মরুর ফুল ১১
সন্ধ্যা বেলা, জায়েদ রুমে বাসে আছে। মেহরিন রুমে ঢুকল। মেহরিন রুমে ঢোকার পরে মনে হল রুমের চেহারা পালটে গেল। মেহরিনের রূপের কারণে আশেপাশের এলাকাও সুন্দর মনে হয়। বর যাত্রী চলে গেছে।“আপনার কাহিনী শুনতে এসেছি” মেহরিন জায়েদের উদ্দেশ্যে বলল।
“আমি ইরান শাহের একজন নগণ্য খাদেম মাত্র। আমার কাহিনী শুনে কী লাভ? আমার কাহিনীতে নেই কোন বীরত্ব, নেই শ্রেষ্ঠত্ব, আছে শুধু হতাশা আর হতাশা।”
“আমি সেই হতাশার কাহিনীই শুনতে চাচ্ছি”
জায়েদ তার কাহিনী শুরু করল। মায়মুনার সাথে শেষ কীভাবে দেখা হয়েছে জায়েদ যখন সেই অংশ বর্ণনা করছিল তখন মেহরিনের চোখে পানি দেখা গেল।
---
রাণী শিরির খাস কামরা। রক্ষী এসে জানাল মাদায়েনের গভর্ণর শাহজাদা সোহরাব এসেছে। অনুমতি পাওয়ার পরে শাহজাদা সোহরাব এল। শাহজাদা সোহরাব ইরানী শাহের ভাতিজা। সালতানাতের শাহজাদাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী। রাণি শিরিরও প্রিয় পাত্র। মূলত রাণি শিরির অনুরোধে তাকে ইরানের রাজধানী মাদায়েনের গভর্ণর করা হয়। অল্প বয়সেই সে সেনাবাহিনীতে ভাল ভূমিকা রাখে। সিরিয়া যুদ্ধে তার বীরত্ব ছিল দেখার মত। মাদায়েনের তৎকালীন গভর্ণরের মৃত্যূ হলে শাহজাদাদের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই শুরু হল- কে মাদায়েনের গভর্ণর হবে। কারণ রাজধানীর গভর্ণর হওয়া মানে ইরান শাহের কাছে থাকা আর ইরান শাহের কাছে থাকা মানে অফুরন্ত সম্ভাবনার দুয়ার খোলা। ইরানের ইতিহাসে এর আগে যত জন সম্রাট হয়েছেন তাদের একটা অংশ এর আগে মাদায়েন অথবা ইস্পাহানের গভর্ণর ছিলেন। শাহজাদা সোহরাব রাণি শিরির শরণাপন্ন হন। রাণি শিরি যেহেতু বাদশাহর সবচেয়ে প্রিয় রাণি তাই তিনি নিজের পছন্দের লোকজনকে বিভিন্ন উচ্চ পদস্থ স্থানে বসানোর সুযোগ পেয়েছিলেন যার মধ্যে একজন হলেন ইরানের সেনাপতি খালেকদুন। তিনি সম্রাটকে ফুসলিয়ে শাহজাদা সোহরাবকে যুদ্ধের ময়দান থেকে ফিরিয়ে এনে মাদায়েনের গভর্ণর পদে অধিষ্ঠিত করেন। এতে অবশ্য বাদশাহর অপর স্ত্রীদের ছেলেরা নাখোশ হয়। নিজের এতগুলো ছেলেকে বাদ দিয়ে ভাতিজাকে মাদায়নের মত একটা গুরুত্বপূর্ণ শহরের গভর্ণর এর দায়িত্ব দিলেন।
সোহরাব কামরায় এলেন। রাণিকে রাজকীয় নিয়মে কুর্ণিশ করলেন। বিনিময়ে রাণির মধুর হাসি উপহার পেলেন।
শাহজাদা “হঠাত জরুরী তলব?”
রাণি “কেন, আমি তোমাকে বুঝি এমনি এমনি ডাকতে পারি না?”
শাহজাদা ভাল করেই জানে ধান্ধা ছাড়া আর কোন কারনে রাণি শিরি কাউকে ডাকে না। নিশ্চয়ই এবার নতুন কোন ধান্ধা আছে। তাকে যে মাদায়েনের গভর্ণর বানিয়েছে তাতেও নিশ্চয়ই রাণির ধান্ধা আছে। অসুবিধা নেই, এই রাণির উছিলায় সে মাদায়েন পর্যন্ত এসে পড়েছে। রাণির এক ভাই খালেকদুন সেনাপতি। কোন মতে যদি সেনাবাহিনীর বড় বড় জেনারেলদের হাত করা যায় তাইলে ইরান রাজ তার মাথায় শোভা পাবে। সমস্যা হল সেনাবাহিনীর একটা অংশ খালেকদুনের সমর্থক যা ইরান শাহকে ভাবিয়ে তুলছে, একটা অংশ তার সমর্থক, একটা অংশ ইস্পাহানের গভর্ণর মহাবীর রুস্তমের সমর্থক। তবে মাদায়েনের গভর্ণর হিসেবে তার সুযোগ একটু বেশি। রাণি শিরি খুব চালাক। তিনি খালেকদুনের মেয়ের সাথে শাহজাদা সোহরাবের সাথে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন। খালেকদুন আর শাহজাদা রুস্তম এক হয়ে গেলে কেউ কারো বিরুদ্ধে যাবে না। শাহজাদার রাস্তা উন্মুক্ত হয়। রাণি শিরির রাস্তাও উন্মুক্ত হয়। কারণ পরবর্তী বাদশাহ হওয়ার তালিকায় যাদের নাম আছে তাদের কেউই রাণি শিরির পছন্দের তালিকায় নেই।
রাণি “তোমাকে যে মেয়ের কথা বলেছিলাম সেই মেয়ের ছবি এনেছি। সে সুদূর আরবে থাকে, সিরিয়া থেকে ভাল মানের শিল্পী পাঠিয়ে মেয়েটার ছবি আঁকা হয়েছে।”
শাহজাদা সোহরাব “কী যেন নাম মেয়েটার, ও হা মেহরিন” শাহজাদা এমন ভাব দেখাল যেন মেয়েটার নাম মনে রাখার মত না।
রাণিও জানে শাহজাদা ভাব দেখাচ্ছে। অথচ কয়দিন আগে রাণি যখন শাহজাদাকে মেহরিনের কথা বলেছে তখন থেকেই শাহজাদার খুব আগ্রহ। রাণি জানে এই শাহজাদাকে কাবু করতে পারে একমাত্র নারীই। এই নারীর লোভ দেখিয়েই তাকে দিয়ে কাজ সারানো যাবে।
শাহজাদা ছবিটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল। এই তো সেই মেয়ে যাকে ইরানের ভবিষ্যৎ রাণি হিসেবে মানায়। খালেকদুন সমর্থন দিলেই তাকে ঠেকায় কে? এছাড়া খালেকদুনও নিশ্চয় তার মেয়েকে ইরানের রাণি হিসেবে দেখতে চাইবেন। শাহজাদার সন্দেহ হল, এত সুন্দর চেহারা কি শিল্পীর কল্যাণে? নাকি সত্যি সত্যি সুন্দরী। রাণি মনে হল শাহজাদার মনের কথা বুঝতে পেরেছেন। তিনি বললেন “চার বছর আগে ওদের সাথে জেরুজালেমে দেখা হয়েছিল। মেয়েটা ছবির চাইতেও সুন্দর!” কথা শুনে শাহজাদা মনে মনে মেয়েটিকে কল্পনা করতে লাগলেন। রাণি বললেন “মাদায়েন শহর রক্ষী প্রধান হিসেবে হাশিমিকে তোমার কেমন লাগে?”
শাহজাদা এতক্ষনে বুঝেছে রাণি তাকে কেন তলব করেছেন- অর্থাৎ হাশিমিকে রাণি মাদায়েন শহরের রক্ষী প্রধান হিসেবে দেখতে চান। সোহরাব একবার ছবির দিকে তাকায় একবার রাণির দিকে। রাণি উত্তরের অপেক্ষায় রইল। হাশিমি সম্পর্কে রাণির ফুফাত ভাই হয়। মিশর যুদ্ধে সেনাপতির দায়িত্ব পালন করা অবস্থায় পায়ে আঘাত পান। পরে তাকে মাদায়েনে নিয়ে আসা হয়। তিনি এখন উঁচু পর্যায়ের সরকারী কর্ম কর্তা হিসেবে আছেন কিন্তু ওনার নির্দিষ্ট কোন পদ নেই, সম্রাট তাকে এমনি এমনি খুশি হয়ে উঁচু পদে রেখেছেন। সোহরাব বলল “হাশিমির তো এক পা নেই, ওনাকে এই পদে…….
“তুমি পারবে কিনা বল?” রাণির কন্ঠে কঠিন সূর।
শাহজাদা মেহরিনের ছবি দেখে বলল “এই মেয়ের জন্য আমি সব কিছু করতে পারব।”
শাহজাদা যখন প্রাসাদ বিদায় নিলেন তখন প্রাসাদের এক রক্ষী প্রাসাদের একটা কক্ষে প্রবেশ করল। এই রক্ষী রাণি শিরির খাস কামরার সামনে পাহারা দেয়। রক্ষী কক্ষে অবস্থিত এক মেয়েকে বলল “শাহজাদা সোহরাবের হাতে একটা ছবি ছিল, তবে ছবিটা কার সেটা জানা যায় নি”
মেয়েটি এই প্রাসাদেই কাজ করে, শাহজাদী বিলকিস এর অধীনে।
এক সপ্তাহ পরে নগর রক্ষী বাহিনী প্রধানের লাশ ফোরাত নদীতে পাওয়া গেল। পরবর্তী রক্ষী বাহিনীর প্রধান হিসেবে হাশিমি নিয়োগ পেলেন।
মেহরিনদের বাড়ীতে জায়েদ এসেছে আজ চার দিন হল। জায়েদ ভেবে কুল পাচ্ছে না সে কী করবে? যে মেয়েকে সে দিন রাত কল্পনা করে সেই মেয়েকে সে কী করে রোমানদের হাতে তুলে দেবে? যাজকের সাথে দেখা করলে ভাল হত। তিনি লোক হিসেবে অনেক ভাল মানুষ। তিনি থাকলে হয়তো এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতেন না। মেহরিন জায়েদের সব কথা শোনার পরে চুপ চাপ কামরা থেকে চলে গিয়েছিল। পরদিন সারাদিন মেহরিনের কোন দেখা নেই। এই মেয়েকে এক মুহুর্ত না দেখলে জায়েদের কেমন যেন লাগে। বিকালে যখন মেহরিনকে দেখল তখন জায়েদের তৃষ্ণার্ত হৃদয়ে পানি ছিটা লাগল।
“সারাদিন কোথায় ছিলে?”
“সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। যখনই চোখ বন্ধ করেছি তখনই আপনার কথা, মায়মুনার কথা মনে পড়েছে। নিজেকে যখন মায়মুনার স্থানে ভাবি তখন মনে হয় বেচারি কত কষ্ট পেয়েছিল”
“নিজেকে যখন মায়মুনার স্থানে ভাবি” এই শব্দগুলো জায়েদের মনে গেঁথে গেল। তার বলতে ইচ্ছে হল “তুমি তো এখন মায়মুনার স্থানেই রয়েছ” কিন্তু এই কথা বলার মত না। সেনাপতির মেয়েকে সামান্য এক সেনা অফিসার প্রেম ভালবাসা নিবেদন করতে পারে না। দুনিয়া এটাকে মেনে নিবে না।
জায়েদের চেহারার পরিবর্তন মেহরিন টের পেল “দুঃখিত আপনাকে মায়মুনার কথা মনে করিয়ে দেবার জন্য। আমি আর ওনার নাম আপনার সামনে মুখেই আনব না।”
জায়েদ হেসে বলল “সে এখন ইতিহাস, তার কথা বাদ দেই। আমার সামনে অনেক দুঃখ পড়ে আছে। নিজের ঘর বাড়ী নেই। চাল, চুলো নেই। এভাবে ঠিকানাবিহীন জীবন আর কতদিন?”
রাতে খাবারের পরে মেহরিনের মা জায়েদের সাথে দেখা করতে এল। তিনি বললেন “আমরা দুই এক দিনের মধ্যে রওনা হব।”
জায়েদ বলল “সে কি? আপনাদের বাড়ীতে না আরেকটা বিয়ের অনুষ্ঠান আছে?”
“সে বিয়ে এখন হচ্ছে না। মুসলমানদের সাথে যুদ্ধে তাদের কয়েকজন আত্মীয় মারাত্মক আহত হয়েছে। এই অবস্থায় তারা বিয়ে পিছিয়ে দিয়েছে।”
জায়েদের এ বাড়ীতে অবস্থানের দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে। মেহরিনকে রোমানদের হাতে তুলে দেয়ার পরে তার সাথে আর দেখা হবে না ভাবতেই কেমন লাগছে।
মেহরিনের মা বললেন “তুমি মাদায়েনে কত দিন থাকবে?”
জায়েদ উত্তর দিল “আপনাদের পৌঁছিয়ে দিয়েই যুদ্ধে ফিরে যাব।”
“একটা মাস থাকতে পারলে ভাল হত। আমার মেয়ের বিয়েতে আমন্ত্রণ জানালাম! মাদায়েনের গভর্ণর শাহজাদা সোহরাবের সাথে মেহরিনের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। মাদায়েন গিয়ে ওর বাবার অপেক্ষা করব। তিনিও দ্রুত সেখানে পৌঁছে যাবেন। তুমি অবশ্যই বিয়েতে থাকবে। তোমার সেনাপতিকে বলে তোমাকে মাদায়েনে রাখার ব্যবস্থা করে দিব। শুনেছি তোমার ঘর বাড়ী কিছু নেই। মাদায়েনে তোমার জন্য থাকার ব্যবস্থা করব।”
জায়েদ কোন মতে মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। তার কথা শোনার মত অবস্থা রইল না। রাতটা তার নির্ঘুম কাটল।