মরুর ফুল ২২
আরব জাহানের পরিস্থিতি মুসলমানদের প্রায় অনুকূলে এসে গিয়েছিলো। ইসলামী দাওয়াতের সাফল্য এবং বড়ো ধরনের বিজয়ের লক্ষণ পর্যায়ক্রমের প্রকাশ পাচ্ছিলো। মসজিদে হারামের দরজা পৌত্তলিকরা মুসলমানদের জন্যে ছয় বছর যাবত বন্ধ করে রেখেছিলো। সেই পবিত্র মসজিদে মুসলমানদের এবাদত অধিকারের স্বীকৃতি আদায়ের প্রাথমিক উদ্যোগ শুরু হয়ে গিয়েছিলো।মদীনা মোনাওয়ারায় রাসূল (সাঃ) স্বপ্নে দেখানো হলো যে, তিনি এবং সাহাবায়ে কেরাম মসজিদে হারামে প্রবেশ করেছেন। তিনি এও স্বপ্ন দেখেন যে, তিনি কাবাঘরের চাবি নিয়েছেন এবং সাহাবারা সহ কাবা ঘর তওয়াফ ও ওমরা পালন করেন। এরপর কয়েকজন সাহাবা চুল কাটেন। কয়েকজন শুধু নখ কাটেন। রাসূল (সাঃ) সাহাবাদের এই স্বপ্নের কথা জানান। সাহাবারা শুনে খুব খুশী হলেন। তারা মনে মনে আশা করছিলেন যে, এ বছর মক্কায় যাওয়ার সম্ভব হবে। রাসূল (সাঃ) সাহাবাদের একথাও জানালেন যে, তিনি ওমরাহ পালন করবেন। একথা বলার পর সাহাবায়ে কেরাম সফরের প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করলেন।
রাসূল (সাঃ) তাঁর সঙ্গে মক্কায় যাওয়ার জন্যে মদীনা ও আশেপাশে ঘোষণা করে দিলেন। অধিকাংশ আরব ইতস্তত করছিলেন। ইতিমধ্যে রাসূল (সাঃ) নিজের জামা-কাপড় পরিষ্কার করলেন। মদীনার দায়িত্ব আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম মতান্তরে নামিলা লাইসী (রা)-কে প্রদান করলেন। রাসূল (সাঃ) তাঁর কাসওয়া নামক উটনীতে আরোহণ করে ষষ্ঠ হিজরীর পহেলা যিলকদ মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হলেন। তাঁ সহধর্মিনী হযরত উম্মে সালমা (রা) সঙ্গী হলেন। সাহাবাদের মধ্যে চৌদ্দশ, মতান্তরে পনেরশ জন যাত্র করেন। রাসূল (সাঃ) মোসাফেরসুলভ অস্ত্র সঙ্গে নিলেন, কোষবদ্ধ তলোয়ার ছাড়া অন্য কোন অস্ত্র নেননি।
রাসূল (সাঃ) এবং মুসলমানররা মক্কাভিমুখে চলছেন। যুল হোলায়ফা নামক জায়গায় পৌঁছে রাসূল (সাঃ) তাঁর হোদীকে [‘হোদী’ এমন জানোয়ারকে বলা হয়, যে, জানোয়ার হজ্জ ও ওমরাহকারীরা মক্কা বা মিনায় যবাই করেন। আইয়ামে জাহেলিয়াতের নিয়ম ছিলো যে, হোদীর পশু ভেড়া বা বকরি হলে চিহ্ন হিসাবে গলায় বস্ত্রখন্ড বেধে দেয়া হতো। তবে উট হলে কোহান চিরে রক্ত চিহ্ন দেয়া হতো। এ পশুর কোন ক্ষতি কেউ করতো না। ইসলামী শরীয়তে এই রীতি অক্ষুণ্ণ রাখা হয়েছে। উটের কোহান চিরে চিহ্ন দিলেন। ওমরাহর জন্যে ইহরাম বাঁধলেন। তিনি এসব কারণেই করলেন যাতে, সবাই নিশ্চিন্ত হতে পারে যে, তিনি কেবল ওমরাহ পালনের জন্যেই যাচ্ছেন, যুদ্ধের কোন ইচ্ছা নেই। কাফেলার আগে খাযাআ গোত্রের একজন গুপ্তচরকে কোরায়শদের মনোভাব জানতে প্রেরণ করা হলো। আসফান নামক জায়গায় পৌছার পর গুপ্তচর এসে খবর দিলো যে, কা’ব ইবনে লুয়াইকে দেখে এলাম। সে আপনার সাথে মোকাবেলা করতে তাদের মিত্র গোত্র আহাবিশ-এর লোকদের সমবেত করছে। এছাড়া অন্যান্য জায়গা থেকেও লোক জড়ো করা হচ্ছে। তারা আপনার সাথে লড়াই করা এবং মক্কা প্রবেশ রোধে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এ খবর পেয়ে রাসূল (সাঃ) সাহাবাদের সাথে পরামর্শ করলেন।
তিনি বললেন, তোমাদের কি অভিমত? কোরায়শদের সহায়তা করতে যেসব গোত্র প্রস্তুতি নিয়েছে, আমরা কি তাদের এলাকায় গিয়ে হামলা করবো? এরপর যদি তারা চুপচাপ থাকে তবু যদ্ধের বিভীষিকা তাদের মন ঘিরে থাকবে। যদি তারা পলায়নপর হয়, তবে আল্লাহর ইচ্ছায় হয়তো কারো না কারো গর্দান কাটা যাবে। নাকি তোমরা চাও যে, আমরা কাবাঘরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবো এবং যারা পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে, তাদের সাথে লড়াই করবো? একথা শুনে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা) বললেন, আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রসূলই ভালো জানেন। কিন্তু আমরা তো ওরাহর উদ্দেশ্যে এসেছি, কারো সাথে লড়াই করতে আসিনি। তবে আমাদের এবং বায়তুল্লাহর মধ্যে যারা অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে তাদের সাথে লড়াই করবো। রাসূল (সাঃ) বললেন, ঠিক আছে, চলো। পরে সকলে মক্কাভিমুকে এগিয়ে চললেন।
এদিকে কোরায়শ রাসূল (সাঃ) এর রওয়ানা হওয়ার খবর পেয়ে পরামর্শ সভার বৈঠকে বসে এ মর্মে সিদ্ধান্তে উপনীত হলো যে, যে কোন মূল্যে মুসলমানদের বায়তুল্লাহ থেকে দূরে রাখতে হবে। রাসূল (সাঃ) আহাবিশ গোত্র পেরিয়ে সফর অব্যাহত রাখলেন বনি কা’ব গোত্রের একজন লোক এসে বললো, কোরায়শরা যী তাওয়া নামক জায়গায় অবস্থান গ্রহণ করেছে। খালেদ ইবনে ওয়ালীদ দু’শো সওয়রের এক বাহিনী নিয়ে কুরাউল গামিম-এ প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। এই স্থান মক্কাভিমুখী প্রধান সড়কে অবস্থিত। খালেদ ইবনে ওয়ালীদ মুসলমানদের বাধা দেয়ার চেষ্টা করলো। সে তার সৈন্যদলকে এমন জায়গা রাখলো, যে জায়গা থেকে উভয় পক্ষ পরস্পরকে দেখতে পায়।
মুসলমানদের যোহরের নামায আদায়ের সময় খালেদ লক্ষ্য করলেন যে, মুসলমানরা রুকু সেজদা করছে। খালেদ নামায শেষে মন্তব্য করলো যে, নামাযের সময় ওরা অসচেতন ছিলো। এ সময়ে যদি আমরা হামলা করতাম তবে ওদের কাবু করতে পারতাম। এরপর খালেদ সিদ্ধান্ত নিলো যে, আছরের নামাযের সময় মুসলমানরা যখন নামাযে দাঁড়াবে তখন হঠাৎ করে তাদের ওপর হামলা করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা সেই সময়ে সালাতুল খাওফ-এর নির্দেশ দেন। খালেদ ইবনে ওলীদ ইচ্ছা থাকা সত্তেও মুসলমানদের ওপর হামলা করতে পারেনি।
এদিকে রাসূল (সাঃ) কুরাউল গামিমের প্রধান সড়ক ছেড়ে অন্য পথ ধরে অগ্রসর হলেন। পাহাড়ী এলাকা দিয়ে ছিলো সেই পথ। অর্থাৎ ডান দিকে ঘুরে রাসূল (সাঃ) হামশ-এর মাঝ খান দিয়ে এমন এক পথে গেলেন, যে পথ সানিয়াতুল মারার নামক জায়গায় গিয়ে ঠেকছে। ছানিয়াতুল মারার থেকে তাঁরা গেলেন হোদায়বিয়া। এই স্থান ছিলো মক্কার অদূরে। কুরাউল গামিম থেকে অন্য পথে মুসলমানদের যেতে দেখে অর্থাৎ পথ পরিবর্তন করতে দেখে খালেদ কোরায়শদের নয়া পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করতে সঙ্গীদের নিয়ে দ্রুত মক্কায় গেলো।
এদিকে রাসূল (সাঃ) তাঁর সফর অব্যাহত রাখলেন। সানয়িাতুযল মারা, নামক জায়গায় পৌছার পর উটনী বসে গেলো। লোকেরা বললো, হল্ হল্। কিন্ত উটনী বসেই রইল। রাসূল (সাঃ) বললেন, এই উটনীর তো এভাবে বসে পড়ার অভ্যাস নেই। তিনি একে থামিয়ে রেখেছেন। যিনি হাতিকে থামিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর তিনি বললেন, সেই সত্তার শপথ, যাঁর হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, ওরা এমন কিছু দাবী করবে না যাতে আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজের প্রতি শ্রদ্ধার প্রমাণ থাকবে। কিন্তু আমি অবশ্যই তা মেনে নেব। এরপর রাসূল (সাঃ) উটনীকে ওঠার জন্যে তাকিদ দিতেই উটনী উঠে দাঁপড়ালো। এরপর রাসূল (সাঃ) পথের কিঞ্চিত পরিবর্তন করে হোদায়বিয়ায় একটি জলাশয়ের কাছে অবতরণ করলেন। জলাশয়ে পানির পরিমাণ বেশী ছিলো না। অল্প অল্প করে নেয়ার পর কিছুক্ষণের মধ্যেই পানি শেষ হয়ে গেলো। সাহাবারা আল্লাহর রসূলের কাছে পিপাসার কথা জানালেন। তিনি শরাধর থেকে একটি তীর বের কর সেটি জলাশয়ে নিক্ষেপের নির্দেশ দিলেন। সাহাবারা তাই করলেন। জলাশয় থেকে এরপর অবিরল ধারায় পানি উঠতে শুরু করলো এবং সাহাবাদের পানির কষ্ট দূর হয়ে গেলো।
রাসূল (সাঃ) নিশ্চিত মনে অবস্থানের এক পর্যায়ে খাযাআ গোত্রের বুদাইল ইবনে ওরারকা সহ খাজাআ গোত্রের কয়েকজন লোকসহ আল্লাহর রসূলের সাথে সাক্ষাতের জন্যে এলেন। তোমাহামর অধিবাসীদের মধ্যে এই গোত্রের লোকেরা ছিলো আল্লাহর রসূল মুসলমানদের হিতাকাঙ্খী। বুদাইল বললেন, আমি কা’ব ইবনে হুওয়ায়কে দেখে এলাম যে হোদায়বিয়ার পর্যাপ্ত পানির জলাশয় নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। তার সঙ্গে নারী ও শিশুরা রয়েছে। সে আপনার সাথে লড়াই করতে এবং বায়তুল্লাহ থেকে আপনাদের দূরে রাখার জন্যে সংকল্পবদ্ধ। রাসূল (সাঃ) বললেন, আমরা কারো সাথে লড়াই করতে আসিনি। লড়াই কোরায়শদের ভেঙ্গে ফেলেছে এবং মারাত্মক ক্ষতি করেছে। কাজেই তারা যদি চায় তবে আমি তাদের সাথে একটা সময় নির্ধারণ করে নেব এবং তারা আমর ও আমার লোকদের মাঝখান থেকে সরে যাবে। যদি তারা চায় তবে লোকেরা যে বিষয়ে প্রবেশ করেছে, সে সম্পর্কেও গাফেল হয়ে যাবে, অন্যথায় তারা শান্তি তো লাভ করবে। যদি তারা লড়াই ছাড়া অন্য কোন ব্যবস্থায় রাজি না হয় তবে সেই সত্তার শপথ, যাঁর হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, আমি দ্বীনের ব্যাপারে ততক্ষণ যাবত তাদের লড়াই করবো, যতক্ষাণ পর্যন্ত আমার দেহে প্রাণ থাকে অথবা যতক্ষণ যাবত আল্লহর ইচ্ছার বাস্তবায়ন না ঘটে।
বুদাইল বললেন, আপনার বক্তব্য আমি কোরায়শদের কাছে পৌছে দেব। পরে তিনি কোরায়শদের কাছে গিয়ে বললেন, আমি ওদের কাছ থেকে আসছি। আমি তাদের কাছে একটা কথা শুনেছি, যদি তোমরা শুনতে চাও তবে বলতে পারি। নির্বোধরা বললো, আমারদের শোনার দরকার নেই। আমরা তাদের কোন কথা শুনতে চাই না। বুদ্ধি-বিবেকসম্
এরপর বনু কেনানা গোত্রের হালিস ইবনে আলকামা নামক এক ব্যক্তি বললো, আমাকে ওদের কাছে যেতে দাও। কোরায়শরা অনুমতি প্রদান করলো। ওকে দেখে প্রিয় নবী সাহাবাদের বললেন, এই লোকটি অমুক। সে এমন কওমের সাথে সম্পর্কিত যারা হোদীর পশুর সম্মান করে। কাজেই পশুপালকে দাঁড় করাও। সাহাবারা পশুপাল দাঁর করালেন এবং নিজেরা লাব্বায়েক বলে তাকে আভ্যর্থনা জানালেন। এই লোকটি এ অবস্থা দেখে বললো, সুবহানাল্লাহ, বায়তুল্লাহ থেকে এদেরে ফিরিয়ে রাখা মোটেই সমীচীন নয়। অন্য কোন কথা না বলেন সে সোজা কোরায়শদের কাফে চলে গেলো এবং বললো, আমি হোদীর অর্থাৎ আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যবাইয়ের জন্যে আনীত পশু দেখেছি। তাদের গলায় বস্ত্রখন্ড বাঁধা রয়েছে এবং বহু পশুর কোহান রক্তাক্ত করে চিহ্ন দেয়া হয়েছে। কাজেই ওদেরকে বায়তুল্লাহ থেকে ফিরিয়ে রাখা আমি সমীচীন মনে করি না। এরপর কোরায়শদের এবং তার মধ্যে এমন কিছু কথা হলো যে, সে ক্ষেপে গেলো।
ওরওয়া ইবনে মাসউদ ছাকাফি এসময় হস্তক্ষেপ করে বললো, তিনি তোমাদের কাছে একটি প্রস্তাব দিয়েছেন। এই প্রস্তাব গ্রহণ করো এবং আমাকে তার কাছে যেতে দাও। কোরায়শরা তাকে অনুমতি দিলো। সে এসে আল্লাহর রসূলৈর সাথে কথা বলতে লাগলো। বুদাইল এবং তার সঙ্গীদের যেসব কথা বলেছিলেন, রাসূল (সাঃ) সেসব কথাই পুনরায় বললেন। সেসব শুনে ওরওয়া বললো, হে মোহাম্মদ (সাঃ), বলুন তো আপনি যদি নিজের কওমকে নির্মূল করে দেন তবে আপনি কি আপনার আগে কোন আরব সম্পর্কে এমন কথা শুনেছেন যে, তিনি নিজের কওমকে নির্মূল নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন? যদি ভিন্নরকম পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, তবে খোদার কসম, আমি এমন সব চেহারা এবং এমন সব উদভ্রান্ত লোকদের দেখেছি, যারা আপনাকে ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার মতোই মনে হয়। একথা শোনার পর হযরত আবু বরক (রা) বললেন, লাত-এর লজ্জাস্থানের ঝুলন্ত চামড়া চোষো গিয়ে। আমরা আল্লাহর রসূলকে ছেড়ে পালিয়ে যাব? ওরওয়া বললো, এই লোকটি কে? সাহাবারা বললেন, এই ব্যক্তি হচ্ছেন হযরত আবু বকর (রা)। ওরওয়া তখন হযরত আবু বকর ( রা)-কে সম্বোধন করে বললো, দেখো, সেই সত্তার শপথ, যাঁর হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, তুমি এক সময় আমাকে অনুগ্রহ করেছিলে। যদি তা না হতো এবং আমার সেই প্রতিদান না দেয়া থাকতো, তবে অবশ্যই আমি ওকথার জবাব দিতাম।
এরপর ওরওয়া রাসূল (সাঃ) এর সাথে বলতে লাগলো। সে কথা বলার সময় রাসূল (সাঃ) দাঁড়ি স্পর্শ করছিলো। মুগিরা ইবনে শোবা (রা) রাসূল (সাঃ) এর শিয়রে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁর হাতে ছিলো তলোয়ার। ওরওয়া আল্লাহর রসূলের দাঁড়িতে হাত দেয়া মাত্র হযরত মুগিরা তলোয়ারের বাঁট দিয়ে তার হাত সরিয়ে দিতেন এবং বলতেন, নিজের হাত আল্লাহর রসূলের দাঁড়ি থেকে দূরে রাখো। এক পর্যায়ে ওরওয়া মাথা তুলে হযরত মুগিরার পরিচয় জানতে চাইল। সাহাবারা বললেন, মুগিরা ইবনে শো’বা (রা)। ওরওয়া বললো, বিশ্বাসঘাতক। আমি কি তোর কাজে ছুটোছুটি করিনি? ঘটনা ছিলো এই যে, হযরত মুগিরা ইবনে শো’বা কিছু লোকের সঙ্গে ছিলেন। এরপর তাদেরকে হত্যা করে তাদের ধন-সম্পদ সঙ্গে নিয়ে মদীনায় এসেছিলেন। রাসূল (সাঃ) এর কাছে এসে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসূল (সাঃ) বলেছিলেন, তোমার মুসলমান হওয়া আমি মেনে নিচ্ছি কিন্তু সে ধন-সম্পদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে ওরওয়া ছুটোছুটি করেছিলো। এখন সে কথাই বলছে। উল্লেখ্য. হযরত মুগিরা ছিলেন ওরওয়ার ভ্রাতুষ্পুত্র।
এরপর ওরওয়া রাসূল (সাঃ) এর সাথে সাহাবাদের বিশেষ সম্পর্ক দেখতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর মক্কায় ফিরে গিয়ে নিজের সঙ্গীদের বললেন, হে কওম, আমি কায়সার কিসরা এবং নাজ্জাশীর মতো সম্রাটদের কাছে গিয়েছি। আল্লাহর শপথ, আমি কোন বাদশাহকে দেখিনি, যিনি তাস সঙ্গীদের কাছ থেকে এতো মর্যাদা লাভ করেন। যতোটা সম্মান ও মর্যাদা মোহাম্মদতে লাভ করতে দেখেছি। আল্লাহর শপথ, তিনি যখন থুথু ফেলেন, সেই থুথু কেউ না কেউ হাত বাড়িয়ে নিয় নেয় এবং মুখে দেহে মাখিয়ে দেয়। তিনি কোন আদেশ করলে সে আদেশ পালনে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তিনি ওজু করতে শুরু করলে তার পরিত্যক্ত পানি গ্রহণে সঙ্গীদের মধ্যে হেুড়োহুড়ি লেগে যায়। তিনি কথা বলতে শুরু করলে তার সঙ্গীরা কণ্ঠস্বর নীচু করে ফেলে। শ্রদ্ধার আতিশয্যে সঙ্গীরা তাঁর প্রতি পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় না। এমন একজন ব্যক্তি তোমাদের একটি ভালো প্রস্তাব দিয়েছেন। এ প্রস্তাব গ্রহণের জন্য আমি তোমাদের অনুরোধ করছি।
কোরায়শের যুদ্ধবাজ যুবকরা যখন লক্ষ্য করলো যে, প্রবীণরা আপোস নিষ্পত্তির ফর্মূলা নিয়ে ব্যস্ত, তখন তারা যুদ্ধ বাধানোর পাঁয়তারা করলো। তারা সিদ্ধান্ত করলো যে, রাত্রিকালে চুপিসারে মুসলমানদের শিবির গিয়ে এমন হাঙ্গামা শুরু করবে যাতে উভয় পক্ষে যুদ্ধের আগুন জ্বলে ওঠে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যে এরপর তারা অগ্রসর হয়। রাতের অন্ধকারে ৭০ অথবা ৮০ জন যুবক তানঈম পাহাড় থেকে নেমে চুপিসারে মুসলমানদের শিবিরে প্রবেশের চেষ্টা করে। কিন্তু মসুলিম সৈন্য কমান্ডার মোহাম্মদ ইবনে মোসলমা (রা) ওদের সবাইকে গ্রেফতার করে রাসূল (সাঃ) এর সামনে হাযির করেন। দয়াল নবী সন্ধির উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্যে তাদের সবাইকে ক্ষমা ও মুক্ত করে দেন। এই সম্পর্কে আল্লাহ রব্বুল আলামীণ বলেন, তিনি মক্কা উপত্যকায় ওদের হাত তোমাদের থেকে এবং তোমাদের হাত ওদের হাত নিবারিত করেছেন, ওদের ওপর তোমাদের বিজয়ী করার পর।’ (সূরা ফাতেহ, ২৪)
রাসূল (সাঃ) মক্কায় একজন দূত পাঠিয়ে তাঁর আগমনের উদ্দেশ্য কোরায়শদের কাছে সুষ্ঠভাবে ব্যক্ত করার প্রয়োজন অনুভব করলেন। একাজে তিনি ওপর ইবনে খাত্তাবকে (রা) ডাকলেন। হযরত ওমর (রা) এটি বলে অপারগতা প্রকাশ করলেন যে, হে আল্লাহর রসূল, যদি যদি অমুসলিমরা আমার ওপর নির্যাতন করে তবে মক্কায় বনি কা’ব গোত্রের একজন লোকও আমার সমর্থনে এসে দাঁড়াবে না। হযরত ওসমানই আমার বিবেচনায় এ কাজের উপযুক্ত। তাকে প্রেরণের আমি আবেদন জানাচ্ছি। তাঁর গোত্রের লোকেরা মক্কায় রয়েছে এবং তিনি কোরায়শদের কাছে আমাদের আগমনের উদ্দেশ্য যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করতে পারবেন। রাসূল (সাঃ) তখন ওসমানকে ডাকলেন এবং কোরায়শদের কাছে যাওয়ার আদেশ দিয়ে বললেন, তুমি ওদের গিয়ে বলবে েযে, আমরা যুদ্ধ করতে আসিনি, ওমরাহ পালনের জন্যেই আমরা এসেছি। তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিয়ো। রাসূল (সাঃ) হযরত ওসমান (রা)-কে একথাও বললেন যে, তিনি যেন মক্কার ঈমানদার পুরুষ ও মহিলাদের কাছে গিয়ে সান্ত্বনা দেন। তিনি যেন তাদের বলেন যে, আল্লাহ তায়ালা জাল্লা শানুহু শীঘ্রই মক্কায় ইসলামকে বিজয়ী শক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করবেন। ঈমানদার হওয়ার কারণে তখন কাউকে চুপিসারে আল্লাহর এবাদাত-বন্দেগী করতে হবে না। হযরত ওসমান (রা) রাসূল (সাঃ) এর পয়গাম নিয়ে রওয়ানা হলেন। বালদাহ নামক জায়গায় কয়েকজন কোরায়শী লোকের সাথে দেখা হলো। তারা বললো, কোথায় যাচ্ছেন? ওসমান (রা) বললেন, আল্লাহর রসূল হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) আমাকে এই বক্তব্য সহ তোমাদের কাছে পাঠিয়েছেন। কোরায়শী লোকেরা বললো, আপনার আনীত বক্তব্য আমরা আগেই শুনেছি। আপনি নিজের কাজে যান। এদিকে সাঈদ ইবনে আস উঠে হযরত ওসমানকে (রা) বললেন, মারহাবা। এরপর নিজের ঘোড়ায় জিন বেঁধে হযরত ওসমানকে (রা) পিঠে তুলে মক্কায় বাসভবনে নিয়ে গেলেন। সেখানে হযরত ওসমান (রা) কোরায়শ নেতাদের কাছে আল্লাহর রসূলের বক্তব্য ব্যাখ্যা করলেন। কোরায়শরা হযরত ওসমান (রা)-কে কাবাঘর তওয়াফের প্রস্তাব দিলো, কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করলেন। রাসূল (সাঃ) এর আগে কাবাঘর তওয়াফ করা তিনি পছন্ত করলেন না।
হযরত ওসমান (রা) তাঁর ওপর অর্পিত কাজ সম্পন্ন করলেন। কিন্তু কোরায়শরা তাঁকে তাদের কাছে রেথে দিলো। সম্ভবত তারা চাচ্ছিলো যে, উদ্ভুত পরিস্থিতির আলোকে পারস্পরিক পরামর্শক্রমে সুনির্দিষ্টি কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হবে। এরপর তারা হযরত ওসমান (রা)-এর আনীত বক্তব্যের জবাব পাঠাবে। দীর্ঘ সময় হযরত ওসমানের (রা) ফিরে না আসায় মুসলমানাদের মধ্যে গুজব ছড়িয়ে পড়লো যে, তাকে হত্যা করা হয়েছে। আল্লাহর রসূলকে এ খবর জানানো হলে তিনি বললেন, কোরায়শদের সাথে যুদ্ধ না করে আমরা এ জায়গা থেকে যাব না। একথা বলার পর তিনি সাহাবাদের বাইয়াতের জন্যে আহ্বান জানালেন। সাহাবায়ে কেরাম অত্যন্ত আগ্রহ দেখিয়ে এবং এ মর্মে বাইয়াত করলেন যে, যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে কেউ পলায়ন করবে না। সর্বাগ্রে বাইয়াত করলেন আবু ছানান আছাদী। হযরত সালমা ইবনে আকোয়া (রা) তিনবার বাইয়াত করলেন। শুরু, মাঝামাঝি সময়ে এবং শেষদিকে। আল্লাহর রসূল নিজের এক হাত অণ্য হাতে নিয়ে বললেন, এ হাত ওসমানের। বাইয়াত গ্রহণ শেষ হলে হযরত ওসমান (রা) এসে হাযির হলে তিনিও বাইয়াত করলেন। বাইয়াতে জাদ ইবনে কায়েস নামস একজন লোক অংশ নেয়নি। সে ছিলো মোনাফেক।
রাসূল (সাঃ) একটি গাছের নীচে এই বাইয়াত গ্রহণ করেন। হযরত ওমর (রা) রাসূল (সাঃ) এর হাত ধরে রেখেছিলেন। হযরত মা’কাল ইবনে ইয়ছার (রা) গাছের কয়েকটি শাখা ধরে রাসূল (সাঃ) এর ওপর থেকে সরিয়ে রাখছিলেন। এই বাইয়াত সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা কোরআনে করিমে এই আয়াত নাযিল করেন, ‘মোমেনরা যখন বৃক্ষতলে তোমার কাছে বাইয়াত গ্রহণ করলো, তখন আল্লাহ তায়ালা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হলেন।’ (সূরা ফাতেহ, আয়াত১৮)
কোরায়শরা পরিস্থিতির নাজুকতা উপলব্ধি করলো। এরপর খুব দ্রুত সোহায়েল ইবনে আমরকে সন্ধি করতে প্রেরণ করলো। সোহায়েলকে তাকিদ দিয়ে বলে দেয়া হলো, আল্লাহর রসূল যেন এ বছর ফিরে যান। কেননা আরবরা বলাবলি করতে পারে যে, তিনি আমোদের শহরে জোর করে প্রবেশ করেছেন। রাসূল (সাঃ) সোহায়েলকে দেখে সাহাবাদের বললেন, তোমাদের কাজ তোমাদের জন্যে সহজ করে দেয়া হয়েছে। এই লোকটি প্রেরণের অর্থ হচ্ছে, কোরায়শরা সন্ধি চায়। সোহায়েল রাসূল (সাঃ) এর কাছে এসে বেশ কিছুক্ষণ তাঁর সাথে আলাপ করলেন। এরপর সন্ধির শর্তাবলী প্রণয়ন করা হলো, শর্তাবলী নিম্নরূপ।
এক) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ বছর মক্কায় প্রবেশ না করেই ফিরে যাবেন। আগামী বছর মুসলমানরা মক্কায় আসবেন এবং তিনদিন অবস্থান করবেন। তাঁদের সঙ্গে আগামী বছর মুসলমানরা মক্কায় আসবেন এবং তিনদিন অবস্থান করবেন। তাঁদের সঙ্গে আত্মরক্ষামূলক অস্ত্র থাকবে। তলোয়ার থাকবে কোষবদ্ধ। কেউ তাদের উত্যক্ত করবে না।
দুই) উভয় পক্ষ দশ বছর যাবত যুদ্ধ বন্ধ বাখেবে। এই সময়ে জনসাধারণ নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ থাকবে। কেউ কারো ওপর হাত তুলবে না।
তিন) মোহাম্মদ (সাঃ) এর মতাদর্শে যারা ইচ্ছা করে, তারা প্রবেশ করতে পারবে কোরায়শদের মতাদর্শে যারা থাকতে চায়, তারা থাকতে পারবে। যে গোত্র অন্য গোত্রে প্রবেশ করবে, সে সেই গোত্রের একাংশ হিসাবে বিবেচিত হবে। কাজেই এমন কোন গোত্রের ওপর বাড়াবাড়ি করা হলে সেই প্রবিষ্ট গোত্রের লোকদের ওপরও বাড়াবাড়ি করা হয়েছে মনে করতে হবে।
চার) কোরায়শদের কোন লোক যদি নেতাদের অনুমতি ছাড়া অর্থাৎ পালিয়ে মোহাম্মদের কাছে যায় তিনি তাকে ফিরিয়ে দেবেন। কিন্ত মোহাম্মদের সঙ্গীদের মধ্যে কেউ যদি আশ্রয় লাভের জন্যে কোরায়শদের কাছে যায়, তবে কোরায়শরা তাকে ফেরত দেবে না।
চুক্তির খসড়া প্রণীত হওয়ার পর রাসূল (সাঃ) শেরে খোদা হযরত আলী (রা)-কে ডেকে শর্তাবলী লেখালেন। শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ লেখার জন্যে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন। অর্থাৎ পরম করুণাময় ও অতি দয়ালূ আল্লাহর নামে শুরু করছি। এতে সোহায়েল বললো, আমরা তো জানি না রহমান কি? আপনি বরং এভাবে লিখতে বলুন, বি-ইসমিকা আল্লাহুম্মা। অর্থাৎ আপনার নামে হে আল্লাহ। রাসূল (সাঃ) হযরত আলী (রা)-কে তাই লিখতে বললেন। এরপর রাসূল (সাঃ) নিম্নোক্ত বক্তব্যসমূহের ওপর আল্লাহর রসূল মোহাম্মদ সন্ধি করেছেন। এ কথা শুনে সোহায়েল বললো, আমরা যদি জানতাম যে, আপনি আল্লাহর রসূল, তবে কাবাঘরে তওয়াফে আপনাকে বাধা দিতাম না এবং আপনার সাথে যুদ্ধও করতাম না। আপনি মোহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ লিখতে বলুন। তিনি বললেন, তোমরা স্বীকার না করলেও আমি আল্লাহর রসূল। এরপর হযরত আলী (রা)-কে বললেন, মোহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ লেখো এবং রসূলুল্লাহ শব্দ মুছে দাও। হযরত আলী (রা) রাযি হলেন না, আল্লাহর রসূল নিজ হাতে শব্দটি মুছে দিলেন। এরপর সন্ধির শর্তাবলী পুরোপুরি লিপিবদ্ধ করা হলো।
সন্ধি সম্পন্ন হওয়ার পর বনু খাযাআ গোত্র রাসূল (সাঃ) এর মতাদর্শে প্রবেশ করলো। এই গোত্রের লোকেরা পৃকতপক্ষে আবদুল মোত্তালেবের সময়েও বনু হাশেমের মিত্র ছিলো। মতাদর্শে প্রবেশ বা মতাদর্শ গ্রহণ করার অর্থ হচ্ছে প্রাচীন নিত্রতা স্বীকারোক্তি এবং মিত্রতা সম্পর্কে সুদৃঢ়করণ। অন্যদিকে বনু বকর গোত্র কোরায়শদের মতাদর্শে প্রবেশ করে।
সিন্ধির শর্তাবলী লেখা হচ্ছিলো এমন সময় শেকল পরিহিত অবস্থায় শেকল টানতে টানতে সেখানে এসে হাযির হলেন সোহায়েলের পুত্র আবু জান্দাল। তিনি মক্কা থেকে এসে নিজেকে মুসলমানদের মধ্যে ফেলে দিলেন। সোহায়েল বললো, ওর সম্পর্কে সর্বপ্রথম আমি আপনার সাথে বাস্তবায়ন করছি। আপনি ওকে ফিরিয়ে দিন। রাসূল (সাঃ) বললেন, সন্ধির কাজ এখনো শেষ হয়নি। সোহায়েল বললো, আবু জান্দালকে ফেরত না দিলে আপনার সাথে আমি সন্ধিই করবো না। রাসূল (সাঃ) সোহায়েলকে বললো, আচ্ছা, তুমি ওকে আমার খাতিরে ছেড়ে দাও। সোহায়েল বললো, আপনার খাতিরেও ওকে ছেড়ে দিতে পারব না। রাসূল (সাঃ) পুনরায় অনুরোধ জানালেন, দাওনা ছেড়ে!
সোহায়েল বললো, না, না, দিতে পারব না। এরপর সোহায়েল আবু জান্দালের মখে থাপ্পড় মারলো এবং মক্কায় ফিরিয়ে নেয়ার জন্যে জামার কলার ধরে টানাটানি করতে লাগলো। আবু জান্দাল তখন চিৎকার করে বললেন, হে মুসলমানরা, আমি কি পুনরায় পৌত্তলিকদের কাছে ফিরে যাব? ওরা আমার দ্বীনের ব্যাপারে আমাকে ফেতনা মধ্যে ফেলে দেবে। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বললেন, আবু জান্দাল, তুমি ধৈর্য ধারণ করো এবং ধৈর্যকেই সওয়াবের কারণ মনে করো। আল্লাহ তায়ালা তোমার এবং তোমার সঙ্গী অন্যান্য কমযোর মুসলমানদের জন্যে প্রশস্ততা এবং আশ্রয়ের জায়গা করে দেবেন। আমরা কোরায়শদের সাথে সন্ধি করছি। আমরা তাদের সাথে এবং তারা আমাদের সাথে আল্লাহর নামে অঙ্গীকরে আবদ্ধ হয়েছি। কাজেই আমরা সন্ধির শর্ত লংঘন করতে পারি না।
হযরত ওমর (রা) দ্রুত আবু জান্দালের কাছে গেলেন। তিনি তার পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলছিলেন, আবু জান্দাল ধৈর্যধারণ করো, ওরা মোশরেক, পৌত্তলিক। ওদের রক্ত কুকুরের রক্ত। এ কথা বলার সাথে সাথে হযরত ওমর (রা) নিজের তলোয়ার আবু জান্দালের কাছে নিয়ে যাচ্ছিলেন। হযরত ওমর (রা) পরে বলেছেন, আমি আশা করেছিলাম যে, আবু জান্দাল আমার কাছ থেকে তলোয়ার নিয়ে তার পিতাকে শেষ করে দেবে। কিন্তু আবু জান্দাল তা করেননি। অবশেষে সন্ধির শর্ত বাস্তবায়িত হলো।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সন্ধির শর্তাবলী লেখানোর পর বললেন, ওঠো এবং নিজ নিজ পশু কোরবানী করো। সাহাবাদের কেউ উঠলেন না। রাসূল (সাঃ) তিনবার একই কথা বললেন, একই আদেশ করলেন। কিন্তু কেউ কোন আগ্রহ দেখালেন না। অতপর তিনি উম্মুল মোমেনীন হযরত সালমার (রা) কাছে এ কথা ব্যক্ত করলেন। নবী সহধর্মিনী বললেন, হে আল্লাহর রসূল, আপনি যদি মনে করে থাকেন যে, হোদীর পশু যবাই করা প্রয়োজন, আপনি নিজেই যান, কাউকে কিছু না বলে নিজের হোদীর পশু জবাই করুন। এরপর আপনার নাপিতকে ডেকে মাথার চুল কামিয়ে ফেলুন। উম্মুল মোমেনীনের পরামর্শ অনুযায়ী রাসূল (সাঃ) নিজের হোদীর পশু যবাই করলেন এবং নিজের মাথার চুল কামানো ব্যবস্থা করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সাহাবারা আল্লাহর রসূলের দেখাদেখি নিজ নিজ হোদীর পশু যবাই করলেন। এরপর একে অন্যের মাথার চুল কাটতে শুরু করলেন। কেউ সব চুল কামিয়ে ফেললেন কেউ চুল ছাঁটাই করিয়ে ছোট করালেন। সবাই গম্ভীর এবং দুশ্চিন্তগ্রস্ত
মক্কা থেকে কিছুসংখ্যক মোমেন মহিলা রাসূল (সাঃ) এর কাছে এলেন। তাদের আত্মীয় স্বজন হোদায়বিয়ার সন্ধি অনুযায়ী তাদের ফেরত দাবী করলেন। রাসূল (সাঃ) এ দাবী প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি যুক্তি দেখালেন যে, এ বিষয়ে চুক্তিতে লিখিত বক্তব্য হচ্ছে এই চুক্তি এই শর্তের ওপর করা হচ্ছে যে, আমাদের যে পুরুষ আপনাদের কাছে যাবে তারা যে ধর্মই বিশ্বাসের ওপরই থাকুক না কেন তাদের অবশ্যই ফিরিয়ে দিতে হবে। এখানে মহিলাদের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়নি।[সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ. ৩০৭] কাজেই মহিলারা সন্ধির এ শর্তের আওতা বহির্ভূত। আল্লাহ রব্বুল আলামীন এরপর এই আয়াত নাযিল করেন। ‘হে মোমেনরা, তোমাদের কাছে মোমেন নারীরা দেশত্যাগী হয়ে এলে তাদেরকে পরীক্ষা করিও। আল্লাহ তাদের ঈমান সমন্ধে সম্যক অবগত আছেন। যদি তোমরা জানতে পারো যে, তারা মোমেন, তবে তাদের কাফেরদের কাছে ফেরত পাঠিও না। মোমেন নারীরা কাফেরদের জন্যে বৈধ নয় এবং কাফেররা মোমেন নারীদের জন্যে বৈধ নয়। কাফেররা যা ব্যয় করেছে, তা ওদের ফিরিয়ে দিও। তোমরা তাদের বিয়ে করলে তোমাদের কোন অপরাধ হবে না, যদি তোমরা তাদেরকে তাদের মোহরানা দাও। তোমরা কাফের নারীদের সাথে দাম্পত্য সম্পর্ক বজায় রেখো না।’ (সূরা মমতাহানা, আয়াত ১০)
এই আয়াত নাযিল হওয়ার পর কোন মোমেন মহিলা হিজরত করে এলে রাসূল (সাঃ) আল্লাহ রব্বুল আলামীন এ সম্পর্কে বলেন, ‘হে নবী, মোমেন নারীরা যখন তোমার কাছে এসে বাইয়াত করে এ মর্মে যে, তারা আল্লাহর সাথে কোন শরিক স্থির করবে না, চুরি করবে না, ব্যাভিচার করবে না, নিজেদের সন্তানকে হত্যা করবে না, তারা সজ্ঞানে কোন অপবাদ রচনা করে রটাবে না এবং সৎকাজে তোমাকে অমান্য করবে না, তখন তাদের বাইয়াত গ্রহণ করো এবং তাদের জন্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা মুমতাহনা, আয়াত ১২)
হিজরত করে আসা মহিলারা উক্ত আয়াতের শর্তাবলী অনুযায়ী অঙ্গীকার করতেন। রাসূল (সাঃ) বলতেন, আমি তোমাদের কাছ থেকে বাইয়াত নিলাম। এরপর তাদের ফেরত পাঠাতেন না।
এ নির্দেশ অনুযায়ী মুসলমানরা তাদের অমুসলিম অর্তাৎ কাফের স্ত্রীদের তালাক দিয়ে দেন। সেই সময় হযরত ওমরের (রা) দুইজন স্ত্রী ছিলেন কাফের। তিনি তাদের তালাক দিলেন। এদের একজনকে মুয়াবিয়া, অন্যজনকে সফওয়ান ইবনে উমাইয়া বিয়ে করেন।
রাসূল (সাঃ) মদীনায় এসে নিশ্চিন্ততা অনুভব করলেন। এ সময় মক্কা থেকে আবু বাছির নামে একজন মুসলমান কাফেরদের অত্যাচার-নির্যা
অন্য লোকটি পালিয়ে মদীনায় এসে মসজিদে নববীতে প্রবেশ করলো। রাসূল (সাঃ) তাকে দেখে মন্তব্য করলেন যে, এই লোকটি বিপদ দেখেছে। সেই লোকটি আল্লাহর রসূলের কাছে এসে বললো, আমার সঙ্গীকে হত্যা করা হয়েছে। আর আমকেও হত্যা করা হবে। এমন সময় আবু বাছির ফিরে এসে বললেন, হে আল্লাহর রসূল, আল্লাহ তায়ালা আপনার অঙ্গীকার পূর্ণ করে দিয়েছেন। আপনি আমাকে তাদের সঙ্গে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, এরপর আল্লাহ তায়ালা আমাকে ওদের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছেন। রাসূল (সাঃ) বললেন, ওর মায়ের ক্ষতি হোক। ওর কোন সাক্ষী মিলে গেলে তো সে যুদ্ধের আগুন জ্বালিয়ে দেবে। একথা শুনে আবু বাছির বুঝলেন যে, এবার তাকে কাফেরদের হাতে তুলে দেয়া হবে। এ কারণে তিনি মদীনা থেকে বেরিয়ে সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় চলে গেলেন। এদিকে আবু জান্দাল ইবনে সোহায়েল মক্কা থেকে পালিয়ে আবু বাছিরের সঙ্গে মিলিত হলেন। কোরায়শদের মধ্যেকার যারাই ইসলাম গ্রহণ করতো তারাই আবু বাছিরের সাথে এসে মিলিত হতো। সেখানে একটি দল গড়ে উঠলো। এরপর এরা সিরিয়ায় যাতায়াতকারী কোরয়াশদের বাণিজ্য কাফেলা লুণ্ঠন করতো এবং কাফেলার লোকদের নির্মমভাবে প্রহার করতো। কোরায়শা অতিষ্ঠ হয়ে রাসূল (সাঃ) কে নিকটাত্মীয়তার দোহাই দিয়ে আবেদন জানালো যে, আপনি ওদেরকে নিজের কাছে ডেকে নিন। এরপর মক্কার কোন মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে আপনার কাছে গেলে তারা নিরাপদ থাকবে। তাদের ব্যাপারে আমরা প্রশ্ন তুলব না। রাসূল (সাঃ) এরপর সমুদ্র উপকূলীয় মুসলমানদের মদীনায় ডেকে আনলেন। এর কিছুদিন পর থেকেই কোরায়শদের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ইসলাম গ্রহণ করা শুরু হল।
Subscribe to:
Post Comments
(
Atom
)
No comments :
Post a Comment