মরুর ফুল ২৩

জায়েদ কারাগার থেকে পালিয়েছে এ কথাটি যেমন খালেকদুনের স্ত্রী ও কণ্যার কাছে গুরুত্বপূর্ণ তেমনি প্রধান কারারক্ষী খুন হয়েছে সেই খবর সোহরাবের কাছে এর চেয়ে বেশি গুরুত্বপুর্ণ। রাজধানী শহরের মধ্যে অবস্থিত কারাগার থেকে বন্দীরা পালিয়ে যাবে আর যাবার সময় প্রধান কারারক্ষীকে খুন করে যাবে এটা সম্রাট মানবেন না। সোহরাবের দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ আসতে পারে। চারিদিকে শত্রুর অভাব নেই। এই সুযোগ বিরোধী পক্ষ অবশ্যই নিবে।
“এত সুরক্ষিত কারাগার থেকে বন্দীরা পালায় কী করে? যেখানে তিন স্তরে নিরাপত্তা থাকে।” সোহরাব স্বগোক্তি করল। শাহজাদা সোহরাব ঘোড়া ছুটিয়ে কারাগারের দিকে গেলেন। পেছন পেছন মেহরিন ও তার মা পায়ে হেঁটে আসছেন। সোহরাব ভাল যোদ্ধা, অনেক ঝানু প্রশাসক। প্রধান কারারক্ষীর গলা কাটা লাশ ভাল করে দেখল। যে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কারারক্ষীর গলা কাটা হয়েছে তাতে নতুন করে শান দেয়া হয়েছে, ধারনা করার কারণ গলার কাটাটা খুব মসৃণ। সে সব কারারক্ষীদের ডাক দিল। সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। দুই জন কারারক্ষীর খোঁজ নেই। হয় তারা পালিয়েছে অথবা তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সোহরাব কারাগারের আশেপাশে মানুষের ও ঘোড়ার পায়ের ছাপ খুঁজল। এই রাস্তায় মানুষ নিয়মিত হাঁটে বলে মানুষের পায়ের ছাপ অনেক পেল কিন্তু ঘোড়ার ক্ষুরের চিহ্ন পেল মাত্র দুইটা।
এই কারাগার খুব গুরুত্বপূর্ণ কারাগার। এখান থেকে পালানো খুব সহজ ব্যপার নয়। ভেতরের সব বন্দীর হাতে যদি তলোয়ার দেয়া হয় তাতে কেউ বের হতে পারবে না। কারণ প্রত্যেকটা দরজা বাইরে থেকে তালা দেয়া। সেই তালা ভেংগে কেউ বের হলে তাকে প্রহরীর মুখোমুখী হতে হবে। প্রহরী যদি তাকে সহযোগীতা করে তাহলে তাদেরকে আরেক দল প্রহরীর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। সেই স্তর পার হলে তাকে একটা দেয়াল পার হতে হবে। সেই দেয়াল অনেক উঁচু ও মসৃণ, মই ছাড়া পার হওয়া অসম্ভব। সেই দেয়ালের একটা জায়গায় একটা দরজা আছে। সেই দরজার তালা বাইরে থেকে লাগানো। সেই দরজা প্রধান কারারক্ষী নিজের হাতে খুলে থাকেন। প্রধান কারারক্ষীর শরীরে ধ্বস্তাধ্বস্তির
চিহ্ন নেই। তিনি নিজেও একজন যোদ্ধা ছিলেন। পাঁচ ছয় জন অস্ত্রধারী বন্দীর সাথে লড়াই করে টিকে থাকার ক্ষমতা এই রক্ষীর ছিল। কিন্তু তিনি ধ্বস্তাধ্বস্তি ছাড়াই কীভাবে ছুরিকাঘাতে মারা গেলেন? সোহরাবের মনে প্রশ্ন জাগল। যে দুই কারারক্ষী নিখোঁজ তাদের একজন জায়েদ যে কক্ষে থাকত সেই কক্ষের সামনে পাহারা দিত। সোহরাবের কাছে পরিস্থিতি জটিল বলে মনে হচ্ছে। তার কেন যেন মনে হচ্ছে বন্দীদের বাইরে থেকে মুক্ত করা হয়েছে। বাঁধা দিতে গেলে প্রধান কারারক্ষী নিহত হন। কিন্তু তাতেও হিসাব মিলছে না। জায়েদকে কেন কারাবন্দি করা হয়েছিল? তার বিরুদ্ধে তো কারো অভিযোগ নেই। সোহরাব জায়েদের কক্ষে থাকা সেই খ্রিস্টান পাদ্রীকে ডাকলেন “তুমি জায়েদের সাথে কত দিন ছিলেন?”
“প্রথম থেকেই, মাস পাঁচেক হবে। দিন তারিখ ঠিক থাকেনা তো, তাই সঠিক হিসেব দিতে পারছি না।” পাদ্রী উত্তর দিল।
“ওর কাছে কি কেউ দেখা করতে আসত?”
“শুনেছি একজন দেখা করতে আসত যদিও জায়েদ কখনো বলেনি কার সাথে দেখা করত। আর সেই লোককে আমিও দেখিনি। লোকটি আসলে জায়েদকে প্রহরী কক্ষ থেকে ডেকে নিয়ে যেত।”
“তার মানে সেই প্রহরীকে ধরতে পারলে জানা যাবে জায়েদের রহস্য কী?”
দূরে কেউ চিৎকার করে উঠল। সোহরাব ও কারারক্ষীরা সেদিকে দৌড় দিল। কারাগার থেকে অদূরে একটা নির্জন স্থানে এক কারারক্ষীর লাশ পাওয়া গেছে। এক পথচারী লাশ থেকে চিৎকার দিয়েছেন। অন্য রক্ষীরা বলল এই রক্ষী জায়েদের কক্ষের সামনে পাহারা দিত। রাগে সোহরাবের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করল। সোহরাবের অনুমতি ছাড়া এই কারাগারে কাউকে ঢোকানো হয় না। আবার এই কারাগার থেকে কাউকে বের করতে হলেও সোহরাবের অনুমতি লাগে। সোহরাব জানেই না এই কারাগারে একজন বন্দি ছিল যাকে কিছুদিন আগে রাজকীয় বাহিনী হন্যে হয়ে খুঁজছিল। সে এখন পলাতক।
সোহরাব এক রক্ষীকে পাঠাল শহর রক্ষী বাহিনী প্রধান হাশিমিকে খবর দিতে। বাকী রক্ষীদের সে জেরা করতে লাগল। কেউ কিছুই বলতে পারল না। সবাই এক রক্ষীর চিৎকার শুনে দৌড়ে এসে দেখে কারাগারের প্রধান ফটকের সামনে কারা প্রধানের লাশ। সেই রক্ষী সোহরাবের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে বলল “প্রতিদিন এ সময় আমার ডিউটি শুরু হয়। প্রধান ফটকে এসে আগের শিফটের রক্ষীর কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নেই, সাথে প্রধান কারারক্ষীও থাকে। আমি কারাগারের ভেতরেই থাকি। বাইরে এসে দেখি প্রধান কারারাক্ষীর লাশ পড়ে আছে। আর প্রধান ফটকে দাঁড়ানো সেই রক্ষীও নেই। দ্রুত গিয়ে ভেতরে অবস্থিত সকল রক্ষীদের খবর দিলাম। ভেতরে তল্লাশী চালিয়ে দেখলাম ভেতরের ঊঁচু দেয়ালের দরজাটা খোলা। তার মানে ভেতরে কেউ ঢুকেছে। দ্রুত সব কক্ষ খুঁজলাম, দেখলাম একটা কক্ষের তিন জন বন্দী গায়েব। অবশ্য সেই কক্ষের আরেক বন্দী খ্রিস্টান পাদ্রী ঠিকই আছে। এমন সময় আপনার লোক গভর্ণর অফিস থেকে আসলেন।”
সোহরাবের এখন কী করা উচিৎ ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। এই খবর সম্রাট জানলে যে কী করবেন তা চিন্তা করছে। সোহরাব ভাবল, কীভাবে কী হতে পারে?
মনে করি বাইরে থেকে হামলা হল তাহলে বাইরের লোকজন নিশ্চয়ই অনেকগুলো ঘোড়ায় চড়ে আসবে। অথচ বাইরে মাত্র দুই একটা ঘোড়ার খুরের চিহ্ন রয়েছে। ঠিক আছে ধরলাম হামলাকারীরা পায়ে হেঁটে বন্দী উদ্ধার করতে এসেছে যদিও সেটা প্রায় অসম্ভব সেক্ষেত্রে কী হত? তারা সবার আগে বাইরের প্রহরীকে হত্যা করত, এরপরে প্রধান ফটকের তালা খুলত। কিন্তু প্রধান ফটকের তালার চাবি ভেতরে কারা প্রধানের কাছে থাকে। কারা প্রধান ইচ্ছা করে তালা না খুললে ভেতর থেকে তাকে মেরে তালা খোলা সম্ভব। সেক্ষেত্রে সম্ভাবনা আছে ভেতরে তাদের কোন লোক ছিল। সে কে হতে পারে? বন্দীদের একজন? নাকি সেই কারারক্ষী যে জায়েদের কক্ষের সামনে পাহারা দিত? কিন্তু ….. সোহরাবের মনে হাজারো প্রশ্ন। ইতি মধ্যে শহর রক্ষী প্রধান হাশিমি ও তার লোকজন চলে এসেছে। মেহরিন ও তার মাও হাজির। আরেক কারারক্ষীকে পাওয়া যাচ্ছে না।
কারাপ্রধানের মৃত্যু ও বন্দী পলায়নের খবর সম্রাটের কানে পৌছে গেছে। খবরটা তার কাছে পৌঁছিয়েছে শাহজাদী বিলকিস।
“জাহাঁপনা জানেন কি কিছুদিন আগে এক রাজকীয় সেনা খুন হয়েছিলেন?”
“জানব না কেন? রাজধানীতে খুন হয়েছে আর আমি জানব না?” বিরক্তির সাথে সম্রাট বললেন।
“আমার কাছে খবর এসেছে যে আরব সেই খুনটা করেছে সেই আরব নাকি মাদায়েনের কারাগারে গত ছয় মাস ছিল।”
“তাই নাকি?” সম্রাট অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন “কিন্তু ওকে তো পুরা রাজকীয় বাহিনী খুঁজছিল!”
“কারাগারের চেয়ে নিরাপদ স্থান মাদায়েনে আর নেই জাহাঁপনা! মাদায়েনের কারাগারে সেই আরব বন্দী হয়ে থাকবে আর শাহজাদা সোহরাব তা জানবে না এটা কি বিশ্বাস যোগ্য? তাও ছয় মাস ধরে? গোটা মাদায়েন যেখানে তন্ন তন্ন করে সেই আরবকে খোঁজা হল তখন কেউ তাকে নিরাপদে লুকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে কারাগারের একটা কক্ষ লুকিয়ে রেখেছিল। রাজকীয় সেনারা ব্যর্থ হল। আমি কী বলতে চাইছি জাহাঁপনা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন?” শাহজাদী জাহাঁপনার দিকে তাকিয়ে তার চেহারা বোঝার চেষ্টা করছে।
সম্রাটের মাথায় কিছুই ঢুকছে না। এদিকে সোহরাব সম্রাটের বিশ্বস্ত লোক। সে কেন এক আরবকে লুকিয়ে রাখবে? তবে তার অনুমতি ছাড়া যে কারাগারে কাউকে লুকিয়ে রাখা যায় না সেটা সম্রাট ভাল করেই জানে।
শাহজাদী চলে যাওয়ার পরে উজির হামিদ এল। সে বলল “জাহাঁপনা আমি আপনার মঙ্গল চাই। আপনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে পাচ্ছি। এই যে এক আরব বন্দি কারাগারে ছিল তাকে লুকিয়ে রেখেছে শাহজাদা সোহরাব। সেই সোহরাবের সাথে মেয়ে বিয়ে দিতে উঠে পড়ে লেগেছেন সেনাপতি খালেকদুন। আমিতো মনে করছি খালেকদুন এই ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত। এক রাজকীয় সেনাকে হত্যা করে তারা সম্রাটে নিরপত্তা পরীক্ষা করে নিচ্ছিল না তো? এছাড়া সেই বন্দীকে নাকি খালেকদুন নিজের হাতে মারার জন্য তার লোকেরা নিয়ে যাচ্ছিল? এখন তো মনে হচ্ছে পুরাই ষড়যন্ত্র। আপনি দ্রুত খালেকদুনকে সেনাপতির পদ থেকে সরান। প্রয়োজনে ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগে তার স্ত্রী ও মেয়েকে গ্রেফতার করুন। তারাও এই ষড়যন্ত্রে জড়িত।”
সম্রাট সিদ্ধান্ত ঘোষনা করলেন এই মুহুর্ত থেকে মাদায়েনের গভর্ণর হিসেবে তার ছেলে ফররুখকে নিয়োগ দেয়া হল। শাহজাদা না হলে সোহরাবের গলা কাটা পড়ত কিন্তু তাকে রাজ পরিবারের লোক হিসেবে তাকে মৃত্যূদন্ড না দিয়ে বন্দী করা হোক। তদন্ত করে দোষী সাব্যাস্ত হলে তার মাথা থাকবে না।” অন্য সময় হলে সম্রাট ঠিকই তার গলা কাটতেন। কিন্তু পর পর কয়েকটি যুদ্ধে হারার পরে সম্রাট এখন ঘরের শত্রু বাড়াতে চাইছেন না।
শাহজাদী বিলকিসের এই চালটি সফল হল। তার প্রতিপক্ষের একটা শক্তি কমেছে। তবে প্রতিপক্ষের প্রধান শক্তি হল খালেকদুন। তাকে রাস্তা থেকে সরাতে না পারলে সামনে বিপদ হবে।
সকালে শাহজাদা সোহরাবের আদেশে যে কারাগারে যে কাউকে বন্দী করে রাখা হত বিকালে শাহজাদাকে সেই কারাগারে বন্দী করা হল।
রেসিপি দেখুন
No comments :

No comments :

Post a Comment