মরুর ফুল ১২

বাগানের ফুলের উপর মালির অধিকার নেই। সে শুধু ফুলের পরিচর্যা করতে পারে, ফুল থেকে সুঘ্রান নিতে পারে কিন্তু সে ফুলের মালিক হয় না। জায়েদের অবস্থা অনেকটা এই রকম। পার্থক্য হল সে ফুলের সুঘ্রান নিতে পারছে না। এক সময় গাছের ফুল কারো না কারো হাতে তুলে দিতে হয়। যখনই সে মেহরিনের ভবিষ্যৎ কল্পনা করছে তখনই তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। মেহরিন কিছুদিন পরে রোমানদের হাতে বন্দী হবে অথবা ইরানী শাহজাদার ঘর আলোকিত করবে। সারা রাত না ঘুমানোর ফলের চোখ জ্বলছে। সকালে একটা গাছের নিচে বসে জায়েদ ভাবতে লাগল- সে এখন কী করবে? অভিযান শেষ না করেই ফিরে যাবে? নাহ, অভিযান শেষ না করে ফিরে গেলে সে আর ইরানী বাহিনীতে ফিরে যেতে পারবে না। কারণ ইরানী বাহিনীতে সে পলাতক হিসেবে তালিকাভূক্ত হয়ে গেছে। যদিও ইরানী বাহিনী অনেক বিশাল। অন্য ইচ্ছা করলে এলাকায় গিয়ে সেনার চাকরি নিতে পারবে। খালেকদুনের অধীনে পাঁচ হাজার অফিসার আর দুই লক্ষ সৈন্য রয়েছে। এই পাঁচ হাজার অফিসারের মধ্যে তাকে বেশি হলে একশ জনে চিনে। অন্য এলাকায় তো চেনার প্রশ্নই আসে না। তবু রিস্ক থেকে যায় কারণ কখন কোন অফিসার কোথায় যে বদলী হয় সেটার কোন গ্যারান্টি নেই। পরিচিত কোন অফিসার দেখে ফেললে সাথে সাথে গর্দান যাবে। তার মানে জায়েদের জন্য ইরানী বাহিনী হারাম। এখন যদি সে মেহরিনকে অপহরণ করে নিয়ে যায় তাহলে রোমানদের কাছে সে বিজয়ী হিসেবে প্রশংসা পাবে কিন্তু নিজের বিবেকের কাছে আজীবন প্রশ্ন বিদ্ধ হয়ে রবে। যদি অপারেশন শেষ না করে রোমান বাহিনীতে ফিরে যায় তাহলে সেখানে তাকে জবাব দিহী করতে হবে। ব্যক্তিগত পছন্দের কারণে রোমানদের শিকারকে ইচ্ছা করেই হাত ছাড়া করার অপরাধে গর্দান যেতে পারে। অর্থাৎ বাঁচতে হলে জায়েদের কাছে এখন তিনটা পথ-
এক, রোমানদের কথা মত মেহরিনকে অপহরণ করা।
দুই, মেহরিনের কাছে নিজের আসল পরিচয় দিয়ে ক্ষমা চেয়ে এখান থেকে চলে যাওয়া। সেক্ষেত্রে দু’টি সম্ভাবনা আছে- হয় মেহরিন ও তার পরিবার তাকে আজীবন ঘৃণার চোখে দেখবে অথবা জায়েদকে ভাল চোখে দেখবে। যে চোখেই দেখুক না কেন এটা করলে মেহরিন নিরাপদে থাকবে। কিন্তু সমস্যা দাঁড়াবে তার সাথে থাকা ছয় জন রোমান সেনা নিয়ে। তাদের বললে তারা হয়তো ভয় পেয়ে চলে যাবে, অন্য এলাকায় কিছু করার সাহস পাবে না। কিন্তু তারা যেয়েই রোমান অফিসারকে জায়েদের বিরুদ্ধে বললেই জায়েদ রোমানদের চাকরিটাও হারাবে। সেক্ষেত্রে আজীন রোমানদের কাছ থেকে গোপনে থাকতে হবে। অবশ্য ইরানের মত রোমানদেরও বিশাল এলাকা। এক স্থানে আশ্রয় নিলে কেউ খুঁজে পাবে না।
তিন, আরেকটা পথ আছে। সেটা হল মদীনায় গিয়ে মা বাবার কাছে চলে যাবে। ছয় জন গোয়েন্দাকে বলবে- বাঁচতে চাইলে আরব ছাড়। নইলে তোমাদের পরিচয় ফাঁস করে দিব। এমনিতেই ওরা পালিয়ে যাবে। এরপরে তার নিজের বাড়ী মদীনায় ফিরবে। মেহরিনদের বলবে-গুরুত্বপূর
্ণ এক কাজে তাদের ইরানে ফিরে যেতে হচ্ছে। যুদ্ধ পরিস্থিতির কথা বললেই বিশ্বাস করবে হঠাত কেন তারা চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মেহরিনরা আজীবন জানবে জায়েদ ইরানের সামান্য একজন সেনা অফিসার ছিলেন। অবশ্য দুই দিন পরে যখন খালেকদুনের সাথে দেখা হবে তখন ঠিকই জেনে যাবে জায়েদ পলাতক ইরানী সেনা। তবে খালেকদুন যখন জানতে পারবেন জায়েদ যুদ্ধের ময়দান থেকে এখানে পালিয়ে এসেছে সাথে ছয় জন সঙ্গী নিয়ে তখন কী ভাববেন?
ভাবতে ভাবতে সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল এমন সময় এক লোক চিৎকার করতে করতে রাস্তা দিয়ে গেল “আজীজ পাগল হয়ে গেছে, সে মুসলিম হয়ে গেছে। আজীজ পাগল হয়ে গেছে, সে মুসলিম হয়ে গেছে।”
ব্যাপারটা জায়েদের কাছে কৌতুকের মত মনে হলেও মেহরিনের বাড়ীর লোকজন বিভিন্ন কথা বার্তা বলা শুরু করল। জায়েদ জানতে পারল আজীজ এই গ্রামেরই এক গরিব বাসিন্দা। সে মদীনায় গিয়ে নবীর অনুসারী হয়ে গেছে। পুরো গ্রামের লোকজন আজীজের বাড়ীতে ভীড় করল। জায়েদও সবার দেখাদেখি সেখানে গেল। আজীজ নামের লোকটাকে সবাই ভতসনা করছে কেন সে বাপ দাদার অনুসরণ ছেড়ে দিয়ে নবীর অনুসরণ করছে। নবীর অনুসরণ করা ছেড়ে দিলে তাকে অনেক সম্পদ দেয়ার আহবানও করা হল। কিন্তু আজীজ কোন মতেই মানবে না। সে তার সিদ্ধান্তে অটল। অনেক ক্ষন বোঝানো শেষ হলে লোকজন যার যার স্থানে ফিরে গেল কেবল জায়েদই ফিরে গেল। ফিরে যাওয়ার সময় একজন আরেকজনকে বলল “দুই একটা যুদ্ধে জেতার পর মুসলমানদের সাহস বেড়ে গেছে। নইলে এতক্ষনে আজীজের চামড়া ছিলে ফেলতাম।” জায়েদও টের পেয়েছে মুসলিমরা যেহেতু আরবের উদীয়মান শক্তি তাই তাদেরকে ঘাঁটানোর সাহস এদের নেই।
জায়েদ আজীজের সাথে কিছুক্ষন কথা বলল। মুসলমানদের সম্মন্ধে কিছু ধারনা নিল। যে ধারনা পেল তাতে বোঝা গেল জায়েদের মদীনায় যেতেই হবে। সে সিদ্ধান্ত নিল মেহরিনকে সে সব কথা বলে দেবে।
মেহরিনদের বাড়ীর সামনে আব্বাসের দেখা পেয়ে গেল। আব্বাস সেই আরব-রোমান সেনা যে সেদিন বেশি মাতলামি করে জায়েদের মার খেয়েছিল। লোকটিকে দেখেই জায়েদের মনে হয় এই লোকটির দ্বারা কখনো ভাল কিছু হবে না। জায়েদ আব্বাসকে বলল “তোমার সাথে আমার কথা আছে।”
আব্বাসের সাথে কথা বলার উদ্দেশ্যে একটু দূরে গেল। আব্বাসকে বলল “আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি মদীনায় ফিরে যাব। এই গোয়েন্দার জীবন আমার ভাল লাগে না। তোমরা নিরাপদ স্থানে চলে যাও। খালেকদুনের পরিবার নিয়ে আমাদের প্ল্যান বাতিল করা হয়েছে।”
আব্বাস কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল “প্ল্যান কে বাতিল করেছে?”
“আমি বাতিল করেছি। আমি এখন থেকে রোমান গোয়েন্দা নই। আর তোমরা এই প্ল্যান বাস্তবায়ন করতে পারবে না। নিরাপদে থাকতে চাইলে তোমরা আজই এই এলাকা ছেড়ে চলে যাও। আমি আজই মদীনার উদ্দেশ্যে রওনা দিব।”
আব্বাসের মনে কী আছে কে জানে। সে অনুনয় করে বলল “আমাদের শুধু আজ রাতটা সুযোগ দাও। আগামীকাল সকালেই আমরা চলে যাব। আমি ভেবে দেখলাম আমরা যে কাজটি করতে যাচ্ছি সেটা উচিৎ হচ্ছে না।”
আব্বাসের কথায় জায়েদের সন্দেহ হল। আব্বাস তো এই ক্যাটাগরির লোক না!
খালেকদুনের স্ত্রীর সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে বাড়ীর একজনকে সে জানাল “আমি মেহরিনের মায়ের সাথে দেখা করতে চাই।”
মেহরিনের মা এসেই বললেন “আমরা আগামী পরশু ইরানে রওনা দেব। তোমরা প্রস্তুতি নেও।”
জায়েদ ইতস্ততঃ করে বলল “আপনার সাথে একটা জরুরী কথা ছিল।”
মেহরিনের মা ব্যস্ত হয়ে বললেন “আমি এখন জিনিসপত্র গোছাতে ব্যস্ত। এখন কথা বলার সময় নেই। ইরানের পথে অনেক দিন সময় পাব। তখন ইচ্ছা মত কথা বলব। তোমাদের আপ্যায়নে কোন সমস্যা হচ্ছে না তো?”
জায়েদের তখন মনে হল –ইশ কেন যে সে মেহরিনের সাথে ইরানে যেতে পারছে না? তাহলে মেহরিনের কাছাকাছি আরো কিছুদিন থাক যেত! জায়েদ বলল “না, না, এরকম আপ্যায়ন আমরা কোথাও দেখিনি।”
রাত হতেই নারী কন্ঠের চিৎকার শোনা গেল “বাঁচাও, বাঁচাও, তোমরা কোথায়, কে আছ? মেহরিনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!”
জায়েদের বুকে কাঁপন ধরে গেল। সে তলোয়ার নিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বের হল। সবার আগে সে গেল সেই ছয় সেনার রুমে, রুম ফাঁকা। সর্বনাশ! যা হবার হয়ে গেছে। মেহরিনকে তারা তুলে নিয়ে গেছে। ওদের ঘোড়াগুলোও নেই, এমনকি জায়েদের ঘোড়াটাও নেই। তার মানে ওটার পিঠে বেঁধেই মেহরিনকে নেয়া হবে। ইতি মধ্যে বাড়ীর লোকজন কান্নাকাটি শুরু করল। মেহরিনের মা প্রায় জ্ঞান হারায়। রাতে মেহরিন তার কামরায় শুতে গিয়েছে। কিছুক্ষন পরে কামরা থেকে শব্দ শোনা গেল। সন্দেহ হলে বাড়ীর এক মেয়ে ঐ রুমে যায়, গিয়ে দেখে মেহরিনের ছোট বোন আহত, জ্ঞান হারিয়েছে। মেহরিনকে আশেপাশে পাওয়া যাচ্ছে না। মেহরিনের রুম থেকে সরাসরি বাইরে যাওয়া যেত, সেই দরজাটা ভাঙ্গা। ঘটনার আকস্বিকতায় কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারল না, মেহরিনের বোন আহত কেন? তবে কেউ না কেউ নিশ্চয়ই মেহরিনকে ধরে নিয়ে গেছে!
জায়েদ আস্তাবলের দৌড় দিল। মেহরিনের ঘোড়াটার গলায় লাগাম পরাল। ঘোড়া ছুটিয়ে সে অন্ধাকারের দিকে ছুটল। ঘোড়াটাও মনে হয় বুঝতে পেরেছে তার মনিব মেহরিনের বিপদ। সম্ভবত সে এখন সেদিকেই দৌড় দিচ্ছে। জায়েদও বাইরে বের হয়ে বোঝার চেষ্টা করল রোমান সৌন্যরা কোন দিকে গেছে। যেহেতু সে নিজেও রোমান গোয়েন্দা তাই সে জানে কোন প্যাটার্ন ফলো করে তারা এখন পালাবে। বিশেষ করে কাউকে অপহরণ করে কোথায় কীভাবে পালাতে হয় সেই ট্রেনিং জায়েদ নিজেও নিয়েছে। কিছুক্ষনপরে দূরে একটা শব্দ হল। জায়েদ সেই শব্দ লক্ষ্য করে ছুটল।
এদিকটা মরুভূমি, বালির পাহাড়। চাঁদের হালকা আলোয় দূরের ঘোড় সওয়ারদের দেখা যাচ্ছে। সে দ্রুত বেগে ঘোড়া ছুটাল। সামনের একটা ঘোড়া দুই জন যাত্রী বহন করছিল। তার মানে ঐ ঘড়াতেই মেহরিন রয়েছে। দুই জনকে নেয়ার কারণে ঘোড়াটা অন্যদের তুলনায় একটু ধীরে চলছে। জায়েদ ঐ ঘোড়ার কাছাকাছি আসতেই দুই সেনা তাকে বাঁধা দিল। জায়েদও পালটা আক্রমণ করল। একজন ধরাশায়ী হল, আরেকজন বেঁচে গেল। জায়েদ আবার দুই সওয়ারওয়ালা ঘোড়ার দিকে তার ঘোড়া ছুটাল। এবার কাছে যেতেই আরেক সেনা তাকে বাঁধা দিল। এবার কঠিন বাঁধা এল। এর সঙ্গে কিছুক্ষন লড়াই হল। দূরে গ্রাম বাসীর ঘোড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। তারা ঘোড়ার শব্দ শুনেই এদিকে এগিয়ে আসছে। এবার সব সেনা ঘুরে দাঁড়াল। পাহাড়ের নিচে দাড়ানোর কারণে চাঁদের আলো এখানে নেই। অন্ধকারের কারণে তাদের পাঁচ জনকে মূর্তি মত লাগছে। একটা ঘোড়ায় একটা বস্তা দেখা যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে, এটাতে মেহরিনকে বেঁধে রাখা হয়েছে। সেনাদের মধ্যে আব্বাস কথা বলল “আমাদের এক সাথীকে তুমি শেষ করেছ বলে মনে কর না তুমি একাই আমাদের পাঁচ জনের সাথে লড়াই করে টিকবে। গ্রাম বাসী এদিকে আসতে আসতে তোমাকে শত টুকরা করে ফেলা যাবে। তুমি আমাদের সাথে যোগ দাও। মেহরিনকে সবাই এক সাথে ভোগ করে রোমানদের হাতে তুলে দিব। রোমানরা তাতে কিছু বলবে না। তুমি যে মদীনায় যাচ্ছ সেই মদীনা ধ্বংসের জন্য কুরাইশরাই যথেষ্ঠ। আমাদের এক সাথী মদীনায় গিয়ে ভূখা নাঙ্গাদের সাথে না খেয়ে মরবে সেটা আমাদেরও ভাল লাগবে না। চল এখান থেকে পালিয়ে যাই।”
জায়েদ তলোয়ার উঁচিয়ে বলল “আমার জীবন থাকতে আমি কিছুতেই মেহরিনকে নিয়ে যেতে দিব না।”
আব্বাস “ভুলে যেও না আমরা তোমার নেতৃত্বেই মেহরিনকে অপহরন করতে এসেছি। আর তুমি যা শা করছ তা তুমি কোন দিন পাবে না। তুমি মেহরিনের প্রেমে হাবু ডুবু খাচ্ছ। তাতে লাভ কী? এই মেয়ে একদিন কোন শাহজাদার ঘরে শোভা পাবে। তুমি ফকির ফকিরই থাকবে। এত উঁচুতে নজর না দিয়ে বরং সবাই মিলে একে ভোগ করি। যা পাও লুফে নাও, পরে আফসোস করবে। এই মেয়েকে তোমার ভালবাসার কথা বলেই দেখ। দূর দূর করে অপমান করে বের করে দিবে যেভাবে কুকুর তাড়ানো হয়।”
“আফসোস তো তুমি করবে আব্বাস। ওকে ছেড়ে দেও নইলে আমার সাথে লড়াই কর” জায়েদ দ্রুত এগিয়ে কাছাকাছি অবস্থান করা সেনার দেহ দুই টুকরা করে ফেলল। ঐ সেনা ভেবেছিল জায়েদ মনে হয় তাদের প্রস্তাবে রাজী হয়েছে। তাই তলোয়ার নিচে নামিয়ে রেখেছিল। জায়েদ দ্রুত সামনে এগোল। ছয় সেনার মধ্যে দুই জন শেষ, একজন মেহরিনকে নিয়ে ঘোড়ায় চড়েছে বলে সেও অনেকটা নিরুপায়, জায়েদকে বাঁধা দিতে পারবে না। আব্বাস সহ বাকি তিন জন জায়েদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। জায়েদ প্রাণ পনে ওদের সাথে লড়াই করল। জায়েদের উদ্দেশ্য একটাই, কোন মতে গ্রাম বাসী আসা পর্যন্ত ওদেরকে ঠেকানো। গ্রাম বাসীরা কাছাকাছি চলে এসেছে। জায়েদ এক সেনার হাত বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। জায়েদ নিজেও আঘাত পেল। তার বাম হাতে কব্জি থেকে রক্ত ঝরছে। তার সাথে এখন দুই জন লড়াই করছে। অবস্থা বেগতিক দেখে যে সেনাটি মেহরিন সহ ঘোড়ায় ছিল সে নেমে এল। জায়েদ তার ঘোড়া পিছনে নিয়ে গেল। সেনারা ভাবল জায়েদ পরাজয় মেনে নিয়ে চলে যাচ্ছে। তারাও দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে জায়েদের দিকে এগিয়ে গেল। পেছন থেকে গ্রাম বাসীর একটা গ্রুপ তাদের দেখে ফেলল। তারা হৈ হৈ করে এগিয়ে এল। সেনারা বুঝেছে জায়েদ এতক্ষন ইচ্ছা করে সময় ক্ষেপন করেছে। এখন আর ঘোড়ায় মেহরিনকে নিয়ে পালানো সম্ভব নয়। তারা মেহরিনকে ঘোড়ার উউরে রেখেই ছুটে পালাল। জায়েদ কাছে গিয়ে দেখে মেহরিন বেহুশ। সেনারা মেহরিনের মুখে চেতনা নাশক ঔষধ দিয়েছে। এই ঔষধ সে নিজেই বহন করে নিয়ে এসেছিল কারণ তার নিজেরই প্ল্যান ছিল মেহরিনকে অপহরণ করার। মেহরিন এখন সহজে জাগবে না। বাড়ী নিয়ে গিয়ে পানি ছিটাতে হবে। সে মেহরিন যে ঘোড়াতে রয়েছে সেই ঘোড়ায় চড়ল, ঘোড়া তার মালিককে পেয়ে অনেক খুশি। এটা জায়েদের ঘোড়া, আসার সময় সিরিয়া থেকে রোমানরা দিয়েছে। মেহরিনকে এক হাতে ধরে আরেক হাত দিয়ে ঘোড়ার লাগাম টেনে গ্রাম বাসীকে নিয়ে জায়েদ বাড়ী ফিরল। এদিকে মেয়ের শোকে মাও বেহুশ। জায়েদ কোলে করে মেহরিনকে বাড়ীর আঙ্গিনায় শোয়াল। একজনের কাছ থেকে পানি নিয়ে মেহরিনের মুখে পানি ছিটাল। মেহরিন মুখ নাড়ল কিন্তু চোখ খুলল না। জায়েদ বলল “কিছুক্ষন পরে ওনার জ্ঞান ফিরবে। চিন্তা ভাবনার কিছু নেই।”
বেশিরভাগ লোক ঘটনা জানে না। প্রথমে অনেকেই ভেবেছে বাড়ীতে ডাকাত এসেছে। ডাকাতী একটা স্বাভাবিক ঘটনা বলে সবাই ডাকাত ধরার জন্য পিছু নিয়েছিল। এখন সবাই ঘটনা জেনে জায়েদকে বাহবা জানাচ্ছে। এই বাড়ীর লোকজন জায়েদকে অনেক আগে থেকে চিনে। এর আগে সে ওদেরকে ডাকাতের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল, এবার তো এ বাড়ীর ইজ্জত হারানো থেকে বাঁচালো।
খালেকদুনের স্ত্রী ইরানী সেনাপতির স্ত্রী। তিনি ইরানী সেনাদের চরিত্র জানেন। এরা এরকমই, কখনো কোন লোভে পড়ে যায় গ্যারান্টি নেই। কোন এলাকা দখল করার পর তারা সেই এলাকার মেয়েদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আবার অনেক ইরানী সেনার হাতে অনেক ইরানী অফিসার, সেনার স্ত্রী লাঞ্চিত হওয়ার ঘটনা তিনি জানেন।
সকালে জায়েদের কাছে খালেকদুনের স্ত্রীর এলেন “শুনেছি তুমি নাকি চলে যাবে? তুমি আমাদের এই পর্যন্ত দুইবার জীবন দান করলে। তুমি কী চাও বল। তুমি যা চাও তোমাকে তাই দেব।”
জায়েদ বলল “কোন মানুষের জীবন দান করার ক্ষমতা নেই। যিনি সৃষ্টি করেছেন জীবন দান করার ক্ষমতা একমাত্র তাঁরই।”
খালেকদুনের স্ত্রী ভাবলেন জায়েদ হয়তো তাদের দেব দেবীর কথা বলছে।
“আমি আজ চলে যাব। আপনাকে নেয়ার জন্য ইরান থেকে সেনা আসবে।”
“তোমরাই তো ইরান থেকে এলে”
“আমাদের মধ্যে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। এছাড়া আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি মদিনায় চলে যাব। ইরানের চাকরি ছেড়ে দেব।”
খালেকদুনের স্ত্রী বললেন “সেটা তোমার ব্যাক্তিগত ব্যপার। কিন্তু এত সম্মানের চাকরি ছেড়ে ঐ মরুতে কেন মরতে যাবে?”
“আমি মুসলমানদের নবীর সাথে দেখা করব। ওনার কথা ভাল লাগলে আমি ইসলামকে নিজের জীবন বিধান হিসেবে গ্রহন করব”
খালেকদুনের স্ত্রী বিড় বিড় করে বললেন “তুমিও পাগল হয়েছ?”
হঠাত বাইরে শোরগোল শুরু হল। অনেকগুলো অশ্বারোহী সেনা উঠানে প্রবেশ করল। পোষাক দেখলেই বোঝা যায় এরা ইরানী সেনা। এরা সেই ইরানী সেনা খালেকদুন যাদেরকে জায়েদকে হত্যা অথবা গ্রেফতার করার জন্য পাঠিয়েছিল। একজন ঘোড়া থেকে নেমেই খালেকদুনের স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললেন “এ বিশ্বাস ঘাতক। আমরা ওকে জীবিত অথবা মৃত ধরে নিতে এসেছি। ও আপনাদের অপহরণ করতে এসেছিল।”
রেসিপি দেখুন