মরুর ফুল ৪৪
জায়েদ যে ধনী ব্যাক্তির ব্যক্তিগত দেহ রক্ষীর চাকরি নিয়েছে তার নাম সোলায়মান। জন্ম সূত্রে সে মূলত সিরিয়ার বিখ্যাত গাসসানী বংশের। মূলত সিরিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী বংশ হওয়ার কারণে গাসসানী বংশ থেকেই সাধারণত সিরিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের গভর্ণর, সেনা অফিসার, সরকারী অফিসার। জমিদার নির্ধারিত হয়। ইরানী কিংবা রোমান যারা যখনই এই এলাকা দখল করেছে তারাই গাসসানীদের হাতে রেখেছে। গাসসানীরা মুলত আরব। তবে এরা মরুচারী না। গাসসানীদের নিজস্ব সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল এক লক্ষের উপরে। এই গাসসানী বংশের নেতা হলেন মূতার গভর্ণর শুরাহবিল যার সাথে তিন হাজাস মুসলিম বাহিনী প্রবল বিক্রমে যুদ্ধ করেছিল। সেটা প্রায় ছয় মাস আগের ঘটনা। তখনো মুসলমানরা আরবের পৌত্তলিকদের কেন্দ্র স্থল মক্কা বিজয় করেনি।সোয়ালায়মানের বাণিজ্য বহর মক্কা মদীনা সহ বিভিন্ন এলাকায় আসা যাওয়া করত। সোলায়মান সাহেব ছিলেন বৃদ্ধ। তিনি বেশি দূরে চলাফেরা করতে পারেন না বলে এখন বাণিজ্য কাফেলায় আসা যাওয়া করেন না। কিন্তু ধনী হওয়ার কারণে তার শত্রুর অভাব নেই। দুই বার তার উপরে আক্রমণ হয়েছিল তার ধন সম্পদ ডাকাতির উদ্দেশ্যে। ডাকাতদের আক্রমনে তার এক ছেলে নিহত হয়, দুই ছেলে আহত হয়। সেই থেকে তিনি ব্যাক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষী নিয়ে চলেন। মাঝে মাঝে রক্ষীরা চাকরি ছেড়ে চলে যেত কারণ গাসসানীরা তাদের সেনা বাহিনীকে শক্তিশালী করার প্রয়োজন মনে করছে। তাই তারা নিত্য নতুন সৈন্য সংখ্যা বাড়াচ্ছে। জায়েদ খেয়াল করে দেখল গাসানীরা মূত রাজনৈতিক কারণে রাসূল (সাঃ) এর বিরোধীতা করছে। গাসসানীদের এই মুহুর্তে রোমানরা পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছে। তাদের পাশে মুসলমানরা যদি শক্তিশালী প্রতিবেশি হয় তাহলে তাদের বিপদ আছে এতদিন জমিদাররা প্রজাদের শোষন করত। অসহায় দুর্বল প্রজারা দলে দলে মদীনার পথ ধরছিল। ছোট খাট গোত্র, বংশ যারা ছিল মূলত নিচু শ্রেণীর তারাও দলে দলে ইসলামের পতাকা তলে জড়ো হচ্ছে। গাসসানীরা যেহেতু সিরিয়ার শাসনকর্তা ছিল তাই এই ব্যাপারটাতে তারা শংকিত হয়ে গেল। এছাড়া ছয় মাসে আগে সংঘটিতে যুদ্ধে তারা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। তিন হাজার সৈন্যের বীরত্ব যদি এমন হয় তাহলে তিরিশ হাজার সৈন্য আসলে কী হবে? ইয়েমেন থেকে কোন বাণিজ্য কাফেলা মক্কা মদীনা হয়ে সিরিয়ায় আসলে জায়েদ সেই কাফেলার লোকদের মক্কা মদীনার কথা জিজ্ঞেস করতেন। কাফেলার লোকদের মুখ থেকে জায়েদ শুনত মুসলমানদের অবিশ্বাস্য বিজয় গাঁথা। কল্পনায় জায়েদ নিজেকেও সেইসব মুজাহিদ বাহিনীর মধ্যে কল্পনা করত যারা দুনিয়ার কোন শক্তিকে ভয় পায় না। মক্কা বিজয়ের পর পরই সংঘটিত হল হোনায়নের যুদ্ধ। জায়েদ এই যুদ্ধের খবর একটু দেরিতেই পায়।
---
এটা ছিলো রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুয়তী জীবনের শেষ পর্যায়। প্রায় তেইশ বছরের শ্রম সাধনায় তিনি যে কষ্ট করেছিলেন তাঁর জীবনের এই পর্যায় ছিলো সেই স্বীকৃতি।
এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে মক্কা বিজয় ছিলো নবী (সাঃ) এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য। এ বিজয়ের ফলে পরিস্থিতির যুগান্তকারী পরিবর্তন হয় এবং আরবের পরিবেশ পরিস্থিতিতে পরিবর্তন দেখা দেয়। এ বিজয় ছিলো পূর্বাপর সময়ের মধ্যে সেতুবন্ধন। আরব জনগণের দৃষ্টিতে কোরাইশ ছিলো দ্বীনের (মূর্তি পূজার) হেফাজতকারী ও সাহায্যকারী। সমগ্র আরব ছিলো এ ক্ষেত্রে তাদের অধীনস্থ। কোরায়শদের পরাজয়ের অর্থ হচ্ছে এই যে, সমগ্র আরব ভূখন্ড থেকে মূর্তিপূজা সমূলে উৎপাটিত হয়েছে চিরদিনের জন্যে।
উল্লিখিত শেষ পর্যায়টি দুই ভাগে বিভক্ত।
এক. মোজাহাদ ও যুদ্ধ।
দুই. ইসলাম গ্রহণের জন্যে বিভিন্ন কওম ও গোত্রের ছুটে আসা। এ উভয় অবস্থা পরস্পরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
হোনায়েনের যুদ্ধ
আকস্মিক অভিযানে মক্কা বিজয় সংঘটিত হয়েছিলো। এতে আরবের জনগণ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলো। প্রতিবেশী গোত্রসমূহের মধ্যে এ অপ্রতাশিত অভিযানের মোকবেলা করার শক্তি ছিলো না। এ কারণে শক্তিশালী অহংকারী উচ্ছৃঙ্খল কিছু গোত্রসমূহ এবং বনু বেলালের কিছু লোক শামিল হয়েছিলো। এসব গোত্রের সম্পর্ক ছিলো কাইসে আইলানের সাথে। মুসলমানদের কাছে আত্মসমর্পণ করা তারা আত্মমর্যাদার পরিপন্থী মনে করছিলো। তাই তারা মালেক ইবনে আওফ নসরীর কাছে গিয়ে মুসলমানদের ওপর হামলার সিদ্ধান্ত নিলো।
শত্রুদের রওয়ানা এবং আওতাস-এ উপস্থিতি
সিদ্ধান্তের পর মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করতে মালেক ইবনে আওফের নেতৃত্বে সকল সমবেত সকল অমুসলিম রওয়ানা হলো। তারা তাদের পরিবার-পরিজন এবং পশুপাল নিজেদের সঙ্গে নিয়ে চললো। আওতাস প্রান্তরে তারা উপস্থিত হলো। আওতাস হচ্ছে হোনায়েনের কাছে বনু হাওয়ানে এলাকার একটি প্রান্তর। কিন্তু এ প্রান্তর হোনায়েন থেকে পৃথক। হোনয়েন একটি পৃথক প্রান্তর। এটি যুল মাজাজ-এর সন্নিকটে অবস্থিত। সেখান থেকে আরাফাত হয়ে মক্কার দূরত্ব দশ মাইলের বেশী।
শত্রুদের সৈন্য সমাবেশ
আওতাস-এর অরতরণের পর লোকেরা কমান্ডার মালেক ইবনে আওফের সামনে হাযির হলো। এদের মধ্যে প্রবীণ সমর বিশারদ দুরাইদ ইবনে ছোম্মাও ছিলো। এই লোকটি বয়সের ভারে ছিলো ন্যুজ। বহু যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ছিলো তার। এক সময় সে ছিলো বীর যোদ্ধা। এখন অভিজ্ঞতা বর্ণনা এবং সে আলোকে পরামর্শ দেয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই। সে মালেককে জিজ্ঞাসা করলো “তোমরা কোন প্রান্তরে রয়েছো?”
তাকে বলা হলো “আওতাস প্রান্তরে।”
সে বললো “এটা সৈন্য সমাবেশের উপযুক্ত জায়গা। কিন্তু গাধা, উট, ঘোড়ার ডাকাডাকি, শিশু সন্তানের কান্না মেয়েদের গলার আওয়ায পাচ্ছি।”
তাকে জানানো হলো “কমান্ডার মালেক ইবনে আওফ সৈন্যদের সাথে তাদের পরিবার-পরিজন এবং পশুপালও নিয়ে এসেছে।”
দুরাইদ এর কারণ জানতে চাইলে তাকে বলা হলো যে, প্রত্যেক যোদ্ধা তার কাছে মজুদ স্ত্রী-পুত্র-কন
মালেক ইবনে আওফের এ জবাব শুনে দুরাইদ বললো “আল্লাহর কসম, তুমি ভেড়ার রাখাল। পরাজিত ব্যক্তিকে কোন কিছু কি ধরে রাখতে পারে? দেখো, যুদ্ধে যদি তুমি জয়ী হও, তবে তলোয়ার এবং বর্শা দ্বারাই উপকৃত হবে। আর যদি পরাজিত হও তবে অপমানিত হবে। কারণ পরাজিত যোদ্ধার স্ত্রী, পুত্র, পরিবার এবং পশুপাল কিছুই নিরাপদ থকবে না।”
দুরইদ বিভিন্ন গোত্রের সর্দারদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলো। সব কথা শোনার পর কমান্ডারকে বললো, “হে মালেক, তুমি বনু হাওয়াযেন গোত্রের পরিবার-পরিজন ও পশুদল নিয়ে এসে ভাল কাজ করোনি। তাদেরকে নিজ জিন এলাকর নিরাপদ জায়গায় পাঠিয়ে দাও। পরে ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে তোমরা বে-দ্বীনের সাথে লড়াই করো। যদি তুমি জয়লাভ করো তবে পেছনের যারা থাকবে তারা এসে তোমাদের সথে মিলিত হব্। যদি পরাজিত হও, তবে ওরা নিরাপদ থাকবে।”
কমান্ডার মালেক ইবনে আওফ এ পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করে বললো, “খোদার কসম, আমি তা করতে পারি না। তুমি বুড়ো হয়েছো তোমার বুদ্ধিও বুড়ো হয়ে গেছে। হয়তো হাওয়াযেন গোত্র আমার আনুগত্য করবে আমি তলোয়ারের ওপর হেলান দিয়ে আত্মহত্যা করবো।” মোটকথা, দুরাইদের নাম বা তার পরামর্শ এ যুদ্ধে শামিল হোক, এটা মালেক পছন্দ করলো না।
হাওয়াজেন গোত্রের লোকেরা বললো, “আমরা তোমার আনুগত্যে অটল রয়েছি।”
দুরাইদ বললো, “আমি এ যুদ্ধের সাথে নাই। এ যুদ্ধের কোন দায়দায়িত্ব আমার নাই। হায়, আজ যদি আমি জওয়ান হতাম, যদি আমার ছুটোছুটি করার মতো বয়স থাকতো, তাবে আমি লম্বা পশমের মাঝারি সাইজের বকরির মতো ঘোড়ার নেতৃত্ব করতাম।”
শত্রুদের গুপ্তচর
মুসলমানদের খবর সংগ্রহে মালেক ইবনে আওফ দু’জন গুপ্তচর পাঠালো। তারা গন্তব্যে পৌঁছার আগেই ফিরে এলো। তারা ছিলো চলৎশক্তিহীন। কমান্ডারের কাছে তাদের হাযির করার পর কমান্ডার বললো, “তোমাদের সর্বনাশ হোক, এ অবস্থা হলো কেন?”
তারা বললো, “আমরা কয়েকটি চিত্রল ঘোড়া এবং মানুষ দেখেছি, এরপরই আমাদের এ অবস্থা হয়েছে।”
এক দিকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শত্রুদের নান রকম খবর পাচ্ছিলেন। তিনি আবু হাদরাদ আসলামিকে বললেন, “তুমি যাও, শত্রুদের মাঝে গিয়ে অবস্থান করে তাদের খবরাখবর এনে দাও। তিনি তাই করলেন।”
মক্কা থেকে হোনায়েনের পথ যাত্রা
অষ্টম হিজরীর ৬ই শাওয়াল রোববার রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা থেকে হোনায়েনের উদ্দেশ্যে রওয়ান হলেন। এটা ছিলো তাঁর মক্কায় আগমনের উনিশতম দিন। তাঁর সঙ্গে ছিল ১২ হাজার সৈন্য। এদের মধ্যে ১০ হাজার মদীনা থেকে মক্কায় এসেছিলেন, বাকি ২ হাজার মক্কা থেকে রওয়ানা হন। মক্কার ২ হাজারের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন নও মুসলিম। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সফওয়ান ইবনে উমাইয়ার কাছ থেকে অস্ত্রসহ একশত বর্ম ধার নিলেন। আত্তাব ইবনে আছিদকে মক্কার গভর্ণর নিযুক্ত করলেন।
দুপুরের পরে একজন সাহাবী এসে বললেন, “আমি অমুক পাহাড়ে উঠে দেখেছি বনু হাওয়াযেন সপরিবারে যুদ্ধ করতে এসেছে। তারা নিজেদের পশুপালও সঙ্গে এনেছে।”
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হেসে বললেন, “ইনশা আল্লাহ আগামীকাল এগুলো মুসলমানদের গনীমতের মাল হবে।” রাতের বেলা হযরত আনাস ইবনে মারছাদ প্রহরীর দায়িত্ব পালন করলেন।
পথে সাহাবারা যাতে আনওয়াত নামে একটি কূল গাছ দেখলেন। মক্কার মোশরেকরা এ গাছের সাথে নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র ঝুলিয়ে রাখতো। এর পাশে পশু যবাই করতো এবং এর নীচে মেলা বসাতো। কয়েকজন সহযোদ্ধা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন, “ওদের যেমন যাতে-আনওয়াত নামে গাছ রয়েছে আপনি আমাদের জন্যেও ওরকম একটি গাছ তৈরী করে দিন।”
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “আল্লাহু আকবর, সেই সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তোমরাতো সেই রকম কথা বলেছো, যে রকম কথা হযরত মুসার কওম তাঁকে বলেছিলো। তারা বলেছিলো, ‘এজআল লানা এলাহান কামা লাহুম আলেহাতুন।’ অর্থাৎ আমাদের জন্যে একজন মাবুদ বানিয়ে দিন, যেমন ওদের জন্যে মাবুদ রয়েছে। তোমরা তো দেখছি পূর্ববর্তীদের তরিকার ওপরই উঠে পড়েছো।”
কিছু লোক সৈন্য সংখ্যার আধিক্য দেখে বললেন, আমরা আজ কিছুতেই পরাজিত হব না। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একথাটিও পছন্দ করলেন না।
মুসলমানদের আকস্মিক হামলাঃ
১০ই শাওয়াল মঙ্গলবার দিবাগত রাতে ইসলামী বাহিনী হোনায়েনে পৌঁছুলো। মালেক ইবনে আওফ আগেই এ জায়গায় পৌঁছে রাতের অন্ধকারে তার সৈন্যদের বিভিন্ন স্থানে গোপনভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছিলো। তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো যে, মুসলমানরা আসা মাত্র তাদের ওপর তীর নিক্ষেপ করবে এবং কিছুক্ষণ পর একজোটে হামলা করবে।
এদিকে খুব প্রত্যুষে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সৈন্যদের বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করলেন। খুব ভোরে মুসলিম সৈন্যরা হোনায়েনের প্রান্তরে পদার্পন করলেন। শত্রু সৈন্য সম্পর্কে তারা কিছুই জানতেন না। শত্রুরা যে ওঁৎ পেতে রয়েছে এ সম্পর্কে অনবহিত মুসলমান সৈন্যরা নিশ্চিন্তে অবস্থান নেয়ার সময় হঠাৎ করে তাদের ওপর তীর বৃষ্টি শুরু হলো। কিছুক্ষণ পরই শত্রুরা একযোগে মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। মুসলমানরা ভ্যাবা চেকা খেয়ে ছত্রভঙ্গ হতে শুরু করলেন। এটা ছিলো সুস্পষ্ট পরাজয়। নও মুসলিম আবু সুফিয়ান বললেন, ওরা সমুদ্র পারে না গিয়ে থামবে না। জাবালা অথবা কালদা ইবনে জোনায়েদ বললো, দেখো আজ যাদু বাতিল হয়ে গেছে। বনু হাওয়াযেন ছিলো তীরন্দাজ, মুসলমানরা হামলা করলে তারা পালিয়ে গেলো। এরপর মুসলমানরা গনীমতের মাল সংগ্রহ করতে লাগল। ইতিমধ্যে শত্রুরা তীর বৃষ্টি দিয়ে মুসলমানদের অভ্যর্থনা জানালো।
সহীহ মুসলিম শরীফে হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, হযরত আনাস বলেন, আমরা মক্কা জয় করেছি। পরে হোনায়েনে অভিযান চালিয়েছি। মোশরেকরা চমৎকার সারিবদ্ধভাবে এসেছিলো। অমন সুশৃঙ্খল অবস্থা আমি কখনো দেখিনি। প্রথম সওয়ারদের সারি, এরপর পদব্রজীদের সারি, তাদের পেছনে মহিলারা এর পেছনে পেছনে ভেড়া বকরি, তারপর পশুপাল। আমরা সংখ্যায় ছিলাম অনেক। আমাদের সৈন্যদের ডানদিকে ছিলেন হযরত খালেদ (রা.)। কিন্তু আমাদের সওয়ার আমাদের পেছনে আত্মগোপন করতে লাগলেন, কিছুক্ষণ পর তারা পলায়ন করলেন। আরবরাও পলায়ন করলো। ওরাও পলায়ন করলো, যাদের সম্পর্কে তোমরা জানো।
সাহবারা ছত্রভঙ্গ হতে শুরু করলে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ডানদিকে আহ্বান জানিয়ে বলেন, হে লোক সকল, তোমরা আমার দিকে এসো, আমি আবদুল্লাহর পুত্র মোহাম্মদ। সেই সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কয়েকজন মোহজেরে এবং তাঁর বংশের সাহাবারা ছাড়া অন্য কেউ ছিলো না। আল্লাহর রসূলের সাথে বারোজন দৃঢ়পদ ছিলেন। সাহাবার নিরাপদে আশ্রয়ের জন্য চলে গিয়েছিলেন। আল্লাহর রসূলের কাছাকাছি আশিজন দৃঢ়ভাবে অবস্থান করেন। ওনারা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেননি।
সেই নাযুক সময়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নযিরবিহীন বীরত্ব ও সাহসিকাতার পরিচয় দিলেন। তিনি শত্রুদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন এবং উচ্চস্বরে বলছিলেন, আনান্নবিউল লা কাযেব আনা ইবনু আবদুল মোত্তালেব অর্থাৎ আমি নবী, আমি মিথ্যাবাদী নই, আমি আবদুল মোত্তালেবের পুত্র।
সেই সময় আবু সুফিয়ান এবং হযরত আব্বাস রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খচ্চর ধরে রেখেছিলেন যাতে করে খচ্চর সামনের দিকে ছুটে যেতে না পারে। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর চাচা হযরত আব্বাসকে বললেন, লোকদের যেন তিনি উচ্চস্বরে ডাকতে শুর করেন। হযরত আব্বাসের ছিলো দরাজ গলা। হযরত আব্বাস বলেন, আমি উচ্চ কন্ঠে ডাকলাম, কোথায় তোমরা বৃক্ষওয়ালা, বাইয়াতে রেদওয়ানওয়ালা। সাহাবার ওনার কন্ঠ শুনে এমনভাবে ছুটে আসতে শুরু করলেন যেমন গাভীর আওয়ায শুনে বাছুর ছুটে আসে। সাহাবারা বললেন, আমরা আসছি।
সাহাবারা ছুটে আসতে শুরু করলে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চারিদিকে একশত সাহাবী সমবেত হলে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শত্রুর মোকাবেলা করলেন। যুদ্ধ শুরু হলো।
এরপর আনসারদের ডাকা হলো। ক্রমে বনু হারেস ইবনে খাযরাজের মধ্যে এই ডাক সীমিত হয়ে পড়লো। এদিকে সাহাবারা রণাঙ্গণ থেকে যেভাবে দ্রুত চলে গিয়েছিলেন, তেমনি দ্রুত ফিরে আসতে লাগলেন। দেখতে দেখতে প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু হলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রণাঙ্গনের দিকে তাকিয়ে বললেন, এবার চুলো গরম হয়েছে। এরপর একমুঠো ধুলো তুলো ‘শাহাতুল উজুহ’ বলে শত্রুদের উদ্দেশ্যে নিক্ষেপ করলেন। এর অর্থ হচ্ছে চেহারা বিগড়ে যাক। নিক্ষিপ্ত ধুলোর ফলে প্রত্যেক শত্রুর চোখ ধুলি ধুসরিত হলো। তারা পৃষ্ট প্রদর্শন করে প্রাণ নিয়ে পালাতে শুরু করলো।
শত্রুদের পরাজয়
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ধুলো নিক্ষেপের পরই যুদ্ধের চেহারা পাল্টে গেলো, শত্রুরা পরাজিত হলো। ছাকিফা গোত্রের ৭০ জন কাফের নিহত হলো। তাদের নিয়ে আসা অস্ত্র ধন-সম্পদ, রসদ, সামগ্রী, নারী, শিশু, পশুপাল সবকিছু মুসলমানদের হস্তগত হলো।
আল্লাহ রব্বুল আলামীন এ সম্পর্কে বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে সাহায্য করেছেন বহু ক্ষেত্রে এবং বিশেষ করে হোনায়নের যুদ্ধের দিনে, যখন তোমাদেরকে উৎফুল্ল করেছিলো তোমাদের সংখ্যাধিক্যে এবং তা তোমাদের কোন কাজে আসেনি এবং বিস্তৃত হওয়া সত্তেও পৃথিবী তোমাদের জন্যে সঙ্কুচিত হয়েছিলো এবং পরে তোমরা পৃষ্ট প্রদর্শন করে পলায়ন করেছিলে, অতপর আল্লাহ তায়ালা তাঁর কাছ থেকে তাঁর রসূল এবং মোমেনদের ওপর প্রশান্তি বর্ষণ করেন এবং এমন এক সৈন্য বাহিনী প্রেরণ করেন যা তোমরা দেখতে পাওনি এবং তিনি কাফেরদের শাস্তি প্রদান করেন। এটা কাফেরদের কর্মফল।‘(সূরা তাওবা, আয়াত ২৫-২৬)
শত্রুদের গমন পথে ধাওয়াঃ
উভয় পক্ষে কিছুক্ষণ মোকাবেলার পরই মোশরেকরা পলায়নের পথ ধরলো। পরাজয়ের পর একদল শত্রু তায়েফের পথে অগ্রসর হলো। একদল নাখলার দিকে এবং একদল আওতাসের পথে অগ্রসর হলো। উভয় পক্ষের সংঘর্ষে সাহাবাদের মধ্যে হযরত আবু আমের আশআরী (র.)শাহদাত বরণ করেন। তিনি একটি দলের নেতৃত্বে ছিলেন।
একদল সহাবী নাখলার পথে গমনকারী অমুসলিমদের ধাওয়া করলেন। দুরাইন ইবনে ছোম্মাকে পাকড়াও করা হলো। হযরত রাবিয়া ইবনে রফি তাকে হত্যা করলেন।
পরাজিত শত্রুদের সবচেয়ে বড় দল তায়েফের দিকে অগ্রসর হলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গনীমতের মাল জমা করার পর তায়েফের পথে রওয়ানা হলেন।
গনীমত
গনীমতের মালের বিবরণ নিম্মরূপ। যুদ্ধবন্দী ৬ হাজার, উট ২৪ হাজার। বকরি ৪০ হাজারের বেশী। চাঁদি ৪ হাজার উকিয়া। অর্থাৎ ১ লাখ ৬০ হাজার দিরহাম। এর ওজন ৬ কুইন্টালের চেয়ে কয়েক কিলো কম। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমুদয় মালামাল জমা করার নির্দেশে দিলেন। যেরানা নামক জায়গায় সমুদয় সম্পদ একত্রিত করে হযরত মাসউ ইবনে আমর গেফারী (রাঃ)-এর নিয়ন্ত্রণে রাখলেন। তায়েফ যুদ্ধ থেকে অবসর না পাওয়া পর্যন্ত এগুলো বন্টন করা হয়নি।
বন্দীদের মধ্যে শায়মা বিনতে হারেস সাদিয়াও ছিলেন। ইনি ছিলেন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দূধবোন। তাঁকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিয়ে এসে তাঁর পরিচয় দেয়ার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি চিহ্নের দ্বারা তাকে চিনতে পারেন। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে যথেষ্ট সম্মান করেন। নিজের চাদর বিছিয়ে তাকে বসতে দেন। সাদিয়ার মতামত অনুসারে তার প্রতি অনুগ্রহ দেখিয়ে তিনি তাকে নিজের গোত্রের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দেন।
তায়েফের যুদ্ধ
এ যুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে হোনায়েনের যুদ্ধেরই অংশ। হাওয়াযেন ও ছাকিফ গোত্র পরাজিত লোকদের অধিকাংশই তাদের কমান্ডার মালেক ইবনে আওফ নসরীর সাথে তায়েফে চলে গিয়ে আত্মগোপন করেছিলো তাই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তায়েফের পথে রওয়ান হলেন।
প্রথমে খালিদ ইবনে ওলীদের নেতৃত্বে এক হাজার সৈন্য পাঠানো হয়, এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে রওয়ান হন। পথে নাখলা, ইমানিয়া এবং মনযিল অতিক্রম করেন। লিয়াহ নামক জায়গায় মালেক ইবনে আওফের একটি দুর্গ ছিলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশে সেই দুর্গ ধ্বংস করে দেয়া হয়। এরপর সফর অব্যাহত রেখে তয়েফ পৌঁছার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তায়েফ দুর্গ অবরোধ করেন।
অবরোধ দীর্ঘস্থায়ী হয়। সহীহ মুসলিম শরীফে হযরত আনাসের (রা.) বর্ণনা অনুযায়ী এই অবরোধ ৪০ দিন স্থায়ী হয়। কোন কোন সীরাত রচয়িতা ২০ দিন বলেও উল্লেখ করেছেন। কেউ ১০, কেউ ১৫ আবার কেউ ১৮ দিন উল্লেখ করেছেন।
অবরোধকালে উভয় পক্ষের মধ্যে তীর ও পাথর নিক্ষেপ করা হয়। মুসলমানদের প্রথম অবরোধকালে তাদের ওপর লাগাতার তীর নিক্ষেপ করা হয়। প্রথম অবস্থায় মুসলমানরা অবরোধ শুরু করলে দূর্গের ভেতর থেকে তাদের ওপর এতো বেশী তীর নিক্ষেপ করা হয়েছিলো যে মনে হয়েছিলো পঙ্গপাল ছায়া বিস্তার করেছে। এতে কয়েকজন মুসলমান আহত এবং ১২ জন শহীদ হন। ফলে মুসলমানরা তাঁবু সরিয়ে কিছুটা দূরে নিয়ে যান।
এর পরিস্থিতি মোকাবেলায় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ যন্ত্র স্থাপন করেন এবং দূর্গ লক্ষ্যে করে কয়েকটি গোলা নিক্ষেপ করেন। এতে দেয়ালে ফাটল ধরে ছিদ্র হয়ে যায়। সাহাবারা সেই ছিদ্র দিয়ে তাদের প্র্রতি পাথর নিক্ষেপ করেন। কিন্তু শত্রুদের পক্ষ থেকে বৃষ্টির মতো তীর নিক্ষেপ করা হয়, এতে কয়েকজন মুসলমান শহীদ হন।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শত্রুদের কাবু করতে কৌশল হিসাবে আঙ্গুর গাছ কেটে পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিলেন। এতে বিচলিত ছকিফ গোত্র আল্লাহ তায়ালা এবং আত্মীয়তার সম্পর্কের দোহাই দিয়ে এ কাজ থেকে বিরত থাকার আবেদন জানালো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা মঞ্জুর করলেন।
অবরোধের সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে একজন ঘোষক ঘোষণা করলো যে, যেসব ক্রীতদাস দূর্গ থেকে নেমে আমাদের কাছে আসবে, সে মুক্ত। এতে ত্রিশজন লোক দূর্গ থেকে এসে মুসলমানদের সাথে শামিল হয়।
আগত ক্রীতদাসদের মধ্যে হযরত আবু বকরাহও ছিলেন। দুর্গের দেয়ালে উঠে ঘূর্ণায়মান চরকার মাধ্যমে তিনি নীচের দিকে ঝুলে পড়েন এবং মুসলমানদের কাছে এস আত্মসমর্পণ করেন। আবরবী ভাষায় ঘারাবিকে বকরাহ বলা হয়। এ কারণে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আগন্তুক এ ক্রীতদাসের উপাধি দিলেন আবু বকরাহ। মুসলমানের কাছে এসে আত্মসমর্পণকারী ক্রীতদাসদের রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুক্ত করে দিলেন এবং তাদেরকে ত্রিশজন সহাবীর দায়িত্বে দিয়ে বললেন, তাদেরকে প্রয়োজনীয় সাজ-সরঞ্জাম দিয়ে দাও। এ ঘটনা দুর্গের শত্রুদের জন্যে বড়োই মারাত্মক হয়ে দাঁড়ালো।
অবরোধ দীর্ঘস্থায়ী হয়ে পড়লো এবং শত্রদের আত্মসমর্পণের কোন লক্ষণ দেখা গেলো না। তারা সারা বছরের খাদ্য দুর্গের ভেতরে মজুদ করে রেখেছিলো। এ সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নওফেল বিনে মাবিয়া দয়লির সাথে পরামর্শ করেন। নওফেল বলেন, শৃগাল তার গর্তে গিয়ে ঢুকেছে। যদি আপনি অবরোধ দীর্ঘায়িত করেন, তবে তাদের পাকড়াও করতে পারবেন। আর যদি ফিরে যান, তবে তারা আপনার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। একথা শুনে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অবরোধ অবসানের সিদ্ধান্ত নিলেন। হযরত ওমর (রাঃ) সাহাবাদের মধ্যে ঘোষণা প্রচার করলেন যে, ইনশা আল্লাহ আগামীকাল আমরা ফিরে যাব । সহাবারা এ ঘোষণার সমালোচনা করলেন। তারা বললেন, এটা কেমন কথা? তায়েফ জয় না করে আমরা ফিলে যাব? রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহবাদের ভিন্নমত শুনে বললেন, আচ্ছা কাল সকালে যুদ্ধে চলো। পরদিন সাহাবারা যুদ্ধে গেলেন, কিন্তু আঘাত খেয়ে ফিরে আসা ছাড়া অন্য কোন লাভ হলো না। এ অবস্থা দেখে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ইনশা আল্লাহ আগামী আমরা ফিরে যাবো। সর্বস্তরের সাহাবারা এ সিদ্ধান্তে সন্তোষ প্রকাশ করলেন। তারা চুপচাপ জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে শুরু করলেন। এ অবস্থা দেখে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃদু হাসতে লাগলেন।
সাহবায়ে কেরাম ফিরে যাওয়ার পথে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘আয়েবুনা তায়েবুন আবেদুনা লেরাব্বেনা হামেদুন।’ অর্থাৎ তোমরা প্রত্যাবর্তনকার
সাহাবারা বললেন, হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, ছাকিফের লোকদের জন্যে বদদোয়া করুন। তিনি বললেন, হে আল্লাহ তায়ালা ছাকিফকে হেদায়াত করুন এবং তাদের নিয়ে আসুন।
Subscribe to:
Post Comments
(
Atom
)
No comments :
Post a Comment