হৃদয় ও আনিকা
রাত ৩ টা.......ক্রিংক্রিং ক্রিংক্রিং....
ঘুমের মধ্যেই ফোন রিসিভ করে আনিকা।
- হ্যালো, হৃদয়। এতো রাতে ফোন দিছিস কেন ?
- হ্যালো, আনি, কই তুই ? কি করিস ?
- আমিতো পুকুরে মাছ ধরি। গাধা কোথাকার।
- আজকাল স্বপ্নে মাছও ধরিস নাকি ?
- উফফ। মাঝরাতে ঘুম ভাঙিয়ে আবার জিজ্ঞেস করে কি করিস। কি বলবি বল হারামি।
- তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে, স্কাইপে আয়।
এবার একটু কোমল হল আনিকা।
- হঠাৎ দেখতে ইচ্ছা করল কেন ? কাল ভার্সিটি যাওয়ার সময় তো দেখতেই পাবি।
- জানি না। আমার এখন তোকে দেখতে ইচ্ছা করছে তুই এখনি আসবি।
- পারব না। তুই বললেই আমার আসতে হবে নাকি ?
- আমি জানি তুই আসবি। বায়, আমি স্কাইপে গেলাম আয় তুই।
বলেই ফোন রেখে দেয় হৃদয়। ও খুব ভালোভাবে জানে যে আনিকা আসবে। আনিকা এসেছিলও।
পরদিন একসাথে রিক্সায় ভার্সিটি যাচ্ছে আনিকা আর হৃদয়। একথা সেকথা বলতে বলতে আনিকা বলে উঠল -
- আচ্ছা হৃদ, তুই মাঝেমাঝে এমন পাগলামি করিস কেন ?
- কি পাগলামি করছি ?
- কি করছি মানে ? কাল রাতে ফোন দিয়ে ঘুমের তো বারোটা বাজায়ে দিছিস।
- এ আর নতুন কি ?
- তাও ঠিক। ছোটবেলা থেকেই তো তুই এই টাইপের।
- কি টাইপের ?
- খামখেয়ালি, জেদি, গাধা আর কত বলব ?
- বলতে থাক।
- তুই এমন কেন ?
- কেমন ?
- জানি না।
বলেই রাগ করে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল আনিকা। হৃদয় মুচকি হাসছে।
ভার্সিটি থেকে বের হওয়ার সময় হৃদয় দেখল আনিকা কার সাথে যেন হেসে হেসে কথা বলছে।
বাসায় ফেরার সময় রিক্সায় -
- আনি, ভার্সিটি থেকে বের হওয়ার সময় কার সাথে কথা বলছিলি রে ?
- ওহহ তুই চিনবি না। ও আমার খুব ক্লোজ একটা ফ্রেন্ড।
- তোর সব ফ্রেন্ডদের তো চিনি আমি। এইডা আবার কোথে থেকে পয়দা হল ?
- আরেহ আছে তুই চিনবি না। ও যা জোস না।
- *লের জোস। চেহারা দেখলে তো গাঁজাখোর মনে হয়। শরীরটা আবার হাতির মত। এই শোন, তুই আর ওর সাথে মিশবি না।
- আরে না সৈকত অনেক ভালো ছেলে। তুই চিনিস না তাই বলছিস।
- এএএএহহ, সৈকত। আমার অত চেনার দরকার নেই। তুই ই চেন।
হৃদয় রাগে জ্বলছে, আনিকা অন্যদিকে ঘুরে মুচকি হাসছে।
- আচ্ছা আনি, আঙ্কেল নাকি অসুস্থ ?
- হমম, হার্টের সমস্যা আবার বেশি।
- চল তো আঙ্কেলকে দেখে আসি।
- চল।
রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে আনিকা ভাবছে হৃদয়ের কথা। হৃদয়কে ভালোবাসে অনেক আগে থেকেই। কিন্তু বলতে পারে না। ভাবে হয়ত হৃদয় নিজেই বুঝে যাবে। কিন্তু কিছুতেই বুঝে না হৃদয়। এজন্যই আনিকা সবসময় ওকে গাধা, বলদ বলে ডাকে।
এদিকে হৃদয়ের অবস্থাও একইরকম। আনিকাকে কিভাবে বলবে বুঝতেই পারছে না। হৃদয় ভাবে এত কেয়ারিং আর পাগলামির পরেও কেন যে আনিকা ওর ভালোবাসা বুঝতে পারে না।
বন্ধুত্ব আর অব্যক্ত ভালোবাসার মধ্যে ওদের রয়েছে অনেক ছোটখাটো ঘটনা। বৃষ্টিতে ছাতা নিয়ে কাড়াকাড়ি, ছাতা নিয়ে দৌড় দেওয়া, পরে আবার একসাথে ছাতার নিচে হাটা, বৃষ্টিতে ভেজা, একজন অন্যজনকে বিরক্ত করা, কারণেঅকারণে ঝগড়া করা আবার বিপদের সময় পাগলের মত উত্তেজিত হয়ে যাওয়া সবই নিয়ে ওদের বন্ধুত্ব আর অব্যক্ত ভালোবাসা।
একদিন দুপুরবেলা ঘুমাচ্ছিল আনিকা। এমন সময় ওর কাছে ফোন এল। ফোনটা ছিল হৃদয়ের বন্ধু জাহিদের। জাহিদের কাছে আনিকা জানতে পারল যে হৃদয়ের একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে, পায়ে প্রচন্ড আঘাত পেয়েছে। ও এখন হাসপাতালে আছে। জাহিদের কাছে হাসপাতালের নামটা শুনে আর সামান্য দেরি না করেই বেরিয়ে পড়ল আনিকা। বাসায় কোন গাড়ি না পেয়ে সিএনজি নিয়েই রওনা হয় হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।
এদিকে হৃদয়ের জ্ঞান ফিরেছে। ওর এক্সিডেন্টের খবর শুনে আনিকার কি অবস্থা হয়ে এটা নিয়ে খুব চিন্তায় আছে ও। তবে আরো বেশি চিন্তা হচ্ছে অন্য একটা বিষয়ে। জাহিদ বলল যে ও অনেক আগেই আনিকাকে ফোন করে সব জানিয়েছে। কিন্তু আনিকা এখনো আসছে না কেন ? এমন সময় হৃদয়ের মোবাইলে একটা ফোন আসে। ফোনটা ছিল আনিকার মায়ের।
- হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম, আন্টি।
- (কাঁদতে কাঁদতে) হ্যালো বাবা। তুমি কোথায় ?
(এসি কেবিনেও ঘামতে শুরু করল হৃদয়)
- আন্টি, কি হয়েছে ?
- আনিকার এক্সিডেন্ট হয়েছে বাবা। মাথায় প্রচন্ড আঘাত পেয়েছে। ডাক্তারও কিছু বলছে না ঠিকমত। তুমি কি আসতে পারবে বাবা ? তোমার আঙ্কেল হার্টের রোগী। আমি একা তো আর পেরে উঠছি না।
- কোন হাসপাতালে আন্টি ? আমি এখুনি আসছি।
আনিকার মায়ের কাছে হাসপাতালের নামটা শুনেই পায়ের ব্যথা নিয়ে পাগলের মত ছুটতে শুরু করল হৃদয়। বন্ধুদের সাথে গেল সেখানে। গিয়ে দেখে আনিকার মা ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। হৃদয়ের বাবা-মাও এসেছে। হৃদয়কে শক্ত করে ধরল ওর বন্ধুরা কারণ ওরা জানে হৃদয়ের ভালোবাসা সম্পর্কে। পরে আনিকার মায়ের থেকে হৃদয় জানতে পারে যে মাথায় প্রচন্ড আঘাত পেয়ে আনিকার দুটো চোখই নষ্ট হয়ে গেছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নতুন চোখ লাগাতে হবে। সবাই চোখ খোঁজা নিয়ে ব্যস্ত। বেশ কিছুক্ষণ পর হৃদয় এক চোখে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে আসে। ওর এক্সিডেন্টের সময়ও নাকি চোখে আঘাত লেগেছিল। পরে হৃদয়ের মুখে ওর এক্সিডেন্টের কথাও শুনতে পায় আনিকা আর হৃদয়ের মা-বাবা।
অবশেষে ডাক্তার এসে বললেন নতুন চোখ পাওয়া গেছে। এখনি অপারেশন করা হবে। অপারেশন ভালোভাবে শেষ হল। কিছুদিন পর চোখের ব্যান্ডেজ খোলা হল আনিকার। হ্যাঁ, এক চোখে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে হৃদয়, বাবা-মা, বন্ধু-বান্ধব সবাইকে।
---- এক মাস পর ----
লেকের পাড়ে বসে আছে আনিকা আর হৃদয়।
- হৃদ, এতকিছুর পর আবার আমরা একসাথে তাই না ?
- তুই কি ভেবেছিলি দুরে চলে যাবি একাই ? জালাবো কাকে তাহলে ?
- উফফ, আচ্ছা তুই কি কোন কথাই সোজাভাবে বলতে পারিস না ?
- নাহ।
- তোকে ছেড়ে যাব কিভাবে বল, যাকে এত ভালোবাসি তাকে ছেড়ে কি এভাবে চলে যাওয়া যায় ?
আনিকা বলে ফেলল নিজের ভালোবাসার কথা।
- ওহহ, তুই ভালোবাসিস আমাকে ?
- হুমম, কেন তুই বাসিস না ?
- কাকে ? তোর মত পাগলকে ? মাথা খারাপ ?
মন খারাপ করে মাথা নিচু করল আনিকা। হৃদয় বলে উঠল-
- যার সাথে সারাজীবন কাটাতে চাই তাকে অন্ধকারে থাকতে দেই কিভাবে বল তো ?
(চমকে উঠল আনিকা)
- মানে কি হৃদ ? তুই ?
- হমম, আমি।
- কখন কিভাবে ?
- আন্টি যখনি বলল যে তোর চোখ লাগবে, আর দেরি না করে ডাক্তার আঙ্কেলের কাছে চলে গেলাম। উনিই সব ব্যবস্থা করলেন। পরে অবশ্য সবাইকে বলেছিলাম। শুধু তুই ই জানতি না।
- তবে আমি যে শুনলাম যে তুই এক্সিডেন্টে চোখে ব্যথা পেয়েছিস ?
- মিথ্যা।
- মানে ?
- আরে গাধী, চোখে যদি এক্সিডেন্টেই ব্যথা পেতাম তাহলে তো ওই হাসপাতালেই ব্যান্ডেজ করাতাম। তোর হাসপাতালে কেন ? আমার বাম চোখ এখন তোর বাম চোখ।
ঘোরের মধ্যে পড়ে আছে আনিকা। এরই মধ্যে জড়িয়ে ধরল হৃদয়কে। কেঁদে দিল। হৃদয় আনিকাকে বলল-
" প্রেম তুমি এসেছিলে আমার জীবনে বৃষ্টি দিনের শীতল বাতাসের মত। শিহরিত করেছিলে মন আমার। অনেক অনেক চেষ্টা করেও তোকে বলতে পারিনি রে। আমার দু দুটো চোখ থাকতে কি আমার ভালোবাসাকে অন্ধকারে হারাতে দিতে পারি ? আমরা দুজন মিলে তো একটা মানুষ, এক আত্মা। একটা মানুষের তো দুটো চোখ থাকে। আমার আর তোর মিলে দুইটা। দুজনে মিলেই তো চলব জীবনের বাকিটা পথ। "
আনিকা এরইমধ্যে লুকিয়ে পড়েছে হৃদয়ের বুকে। লেকের পাড়ের নীরবতা যেন ওদের আরও একা থাকার সুযোগ করে দিচ্ছে।
---- কয়েক বছর পর ----
আজ ওদের বিয়ে। স্টেজে পাশাপাশি বসে আছে হৃদয় আর আনিকা। দুজনে দুজনের হাতটা শক্ত করে ধরে আছে। একসাথে পথচলা তো সবে শুরু। এভাবেই একসাথে থাকতে চায় ওরা সারাটা জীবন।
লেখা: R Hasan