকার। জায়েদকে বলা হল “তুমি এখনই বেরিয়ে পড়। তোমার প্রথম গন্তব্য জেরুজালেম। সেখানে ইরানী সেনাপতি মহাবীর খালেকদুনের কাছে আমার এই চিঠিটা দিবে। তুমি ওনার নির্দেশ পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। আমি আমার বাহিনী নিয়ে এখনই রওনা দিচ্ছি। সেনাপতি যদি দুই দিনের মধ্যে তোমাকে কোন নির্দেশ না দেয় তাহলে তুমি গাজা হয়ে পশ্চিম তীরে চলে আসবা। আমাকে এই দুই স্থানের যেকোন এক স্থানে পাবে। হেরাক্লিয়াস যেহেতু এডেন দখল করেছেন এখন নিশ্চয়ই পশ্চীম তীম দখলের চেষ্টা করবে।”জায়েদ জেরুজালেমের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। দিনের বেলায় কোথাও বিশ্রাম নিল না। পথের সকল সেনা চৌকিতে নির্দেশ ছিল ইরানী দূত যদি চৌকিতে যায় তাহলে তার জন্য তাজাদম ঘড়ার ব্যবস্থা করতে। জায়েদ পথে দুইটা চৌকি পেল। সেখানে তার পরিশ্রান্ত ঘোড়া রেখে নতুন তাজা ঘোড়া নিতে হয়েছে।
জেরুজালেম, পৃথিবীর পুরানো নগরীর অন্যতম। কয়েক বছর আগে এখানেই ইরানীরা ৯০ হাজার খ্রিস্টান হত্যা করেছিল। জেরুজালেমের অট্টালিকা দেখে জায়েদ অভিভূত হয়ে গেল- এখানে কি মানুষ থাকে? নাকি সবাই…. জায়েদ আরব বেদুঈনদের গরিবি হালতের কথা টের পেল। এদের তুলনায় আরবরা কত গরিব। তাদের এলাকার সবচেয়ে বড় ধনী এখানে গরিব হিসেবেই বিবেচিত হবে। জায়েদ যে বাড়ীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেটাকে প্রাসাদ না বললে ভুল হবে। প্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সৈন্য জায়েদের পরিচয় জেনে তাকে ভিতরে বসতে দিল। কিছুক্ষন পরেই তার ভেতরে ডাক পড়ল। প্রাসাদের বাইরের চেহারার চাইতে ভেতরের ঔজ্জ্বল্য অনেক বেশি। দামী কার্পেটে হাঁটতে মনে হল এখানে তার মত গরিব মানুষ বেমানান। স্বর্ণের তৈরি চেয়ার টেবিলও দেখল।
কড়া পাহারা বেষ্টিত এক রুমে তাকে নেয়া হল। বোঝা গেল, এটাই সেনাপতির অফিস আর সবার কেন্দ্র বিন্দুতে যিনি বসে আছেন তিনিই সেনাপতি খালেকদুন। এই সেনাপতির কথা জায়েদ অনেক শুনেছে। উনি গত তিরিশ বছর ধরে ইরানী সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পদে কাজ করেছেন। গত তিন বছর হল তিনি সেনাপতি হিসেবে যুদ্ধ ক্ষেত্রের দায়িত্বে আছেন। ওনার মত বীর ইরানে খুব কমই আছে। জায়েদের দেয়া চিঠিটা পড়তে পড়তে খালেকদুনের চেহারাও বদলে গেল। তিনি জায়েদকে জিজ্ঞেস করলেন “এটা কয়দিন আগের খবর?”
জায়েদ উত্তর দিল “পরশু দুপুরে দূর এসেছিল”
সেনাপতি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন “তখন কি তোমরা দামেস্কে ছিলে?”
জায়েদ “জ্বী হুজুর। দামেস্ক থেকেই আমি এসেছি”
“কীভাবে এত দ্রুত এলে?”
“পথে দিনের বেলায় কোথাও বিশ্রাম নেই নি….. সেনাপতির অবাক হবার পালা কমে এবার জায়েদের দিকে প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকাল “তোমার মত ফৌজ থাকতে ইরানের কোন চিন্তা করতে হবে না। বাড়ী কোথায় তোমার?”
জায়েদ “মদীনা” বলেই তার মনে হল সে ভুল বলেছে। সংশোধন করে বলল “ইয়াসরিব”
“পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত তুমি আমার মেহামান হয়ে থাক” বলেই চাকরের দিকে তাকালেন। চাকর জায়েদকে মূল মহলের বাইরে একটা রুমে নিয়ে গেলেন। আশে পাশের লোকদের দেখে মনে হল এটা ‘ভিআইপি গেস্ট রুম’। চাকরটা জায়েদের উদ্দেশ্যে বলল “তোমার ভাগ্য ভাল যে সেনাপতি তোমাকে এই গেস্ট রুমে থাকতে দিয়েছে। যত দূত আসে সবাইকে সেনা ছাউনিতে থাকতে দেয়া হয়। তিনি তোমার গতিতে খুশি হয়েছেন। মনে হয় তোমার জন্য কোন ভাল খবর আছে।”
পরদিন সকাল জায়েদ মহলের পাশে একটা বাগানে গেল। বাগানের পাশে একটা খোলা জায়গায় বাচ্চারা তীরন্দাজী প্র্যাকটিস করছে। এরা জেরুজালেমের আমীর ওমরাহর ছেলে মেয়ে, শখ করে তীরন্দাজী শিখছে। অবশ্য বড় হয়ে এদের কেউ কেউ বীর হয়। বাচ্চাদের সাথে জায়েদও যোগ দিল। ঘটনা হল, বাচ্চারা কী একটা বিষয় নিয়ে বাজী ধরেছে আর সাক্ষী হিসেবে জায়েদকে রেখেছে। বাচ্চারা খুব দ্রুত অচেনা কারো সাথে মিশতে পারে। পরদিন বাজীর ফলাফল জানার জন্য জায়েদকে সকাল সকাল আসতে হল। আজ ওরা আবার বাজী ধরল- সেটা হল কার তীর বেশি লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে। বাচ্চারা জায়েদকে বিচারক বানাল। জায়েদ খুবই মজা পেল। তার ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল।
একটা গাছের একটা নির্দিষ্ট ডাল টার্গেট করা হল। তীর নিক্ষেপ করতে হবে দৌড়ে দৌড়ে। হএক থেকে দশ গুণতে যে সময় লাগে সেই সময়ে তীর মারতে হবে। দেরি করলে সে ডিসকোয়ালিফাইড। জায়েদকে গুণার দায়িত্ব দেয়া হল। দশ এগারো বছরের এক মেয়ে তীরন্দাজীতে প্রথম হল। সে খালেকদুনের মেয়ে। বাবার মতই বীর! এই বয়সে যা তীরন্দাজী দেখাল সেটা মারাত্মক। খালেকদুনের ১১ স্ত্রীর ঘরে মোট ৩০ এর বেশি সন্তান আছে। যে মেয়েটা প্রথম হয়েছে তার নাম মেহরিন। তার মা আরব, খালেকদুনের নয় নম্বর স্ত্রী। এই স্ত্রী বনু গাফতান বংশের মহিলা। ইস্কানাদারিয়া বিজয়ের পরে খালেকদুন এই মেয়ের খোঁজ পায়। এক আরব বণিক দল মেয়েটাকে বিক্রি করে দেয়। প্রথমে সে খালেকদুনের দাসী হিসেবে হেরেমে ছিল। পরে মেয়েটির নজর কাড়া রূপ দেখে খালেকদুন ভাবে মহলে অনেক দাসী আছে কিন্তু সুন্দরী বৌ থাকলে নিজের আভিজাত্য আরো বাড়বে। মেয়েটাকে সে স্ত্রীর মর্যাদা দেয়। ইরানী বড় অফিসার বণু গাফতান বংশের মেয়ে বিয়ে করেছে এটা ওদের জন্য সুখবর।
তিন দিন পরে জায়েদের ডাক পড়ল। সেনাপতি বসে আছেন। ওনাকে বসফরাসের এপাড়ে যেতে হবে যেখানে ইরানী সেনারা কনস্টেনেটিপোল আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করছে। সেখানকার সেনাপতিকে দায়িত্ব পালনে অবহেলার কারণে পদচ্যুত করা হয় এবং খালেকদুনকে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়। খালেকদুন এক দিনের মধ্যেই সেখানে যাবেন। যেহেতু তিনি যুদ্ধ ক্ষেত্রে যাবেন তাই সেখানে কোন স্ত্রীকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। বেশিরভাগ স্ত্রী এই সময়ে জেরুজালেমেই থাকবে। তবে দুই একজন স্ত্রী এই সময়ে বাবার বাড়ী চলে যাবে। মেহরিনের মা তার তিন ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে আরবে যাবেন। জায়েদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তাদেরকে নিরাপদে বাড়ীতে পোঁছে দেয়া।
পরদিন সকালে খবর আসল হেরাক্লিয়াস ইস্কান্দারিয়া আক্রমণ করেছে। জায়েদ প্রায় একশ জনের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে আরবের উদ্দেশ্যে রওনা হল। সিরিয়া সীমান্তে এসে বাহিনীর অর্ধেক ফিরে গেল। বাকী অর্ধেক নিয়ে জায়েদ মরুভূমিতে প্রবেশ করল। জায়েদের অধীনে রক্ষীর সংখ্যা বিশ জনের মত। মরুভূমিতে ডাকাতি সাধারণ ঘটনা। বিশ জন প্রশিক্ষিত সৈন্য একশ জন ডাকাতকে ধরাশায়ী করতে পারবে। তবুও জায়েদ সাবধানে চলতে লাগল। কিন্তু তাদের কপালে খারাপ। এক উপত্যকায় তাদের উপর আক্রমণ করা হল। তুমুল লড়াইয়ের পরে ডাকাত দল পালিয়ে গেল কিন্তু দশ জন সৈন্য মারাত্মক যখম হল, দুই জন মনে হয় বাঁচবে না। জায়েদের কাছে অবাক করার মত বিষয় হল মেহরিন নিজেও লড়াই করেছে। এই ছোট মেয়ে তীর মেরে অনেক ডাকাতকে হত্যা করেছে। জায়েদ অভিভূত হয়ে গেল।
বণূ গাফতানের এলাকায় এসে তার পুরানো সৃতি মনে পড়ল। এই আরবে কী হচ্ছে আর বাইরে দুনিয়া কী হচ্ছে তার কোন পার্থক্য নেই। আরবে এক ভাই আরেক ভাইকে মারে আর বাইরে এক জাতি আরেক জাতিকে।
জায়েদ সেখানে এক রাতে থাকল। খাবার খেতে খেতে সে মুরুব্বীদের আলোচনা শুনল। ওনাদের কথা বার্তার একটা বড় অংশ রম-ইরানের যুদ্ধ নিয়ে আর বাকী অংশ মদীনার নবীকে নিয়ে। কুরাইশরা মদীনার ইহুদীদের সাথে যুক্তি করেছে নবীকে যেন তাদের হাতে তুলে দেয়। কিন্তু মদীনাবাসী জীবন থাকতেও নবীকে দিবে না। জায়েদ যেহেতু মদীনার লোক তাই সেও আলোচনায় অংশ নিল “ইয়াসরিবের লোকজন মেহামানকে জীবন দিয়ে ভালবাসে। তাদের অসম্মান হতে দিবে না। তবে ইহুদীরা সব কাজ করতে পারে”
একজন বলে উঠল “কুরাইশরা ইহুদীদের জন্য অপেক্ষা করছে না। তারা নিজেরাই নবীকে ধরার জন্য মদীনার দিকে লোক পাঠিয়েছে। গত সপ্তাহে তাদের মদীনায় পৌঁছে যাওয়ার কথা।
জায়েদ জিজ্ঞেস করল “আর মদীনাবাসী কী করছে?”
জবাব এল “তাদের একটা অংশ প্রতিরোধ করবে বলে ঘোষনা দিয়েছে। তবে প্রতিরোধ করতে পারবে বলে মনে হয় না। কারণ কুরাইশরা অস্ত্র সত্র নিয়ে হাজার খানেক যোদ্ধা নিয়ে মদীনার দিকে গেছে। মদীনায় আর যাই হোক না কেন নবীর পক্ষে লড়াইয়ে হাজার খানেক লোক পাওয়া যাবে না। কুরাইশরা মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করেই ছাড়বে।”
জায়েদ সেই নবীর কথা ভেবে দুঃখ পেল যে লোক নিজের বংশ ছেড়ে দ্বীন প্রচারের স্বার্থে আরেক এলাকায় গিয়ে পালাল সে এলাকায়ও থাকতে পারল না।
পরদিন ভোরে সে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হল। পথি মধ্যে এক গ্রামে মেলা হচ্ছিল। মেলা দেখেই তার রুকাইয়ার কথা মায়মুনার কথা মনে পড়ে গেল। মেলার লোকজনের মুখে মুখে একটাই আলোচনার বিষয়- কুরাইশদের বাহিনী বদরে মার খেয়ে ফিরে গেছে।
জায়েদের কাছে ব্যপারটা অবিশ্বাস্য মনে হল। জায়েদ একজনকে জিজ্ঞেস করল “আপনি কি সত্যি জানেন?”
লোকটি বিরক্ত হয়ে উত্তর দিল “জানি না মানে? আমি বিভিন্ন দেশে মেলায় মেলায় ব্যবসা করে বেড়াই, আমি জানব না? আমি ঐ এলাকা চার দিন আগে পার হয়ে আজ এখানে পৌঁছুলাম। আমি নিজে কুরাইশদের দুর্দশা দেখেছি। ওদের নিজের মুখেই শুনেছি যুদ্ধের কথা। মদীনা থেকে দূরে বদর প্রান্তরে এক হাজার সশস্ত্র কুরাইশের বিরুদ্ধে প্রায় নিরস্ত্র মুসলমানদের যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে মাত্র ৩১৩ জন মুসলমান অংশগ্রহণ করেছে। কুরাইশ দল এমন ভাবে হেরেছে যে তাদের এই হারের কথা আজীবন মনে থাকবে। তবে তার মক্কায় ফিরে আবার নতুন উদ্দোমে যুদ্ধ করার জন্য এগিয়ে আসবে। তখন হয়তো নবী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কারণ কুরাইশরা যদি এবার চার পাঁচ হাজার যোদ্ধা নিয়ে আসত তাহলে মদীনা বাতাসেই উড়ে যেত।”
জায়েদ সিরিয়া ফিরে গেল। দামেস্কে গিয়ে শুনল ইস্কান্দারিয়ার পতন হয়েছে। পর পর দু’টি বন্দর হারিয়ে ইরানীরা ভড়কে গেল। তবুও তারা সর্ব শক্তি দিয়ে রোমানদের রুখে দিল যাতে তারা বন্দরের ভেতরে শহরে প্রবেশ করতে না পারে। জায়েদ এখন পর্যন্ত যুদ্ধের ময়দানে সম্মুখ লড়াইয়ে অংশ গ্রহণ করে নাই। এবার সে সুযোগ পেল। তাকে আরমেনিয়ায় পাঠানো হল সম্মুখ যুদ্ধের জন্য। তাকে এক হাসার সৈন্যের সালার হিসেবে পাঠানো হল।
জায়েদ এবার যাজকের কথা রাখতে পারবে।