Header Ads

মরুর ফুল ৪৩

সেনাদল এবং প্রতিনিধি দল প্রেরণঃ
১. মক্কা বিজয়ের পর পরই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৮ম হিজরীর রমযানের ২৫ তারিখে খালেদ ইবনে ওলীদ (রা.)-এর নেতৃত্বে একটি অভিযান প্রেরণ করেন। ওজ্জা নির্মূল করতে এ অভিযান প্রেরণ করা হয়। ওযযা ছিলো নাখালায়। কোরায়শ এবং সমগ্র বনু কেনানা গোত্র এ মূর্তির পূজা করত। এটি ছিলো তাদের সবচেয়ে বড় মূর্তি। বনু শায়বান গোত্র এ মূর্তির তত্ত্বাবধান করতো। হযরত খালেদ তিরিশ জন সওয়ারী সৈন্যসহ নাখলায় গিয়ে এ মূর্তি ভেঙ্গে ফেলেন। ফিরে আসার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত খালেদকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি কিছু দেখেছ? তিনি বলেন, কই না তো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তবে তো তুমি মূর্তিই ভাঙ্গতে পারোনি?
হযরতে খালেদ পুনরায় নাঙ্গা তলোয়ার উঁচিয়ে গেলেন। এবার তিনি দেখলেন তাঁর দিকে এক কালো নগ্ন মাথা ন্যাড়া মহিলা এগিয়ে আসছে। হযরত খালেদ এরপর তরবারি দিয়ে আঘাত করলেন। এতে সেই মহিলা দুই টুকরো হয়ে গেলো। হযরত খালেদে এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এসে খবর দিলেন। তিনি বলেলেন, হাঁ সেই ছিলো ওযযা। এবার সে তোমাদের দেশে পূজার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে গেছে।
২. এরপর সেই মাসেই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সোয়া নামক অন্য একটি মূর্ত ধ্বংস করতে আমর ইবনু আসকে পাঠালেন। এটা ছিলো মক্কা থেকে তিন মাইল দূরে। রেহাত এলাকায় বনু হোযাইল গোত্র এর পূজা করতো। হযরত আমর সেখানে যাওয়ার পর পুরোহিত বললো “তুমি কি চাও?”
তিনি বলেলেন “রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে এ মূর্তি ধ্বংস করতে এসেছি।”
পুরোহিত বললো “তুমি সেটা পারবে না।”
তিনি বললেন “কেন?”
পুরোহিত বললো “অদৃশ্য থেকে তোমাকে বাধা দেয়া হবে।”
তিনি বললেন “তোমার জন্যে আফসোস। এই মূর্তি কি দেখতে পায়? শুনতে পায়? তুমি এখনো মিথ্যার ওপর রয়েছো?”
এরপর তিনি মূর্তি ভেঙ্গে সঙ্গীদের মূর্তিঘরে অনুসন্ধান চালাতে বললেন। কিন্তু কোন জিনিস পাওয়া গেলো না। হযরত আমরের নির্দেশে মূর্তি ঘরও ধ্বংস করে দেয়া হলো। এরপর তিনি পুরোহিতকে জিজ্ঞাসা করলেন “কি? কেমন বুঝলে?”
পুরোহিত বললো “আমি লা শারিক আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করলাম।”
৩. সেই মাসেই হযরত সা’দ ইবনে যায়েদ আশহালির নেতৃত্বে বিশজন সৈন্য প্রেরণ করা হলো। এরা মানাত মূর্তি ধ্বংস করতে গেলেন। কোদায়েদের কাছে মাশাল নামক এলাকায় এ মূর্তি ছিলো। গাসসান, আওস এবং খাযরাজ গোত্র এর পূজা করতো। হযরত সা’দ সেখানে পৌছার পর পুরোহিত বললো, “কি চাও?”
তিনি বললেন “মানাতকে ধ্বংস করতে চাই।”
পুরোহিত বললো “তুমি জানো আর তোমার কাজ জানে।”।
হযরত সা’দ লক্ষ্য করলেন, বীভৎস চেহারার কালো ন্যাড়া মাথা এক মহিলা বেরিয়ে এসেছে। সে বুক চাপেড়াতে চাপড়াতে সে হায় হায় করছিলো।
পুরোহিত বললো “মানাত তোমার কিছু নাফরমানকে ধারো।” ইত্যবসরে হযরত সা’দ তলোয়ার দিয়ে মানাতকে দ্বিখন্ডিত করে ফেললেন। এরপর মূর্তিঘর ধ্বংস করা হলো। কিন্তু সেখানে কোন কিছু পাওয়া গেলো না।
৪. ওজ্জা ধ্বংস করে ফিরে আসার পর সেই মাসেই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত খালেদ (রাঃ) কে বনু জাজিমার কাছে পাঠালেন। ইসলামের দাওয়াত নিয়ে তাঁকে পাঠানো হয়েছিল। হযরত খালেদ (রাঃ) মোহাজের, আনসার এবং বনু সালিম গোত্রের সাড়ে তিন শত লোক নিয়ে রওয়ান হলেন। বনু জাজিমা গোত্রের কাছে পৌঁছে তারা ইসলামের দাওয়াত দিলেন। তার ‘আসলামনা ’ অর্থাৎ আমরা ইসলাম গ্রহণ করলাম বলার পরিবর্তে বললো, ছাব্বানা ছাব্বানা অর্থাৎ আমরা নিজেদের দ্বীন ত্যাগ করলাম। এতে হযরত খালেদ তাদের হত্যা এবং গ্রেফতার শুরু করলেন। তারপর একজন করে বন্দীকে নিজের প্রত্যেক সঙ্গীর কাছে দিয়ে তাদের হত্যা করার নির্দেশ দিলেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর এবং তাঁর সঙ্গীরা সেনাপতির আদেশ পালনে অস্বীকৃতি জানালেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে এ ঘটনা উল্লেখ করা হলো । তিনি দুই হাত আকাশের দিকে তুলে দুই বার বললেন, ‘হে আল্লাহ তায়ালা খালেদ যা ‍কিছু করেছে, আমি তা থোকে তোমার কাছে পানাহ চাই।’
হযরত খালেদের নির্দেশে বনু সালিম গোত্রের লোকেরা নিজেদের বন্দীদের হত্যা করেন। আনসার এবং মোহাজেররা তাদের বন্দীদের হত্যা করেননি। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ঘটনার পর হযরত আলী (রাঃ)-কে পাঠিয়ে নিহতদের ক্ষতিপূরণ এবং তাদের অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি পূরণের ব্যবস্থা করেন। এই ঘটনায় হযরত খালেদ এবং হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ)-এর মধ্যে তীব্র কথা কাটাকাটি হয়েছিলো। এ খবর শোনার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, খালেদ, থামো, আমার সাথীদের কিছু বলা থেকে বিরত হও। আল্লাহর শপথ, যদি ওহুদ পাহাড় সোনা হয়ে যায় এবং তার সবটুকু ‍তুমি আল্লাহর পথে ব্যয় করো তবু আমার সাথীদের মধ্যে কারো এক সকাল বা এক বিকেলের এবাদাতের সম মর্যাদাতেও তুমি পৌঁছুতে পারবে না।
মক্কা বিজয়ের যুদ্ধই ছিলো প্রকৃত মীমাংসা কারী যুদ্ধ এবং মক্কা বিজয়ই ছিলো প্রকৃত বিজয়, যা মোশরেকদের শক্তিমত্তা ও অহংকারকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিয়েছিলো। আরব উপদ্বীপে শেরক বা মূর্তিপূজার আর কোন অবকাশই থাকলো না। কেননা মুসলমান ও মোশরেক ছাড়া সাধারণ শ্রেণীর মানুষরা অত্যন্ত কৌতুহলের সঙ্গে ব্যাপারটি দেখতে চাচ্ছিল যে, এই সংঘাতের পরিণতিটা কি রূপ নেয়। সাধারণ মানুষ এটা ভালভাবেই জানতো যে, যে শক্তি সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে, কেবলমাত্র সেই শক্তিই কাবার ওপর স্বীয় অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে। তাদের বিশ্বাসকে অধিক বলীয়ান করেছিলো অর্ধশতাব্দী পূর্বে সংঘটিত আবরাহা ও তার হস্তী বাহিনীর ঘটনা। আল্লাহর ঘরের ওপর আক্রমণ চালানোর উদ্দেশ্যে অগ্রসরমান হস্তীবাহিনী কিভাবে ধ্বংস নিচিহ্ন হয়েছিলো তা তৎকালীন আরববাসীরা চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করেছিলো।
স্মরণ করা যেতে পারে যে, হোদায়বিয়ার সন্ধি ছিলো মক্কা বিজয়ের সূচনা বা ভূমিকা স্বরূপ। এ সন্ধির ফলে শান্তি ও নিরাপত্তার ঝর্ণা চারিদেকে প্রবাহিত হচ্ছিলো। মানুষ একে অন্যের সাথে খোলাখোলি আলাপ করার সুযোগ পাচ্ছিলো। ইসলাম সম্পর্কে তারা মতবিনিময় ও তর্ক বিতর্ক করছিলো। মক্কায় যেসব লোক গোপনে ইসলাম গ্রহণ করেছিলো তারাও দ্বীন সম্পর্কে মত বিনিময়ের সুযোগ পেলো। ফলে বহু লোক ইসলামে দীক্ষিত হলো। ইতিপূর্বে বিভিন্ন যু্দ্ধে মুসলমানদের সংখ্যা তিন হাজারের বেশী ছিলো না। অথচ মক্কা বিজয়ের সময় তাদের সংখ্যা ছিলো ১০ হাজার।
এ সিদ্ধান্তমূলক যুদ্ধে লোকদের দৃষ্টি খুলে গেলো। তাদের চোখের ওপর পড়ে থাক সর্বশেষ পর্দাও অপসারিত হলো। দ্বীন ইসলাম গ্রহণের পথে আর কোন বাধাই রইল না। মক্কা বিজয়ের পর মক্কার রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আকাশে মুসলমানদের সূর্য চমকাতে লাগলো। দ্বীনী কর্তৃত্ব দুনিয়াবী অধিপত্য উভয়েই পুরোপুরি মুসলমানদের হাতে এসে গেলো।
হোদয়বিয়ার সন্ধির ফলে মুসলমানদের যে অনুকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিলো মক্কা বিজয়ের পর তা পূর্ণতা লাভ করলো। পরবর্তী অধ্যায় ছিলো শুধু মুসলমানদের জন্যে এবং পরিস্থিতি ছিলো মুসলমানদের একক নিয়ন্ত্রণে। এরপর আরবদের বিভিন্ন গোত্রের সামনে একটা পথই খোলা ছিলো তারা প্রতিনিধিদলসহ গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করবে এবং দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়বে।
মোট কথা মক্কা বিজয়ের পরে আরবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবার আর কোন শক্তি থাকল না। ব্যপারটা আরবদের জন্য ভাল হলেও দুনিয়ার সবচেয়ে বড় শক্তি ইরানের সম্রাট ও রোমান সম্রাটদের দুশ্চিন্তার কারণ হল। তাদের সীমানায় শক্তিশালী রাষ্ট্রের জন্মকে কেউ ভাল চোখে দেখল না।
তাবুকের পথে আসতে আসতে জায়েদ এসব কথাই ভাবছিল। আরবদের না হত ম্যানেজ করা গেল কিন্তু পরাশক্তি ইরান ও রোমানরা এখন মুসলমানদের বিরুদ্ধে কী কী ব্যবস্থা নেয় তা নিয়ে সে চিন্তায় পড়ে গেল।
জায়েদ-মেহরিনের বিয়ের বয়স পাঁচ মাস হয়ে গেছে। তারা যেহেতু ঘর বাড়ীর বাইরে রয়েছে তাই তাদের কোথাও যাবার তাড়াহুড়া নেই। একেকটা এলাকায় তারা যখন প্রবেশ করে তখন সেই এলাকায় কিছুদিন থাকে। সেই সব এলাকার প্রাকৃতিক দৃশ্য জায়েদের কাছে নতুন কিছুই নয় কিন্তু এসব দৃশ্য মেহরিন খুব পছন্দ করে। ধনীর মেয়ে হবার কারণে এতদিন সে শুধু নির্দিষ্ট এলাকায় ঘুরতে পারত। জায়েদের সাথে পালিয়ে যাবার পরে নতুন জীবনটা তার কাছে উপভোগ্য মনে হচ্ছে। জায়েদ খেয়াল করেছে ইদানিং মেহরিনের শরীর আগের মত চলছে না। সে মেহরিনকে নিয়ে পেরেশান হয়ে পড়ল। মুসাফির অবস্থায় অসুস্থ হয়ে পড়লে বিপদ আছে। মেহরিন জায়েদকে সুখবর দিল- সে সন্তান সম্ভাবা!
এই খবরে জায়েদ যেমন খুশী হল তেমনি পেরেশানিতে পড়ে গেল। তদুম্মাতুল জন্দল থেকে তারা এখনো অনেক দূরে। মেহরিনের যে অবস্থা তাতে এই শরীর নিয়ে যাত্রা করা ঠিক হবে না। জায়েদ সিদ্ধান্ত নিল বাচ্চা না হওয়া পর্যন্ত এই এলাকায় থেকে যাবে। কয়েক দিন সন্ধ্যান করে এক আরব ধনীর ব্যক্তিগত দেহ রক্ষীর চাকরি পেয়ে গেল। এই এলাকাটা অনেকটা শহরের মত। ধনী লোকটি বিরাট ব্যবসায়ী। আরবের সব এলাকায় তার ব্যবসা রয়েছে। জায়েদ শহরের পাশে একটা ঘর তুলে থাকা শুরু করল। কুটিরের মধ্য থেকেও যে মানুষ অনেক সুখে থাকে তা মেহরিন এই প্রথম বুঝল। জায়েদ জানে মেহরিন অনেক ধনীর মেয়ে, তাই সে যাতে কোন কষ্ট না পায় সেদিকে সে খেয়াল রাখল।

No comments