লালসালুর বিয়ে ৬-৯

লালসালুর বিয়ে ৬-৯

বাস, ট্রেন, নারী এই তিনটির জন্য অপেক্ষা করতে নেই। একটা গেলে আরেকটা আসবে। কিন্তু সমস্যা হল পছন্দের মানুষকে হারিয়ে ফেলার দুঃখ সহ্য করা অনেক কঠিন। অনেকে সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে, অনেকে দেবদাস হয় কিন্তু পার্বতীরা ঠিকই সুখে শান্তিতে বাস করে। আবার অনেকে সাধু ব্রত বেছে নেয়। ঠিক তেমনি এক ছ্যাঁকা খেয়েছিল আমার স্কুল জীবনের বন্ধু রাজীব। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে আমরা এক ক্লাসে পড়তাম। আমরা পাঁচ বন্ধু এক স্যারের বাসায় প্রাইভেট পড়ার সময় দুই বন্ধু এক সাথে একই মেয়েকে পছন্দ করে, মেয়েটি খাস্তগীর স্কুলে পড়ত। কোন বন্ধু তাদের পছন্দের কথা মেয়েটিকে স্কুল জীবনে জানাতে পারেনি। কলেজে দেখা গেল আমরা আর সেই মেয়েটি একই কলেজে একই সেকশনে ভর্তি হয়েছি। কলেজ জীবনেও দুই বন্ধুর কেউ মেয়েটিকে ভালবাসার কথা জানাতে পারে নি। কলেজ শেষ করার পর দুই বন্ধু জানতে পারল মেয়েটির এক হিন্দু ছেলের সাথে প্রেম রয়েছে, ঐ হিন্দু ছেলেটি আবার আমাদের বন্ধু তখন থেকেই রাজীব বেচারা দুঃখে হাফ মেন্টাল হয়ে যায়। তার লেখাপড়া, খেলাধুলা কোন কিছুর প্রতি মন বসে নাই। নর্থ সাউথে অনেক সুন্দরী-সেক্সী মেয়ের আনাগোনা, তার কাছে সেই সব মেয়ের সৌন্দর্য ফিকে মনে হত! গত বছর রাজীব সব ভুলে বিয়ে করেছে। রাজীবের সেই মেয়ের কথা ভুলতে সময় লেগেছে ১৪ বছর!
ভাবীর কাছে ফারজানার বিয়ের খবর শুনে যতটা ব্যাথিত হয়েছি ততটা অবাক হয়েছি। কারন ভাবী তখন বলেছিলেন ফারজানার অবিবাহিত বড় বোন আছে, লেখাপড়া শেষ না করে বিয়ে দিবে না ইত্যাদি হাবিজাবি। তাহলে কি তারা সিদ্ধান্ত বদল করেছে? ফারজানার বড় বোনের বিয়ে দিয়েছে? এত কিছু ভাবছি এর মধ্যে ঘটে যেতে লাগল একের পর এক অঘটন!
গত এক বছরে আওয়ামীলীগ সরকার একটা ঘটনা ঢাকার জন্য আরেকটা ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। সুরঞ্জিতের কালো বিড়ালের দুর্নীতি ঢাকা দিতে আরেকটা ঘটনা ঘটিয়েছিল, সেই ঘটনা ধামাচাপা দিতে আরেকটা ঘটনা। সেই সূত্র ধরে কাদের মোল্লার ফাঁসি, ফঁসির পরে বিজয় দিবসে পতাকা প্রার রেকর্ড, পতাকার পরে বাড়ল দিদ্যুতের দাম, এরপর জাতীয় সঙ্গীতের রেকর্ড মোট কথা একটা ইস্যূ নিয়ে কেউ গরম হবার আগে আরেকটা ইস্যু তৈরি করতে লাগল, আর একেকটা ইস্যু এমনভাবে তৈরি হতে লাগল যাতে জাতী আগের ইস্যুটা ভুলে যায়। এটা আওয়ামীলীগের ভাল পলিসি। আমার জীবনেও এরকম একের পর এক ইস্যূ আসতে লাগল যাতে আমি ফারজানার শোক ভুলে যেতে যাছিলাম।
বাবার বুকের ব্যাথা দিন দিন বেড়ে যেতে লাগল, বাইপাস করা জরুরী। ঠিক হল বারডেম হাসপাতালের পাশে ইব্রাহীম কার্ডিয়াক সেন্টারে অপারেশন হবে। ফ্যামিলীর কারো এত বড় অপারেশন দেখিনি, তাই অনেক ভয় লেগেছিল। টেনশনে এক মাস ঠিক মত ঘুমাতে পারিনি। বড় ছেলে হিসেবে আমার দায়িত্ব বেশি ছিল। টানা এগার দিন হাসপাতালে ছিলাম। এটা নিয়ে তখন সামুতে পোষ্ট দিয়েছিলাম। ছয় ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়েছিল তার বেশিরভাগ পেয়েছিলাম ব্লগে পোষ্ট দিয়ে! এটা আমার ব্লগ জীবনের অন্যতম সাফল্য। অনেকে ফোন করে সান্তনা দিয়েছিলেন।

অপারেশনের টেনশন যখন শেষ ফারজানার টেনশন যখ শুরু হচ্ছিল ঠিক তখনই আমাদের ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগল। তখন সাভার ইপিজেডের পাশে একটা ফ্যাক্টরিতে চাকরি করতাম। বিল্ডিং এর ছাদে কিছু কাজ হত। সেখানে টিন শেড বানিয়ে প্রোডাকশন ফ্লোর বানানো হয়েছিল, সেখানেই আগুন লেগেছিল। ভাগ্য ভাল আগুন বেশি ক্ষতি করেনি কিন্তু তাতে প্রশাসনের টনক নড়েছিল-কারন ছাদের উপরে স্থাপনা করা নিষিদ্ধ, ফায়ার লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে। আর ফায়ার লাইসেন্স বাতিল হয়ে গেলে ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাবে। ফায়ার সার্ভিসের অফিস খুব কাছে হওয়ায় তাদের কাছে বিষয়টি বেশ পরিষ্কার ছিল। তারা এসে ফ্যাক্টরিতে তালা লাগিয়ে গেল। ফ্যাক্টরি বন্ধ, বেতনও বন্ধ। আমার তখন মাথায় বাঁশ। হঠাত করে চাকরি চলে গেলে বিপদ। প্রায় দেড় মাসের বেতন পাওনা এটাও যদি বন্ধ হয়ে যায়…… আল্লাহ সেবার বাঁচিয়েছিল। মন্ত্রী এমপি নেতা কর্মী ধরে সেবার বাঁচা গিয়েছিল। দুই মাস পরে আমরা বেতন পেয়েছিলাম। আর ঐ মুহূর্তে অন্য কোথাও চাকরিও পাচ্ছিলাম না।
ফ্যাক্টরি চালু হওয়ার পরে টেনশন যখন মুক্ত হব হব ঠিক তখনই আমার সেই খালাত ভাই মারা গেল যার কথা আমি ২নং স্টেটাসে বলেছিলাম। তিনি আমার অভিভাবক ক্যাটাগরির ছিলেন। ওনাকে এখনো অনেক মিস করি। বিশেষ করে আমাদের ফ্যামিলীর পক্ষ থেকে ফারজানার সাথে বিয়ের ব্যাপারে তিনিই প্রথম আগ্রহ দেখিয়েছিলেন আজ ভাইয়া নেই ফারজানাও নেই।
এই তিনটি ঘটনার সাথে নতুন একটি ঘটনা যোগ হল-আমাদের কোম্পানীতে অভ্যন্তরীণ গ্রুপিং শুরু হল, আজ এর চাকরি যায় তো কাল ওর চাকরি যায়। এত টেনশন নিয়ে চাকরি করা দুরূহ। তাই অন্য দিকে চাকরি খোঁজায় মন দিলাম। এর মধ্যে একদিন বসের বাসায় গেলাম। ফারজানার খোঁজ নিলাম। যখন জানতে পারলাম ফারজানার বিয়ে হয় নি তখন মনে একটা ক্ষীন আশা জাগল।
ফারজানার বিয়ে সম্মন্ধে ভাবী আমাকে এর আগে যা জানিয়েছিল তার সার কথা হল- উত্তরার মাসকট প্লাজায় ও নর্থ টাওয়ারে কয়েকটি দোকান আছে এমন এক ধনী ব্যবসায়ী ফারজানাকে এই বাসায় দেখে। ঐ ছেলে সরাসরি ফারজানাকে অফার করে। ফারজানা উত্তরে বলেছিল- বিয়ের বিষয়ে আমি কিছু জানি না, যা করার আমার ভাই করবে। ভাবী মনে করেছিলেন ‘ফারজানা ঐ ছেলের সাথে বিয়েতে রাজী’।
অথচ ফারজানার ফ্যামিলী থেকে বিয়ের নাম গন্ধ নেয়াও যাচ্ছে না। ওদের টার্গেট ওর বড় বোণ। আগে বড় জনের বিয়ে তারপর দেখা যাক। তার মানে এক বছরে সিদ্ধান্ত অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ওর বড় বোন যিনি ছেলে নিয়ে থাকতেন তিনি তিন চার মাস আগে ছেলে পুলে সহ ইউরোপে চলে গেছেন। উনি সেটেক হলেই ফারজানা ও বড় ভাইকে নিয়ে যাবেন।
আমি তখন ভাবীকে জোর করলাম যাতে আমার বিয়ের প্রস্তাব ফারজানাকে আবার দেয়। হিসেবে করে দেখলাম, ফারজানার ব্যপারে আমি ভাবীকে গত এক বছরে দশ থেকে বারো বার বলেছিল। একবারও ফলাফল আসে নি কিন্তু এই প্রথম অদ্ভুত এক ফল এলো।
আমাকে একদিন ভাবী উত্তরায় দেখা করতে বললেন, আমি অফিস শেষে হাজির হলাম। কিছুক্ষন পরে ভাবী এক মেয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি অবাক হলাম এ কে? ফারজানার সাথে চেহারার অনেক মিল তবে ফারজানার মত লম্বা, সুন্দর নয়, তবে সুন্দর! হঠাত মনে হল ফারজানার তো একটা বড় বোন আছে যার বয়স ওর চেয়ে চার বছর বেশি। তখন মেজাজ চড়ে গেল, ঐ মেয়ের সাথে ঠিকমত কথা বললাম না। এমনভাবে কথা বললাম যাতে মেয়েটি দ্রুত চলে যায়। ও আমার অনের ভাব বুঝতে পেরে দ্রুত রুম ত্যাগ করল আর আমি ঐ বাসা ছেড়ে চলে আসলাম।
বসের কাছে পরে শুনেছিলাম-আমার এত আগ্রহ দেখে ভাবী ফারজানার বড় বোনকে স্কাইপিতে আমার কথা বলেছিলেন। বড় আপা উত্তরে বলেছিলেন ফারজানার বড় বোনকে বিয়ে না দিয়ে ফারজানার কথা কোনভাবেই ভাবা যাবে না। ঐ ছেলের (আমার) যদি এত আগ্রহই থাকে তাহলে বড় মেয়েটাকে দেখাক। দু’জন দু’জনকে পছন্দ করলে তখন ফ্যামিলীগত ভাবে আগানো যাবে। এ কারনে ভাবী আমার সামনে বড় বোনকে নিয়ে এসেছিল।
বিষয়টা আমার ‘গরু মেরে জুতো দানের’ মত মনে হয়েছিল। ঐ ঘটনায় ফারজানার প্রতি আমার আশা শেষ হয়ে গেল। আশা যখন শেষ তখনই পরিচয় হল ছোট বোনের মত এক ব্লগার ডাঃ সেতু ও তার বান্দর ভাই হবু ডাক্তার মামুনের সাথে। এটা ছিল আমার লাইফের একটা টারনিং পয়েন্ট। ডাঃ সেতু রেইন স্পট নামে বিভিন্ন ব্লগে লিখে আর মামুন বিভিন্ন নিকে লিখে। ১০০ ভাগ আওয়ামীলীগার বাবার ঘরে জন্ম নেয়া এই দুই ছেলে মেয়ে কীভাবে যেন জামাতী (!) হয়ে গেল। সেতুর মাধ্যমেই তানিয়ার সাথে পরিচয় এবং সে ই ছিল আমার জীবনের শেষ…


বাংলা ব্লগ জগতে তখন নতুন নতুন ব্লগ সাইট চালু হচ্ছিল। বেশিরভাগ নাস্তিকদের ব্লগ। নাস্তিকদের অনেকেই সামু ব্লগের সাথে কম্পিটিটিশানে নেমে নিজেরা ব্লগ সাইট খুলছিল। নাস্তিকদের প্রশ্নের জবাব দিতে ও ডান পন্থী ব্লগারদের একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা জরুরী হয়ে পড়েছিল। আমি কম্পিউটার প্রোগ্রামার নই তাই ব্লগ সাইট তৈরি করতে কী রকম টাকা লাগবে তা ধারনা নেয়ার জন্য গেলাম ব্লগার ত্রিভুজ ভাইয়ের কাছে। ওনার কাছে গেলাম এই কারনে সামুতে তিনি ছিলেন ডান পন্থী ব্লগারদের গুরু অপরদিকে অমি রহমান পিয়াল ছিলেন বাম ও নাস্তিক ঘরানার বগারদের গুরু। ত্রিভুজ ভাই জানালেন ব্লগ সাইট তৈরি ও মেইন্টেইনেন্সে প্রায় লাখ তিনেক টাকা লাগবে। সামুর মালিক আরিল্ডের কাছেও যোগাযোগ করলাম, উনি জানালেন আট লাখ টাকা লাগবে। এত টাকা দিয়ে ব্লগ সাইট তৈরি করা তো দুরের কথা দশ হাজার টাকা দিয়ে ব্লগ সাইট তৈরির সামর্থ্য ঐ মুহূর্তে আমাদের মানে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী ব্লগারদের ছিল না। সাবেক মন্ত্রী পর্যায়ের অনেক বিএনপি নেতার কাছে গেলাম, ওনারা কেউ ব্লগ বোঝেন না, বোঝার চেষ্টা করেননি। ওনারা জানতেই পারলেন না ব্লগ নামের একটা জিনিস আছে যা দিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী তরুণদের আওয়ামী সমর্থক এ পরিণত করা হচ্ছে যা তারা নিজেও বোঝে না।
এমন সময় জাপান প্রবাসী এক সিনিয়ার ভাই ফোন দিলেন। উনি ফ্রী ব্লগ তৈরি করে দিবেন। সাথে আছেন বাংলাদেশের কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও মালয়েশিয়ার মাল্টিমিডিয়া ইউনিভার্সিটির শিক্ষক। এছাড়া বাংলাদেশের কিছু ডান পন্থী ব্লগার। আমি যোগাযোগ করলাম ওনাদের সাথে, নিয়মিত মিটিং করতাম। শেষ পর্যন্ত ‘আমার বর্ণমালা’ ব্লগ তৈরি হল। একই সাথে তৈরি হল জামাত শিবিরের সমর্থকদের তৈরি ‘সোনার বাংলা’ ব্লগ। একই প্ল্যাটফর্ম এর ব্লগাররা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। সামু ছেড়ে কেউ কেউ যাচ্ছে সোনার বাংলায় কেউ কেউ আসছে আমার বর্ণমালায়। জামাতীদের একটা সুবিধা হল মরণ পর্যন্ত তারা এক সাথে থাকে, এক নির্দেশে মরে আর জাতীয়তাবাদীদের ‘অসুবিধা’ হল এক জায়গায় দশ মিনিট দুইজন জাতীয়তাবাদী থাকলে তারা দু’টি গ্রুপ সৃষ্টি করে! বর্ণমালার ব্লগার বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন ব্লগারদের সাথে যোগাযোগ শুরু করলাম। এর মধ্যে একজন হল ডাঃ সেতু। সে সাবেক বেগম খালেদা জিয়া মেডিকেলের কলেজের ছাত্রী। আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এসে সেই মেডিকেলে কলেজের নাম দিয়েছে সোহরোয়ারদী মেডিকেল কলেজ। এক ডাক্তার বড় ভাইয়ের সাথে ঈদের দিনে ওদের বাসায় গিয়েছিলাম। সেতুর ভাই মামুন মেডিকেলে পড়ে, সেও ব্লগার। এক ঢিলে দুই পাখি। সেতুর সাথে চুক্তি করেছিলাম ‘আমি তোমার জন্য ডাক্তার পাত্র খুঁজে দিব আর তুমি আমার জন্য ‘রোগী’ পাত্রী খুঁজে দিবা’। এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলতেই হয়- প্রথম দিন সেতুর আম্মা মানে আন্টিকে একজন ডাক্তার পাত্রের কথা বলেছিলাম ডাঃ দোলন, দেড় বছর পরে সেই ডাক্তারের সাথেই সেতুর বিয়ে হয়!!! এটা মিরাকল ঘটনা। এটা নিয়ে গতকাল একটা আলাদা স্টেটাস দিয়েছিলাম।
সেতু আমার জন্য তার পরিচিত এক মেয়ে দেখল, ১০০ ভাগ জামাতী পরিবার। মেয়ে সিদ্ধেশ্বরিতে পড়ে। তবে মেয়ে ছাত্রী সংস্থা করে না। আমাদের বাসায় পর্দা কেউ করে না, পর্দানশীল মেয়ে সবাই পছন্দ করে কিন্তু কেউ ছাত্রী সংস্থার মেয়ে পছন্দ করে না। আমি নিজেও কখনো ভাবিনী ছাত্রী সংস্থার বা জামাতী ফ্যামিলীর সাথে বিয়ের সম্পর্ক করব কিন্তু ফারজানার কাছে ‘রিফিউজের’ পরে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে মেয়েই এখন পাব সেই মেয়েকেই আমি বিয়ে করব, এখন আর বাছ বিচার করব না। কোন মেয়ে দেখতে কেমন, ফ্যামিলী কী কোন বাঁধাই মানব না। আমি আমার জিদের কথা আমার ফ্যামিলীকে জানালাম। ওনারা বললেন-তোর লাইফ, তুই যা খুশি তাই কর।
২০১০ সালের অক্টোবরের শেষ শুক্রবার ছিল ২২ তারিখ। ঐদিন সংসদ ভবনের পাশের একটা রেস্টুরেন্টে প্রথম তানিয়ার সাথে আমার দেখা হয়। সাথে ছিল সেতু ও তার মা। মেয়ের কথা বার্তায় চালু মনে হল। আমার তখন মাথায় শুধু বিয়ের জিদ, বিয়ে করতেই হবে। ব্যপারটা এরকম, শাহবাগীরা শ্লোগান দিয়েছিল “আর কোন দাবী নাই কাদের মোল্লার ফাঁসী চাই” ঠিক এরকমই আমার তখন মনে হচ্ছিল- “আর কোন দাবী দাবী, এবার বিয়ে করাই চাই”।
তানিয়ার সাথে ফারজানার তুলনা করে লাভ নাই, আকাশ পাতাল পার্থক্য। আমার আকাশের চাঁদ দরকার নাই, মাটির মানুষ হলেই চলবে। তানিয়াকে দেখার পরে তানিয়ার মুখ থেকে শুনলাম জামাতী ফ্যামিলী হওয়ার পরেও সে এতদিন ছাত্রী সংস্থা করেনি কিন্তু এখন থেকে সে ছাত্রী সংস্থা করবে। আমি মনে মনে বললাম –ঘুরে ফিরে আমার কাছে বার বার ছাত্রী সংস্থা আসছে কেন? আমাকে জিজ্ঞেস করল এ ব্যপারে আমার কোন বক্তব্য আছে কি না। আমার বক্তব্য তখন পুরা শাহবাগীর মত –দাবী শুধু একটাই……………. তোমার যা খুশি তা কর।
নভেম্বরের প্রথম দিকে নতুন একটা চাকরিতে জয়েন করলাম। মূলত বিয়ে করার উদ্দেশ্যেই এই চাকরিতে জয়েন করা। আগের চেয়েও কম বেতন হলেও সুবিধা হল এই চাকরিটা কনসাল্টেন্ট ক্যাটাগরির। মানে আমাকে নিয়মিত ফ্যাক্টরি যেতে হবে না, শুধু ফোনে পরামর্শ দিলেই চলবে। আর মাঝে মাঝে বিভিন্ন বায়িং হাউজে গিয়ে ঐ প্রতিষ্টানের জন্য কাজ নিয়ে আসতে হবে। তার মানে সপ্তাহের তিন দিনই বাসায় থাকতে পারব আর বাকী দিন গুলোতে ইচ্ছে মত অফিস করব। বিয়ের এক দেড় বছর পর এই চাকরি ছেড়ে নতুন চাকরির খোঁজ করতে হবে। চাকরি বদলের আরেকটা কারন হল আগের চাকরির অবস্থা খারাপ হতে শুরু করেছিল, নিয়মিত বিরতিতে কারো না কারো চাকরি যাচ্ছিল। হঠাত যদি আমার চাকরি চলে যায় তখন যদি চাকরি না পাই।
সংসদ ভবনের পাশে পাত্রী দেখার পরে দুই মাস কোন খবর নেই। আমিও যোগাযোগ রাখিন, যা হবার হবে। ডিসেম্বরের শেষের দিকে ওদের পক্ষ থেকে যোগাযোগ হল। ওরা ফ্যামিলীগত ভাবে যোগাযোগ করতে চাইছে। আমার বাসার পক্ষ থেকে আমার মা ওদের বাসায় গেল-পাত্রী পছন্দ হল না। কিন্তু আমার চাপাচাপিতে বিয়েতে রাজী হল। মা বললেন-এমন মেয়ে তোর পছন্দ হল! আমি উত্তর দিলাম- আমি যেই মেয়ের মেয়ের কথা (ফারজানার) তোমাদেরকে বলেছিলাম তার জন্য তো একটুও আগ্রহ দেখালে না। মা বললেন-তখন তো ঐ মেয়ের বিয়ের বয়সই হয়নি। এভাবে প্রায় সময় আমার সাথে আমার বাবা মায়ের ফারজানার বিষয়টা নিয়ে আলাপ হতে লাগল।
২০১১ সালের জানুয়ারীর ১৯ তারিখ। আমার বাবা, চাচা, খালু সহ অন্যান্য মুরুব্বীরা তানিয়ার ফ্যামিলীর সাথে বিয়ের জন্য ‘অফিসিয়াল মিটিং’ করেন। ঐ বৈঠক থেকে এসে আমার বাবা খুব ক্ষেপে যায়। বিয়ের ব্যপারে উনি রাজী নন তবুও আমার ‘শাহবাগী’ আচরন থেকে উনি মনের বিরুদ্ধে রাজী হলে। বিয়ের তারিখ ঠিক হয় ফেব্রুয়ারী শেষের দিকে। এর মধ্যে
একদিন আমার মা গিয়ে তানিয়ার হাতে আংটি পরিয়ে দিলেন। এত ঘটনা ঘটছে অথচ তানিয়ার সাথে সেই একদিন যে দেখা সেই দেখার পর আর কোন দেখা হয় নি কথাও হয় নি। ওর কোন ছবিও নেই! এই হল ছাত্রী সংস্থা!!!
সেতুর চেষ্টায় আমি তানিয়ার সাথে কথা বলা শুরু করলাম। সে বাসার ল্যান্ড ফোন থেকে ফোন করত। ল্যান্ড ফোনের একটা প্যারালাল লাইন ছিল ডাইনিং রুমে আরেকটা লাইন ছিল ওর বাবার রুমে। প্যারালাল লাইনের কারনে বোধহয় আমার সাথে ‘সাবধানে’ কথা বলত। মোবাইল নম্বর চেয়ে প্রথমে পাইনি, পরে দিয়েছে। মাঝে মাঝে কথা বলতাম। এরপরে শুরু করলাম মোবাইলে কথা বলা। আন্তরিকতা বাড়তে থাকল আর আমি ফারজানার কথা ভুলে গেলাম। তানিয়াকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করলাম। বিয়ে তো আর মাত্র ক’টা দিন পর, বাইরে দেখা করা যায় না? উত্তরে কড়া ভাষায় ‘না’ আসত। বিয়ের মাত্র পনের দিন বাকী এমন সময় খবর এলো তানিয়ার বাবা অসুস্থ, বিয়ের তারিখ পিছিয়ে দিতে হবে। আমার ফ্যামিলী বিয়ে পিছিয়ে দিলেই খুশী, বিয়ে না হলে আরো খুশী, যেহেতু সম্পূর্ণ ওনাদের অমতে বিয়ে হচ্ছে। বিয়ের নতুন তারিখ নিয়ে মার্চে আলোচনা হল। আমি তখন তানিয়া ছাড়া আর কিছু বুঝি না। ঠিক হল আগামী পহেলা বৈশাখ ১৪ এপ্রিল ২০১১ বিয়ে হবে। এটা যেহেতু এপ্রিল মাস এবং পহেলা বৈশাখে আসছে তাই এই স্টেটাস সিরিজ আকারে লিখছি। এই পহেলা বৈশাখেই আমার জীবনে একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে।
মার্চ মাস হল ‘ব্যর্থ আলোচনার’ মাস। এই মাসে আলোচনা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ব্যর্থ হয়েছেন। মার্চে আলোচনা করে আমাদের বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হবার পর পরেই আবার বিয়ের তারিখ কেন্সেল হয়। তানিয়ার বাবা ছিলেন হাই স্কুলের শিক্ষক। এপ্রিলে কী এক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা আছে তাই ঐ মাসে বাসায় এত বড় আয়োজন করা যাবে না। আমার মনে কেমন যেন খুঁত খুঁত করতে লাগল। বার বার বিয়ের তারিখ ভেঙ্গে যাচ্ছে কেন? একটা বিষয় নিয়ে এত ডিলে হওয়া ভাল লক্ষণ নয়।
লক্ষণ ভাল বা খারাপ যাই হোক না কেন আমি তখন তানিয়া স্বপ্নে বিভোর আর তানিয়াও আমার স্বপ্নে বিভোর। ১লা বৈশাখের দিন বিয়ে হবে না ঠিকই তবে তানিয়ার ফ্যামিলী আমাদের ফ্যামিলীর সবাইকে দাওয়াত দিল। আমি ছাড়া পরিবারের সবাই সেই দাওয়াতে গেল, তানিয়ার জন্য গিফট কেনা হল। বিয়েতে কে কি গিফট করবে কীভাবে অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে সে নিয়ে আলোচনা করার উদ্দেশ্যেই এই দাওয়াতের আয়োজন করা হয়েছে।
তানিয়ার বাবা ছিলেন কাট খোট্টা টাইপের মানুষ, কথা খুব কম বলেন। আমার বাবা মা কেউ কম কথা বলা লোক পছন্দ করেন না। সেদিন কী হয়েছিল জানি না দাওয়াতের মাঝে দুই পক্ষের মাঝে মনোমালিন্য হল। তর্কা তর্কী হল, তর্কা তর্কীর মধ্যে বিয়ের নতুন তারিখ ঠিক হল পরের মাস অর্থাৎ ২০ শে মে শুক্রবার।
রাতে বাসায় এসে আমার মা আমাকে অনেক বোঝালেন-এই বিয়ে ভেঙ্গে দিতে। উনি মন থেকে ঐ ফ্যামিলীকে মানতে পারছেন না। এরকম মেয়ে ওনার বউ হবে এটাও মানতে পারছেন না। বাবাও আমাকে বোঝালেন, আমি কোনভাবেই মানতে পারছি না। আমি শাহবাগীর মত এক দফা দাবী………… ।
পরদিন সকালে আমার মা সিদ্ধান্ত দিলেন- মরে গেলেও এই বিয়ে হতে দিবেন না। তুই ইচ্ছা করলে তোর মত যা ইচ্ছা কর। আমি ওসবে নেই। আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। ঐদিন অফিসে যাওয়ার কথা ছিল, যাইনি। সারাদিন মন খারাপ করে বাসায় শুয়ে ছিলাম। তানিয়া একবার ফোন করেছিল, ওকে জানালাম। সে বলল-আসলে ওর বাবার বয়স হয়েছে, মাস্টার মানুষ, সবাইকে মাস্টারি শেখাতে চায়। এটা নিয়েই সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানের জন্য তানিয়ার এক নানার কাছে সাহায্য নিতে হবে। উনি খুব চালাক মানুষ। তানিয়া সেই নানাকে ফোন দিয়ে আমার নম্বর দিয়ে দেন। নানা আমাকে ফোন করলেন, কথা বলে সমস্যার কথা জানলেন। উনি আমার বাবা মায়ের সাথে দেখা করার প্ল্যানও করলেন।
নানার এই প্ল্যানও দু’দিনের মধ্যে ভেস্তে গেল। আমার অবস্থা তখন পুরোপুরি দেবদাস! দেবদাস কী কারনে মদ ছন্নছাড়া জীবন বেছে নিয়েছিল তখন হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। আমারও তখন দেবদাস হতে ইচ্ছে করছিল। ওইদিন ছিল ১৭ই এপ্রিল। আমাদের ফ্যামিলী সেতুর মায়ের মাধ্যমে জানিয়ে দেয় আমাদের বিয়ে বাতিল। আর যেন আমাদের সাথে এই বিষয়ে যোগাযোগ না করে। আমি তখন কী করব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমাদের আত্মীয় স্বজন কেউ আমার পক্ষে এলেন না।
এই কয়দিনে তানিয়ার সাথে আমার নিয়মিত কথা হত। আমি তানিয়াকে বললাম-যেকোন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত হতে। কী পরিস্থিতি এটা বললাম না। বলব কী, নিজেও জানি না কী হতে পারে।
তিন দিন পরে ১৮ই এপ্রিল অফিসে গেলাম। বস আমার অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করলেন আমার কী সমস্যা? আমি আমার সমস্যা খুলে বললাম। বস বললেন-সিদ্ধান্ত নিজেকেই নিতে হবে। সিদ্ধান্ত বলতে তিনি বুঝিয়েছেন কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করা। আমার এই আইডিয়াটা পছন্দ হল।
কাজী অফিসে বিয়ে করার একটা সুবিধা আছে। আমার এক বন্ধু সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা খরচ করে কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করেছে যেখানে আমার বিয়ের জন্য পাঁচ লক্ষ টাকা বাজেট করা হয়েছে। কিন্তু টাকা বাঁচানোর কারনে খুশী হতে পারলাম না কারন ফ্যামিলীর কেউ বিয়েতে রাজী নন। দুই একজন বন্ধু বান্ধবের কাছ থেকে কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ের তথ্য নিলাম।
ঐদিন ই তানিয়াকে ফোন দিয়ে কাজী অফিসের কথা বললাম। কিন্তু একটা ছেলের জন্য বিষয়টা যত সহজ একটা মেয়ের জন্য ততই কঠিন। সে কোন মতেই কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করতে রাজী হল না। আমি তানিয়ার নানার সাথে কথা বললাম-উনিও রাজী নন। বিয়ে হলে ‘অফিসিয়ালী’ এগোতে হবে।
আমার মন আরো ভেঙ্গে পড়ল। মাথা এবার নষ্ট হবার যোগাড়। কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। ভাবছিলাম ক’দিনের জন্য কক্সবাজারে বেড়িয়ে আসব, মন ভাল হয়ে যাব কিন্তু কক্সবাজারের কথা মনে হয়ে মন আরো খারাপ হয়ে গেল কারণ মাত্র ক’দিন আগে তানিয়ার সাথে কক্সবাজারের হানিমু করার পরিকল্পনা করেছিলাম। পুরুষ মানুষ খুব শক্ত আঘাত না পেলে কাঁদে না। আমি কেঁদেছিলাম। বিশেষ করে ১লা বৈশাখের রাত থেকে ঠিক মত ঘুমাতে পারলাম না।
এভাবে চলে এলেও ঐতিহাসিক ২০শে এপ্রিল। এ দিনে ঘটে গেল এক দারুন চমক!
২৫শে মার্চ কালো রাতে যখন বাংলাদেশীদের গণহত্যা চলছিল তখন বাংলার মানুষ বুঝতে পারে নি তাদের কী করা উচিত। প্রিয় নেতা গ্রেফতার, বাকীগুলো আত্মগোপনে। এই মুহূর্তে শক্তিশালী এক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সাধারন মানুষের কী করা উচিৎ তা নিয়ে যখন সবাই টেনশন করছিল ঠিক তখনই ভোর রাতে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেক ভেসে আসে অসম সাহসী এক কন্ঠস্বর “আমি মেজর জিয়া বলছি, আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করছি”। এরকম ঘটনা মানুষের জীবনে খুব ঘটে। কিন্তু সেদিন আমার জীবনে ঠিক এ ধরনের ঘটনাই ঘটেছিল।
২০শে এপ্রিল ছিল শুক্রবার। অন্যান্য শুক্রবারের মত এদিন ভাল থাকার কথা ছিল যেহেতু ছুটির দিন। কিন্তু তানিয়ার বিরহে মন খারাপ। সেদিন রাত আনুমানিক আট টার সময় আমার মোবাইলে অপরিচিত নম্বর থেকে একটা ফোন আসে।
নারী কন্ঠের সেই ফোন থেকে জিজ্ঞেস করল-আপনি কি লালসালু?
আমি বললাম-জ্বী। কে বলছেন প্লীজ? (ভেবেছিলাম তানিয়ার ফ্যামিলী থেকে কেউ ফোন করবে, কিন্তু ওদের ফ্যামিলী থেকে কেউ ফোন দিল না)
উত্তরে যা শুনলাম তা শুনে আমি আর অল্পের জন্য হার্টফেইল করতাম।
উত্তর এল “আমি ফারজানা বলছি!!!


শিবিরের কর্মীরা একটা প্রোগ্রাম করে নাম শব বেদারী। শব বেদারী প্রোগ্রাম রাতে কোন এক মসজিদে হয়। সারা রাত তারা নামাজ কালাম ইবাদত করে এবং সকালে মোনাজাতের মাধ্যমে শব বেদারী প্রোগ্রাম শেষ করে। শিবির না করলেও এরকম একটা শব বেদারী প্রোগ্রাম দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। এক এলাকার শিবিরের কর্মীরা এক মসজিদে শব বেদারী করবে (এলাকার নাম বললাম না)। সমস্যা হল ঐ মসজিদে কখনো শিবির প্রোগ্রাম করে নি। কীভাবে যেন এলাকার পুলিশের এসআই খবরটা পায়। এসআই সাহেব আমাদের কয়েকজনকে ব্যপারটা জানায়। আমি জানালাম ওরা আমাদের ৪ দলীয় জোটের লোক, ওরা প্রোগ্রাম করতেই পারে। তবুও রাতে কী হয় দেখার জন্য এসআই সাহেব রাতে আমাকে ও ছাত্রদলের এক নেতাকে নিয়ে সেই মসজিদে যাই। উল্লেখ্য তখন চার দলীয় জোটের শাষন চলছিল। তখন ওরা তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ছিল। এই প্রোগ্রামে শিবিরের কর্মীরা প্রায়ই করে। এটা নাকি ওদের মন শুদ্ধির ইবাদত। এছাড়া এ সময় আল্লাহ দোয়া বেশি কবুল করেন। বিশেষ করে রাতের শেষ প্রহরে আল্লাহ সবচেয়ে নিকটবর্তী আসমানে চলে আসে। আল্লাহ বান্দাদের কাছে আশা করে –কার কী চাওয়া আছে বল,আল্লাহ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। নিজের জীবনে মাঝে মাঝে এই পলিসি ব্যবহার করার চেষ্টা করি। এক সময় প্রতি মাসে একবার হলেও মাঝ রাতে উঠে ইবাদত করতাম। এই ইবাদতের নিয়ম হল-ঘুম থেকে মাঝ রাতে ওঠে ফজর নামাজ পর্যন্ত তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া, কোরান শরীফ তেলাওয়াত করা। আমি নিজে এর অনেক ফল নগদে পেয়েছি। গভীর রাতে ওঠে কেউ যদি আল্লাহর কাছে কিছু চায় আল্লাহ ঠিকই তাকে দেয়। আমি এর জলজ্যান্ত প্রমাণ। বিপদে পড়ে যখনই তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে ‘বড় কিছু’ চেয়েছি তখনই আল্লাহ আমাকে তা দিয়েছেন।
১৪ই এপ্রিল যখন আমাদের ফ্যামিলী থেকে সিদ্ধান্ত পেলাম তানিয়ার সাথে আমার আর ‘ফ্যামিলীগত ভাবে’ বিয়ের সম্ভাবনা নেই তখন থেকেই মনে মনে আল্লাহকে ডাকছি ‘সুন্দর একটা সমাধানের জন্য’। তিন দিন পরে যখন তানিয়া আমার সাথে কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানাল সেই রাত ও তার পরের রাতে সারা রাত ধরে ‘শিবিরের সিস্টেমে’ আল্লাহর কাছে চাইলাম। আল্লাহ এবারও আমাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন “আল্লাহ যা করেন মানুষের মঙ্গলের জন্যই করেন”।
আগের স্টেটাসে একটি কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। তানিয়া যখন কাজী অফিসে যেতে অস্বীকৃতি জানাল তখন আমার হঠাৎ করে মনে হল যে মেয়ে আমার সাথে কাজী অফিসে যাওয়ার সাহস করে নাই সেই মেয়ে কীভাবে আমার জীবন সাথী হবে? তখন কেন যেন ফারজানার কথা মনে পড়ে গেল।
এর মধ্যে আমার ‘দেবদাস’ অবস্থা দেখে বাবা মা দ্রুত পাত্রী খোঁজা শুরু করলেন। ওনাদের ভাবখানাও তমন শাহবাগীদের মত হয়ে গিয়েছিল- আর কোন দাবী নাই লালসালুর বিয়ে চাই। যেকোন মেয়ে পেলে তখন আমাকে সেই মেয়ের সাথে বিয়ে দিবে! যে ফারজানার সাথে বাবা মায়ের বিয়ে দিতে আপত্তি ছিল সেই ফারজানার কথা বাবা মা নিজেই জিজ্ঞেস করল। আমি বললাম “যা বলার ভাবীর সাথে বল, আমি কিছু জানি না”। মা ভাবীর সাথে কথা বললেন।
২০শে এপ্রিল শুক্রবার রাতে ফারজানা যখন আমাকে ফোন করে তখন আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না ঐ ফারজানা আমাকে ফোন করবে। ফোন করার কোন কারনই তো দেখছি না।
আমি ফারজানাকে প্রথম দেখায় পছন্দ করেছিলাম-এই কথা ভাবী ফারজানাকে তখনই বলেছিল। ফারজানা উত্তরে বলেছিল “আমি এত কাল ছেলেকে বিয়ে করব না”
এর আগের বিভিন্ন স্টেটাসে আমি বলেছিলাম ফারজানাকে দেখার পরে প্রায় দুই বছর পর্যন্ত আমি ভাবীর কাছে ফারজানার বিষয়ে আলোচনা করেছিলাম, প্রত্যেকবারই ভাবী ফারজানাকে আমার কথা বলেছিল। বরফ শীতল পর্বতও গরমে ধীরে ধীরে গলে ঠিক সেরকম ফারজানার মনে আমার স্থান খুব ধীরে ধীরে হচ্ছিল। একটা ছেলে দুই বছর ধরে তার পেছনে লেগে আছে এটা ফারজানার কাছে আশ্চর্যজনক মনে হয়েছিল। ভাবীর কাছে মা যখন ফোন করেছিল তখন ভাবীর কাছ থেকে আমার কথা শুনে ফারজানা ফোন নম্বর কালেকশান করে আমাকে ২০শে এপ্রিল রাতে ফোন করে। এই ফোনের উদ্দেশ্য আমাকে ঝালিয়ে নেয়া!
আমাকে ঝালিয়ে নেয়ার মত আর বাকী কিছু নেই কারণ আমি গত দুই বছর ধরে ওয়েল্ডিং এর মত ঝলছি। আমার ব্যপারে ফারজানার আরো দুইটা কারনে আগ্রহ দেখাল সেটা হল- একাকীত্ব আর নিরাপত্তা।
আমি আগেই বলেছি ফারজানারা ভাই বোন মিলে উত্তরায় থাকত। বড় বোন যখন তার তিন ছেলে নিয়ে দুই তিন মাস আগে ইউরোপে চলে যায় তখন থেকেই ফারজানা একাকীত্বে ভোগতে থাকে। আগে ঘর ভর্তি মানুষ ছিল আর এখন কেউ নেই। তাই তার বেশিরভাগ সময় কাটত আমার বসের বাসায়।
দুই নম্বরে তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কথা বলেছিলাম। তিন মাস আগে বড় বোন ইউরোপে চলে যাওয়ার পর পরই ফারজানার বড় ভাই ইউরোপের ভিসা পায়, তিনি আগামী মাসে চলে যাবেন। সেজো ভাই একজন ব্যাংকার, পোষ্টিং হয়েছে এক জেলা সদরে তিনিও চলে গেছেন। ঢাকায় ফারজানা সম্পূর্ণ একা হয়ে গেল। যেহেতু সে ইডেন কলেজে ভর্তি হয়েছে তাই তার ভাই তাকে ইডেনের হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করার কথা জানলেন। প্রতি মাসে তিনি ইউরোপ থেকে টাকা পাঠাবেন আর সেই টাকা দিয়ে ফারজানা তার লেখাপড়ার খরচ চালাবে। ঢাকায় একা থাকা ফারজানার পক্ষে অনেক কষ্টের হবে। দুই নম্বর হল ভাই ইউরোপে গেলে উনি নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকবেন কারণ ইউরোপে অবস্থা বেশি ভাল না, অনেকে কাজ পাচ্ছে না। এর মধ্যে তিনি কেন যে ইউরোপ যাচ্ছেন? এইসব কথা চিন্তা করতে করতে যখন আমার বাবা মায়ের কাছ থেকে ফারজানার জন্য প্রস্তাব ভাবীর মাধ্যমে এলো তখন ফারজানা আমাকে ফোন করার কঠিন সিদ্ধান্ত নিল। আমাকে যাচাই বাছাই করে যদি ওর পছন্দ হয় তাহলে সে আমার ব্যপারে আগ্রহী হবে নচেৎ ………….
ভাবীর কাছে আমার একটা বায়োডাটা ছিল। এটা বিয়ের উদ্দেশ্যে এক সময় ভাবীর কাছে দিয়েছিলাম যদি ফারজানার ফ্যামিলীকে সুযোগ মতন দেয়া যায়। এই বায়োডাটা নিয়ে ভাবী ফারজানার বড় ভাইয়ের কাছে গেল-বড় ভাইয়ের একটাই উত্তর “বড় বোনকে বাদ দিয়ে ছোট বোনকে বিয়ে দেয়া যাবে না। আর ওর এখনো বিয়ের বয়সই হয় নি। আগে লেখা পড়া শেষ হোক…….” সেই পুরানো গান। আমার বায়োডাটা ভাবী বড় ভাইয়ের হাতে দিয়েছিলেন কিন্তু ভাইয়া তা খুলেও দেখেন নি, টেবিলে রেখে অফিসে চলে গেলেন। ফারজানা সেই বায়োডাটা খুলে আমার নম্বর যোগাড় করে।
রাতে প্রথম যখন ফারজানা আমার সাথে কথা বলে তখন এটাও বলে-ওর কাছে যে মোবাইলটা আছে তা তার ভাগিনা ইউরোপে যাওয়ার আগে দিয়ে যায়। এটার খবর ভাইয়া জানে না, জানলে খবর আছে। আর এই ফোনটার চার্জ বেশিক্ষন থাকে না, সব সময় সাইলেন্ট মুডে রাখতে হয় যাতে ভাইয়া টের না পায়। সে রাত এগারোটার পরে কল দিবে বলে লাইন কেটে দিল। ঐ মুহূর্তে আমি আমার মাকে কথাটা বললাম-ফারজানা আমাকে ফোন করেছে। মা উত্তরে বললেন-যেভাবেই হোক এই মেয়ের সাথেই তোকে বিয়ে দিব! রাতে ফারজানার ফোন বন্ধ পেলাম। টেনশন হচ্ছিল, একবার কথা বলেই কি সব শেষ? রাত তিনটা পর্যন্ত চেষ্টা করলাম, না পেয়ে ঘুমিয়ে গেলাম। সকালে অফিসে যাওয়ার সময় ফারজানাকে ফোনে পাওয়া গেল-এবার কথা বললাম প্রায় এক ঘন্টা!!! কথার বিষয়-তার নিরাপত্তা। তাকে যদি বিয়ে করি তাহলে কী কী সমস্যা হতে পারে, কে কে বাঁধা দিতে পারে। আমি তাকে সব নিশ্চয়তা দিলাম। ওইদিন সন্ধ্যায় আবার কথা হল। একই বিষয়-তার নিরাপত্তা। বাংলাদেশের মেয়েরা বিয়ে করতে গেলে এই জিনিসটাই বেশি খোঁজে। পরদিন সন্ধ্যায় আবার কথা বললাম। জীবনের ঐদিনই প্রথম কোন মেয়ের কাছ থেক শুনলাম “আ-লা-বু!!!


আমি পাইলাম! আমি উহাকে পাইলাম!! অবশেষে উহাকে পাইলাম!!!
যার পেছনে অনেকদিন ঘুরেছি তাকে এভাবে পেয়ে যাব তা কল্পনাও করিনি। স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন। যেহেতু ফারজানা স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছে তাই এই সুযোগ হারাতে চাই না। যেদিন ফারজানা আমাকে “আ-লা-বু” বলে তার পরদিন মায়ের সাথে ফারজানার ফোনে কথা বলিয়ে দিলাম। মা’রও সেইরকম উতসাহ, সাথে বাবারও অথচ দেড় বছর আগে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। মা বাবার সমর্থন পেয়ে আমাকে আর পায় কে! এবার আর কোন বাঁধা মানব না। তবে বাঁধা অনেকগুলো রয়েছে এর মধ্যে এক নম্বর হল ফারজানার বড় বোনের বিয়ে হয় নি, বড় বোন ছাড়া কি ছোট বোনের বিয়ে হবে?
সকালে ফারজানার সাথে ফোনে কথা বলছি। সে আমাকে তার বাড়ীর নম্বরে ফোন দিতে বলল। আমি ওর বাড়ীর নম্বরে ফোন দিয়ে কল কনফারেন্স করলাম। কনফারেন্সে সে তার মা ও বড় বোনের সাথে কথা বলল। মায়ের কথা একটাই, কুমিল্লার ছেলের সাথে তোকে বিয়ে দেয়া যাবে না, এছাড়া তোর বড় বোন আছে। ফারজানার উত্তর শুনে আমি অবাক হলাম। সে মা’কে উত্তরে জানাল-এই ছেলের সাথে বিয়ে না দিলে আমি ওর সাথে পালিয়ে যাব!!! আমার তখন মাথা ঘুরছে, এই মাইয়া কয় কী? এরকম মেয়েই তো আমার বউ হিসেবে দরকার। পর পর তিন চার দিন ফারজানা এভাবে তার বাড়ীতে কথা বলল। বাড়ীর কেউ ওর বিয়ের ব্যপারটা মানছে না আবার ফারজানাও তার কথায় অনড়, সে আমাকে বিয়ে করেই ছাড়বে। কথা প্রসঙ্গে বলে রাখি প্রায় পৌণে দুই বছর আগে ফারজানাকে যে দশ মিনিটের জন্য দেখেছিলাম, সেই শেষ দেখা এর মধ্যে আর দেখা হয় নি। অবশ্য রিলেশনের পরে বিয়ের আগে দুই দিন দেখা হয়েছিল।
যেহেতু আমাদের ফ্যামিলী রাজী কিন্তু ফারজানার ফ্যামিলী রাজী না তাই আমি কিছু বিকল্প চিন্তা ভাবনা করলাম। কাজী অফিসে বিয়ের একটা প্ল্যান করলাম। ফারজানাকে বলতেই ফারজানা রাজী হল। মজার ব্যপার হল কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করতে হলে কী কী কাগজপত্র লাগে আর কী প্রসেসে এগোতে হবে তার খোঁজ আমার বাবা এনে দিলেন!
ফারজানার মা ঢাকায় ফারজানার বড় ভাইয়ের সাথে কথা বললেন। বড় ভাই ফারজানাকে অনেক বোঝালেন। কিন্তু তাকে কেউ মানাতে পারেনি। অবশেষে বাধ্য হয়ে বড় ভাই আমার বসের স্ত্রীকে বললেন “লালসালুর ফ্যামিলীকে বলেন যোগাযোগ করতে”। আমরা তখন ‘অফিসিয়ালী’ যোগাযোগ করলাম।
দীর্ঘ এক মাস ‘যুদ্ধের’ পর অবশেষে ২০১১ সালের ২৬শে মে আমার আর ফারজানার বিয়ে হল। বিয়ের দিন ছিল বৃহস্পতিবার। রাতে ওদের উত্তরার বাসায় গিয়ে বিয়ে করলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় বিয়ে করা বউকে ঐ রাতে বাসায় নিয়ে আসতে পারিনি, পরদিন বিয়ের অনুষ্ঠান করে আমার হাতে বউকে তুলে দিবে।
পরদিন শুক্রবার ২৭শে মে বউ নিয়ে বীরের বেশে ঘরে ফিরি।
অবশেষে তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল।
পুনশ্চঃ শেষ লেখাটা খুব সাদামাটা হয়ে গেছে। ইচ্ছে করেই করেছি কারণ লেখার মুড চলে গেছে
রেসিপি দেখুন