মরুর ফুল ৮

জায়েদ এই প্রথম রোমান সৈন্যদের দেখল। যুদ্ধ ক্ষেত্রেওও এই প্রথম দেখা। যে রোমান সৈন্যদের কথা আজীবন শুনেছে তাদের বীরত্বগাঁথা ছোটকাল থেকে শুনেছে সেই রোমান বাহিনীকে সরাসরি দেখল। সে এর আগে সিরিয়ার যে রোমান গোপন ঘাঁটিতে প্রশিক্ষন নিয়েছিল সেখানে কেউ রোমান ছিল না। তারা মূলত আরব খ্রিস্টান ছিল। সে নিজে মূলত রোমান বাহিনীর পক্ষ হয়ে কাজ করছে। জায়েদ আরেকটা বিষয় ভেবে কূল পাচ্ছে না, এত বড় গোয়েন্দা বাহিনী রোমানরা কীভাবে মেইন্টেইন করে! আরমেনিয়া মুলত খ্রিস্টান অধ্যুষিত এলাকা। ইরানীরা এই দেশ জয় করে হাজার হাজার খ্রিস্টান হত্যা করেছে। এমন কোন বাড়ী নেই যেই বাড়ীর মেয়েদেরকে সৈন্যরা লাঞ্চিত করে নাই। আরমেনিয়ার সাধারণ মানুষ এই দুই কারণে ইরানীদের দুই চোখে দেখতে পারত না। আরমেনিয়ায় খ্রিস্টানদের শক্তিশালী গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক আছে। জায়েদ আর্মেনিয়া যাওয়ার এক মাস পরেই সেই নেটওয়ার্কের সন্ধ্যান পায়।
ইরানী সৈন্যদের মধ্যে অনেক রোমান গোয়েন্দা ছিল যাদের বিভিন্ন কাজ ভাগ করা ছিল। মাঝে মধ্যে গোয়েন্দারা ধরা পড়ে। তখন চলত অমানবিক নির্যাতন। তার জানা মতে কারা এই ছাউনিতে গোয়েন্দার কাজ করে তা জানার উদ্দেশ্যেই এই নির্যাতন করা হয়। এক পর্যায়ে রাকে মেরে ফেলা হয়। একবার এক তাঁবুর সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁবুর সামনে মাটিতে একটা চিহ্ন তার চোখে পড়ে। চিহ্নটা খুব সাধারণ, মানুষের পায়ের ছাপ। কিন্তু জায়েদ সিরিয়ার ট্রেনিং এ জানে এই পায়ের ছাপের একটা স্পেশাল বৈশিষ্ট আছে। পায়ের ছাপের চারিদিকে একটা ত্রিভূজ আঁকা রয়েছে। দেখলে যে কেউ মনে করবে একজন মানুষ স্বাভাবিক ভাবে দাঁড়িয়ে থাকার সময় জুতার দাগ সৃষ্টি হয়েছে। জায়েদের এই সংকেত জানা ছিল। সে সংকেত অনুসরণ করে দেখল সামনের ডান পাশের তিন নম্বর তাঁবুতে যেতে নির্দেশ করা আছে। জায়েদ সেই তাঁবুতে উঁকি দিল। ভেতরে তিন জন লোককে দেখে নির্দিষ্ট বিরতি নিয়ে কয়েকটা কাশি দিল। এটাই ওদের সংকেত।
তাঁবুতে যিনি আছেন তাদের একজন বড় মাপের কমান্ডার। ওনার সাথে কথা বলে জায়েদ জানতে পারল এই ছাউনিতে এই পর্যন্ত তিরিশ জন রোমান গোয়েন্দার খোঁজ পাওয়া গেছে। আরমেনিয়া শহরের পাশে এক ভাঙ্গা গীর্জায় প্রতি শনিবার বিকালে এখান থেকে গোপন খবর চলে যায়। গীর্জায় রোমান অফিসার আছেন যাজকের ছদ্ম বেশে। তিনি এই খবর রোমান সেনাদের কাছে পাস করেন। গত এক মাসে রোমানরা তিনটা হামলা করেছিল। হামলায় ইরানীরা পেরে উঠতে পারছিল না কারণ ইরানীদের প্ল্যান ওরা আগে থেকেই জানতে পেরেছিল। তাই অল্প সংখ্যক সৈন্য দিয়েই রোমানরা আরমেনিয়া ছেড়ে পালাতে বাধ্য হল। আরমেনিয়ার পতনের কিছু দিনের মধ্যে রোমান সম্রাট অস্ট্রিয়া জয় করলেন। কিছু দিনের মদ্যে এতগুলো এলাকা হাত ছাড়া হওয়ার পরেও ইরান সম্রাট ভয় পেল না। কারণ মূল ভূখন্ড এখনো ইরানীদের দখলে আছে। বসফরাসের এপাড় থেকে অবরোধ তুলে নিলেন না। ইরানীদের তখন দশ লক্ষ সেনা ছিল। ইরান সম্রাট চাইলে আরো দশ লক্ষ সেনা যোগাড় করতে পারত। তিনি কন্সটেন্টিপোলের
দিকে মনযোগ দিলেন। সেনাপতি খালেকদুনকে নির্দেশ দিলেন যে করেই হোক রোমানদের রাজধানী হামলা চালানোর। খালেকদুন অনেকবার চেষ্টা করল কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী নৌবাহিনীর জন্য নদী পার হতে পারলেন না। রোমানদের শক্তিশালী নৌবাহিনীর সাথে যোগ দিল তুর্কী নৌবাহিনী। তুর্কীদের ম্যানেজ করার জন্য রোমান সম্রাট অভিনব পন্থা অবলম্বন করলেন। নিজের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে দিলেন তুর্কী সম্রাটের সাথে। তুর্কীরা রোমানদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইরানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে গেল।
আরমেনিয়া যুদ্ধে হারের পরে জায়েদ সহ পুরো বাহিনী বসফরাসের এপাড়ে খালেকদুনের অধীনে চলে এল। রোমান সম্রাট এবার ভিন্ন চাল চাললেন। খালেকদুন সহ অনেক ইরানী অফিসারকে লোভনীয় প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু সেনাপতি সহ বেশিরভাগ অফিসারকে বাগে আনতে ব্যার্থ হলেন। এবার তিনি নিলেন ভিন্ন পন্থা।
এক সন্ধ্যায় ইরানী ছাউনির রোমান গোয়েন্দারা এক স্থানে মিলিত হল।
গোয়েন্দা প্রধান জায়েদকে বলল “তোমাকে আরবে একটা অপারেশনে যেতে হবে”
আরবের কথা শুনে জায়েদের বুকটা কেমন যেন করল। শেষ বার আরবে চার বছর আগে গিয়েছিল খালেকদুনের স্ত্রী কণ্যাকে বাড়ীতে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে।
রোমানরা গত কয়েক বছরে যুদ্ধে জিতেই যাচ্ছে কিন্তু এই অবরোধ উঠাতে পারছে না। এখানে দুই লক্ষ সৈনিক আছে। এদের নেতৃত্বে আছে খালেকদুন। খালেকদুনকে হত্যার চেষ্টা করে ইতিমধ্যে আমাদের দুই জন গোয়েন্দা নিহত হয়েছে। এছাড়া রোমান সম্রাটের পক্ষ থেকে খালেকদুনকে অনেক অফার করা হয়েছিল, সেটাও ব্যার্থ হয়েছে। এখন আমরা যে কাজটি করবে সেটা হল- খালেকদুনকে মানসিক ভাবে ভেঙ্গে দেয়া। তার ১১ স্ত্রীর মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রীকে তুমি বাড়ীতে পৌঁছে দিয়েছিলে। তাকে ইরানের রাজধানী মাদায়েনে চলে যাওয়ার জন্য খালেকদুন স্ত্রীকে একটা চিঠি লিখে। সেই সাথে বলে “আমি কিছু লোক পাঠাচ্ছি, তাদের সাহায্য নিয়ে তুমি মাদায়েনে আমাদের বাড়ীতে পৌঁছে যাও। তুমি রাণী শিরির কাছাকাছি থাকবে। রাণিকে আমি তোমার কথা বলেছি ” যে দূত এই চিঠি নিয়ে যাচ্ছিল তাকে রোমান সেনারা আরবে যাওয়ার পথে সিরিয়ায় গ্রফতার করেছি। দূতের সাথে ছয় জন লোক ছিল। তাদের প্রত্যেককে হত্যা করা হয়েছে। তোমার কাজ হবে “তুমি খালেকদুনের ছয় নম্বর স্ত্রীকে নিয়ে আরব থেকে বের হয়ে সিরিয়ার কাছাকাছি চলে আসবে। নির্দিষ্ট স্থানে আমাদের সেনারা তাকে গ্রেফতার করবে। খালেকদুনের স্ত্রী সন্তান আমাদের হেফাজতে থাকলে রোমান সম্রাটের প্রস্তাব সে ফিরিয়ে দিতে পারবে না। আর ফিরিয়ে দিলে খালেকদুন তার সবচেয়ে প্রিয়তমা স্ত্রীর লাশ দেখবে।”
জায়েদ অনেক ক্ষণ ধরে চুপ করে রইল। আরবরা যুদ্ধ করলে নারী শিশুর প্রতি এতটা খারাপ আচরণ করে না যতটা খারাপ আচরণ এরা করে। যাজক তার জীবন না বাঁচালে জায়েদ হয়তো অন্য কোথাও পালিয়ে যেত কিন্তু সে যে যাজককে কথা দিয়েছে তার শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে হলেও রোমান সম্রাটে সাথে থাকবে। কিন্তু নারী শিশুকে জিম্মি করে বিরোধী পক্ষের সেনাপতির সাথে গোপন আলোচনাকে জায়েদের অমানবিক মনে হল। যে শিশুরা যুদ্ধ কী জিনিস তা জানে না সেই শিশুরা হবে যুদ্ধের বলি। তাদের নিয়ে জুয়া খেলা হবে। জায়েদ সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না সে কী করবে।
গোয়ন্দা প্রধান বলল “এই কাজে তোমাকে সিলেক্ট করার কারণ হল খালেকদুনের স্ত্রী বাচ্চারা তোমাকে চিনে। ওরা কোন সন্দেহ করতে পারবে না। আর যদি ঘুণাক্ষরেও টের পেয়ে যায় তাহলে আরবরা তোমাকে মেরে ফেলবে।”
জায়েদ ভেবে দেখল, এই উছিলায় আরবে ঘুরে আসি। আর সেই নবীর কাহিনীও শুনে আসি। বদরের যুদ্ধে হারার পরের বছরই তো কুরাইশরা নতুন শক্তি নিয়ে মদীনা আক্রমণ করবে বলে জানা গিয়েছিল। সেই নবী ও তার অনুসারীদের কী অবস্থা সেটা জানা হয়ে যাবে।
৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ই মার্চ ঐতিহাসিক বদরের যুদ্ধ সংগঠিত হয়। যুদ্ধে হেরে কুরাইশরা প্রতিশোধ নেয়ার উদ্দেশ্যে পরের বছর আবার যুদ্ধ করে। এই যুদ্ধের নাম উহুদের যুদ্ধ। এই যুদ্ধ সংগঠিত হয় ৬২৫ খ্রিস্টাব্দের ২৩ শে মার্চ। যুদ্ধের প্রথম দিকে মুসলমানরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পরে যুদ্ধে জিতে। জায়েদ যখন খালেকদুনের স্ত্রী কণ্যাদের ধরার উদ্দেশ্যে আরবে পৌঁছুল তখন মাত্র খন্দকের যুদ্ধ শেষ হল। জায়েদ একটা জিনিস টের পেল, পুরো আরব জুড়ে এক সময় আলোচনার বিষয় ছিল রোমান-ইরান যুদ্ধ আর এখনকার আলোচনার বিষয় হল মদীনার নবী। এর আগে আরবে কখনো রাষ্ট্র ছিল না। নবী প্রথম রাষ্ট্রের গোড়া পত্তন করেন। মদীনা ও আশেপাশের গোত্র গুলো নবীর আনুগত্য মেনে নিয়েছে। দিন দিন এর অনুসারি বেড়ে চলেছে। খন্দকের যুদ্ধে যার বুদ্ধিতে খন্দক তৈরি করা হল উনি একজন ইরানী, নাম সালমান ফার্সী। জায়েদ যখন খালেকদুনের শশুরবাড়ী পৌছুল তখন সেখানে বিয়ের উৎসব চলছে। আরবী বিয়ে বাড়ী দেখার পর তার মনে হল সেই দিনের কথা যেদিন মায়মুনার বিয়ে হয়েছিল আর সে আরব থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল।
“এতদিনে আমাদের কথা মনে পড়ল?” নারী কন্ঠের কথা শুনে জায়েদ এক দিকে তাকাল। চার বছর আগে এই মেহরিনকে ছোট অবস্থায় দেখেছিল। আজ সে অনেকটা নারীতে পরিণত হয়েছে। চেহারা ঠিক মায়ের মতন হয়েছে। মেয়েটার রূপ যেন মরুভূমির সকল তাপ শুষে নিয়ে ঠান্ডা বাতাসের ব্যবস্থা করছে। ক্ষণিকের জন্য জায়েদের মনটা কেমন করে উঠল। এই মেয়ে ও মাকে সে কিডন্যাপ করতে এসেছে? এই মেয়েকে যেকোন রাজার হেরেমে মানাবে। এ অবশ্য রাজা বাদশার বংশধর। খালেকদুন রাণি শিরির আত্মীয় হন। এসব মেয়ে বিয়ে হয়তো কোন রাজা বাদশা আমীর ওমরার ছেলের সাথে হত।
জায়েদ নিজেকে সামলে কোন মতে বলল “তুমি আমাকে চিনেছ?”
মেহরিন “বাহ, চিনব না? আপনি আমাদের ডাকাতের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। আপনার এ ঋন কীভাবে শোধ করি বলেন তো? মা আপনার কথা প্রায়ই বলে। আপনার বাড়ী তো আশেপাশের কোথাও, তাই না?”
জায়েদ উত্তর দিল “ইয়াসরিব”
“ইয়াসরিবের নাম এখন মদীনা। ঢাল তলোয়ার ছাড়া রাষ্ট্র! আপনি নবীকে দেখেছেন?”
“না, নবীকে দেখিনি, দেখার সুযোগ পাই নি”
“ওমা, আপনি বাইরে কেন? ভেতরে আসুন”
আগে যখন এ বাড়ী এসেছিল তখন এই দালান ছিল না, পরে বানিয়েছে। জায়েদ বাইরের কক্ষে অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষন পরে মেহরিনের মা আসলেন। জায়েদকে দেখেই বললেন “বাবা তুমি এতদিন পরে এলে?”
মহিলার আন্তরিকতা যত বাড়ছে জায়েদের উৎকণ্ঠা ততই বাড়ছে। আরব মেয়ে হওয়ায় জায়েদেকে উনি স্নেহের চোখে দেখে। জায়েদ জানে শেষ পর্যন্ত রোমানরা এদের হত্যা করবে। কারণ খালেকদুন একজন সাহসী যোদ্ধা। স্ত্রী সন্তানের জন্য তিনি কখনো পিছপা হবে না। আর পিছপা না হলে রোমান সম্রাটের দেয়া প্রস্তাবে রাজী হবেন না। আর রাজী না হলে নির্ঘাত খালেকদুনের পরিবারের সবাইকে হত্যা করা হবে। হত্যা করার আগে মেহরিনের সাথে কী কী আচরণ করা হবে সেটা ভাবতেই জায়েদ অসহায় হয়ে পড়ল। একদিকে যাজকের প্রতি তার জীবন বাঁচানোর কৃতজ্ঞতা আরেকদিকে মানবিক দিক। বিশেষ করে মেহরিনের দিকে তাকালেই তার মায়মুনার কথা মনে পড়ে।
খালেকদুনের স্ত্রী জায়েদকে বললেন “তুমি কিছুদিন এ বাড়ীতে থেকে যাও। আমার ছোট ভাইয়ের মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। এই বিয়ের পরে আমার চাচাতো ভাইয়ের বিয়ে হবে। পর পর এতগুলো আনন্দ মিস করতে চাই না। তুমিও আমাদের সাথে আনন্দের শরীক হও। আশা করি তোমার দিন খারাপ কাটবে না।”
জায়েদ ভাবল, এদের জোরাজোরি করলে হয়তো সন্দেহ করতে পারে। এছাড়া খালেকদুনের চিঠিতে তাদেরকে কোন সময় বেঁধে দেয়া হয় নাই। জায়েদের সাথে যে ছয় জন সাথী এসেছে তারা সবাই আরব কিন্তু রোমান সৈন্য। এদেরকেও প্রশিক্ষন দিয়ে আনা হয়েছে যাতে কেউ সন্দেহ করতে না পারে। এছাড়া এখানে কিছুদিন থাকলে মেহরিনকে দেখতে পারবে। এই মেয়েকে যখনই দেখে তখনই মনে হয় এই মেয়ে যদি আজীবন কাছে থাকত!
জায়েদ টের পেল মেহরিনের রূপ গুণের প্রশংসা পুরো এলাকায় ছড়িয়ে আছে। তীরন্দাজীতে তার সম কক্ষ এই এলাকায় কেউ নেই। তলোয়ার চালানোতেও সে খুব দক্ষ। আর সৌন্দর্যের কথা! গোত্রের লোকজন ভাবছে এই মেয়ে ইরানীর রাণি হবার যোগ্যতা রাখে। তারা মেহরিনের উপমা দিয়েছে ‘মরুর ফুল’।
রেসিপি দেখুন