লালসালুর বিয়ে ১-৫
লালসালুর বিয়ে ১-৫১
উত্তরা চৌদ্দ নম্বর সেক্টরে আমার এক বস থাকতেন। আমি ওনার বাসায় নিয়মিত আসা যাওয়া করতাম। পিতৃতূল্য এই বস আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিকে এক সন্ধ্যায় ওনার বাসায় গিয়েছিলাম। উনি থাকতেন তিন তলায়। ওনার নীচ তলার এক মেয়ের সাথে বসের স্ত্রী মানে আমার ভাবীর সাথে গলায় গলায় ভাব। সেই মেয়ে ঐ মুহূর্তে ঐ বাসায় ছিল। বস মেয়েটিকে আমার সামনে নিয়ে এসে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি মেয়েটির রূপ দেখে কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হল বুকের মধ্যে হার্ট বিট হচ্ছে না! যেমন লম্বা, তেমনি ফর্সা, তেমনি চেহারা। এই মেয়ের চেহারা ঠিক বোম্বের নায়িকাদের মত। প্রচলিত পোষাকের যে সিস্টেম মেয়েটি সেই সিস্টেমের বাইরে ছিল। মানে হল, বর্তমানে সব মেয়েদের পোষাক বডি ফিটিং, যে পোষাক পরলে মেয়েদের বুক পাছা, কোমরের মাপ বলে দেয়া যায় মেয়েটি এই ধরনের পোষাক পরে নি অর্থাৎ ঢোলা লুজ ফিটিং থ্রি পিস পরেছে। সুন্দরী মেয়েরা নিজেকে দেখাতে ভালবাসে, টাইট ফিটিং ড্রেস এখন অসুন্দরীরাও পরে আর সুন্দরী হলে তো কথাই নেই, কীভাবে নিজেকে বেশি করে শো করা যায় তা নিয়েই ব্যস্ত থাকে। মেয়েটির মাথায় কাপড় ছিল। বস মেয়েটিকে বসতে বললেন, মেয়েটি বসল। প্রায় দশ মিনিটের মত মেয়েটির সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম কিন্তু ঠিক মত কথা বলতে পারলাম না। আমি মনে হয় কথা বলা ভুলে গিয়েছিলাম। মেয়েটি উত্তরা উইমেন্স কলেজে ইন্টারে পড়ে।
ওই সময় হঠাত মনে হল সারা জীবন আমি যে ধরনের মেয়ে স্বপ্নে খুঁজেছি, যে ধরনের মেয়ে নিয়ে ঘর বোনার স্বপ্ন দেখেছি তার সাথে এই মেয়ের সব কিছুই মিলে যায়। এমন মেয়েকে বাস্তবে দেখব তা কল্পনাতেও ভাবিনি। কিন্তু আমার আর এই মেয়ের মধ্যে যে ফারাক তাতে কি এই মেয়েকে বিয়ে করা যাবে?
এই মেয়ে মাত্র ইন্টারে পড়ে। শুনলাম বড় ভাই বোনের অনেকেই এখনো বিয়ে করে নাই, লম্বা সিরিয়াল আছে। আরো অনেক ঝামেলা আছে। এত সুন্দরী মেয়ে আমার মত একটা কালো ছেলেকে পছন্দ করবে কী না। ওদের ফ্যামিলী কি ঝামেলা করবে? আমাদের ফ্যামিলীর কী মত থাকবে? বাবা-মার চাহিদানুযায়ী পাত্রী হলে এই মেয়ে অযোগ্য। তাদের কিভাবে ম্যানেজ করব?
২
দশ মিনিট মেয়েটির সাথে কথা বললাম। আমার কাছে দশ মিনিট দশ সেকেন্ডের মত মনে হল। মেয়েটি যখন উঠে গেল তখন ইচ্ছে হল তাকে বলি “আরো কিছুক্ষন কাছে থাক না” কিন্তু সাহসে কুলালো না। এছাড়া ভাবী কী মনে করবে। মেয়েটি চলে যাবার পরে আমার মনে হতে লাগল রবীন্দ্রনাথের সেই উক্তি- আমি পাইলাম, আমি উহাকে পাইলাম। রবীন্দ্রনাথে এই মেয়েকে দেখে নিশ্চয়ই গাইতেন- আমারো পরানো যাহা চায়, তুমি তাই তুমি তাইগো।
ঐ বাসা থেকে বের হয়ে নীচে নামছিলাম। নীচ তলায় এসে হাটা স্লো করলাম-আশা, যদি ঐ মেয়েটিকে একটু দেখা যায়! কিন্তু না, ওর দেখা পেলাম না। বিল্ডিং এর বাইরে এসে মা কে ফোন দিলাম- মা তোমার পছন্দের মেয়ে পেয়েছি। মা খুশি হলেন কিন্তু এও জানালেন শুধু চেহারা দেখেই বিয়ে করা যায় না, বিয়ের সময় অনেক কিছু দেখতে হয়। আমি এত কিছু বুঝি না, এই মেয়েকে আমার চাই ই চাই।
বাসায় গিয়ে বাবা মার সাথে ডিটেইলস আলাপ করলাম, তার আগে অবশ্য বসের কাছ থেকে ওর সম্মন্ধে কিছু তথ্য নিলাম, যেসব প্রশ্ন আমার বাবা-মা আমাকে করতে পারে। ঘুরে ফিরে প্রশ্ন একটাই- ঐ মেয়ে কি এখন বিয়ের জন্য প্রস্তুত? বাবা-মা কেমন যেন ইতস্তত করছিল। এর মধ্যে অনেক কারন আছে। প্রথমত, মেয়েটি মাত্র ইন্টারে পড়ে। বাবা-মার ইচ্ছা গ্র্যাজুয়েট বৌ ঘরে আসবে। দ্বিতীয়ত, মেয়েটির বাড়ী খুলনার দিকে আর আমাদের কুমিল্লায়। আমার বাবা প্রথম শ্রেনীর সরকারী অফিসার, তাই তিনি চাচ্ছেন প্রথম শ্রেনীর সরকারী বেয়াই। অথচ মেয়েটির বাবা কৃষক, ঢাকায় ভাইয়ের বাসায় থাকে। আত্মীয় স্বজনকে আমার বাবা-মা জানালেন তারা কেউ ‘কৃষকের মেয়েকে’ ঘরে আনতে রাজী নন। এটা হল আমার দিকের অবস্থা আর মেয়ের দিকের অবস্থা হল, মেয়ের বড় দুই বিবাহযোগ্য ভাই ও এক বোনের এখনো বিয়ে হয় নি। এছাড়া মেয়েটি মেধাবী, এসএসসিতে এ প্লাস পেয়েছে ইন্টারেও এ প্লাস পাবে। এই মেয়েকে এত দ্রুত বিয়ে দেয়ার চিন্তা ওদের ফ্যামিলীর কারো মাথাতে আসে নি। এখন এই মেয়ে যদি অনার্স শেষ করেও বিয়ে করে তাহলে আরো সাত বছর লাগবে মানে আমাকে সাত বছর অপেক্ষায় থাকতে হবে যদি ওকে বিয়ে করতে হয়! ততক্ষণে এই মেয়ে কি ‘ফ্রী’ থাকবে? যদি কাউকে পছন্দ করে ফেলে? এসব চিন্তা ভাবনা করতে করতে উত্তরায় বসের স্ত্রী মানে ভাবীকে ফোন দিলাম “ভাবী, আপনি যে মেয়েটির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তাকে আমার পছন্দ হয়েছে, এখন আপনি কী করবেন ব্যবস্থা করুন। ভাবী অবাক হয়ে বললেন “আমি তো বিয়ের জন্য ঐ মেয়েকে তোমার সামনে আনি নি। এই মেয়ের তো এখনো বিয়ের বয়স হয় নি। ওর ভাই যদি জানে তাহলে আমার খবর আছে, আমার সাথে ফারজানাকে মিশতে দিবে না।” এই প্রথম মেয়েটির নাম জানলাম ‘ফারজানা’।
৩
ফারজানা আমার জীবনে ঝড়ের মত এসেছিল। ও কালবৈশাখী ঝড়ের মত হঠাত করে এসে আবার হঠাত করে চলে যাবে এটা ভাবতেই আমার বুকে কেমন যেন করত। এই মেয়েকে ছাড়া কীভাবে থাকব? ‘দিল্লী বহু দূর’- যে মেয়েকে আমার পছন্দের কথাই বলা হয় নাই তাকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখছি কীভাবে? এমন যদি হত ফারজানার সাথে আমার বিয়ের কথা চলছে তাহলে একটা কথা ছিল। আমি আর ফারজানা দু’জন যোজন যোজন দূরত্বে অবস্থান করছি। মাঝে মাঝে ভাবতাম ওর সাথে যদি প্রেম করতে পারতাম! নাহ প্রেমের বয়স এখন আর নাই। সরাসরি বিয়ে করতে হবে। আর বিয়ে করতে হলে ফ্যামিলীগত ভাবে এগোতে হবে। যেহেতু ফারজানার ফ্যামিলী থেকে ফারজানার বিয়ের ব্যপারে কোন আগ্রহ নেই তাই আমাদের ফ্যামিলী এ ব্যপারে কোন আগ্রহ দেখালো না। এভাবে এক সপ্তাহ চলে গেল। এই এক সপ্তাহের প্রতিটি দিন আমি ফারজানার কথা ভেবেছি, মনে মনে ঘর বাঁধার কথা ভেবেছি কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে সব ভেস্তে যাচ্ছে যখন কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরে আসি। আর আমি না হয় জীবনে একবার এরকম মেয়ে দেখে পাগল হয়েছি, ফারজানার নিশ্চয়ই এরকম অনেক ছেলেকে দেখেছে, সে কি পাগল হয়েছে? হবার কথাও নয়। আমি যদি নায়ক মার্কা চেহারার হতাম তাহলে হয়তো সে আমাকে নিয়ে কিছুটা চিন্তা ভাবনা করত কিন্তু এ বয়সী মেয়েরা আমার মত ছেলেকে পছন্দ করে না। এটা আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি।
এক সপ্তাহ পরে আমার বাসায় আমার এক খালাতো ভাই আসলেন যিনি আমাদের পরিবারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। বয়সে উনি আমার মায়ের চেয়েও সিনিয়ার। ভাইয়াকে ফারজানার কথা বললাম। উনি আমাকে বললেন- তুই ব্যবস্থা কর, যা করার লাগে আমি করব। উনি আমার মা’কে অনেক ক্ষন ধরে বোঝালেন- ছেলে যা চায় তাই করেন। মা সম্ভবত ভাইয়ার চাপে জোর করে আমাকে বললেন- তোর যা খুশি তা কর। তার মানে মা রাজী নন কিন্তু ভাইয়ার চাপে হা বলেছেন। আমার কি এত কথা শোনার দরকার আছে? আমি উত্তরার ভাবীকে ফোন দিলাম “ভাবী আর তো পারছি না। একটু ব্যবস্থা করুন না প্লীজ।”
ভাবী আমার মনের কথা বুঝতে পেরে “ওদের ফ্যামিলীর কেউ বিয়ের নাম গন্ধ শুনতে চায় না আর আমি কীভাবে বিয়ের কথা বলব?”
“তাহলে আমি যে ফারজানাকে পছন্দ করি তার কথা জানিয়ে দাও। আমি ওর জন্য আজীবন অপেক্ষা করব। যখন ওর ফ্যামিলী বিয়ে দিতে রাজী হবে তখনই বিয়ে করব।”
“লালসালু, তুম কি পাগল হয়েছ। তোমার বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে আর ফারজানার এখনো বিয়ের বয়সই হয়নি। সে কেন তোমার জন্য অপেক্ষা করবে?”
আমি অসহায় বোধ করলাম। এ কেমন পরীক্ষা! আল্লাহ কেন আমার চোখের সামনে ফারজানাকে আনল? আর আনলই বা যখন তখন কেন আমাদের মিলনের ব্যবস্থা করছেন না? আমি তো খারাপ কিছু চাইনি, বিয়ে করতে চেয়েছি।
৪
ফারজানার কথা গত কয়েকদিন স্টেটাসে লিখছি এ কারনে, এপ্রিল মাসের সাথে ফারজানার সৃতি জড়িয়ে আছে।
প্রথমেই জানিয়ে রাখি, এই কাহিনী সম্পূর্ণ বাস্তব। হয়তো কারো নাম পরিচয় প্রকাশ না করার জন্য কারো নাম ঠিকানায় ঈষৎ পরিবর্তন করা হয়েছে। আর যারা এই স্টেটাস অর্থাৎ ৪ নং স্টেটাস প্রথম পড়ছেন তাদেরকে অনুরোধ করছি বাকী ১,২ ও ৩নং স্টেটাস পড়ার জন্য, যা আমার টাইম লাইনে আছে। ঐ স্টেটাস গুলো না পড়লে এই পর্ব বুঝবেন না। ও আরেকটা কথা, এই গল্পের শিরোনাম দিয়েছিলাম- বিয়ের আগের শেষ ছ্যাঁকা, এখন নাম পরিবর্তন করে রেখেছি “যে প্রেম শেষবার এসেছিল জীবনে!”
যাহোক মূল কাহিনীতে ফিরে আসি। ভাবীর কাছে সাড়া না পেয়ে আমি আমার বসকে জানাতে উদ্দোগী হলাম, কিন্তু লজ্জায় বলতে পারছিলাম না। প্রথম স্টেটাসেই বলেছি বস আমার পিতৃতম, বয়সেও আমার বাবার কাছাকাছি। ওনাকে কীভাবে বলি! লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে ওনাকে বলেই ফেললাম। উনি জানালেন “উনি শেষ চেষ্টা করবেন।” বস ভাবীকে এ ব্যপারে দায়িত্ব দিলেন।
ফারজানার ফ্যামিলীর অবস্থা জানিয়ে রাখা ভাল। ১০০ ভাগ গ্রামে বড় হওয়া ফারজানারা ১১ ভাই বোন। এক বোন মারা গেছেন। ফারজানার বাবা মারা গেছেন ২০০৮ এ। ভাই বোনদের মধ্যে ফারজানাই সবচেয়ে ছোট। ইমিডীয়েট বড় বোন অনার্সে পড়ে যার এখনো বিয়ে হয় নাই। বাংলাদেশের নিয়মানুযায়ী বড় বোনের বিয়ে না হলে ছোট বোনের বিয়ের নাম কেউ মুখে নেয় না। ও থাকে উত্তরা ভাইয়ের বাসায়। সেই ভাইও জীবনের ঘানী টানতে টানতে বিয়ে করে নাই। বড় এক বোন তার ছেলে মেয়ে সহ একই বাসায় থাকে, ঐ বোনের ছেলে মেয়ে উত্তরায় লেখাপড়া করে, হাসবেন্ড থাকেন ইউরোপে। আরেক বোন ফ্যামিলীসহ থাকে পশ্চিম ইউরোপের একটি দেশে। তাদের মূল টার্গেট ইউরোপে চলে যাওয়া। ফারজানা ও তার বোনের জন্য যদি ইউরোপে বস বাসরত বাংলাদেশী ছেলে পায় তাহলে সেখানে তাদের বিয়ে দিবে-এটাই ওদের ইচ্ছা। সেক্ষেত্রে সব বোন মিলে ইউরোপে থাকতে পারবে। যে পর্যন্ত ইউরোপে যেতে না পারছে সেই পর্যন্ত তারা উত্তরায় থাকবে।
ভাবী ফারজানার বড় বোনকে আমার কথা বললেন। বড় বোন জানালেন-ফারজানার বিয়ে এখন দেয়া যাবে না। ১. আগে বড়টার বিয়ে হোক। ২. ‘কুমিল্লার’ ছেলে তাদের পছন্দ নয়, খুলনার দিকের পাত্র হলে ভেবে দেখা যেতে পারে। ৩. তাদের বড় বোন ফারজানার জন্য ইউরোপের পাত্র খুঁজছেন, যেহেতু ফারজানা অপূর্ব সুন্দরী তাই ধনী পাত্র পাওয়া কোন ব্যপার না।
তার মানে আমি তিন কারনে রিজেক্ট হয়ে গেলাম- এক, কুমিল্লা বাড়ী হওয়ার কারনে, দুই, ইউরোপে না থাকার কারনে ও তিন, ধনী না হওয়ার কারনে। অবশ্য আমার দেখা যত সুন্দরী দেখেছি রায় সবারই বিয়ে হয়েছে কোটিপতি পাত্রের সাথে। আমার মামাতো বোন গ্রামের সুন্দরী মেয়ে, তাকে কীভাবে যেন এক কোটিপতি ফ্যামিলী খুঁজে পায়, পরে তাদের বিয়ে হয়ে যায়। তারপরে একটা কথা আমার কানে এসেছে, সেটা হল-আমি গার্মেন্টসে চাকরি করি। গার্মেন্টস এর নাম নিলে এখনো অনেকে নাক সিটকায়। তখন আমার পঞ্চাশ হাজার টাকা বেতন ছিল, কিন্তু বেতনকে ছাপিয়ে আমার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকল। আপনারা যারা গার্মেন্টসে চাকরি নিতে আগ্রহী বলে আমাকে মেসেজ পাঠান তারা বষয়টি ভেবে দেখবেন!
ফারজানার ফ্যামিলী আমার মত পাত্রকে পছন্দ করবে না। আমাদের ফ্যামিলীও ফারজানার ফ্যামিলীকে পছন্দ করছে না। যেহেতু অফিসিয়ালী আগানোর পথ বন্ধ তাই আমি আনফিসিয়ালী আগানোর প্ল্যান করলাম। ফারজানাকে বিয়ের প্রস্তাব ও প্রেমের প্রস্তাব দু’টিই এক সাথে দিব। সেক্ষেত্রে ভাবীকে দরকার। ভাবীর কাছে কয়েকবার গিয়েছিলাম কিন্তু লাভ হয় নি। যখনই ফারজানার প্রসঙ্গ তুলি তখনই ভাবী বিভিন্ন উছিলা ধরে কথা ঘুরিয়ে নেন। একবার বলেন, মেয়ে তাবলীগ করে, নিয়মিত তালিমে যায়, এসব কথা তার সামনে বলাই যাবে না। আরেকবার বলেন, ও বাড়ী গেছে। এভাবে ভাবী আমাকে ঝুলিয়ে রাখলেন। আমাদের ফ্যামিলী থেকেও আমার জন্য পাত্রী দেখা চলছে।
আমি তখন ব্লগ জগতে জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করছিলাম। আজে বাজে লেখা লিখলেও অনেক প্লাস/লাইক/কমেন্ট পড়ত যা আমার ফ্রেন্ড লিস্টের অনেকেই জানে। ফেইসবুকে তখন একটা একাউন্ট করা জরুরী হয়ে পড়ল। একাউন্ট খুললাম মূল নামে। সেই আইডিতে অনেক ব্লগার এড হল। এর মধ্যে এক মেয়ের সাথে পরিচয় হয়েছিল যার নাম ‘তাজকিয়া বিনতে নাজিব’। ফেইসবুকে সেলিব্রেটি এই মেয়েকে অনেকেই চিনেন। এক সময় দিগন্ত টিভির সংবাদ পাঠিকা ছিল। তাজকিয়ার সাথে আমার ফেইসবুকে হুব ভাব হয়ে যায়। তাজকিয়া হঠাত একদিন জানায়-তার এক সিনিয়ার সংবাদ পাঠিকা আপু আছে যে বিয়ের জন্য পাত্র খুঁজছে। আপনার সাথে মনে হয় ভালই হবে। আপনি যদি আগ্রহী হন তাহলে আমি সেই আপুর সাথে কথা বলে দেখতে পারি। নাম জিজ্ঞেস করলাম কিন্তু তাজকিয়া সেই মেয়ের নাম বলল না। তিন চার দিন পরে আমাকে ফোনে জানাল-ভাইয়া আপনাকে যার কথা বলেছিলাম সেই মেয়েকে আপনার প্রোফাইল দেখালাম, সে আগ্রহী হয়েছে। আপনি এখন আমাদের সাথে এক জায়গায় মিট করেন। দু’জনের সাথে কথা বলিয়ে দিব। এরপর আপনারাই সিদ্ধান্ত নিবেন আপনারা কি সামনে আগাবেন নাকি বাদ রাখবেন। এবার ওর সেই আপুর নাম জিজ্ঞাসা করলাম, সে নাম জানাল, এও বলল অমুক দিন সকাল এগারোটায় দিগন্ত টিভিতে এই মেয়ে খবর পড়বে, আপনি দেখে নিয়েন। আমি এই প্রথম দিগন্ত টিভির খবর দেখার প্রতি আগ্রহ বোধ করলাম।
৫
কিশোর কিশোরীদের উপস্থাপনায় ‘মুক্ত খবর’ নামের একটা অনুষ্ঠান একুশে টিভির প্রথম দিকে প্রচারিত হত। সেই মুক্ত খবরে এক মেয়ে সংবাদ উপস্থাপনা করত। মেয়েটির চেহারা ছিল প্রিতী জিনতার মত, এমনকি পোষাক আষাকও! টিভিতে যতদিন ঐ মেয়েকে দেখেছি ততদিন দেখেছি ভিন দেশী পোষাক পরে অনুষ্ঠান করছে। ঐ মেয়ের নাম এই মুহূর্তে খেয়াল আসছে না তবে চেহারা ঠিকই খেয়াল আসছে। তখন কার ছেলেদের কাছে প্রিয় এই মেয়েটি যখন শুনলাম আমার এক বন্ধু শাফকাত এর আত্মীয় তখন ইছে হল মেয়েটিকে একবার দেখি। তখন চট্টগ্রামে থাকতাম, সেখানকার কোন মেয়েকে শার্ট প্যান্ট পরা অবস্থায় দেখিনি, এমনকি ওড়না ছাড়াও দেখিনি।
২০০৫ সালে হঠাত একদিন উত্তরার সী শেল রেস্টুরেন্টে সেই মেয়েটির সাথে দেখা। শাফকাতের বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানে ঐ মেয়ে ফ্যামিলী সহ এসেছিল। সে তখন চারুকলা ইন্সটিটিউটে পড়ত, আমাদের এক বা দুই ব্যাচ জুনিয়ার হবে। মেয়েটা বাস্তবেও অনেক সুন্দরী। আমার বন্ধু আমার সাথে তার কথা বলিয়ে দিল। মিডিয়ার কোন সুন্দরীর সাথে আমার ঐ প্রথম সামনা সামনি দেখা এবং কথা বলা। তখন থেকেই ভাবতাম মিডিয়াতে যত মেয়ে কাজ করে সবাই অসাধারন সুন্দরী। তবে মিডিয়ার মেয়েদের চরিত্র নিয়ে যথেষ্ঠ সন্দেহ রয়েছে। এদের অনেকেই পিয়ালের ফ্ল্যাটে নিয়মিত আসা যাওয়া করে।
দিগন্ত টিভির মালিক জামাত নেতারা। এ টিভিতে জামাতের অনেক নেতা কর্মী চাকরি করে। এর মধ্যে আমার পরিচিত অনেকেই আছেন। জামাতের বাইরেও কিছু আছে, যেমন হিন্দু একজন পরিচালক, একজন বৌদ্ধ ম্যানেজার এছাড়াও মুসলমানদের মধ্যে কিছু জামাতের বাইরের লোক ছিল। দিগন্ত টিভি যখন মেয়েদের দ্বারা উপস্থাপনা বিশেষ করে সংবাদ পাঠ শুরু করাল তখন ভাবতাম এরা মনে হয় ওদের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রী সংস্থার প্রোডাক্ট। এ কারনেই মনে হয়েছে যেহেতু তারা হিজাবী। কিন্তু আমার ধারনা ভুল প্রমানিত করে দেখলাম এদের অনেকেই বেপর্দা এবং ছাত্রী সংস্থার সাথে দূর তম সম্পর্ক নেই। এদের মধ্যে এক মেয়ে কিছুদিন চ্যানেল আই এ খবর পড়ত কয়দিন পরে দেখি দিগন্তে খবর পড়ছে হিজাব পরিধান করে। আমার দু’জন বন্ধু দিগন্ত টিভিতে চাকরি করত, যাদের মাধ্যমে ওদের কিছু খবর পেতাম। ওদের সংবাদ পাঠিকাদের অনেকেই অফিসে এসে হিজাব পরিধান করত আবার অফিস থেকে বের হওয়ার সময় বোরখা খুলে ফেলত।
তাজকিয়া আমাকে যখন ওদের অফিসের এক সংবাদ পাঠিকার কথা বলল তখন আমার মনে হয়েছিল এটা কোন টাইপের মেয়ে? এ মেয়ে কি ছাত্রী সংস্থা করে? নাকি অফিসে ঢুকে বোরখা পরে? দু’টি ভন্ড ক্যাটাগরি! যেহেতু মিডিয়ায় কাজ করে তাই আমার মেয়েটাকে দেখার খুব আগ্রহ দেখা দিয়েছিল। দু’দিন পরে বুধবার সকাল এগারোটায় টিভিরে মেয়েটি সংবাদ পরিবেশন করল। আমি অফিস থেকে আর আমার মা বাসা থেকে টিভিতে পাত্রী দেখল। টিভিতে মেয়েটিকে কেমন যেন বুড়ী বুড়ী লাগছিল, আসলে হিজাব পরলে অনেককে বেশি বয়সী লাগে। বুড়ী মেয়ে কার ই বা পছন্দ কিন্তু আমার মেয়েটির সাথে দেখা করার খুব সখ হল তাই আরো দু’দিন পরে শুক্রবার বিকেলে নয়া পল্টনস্থ যেকোন রেস্টুরেন্টে দেখা করার প্ল্যান করলাম।
নয়া পল্টন এলাকা আমার অনেক ভাল করে চেনা কারন এই এলাকায় আমি দু’বছর চাকরি করেছি। এছাড়া বিএনপির কেন্দ্রীয় অফিস নয়া পল্টনে অবস্থিত। কিন্তু এই এলাকার কোন চাইনিজ রেস্টুরেন্ট চিনি না! চিনব কী করে? আমার দৌড় টং দোকান পর্যন্ত। স্পট ঐ এলাকায় গিয়ে ঠিক করব ভেবে আমি আর আমার ছোট বোন সহ নয়া পল্টনে পৌঁছুলাম। শুক্রবার ঐ এলাকার বেশিরভাগ চাইনিজ বন্ধ থাকে এটা আগে জানতাম না। অনেক খুঁজে শেষ পযন্ত হোটেল মিড নাইট সান-৩ খোলা পেলাম। এটার অবস্থান হল বিএনপি অফিস থেকে পশ্চিম দিকে গেলে হাতের ডান দিকে। মিড নাইট সানে-৩ তে তাজকিয়া ঐ মেয়েকে নিয়ে আসল। এই মেয়েকে টিভিতে যতটা বুড়ী বুড়ী লাগছিল বাস্তবে ততটা খুকী খুকী লাগছিল! এতো অনেক সুন্দরী। কিছুক্ষন কথা বললাম, বাসায় ফিরে এলাম কিন্তু অবাক হলাম আমি এই মেয়ের সাথে ফারজানার সাথে তুলনা করা শুরু করেছি। কে বেশি সুন্দরী? উত্তর এলোঃ ফারজানা। এ ধরনের অনেক প্রশ্ন মনে মনে এলো কিন্তু উত্তর এলো একটাইঃ ইস্ট অর ওয়েস্ট ফারজানা ইজ দ্যা বেস্ট। এই মেয়ের সাথে আর এগোতে পারলাম না কারন মেয়েটা অনেক উচ্চাকাঙ্খী। আমাকে অনেকগুলো শর্ত দিয়েছিল আর বলেছিল এই শর্তগুলো মানতে পারলে তার সাথে বিয়ে সম্ভব না হলে নয়। এর মধ্যে একটা শর্ত ছিল-আমাকে জামায়াতে ইসলামী করতে হবে!!! ছাত্রী সংস্থার অগ্রসর কর্মী (ছেলেদের ক্ষেত্রে সাথী), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী এই মেয়েকে আমার কোনমতেই বিয়ে করা সম্ভব না। জামাত করার চাইতে বিয়ে না করা অনেক ভাল।
হোটেল মিড নাইট সান এ পাত্রীর সাথে দেখা করা আর ফারজানার সাথে দেখা করার মধ্যে সময়ের তফাৎ ছিল দেড় মাসের মত। মাথায় আবার ভূত চাপল উত্তরার (ফারজানার) খবর জানার জন্য। আমাদের কি বিয়ে সম্ভব? আর এক মেয়ের জন্য আমার বসে থাকা কি ঠিক হবে? এই মেয়েকে বিয়ে করতে হবে এমন কি কোন বাধ্য বাধকতা আছে? দুনিয়াতে তো অনেক মেয়ে আছে, একজনের জন্য অপেক্ষা করে লাভ কী? বাবা-মা দু’একটা পাত্রীর বায়োডাটা ছবি যোগাড় করে আমার সামনে মাঝে মাঝে রাখতেন, আমি দেখতাম আর ফারজানার সাথে মেলাতাম। একটাকেও ফারজানার কাছাকাছি পেলাম না।
মাঝে মাঝে উত্তরার সেই বাসার সামনে গয়ে ধীরে ধীরে হাঁটি-আশা করতাম ইশ যদি ফারজানা বের হত। ওর মোবাইল ছিল না আর আমার এত সাহস ছিল না মোবাইল নম্বর যোগাড় করে কোণ মেয়েকে ফোন করব।
একদিন উত্তরার সেই ভাবীকে ফোন করলাম-ফারজানার কী খবর জানার জন্য। ভাবী ফোন দিলেন-ফারজানার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আমি যেন এই ব্যপারে আর ওনাকে কখনো ফোন না করি।
চলবে