মরুর ফুল ১৩
কিসরার প্রাসাদ, ইরানের রাজধানী মাদায়েনে নদীর তীরে অবস্থিত এই প্রাসাদটি ইরানের গর্ব। প্রায় এক হাজার বছর ধরে সাসানী রাজ বংশ এই প্রাসাদের দখলে রয়েছে। ইরানের বাদশাহকে তখন ‘কিসরা’ ডাকা হত। চোখ ধাঁধানো এই প্রাসাদের বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। বিশাল এই প্রাসাদ কেন্দ্রিক আশে পাশে কর্ম চারীদের বাস ভবন। অসংখ্য স্ত্রী ছাড়াও বাদশাহর হেরেমে ছিল কয়েক শ সুন্দরী। এদের দুনিয়ার বিভিন্ন স্থান থেকে এখানে নিয়ে আসা হত। অনেক সুন্দরী নিজে নিজে ইচ্ছা করেই চলে আসত। অনেক সুন্দরী মেয়ের বাবা-মা তার সুন্দরী মেয়ের ব্যপারে চিন্তা ভাবনা করত এই মেয়েকে ভবিষ্যতে বাদশাহর হেরেমে স্থান দিতে পারলে এলাকায় তাদের নাম ডাক বেড়ে যাবে। অনেক সময় দাস ব্যবসায়ীরা আরব থেকে সুন্দরী ধরে আনত। এইসব সুন্দরীর বয়স বেড়ে গেলে তাদেরকে হেরেম থেকে ছুঁড়ে ফেলা হত। কিছু কিছু সুন্দরীর অবস্থা ছিল অনেকটা রাজ রাণির মত। তারা যেকোন ভাবেই বাদশাহর মনে স্থান করতে পেরেছিলেন। দুর্বল মুহুর্তে বাদশাহ এদের কথা শুনতেন। তবে সাসানী বংসের ঐতিহ্য রক্ষার খাতিরে বাদশাহ এদেরকে অফিসিয়ালি রাণির মর্যাদা দিতেন না।হেরেমে সুন্দরী নারীর একটা অংশ ছিল নর্তকী। এছাড়া প্রত্যেক শাহজাদা শাহজাদী রাণি উচ্চ পদস্থ কর্ম কর্তা সবার জন্য ব্যক্তিগত দেহ রক্ষী ছিল। সব মিলিয়ে তখন কিসরার প্রাসাদের কর্মচারীর সংখ্যা ছিল প্রায় দশ হাজার! ইতিহাসের যে সময়ে কথা এই গল্পে বর্ণনা করা হয়েছে সেই সময়ে ‘কিসরা’ ছিলেন অহংকারী বাদশাহ ‘খসরু পারভেজ’। যিনি নিজেকে অপরাজেয় ভাবতেন।
কিসরাদের কাজই ছিল আশেপাশের রাজ্যে হামলা চালিয়ে সেই রাজ্য দখল করে করদ রাজ্যে পরিনত করা। দুনিয়ায় তাদের একমাত্র প্রতিযোগী ছিল রোমান সম্রাজ্য। বিশেষ করে সিরিয়া, আরব, জেরুজালেম, পশ্চিম এশিয়ায় দুই পক্ষের মধ্যে প্রায়ই সংঘর্ষ হত। কিসরার দরবারের একটা বড় সময় কাটত এই সব যুদ্ধ বিগ্রহ পরিচালনার কাজে।
দুনিয়ার সবচেয়ে বড় এই প্রাসাদের সবচেয়ে অন্ধকার দিক ছিল ‘প্রাসাদ ষড়যন্ত্র’। এখানে কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না, কেউ কাউকে ছাড় দেয় না। বাবা ছেলের, ভাই ভাইয়ের, ভাই বোনের, মা ছেলের বুকে ছুরি ধরা এখানে স্বাভাবিক ব্যপার। কিসরার দিনের বাকী সময় কাটত এইসব প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ঠেকানোর ব্যাপারে। ষড়যন্ত্রকারীদের
বিলকিস দরবারের গুরুত্বপুর্ণ লোকদের হাত করেছে। কিন্তু তার একটাই পথের কাঁটা-রাণি শিরি। শিরি সম্পর্কে শাহজাদী বিলকিসের সৎ মা হন কিন্তু দুই জনের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই লেগেই আছে। বিলকিসের শক্তি যেমন তার চেহারা তেমনি শিরির শক্তি হলেন কিসরা। কারণ কিসরা তার রাণিদের মধ্যে শিরিকেই বেশি পছন্দ করেন। রাণি শিরিকে তিনি অনেক বিশ্বাস করেন। শিরিকে কিসরা যখন জিজ্ঞেস করলেন “পরবর্তী কিসরা হিসেবে তোমার কাকে পছন্দ?”
তিনি আশা করেছিলেন শিরি হয়তো তার নিজের কোন ছেলের নাম বলবেন। কিন্তু কিসরাকে অবাক করে দিয়ে শিরি বললেন “হামিদ”
“হামিদ?” কিসরা অবাক। হামিদ কিসরার দ্বিতীয় স্ত্রীর বড় ছেলে। এই মুহুর্তে সে ইরাকের শাসন কর্তা হিসেবে কর্ম রত আছে।
শিরি বললেন “যোগ্য লোককে যোগ্য স্থানে বসালে আপনার মুখ রক্ষা হবে”
“আমি ভেবেছিলাম তুমি তোমার ছেলেদের নাম বলবে”
“আমি সারা জীবন আপনার গোলাম হয়ে থাকতে চাই। বাদশাহীর প্রতি আমার ও আমার ছেলেদের কোন লোভ নেই।” এই কথায় শিরির প্রতি কিসরার বিশ্বাস আরো বেড়ে গেল। অথচ কিসরা জানে না এই মুহুর্তে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের দৌড়ে রাণি শিরি সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছে।
রাণি শিরির চাচাতো ভাই খালেকদুন, কিসরা সম্রাটের ছোট কালের বন্ধু এখন প্রধান সেনাপতি। সেনাপ্রধান হওয়ার ক্ষেত্রে খালেকদুনের যোগ্যতার সাথে রাণি শিরির সমর্থন যোগ হয়েছিল। কিন্তু বিলকিস যখন দেখলে খালেকদুন সেনা প্রধান হয়ে গেছে তখন সে আরেক চাল চালল। কিসরার আশেপাশে যেসব দরবারী থাকে বিলকিস তাদেরকে ম্যানেজ করল। তারা সবাই কিসরাকে বললেন “এই মুহুর্তে কনস্টেন্টিপোল অভিযানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ লোক হলেন সেনাপতি খালেকদুন। তাকে রাজধানীতে না এনে জেরুজালেম থেকে সরাসরি বসফরাস প্রণালীতে পাঠানো হোক। সম্রাট তাই করলেন। রাণি শিরির একটা চেষ্টা পূরণ হলেও সেই চেষ্টা বিলকিসের কারণে ব্যার্থতায় পর্যবসিত হয়। শিরি এবার নজর দিলেন এর পরে কাকে ‘শিকার’ করা যায়। শিরি নজরে পড়ল সম্রাটের ভাতিজা সোহরারের দিকে। সোহরাব রোম-ইরান যুদ্ধে ভাল ভূমিকা রেখেছে। সবাই তাকে সমীহ করে। কিন্তু শিরি সোহরাবের চেহারায় ক্ষমতার লোভ দেখেছিলেন। সোহরাবের আরেকটা লোভ আছে- সেটা হল সুন্দরী নারীর প্রতি। যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে সে যে এলাকায় যায় সেই এলাকার সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটাকে তার চাই ই চাই তা সে কার বোন হোক কারো স্ত্রী হোক। রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেও ইরানী মেয়েরা তার কাছ থেকে রেহাই পেত না। অবশ্য বেশিরভাগ মেয়েরা ঝামেলা করত না কারণ তারা সম্রাটের ভাতিজার কাছে নিজেকে সঁপে দিচ্ছে। কিন্তু যাদের আত্ম সম্মান ছিল তারা হয় প্রাসাদের ছাদ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ত অথবা তাদের জোর করা হত। শাহজাদা সোহরাব অবশ্য মূল ইরানের ভিতরে অর্থাৎ মাদায়েন, ইস্পাহান, কাদেসিয়া সহ গুরুত্বপূর্ণ শহরে এসব কাজ করতেন না। রাজধানী থেকে বহু দূরে এসব কাজ করলেও রাণি শিরির বিশ্বস্ত লোকজন সোহরাব সম্মন্ধে এসব তথ্য দিত। রাণি শিরি এবার টোপ ফেললেন। লোক মুখে শোনা গেল খালেকদুনের মেয়ে মেহরিন অসাধারণ রূপবতী। শিরি খালেকদুনকে শাহজাদা সোহরাবের ব্যপারে পত্র দিতেই খালেকদুন প্রথমে জ্বলে উঠলেন। কারণ সেনাপতি হওয়ার কারণে তিনি জানতেন সোহরাবের চরিত্র কী। কিন্তু খালেকদুন সরাসরি বিরোধীতা করলেন না। কারণ খালেকদুন ভাল করেই জানেন ইরানের প্রাসাদে কখন কী ষড়যন্ত্র চলে। এছাড়া তিনি রাণি শিরির অনুগ্রহে সেনাপ্রধান হয়েছেন, তাকে ক্ষেপানো যাবে না। তিনি বললেন, আমি বিয়েতে রাজী তবে যুদ্ধ শেষে আমি মাদায়েন ফিরলে তবেই বিয়ে হবে। পরে অবশ্য খালেকদুব চিন্তা ভাবনা করে দেখল মেয়ের বিনিময়ে যদি রাজ পরিবারের আরো কাছে যাওয়া যায় তাহলে অসুবিধা কী? সম্রাট তার ছোট কালের বন্ধু কিন্তু সম্রাটের ভাই, ছেলে সবাই তো আর খালেকদুনকে এক চোখে দেখে না। অনেকে প্রকাশ্যে অথবা গোপনে বিরোধীতা করছে।
রাণি শিরি খালেকদুনের চিঠির জবাবে লেখলেন “ভাই, তুমি মেহরিন ও তার মাকে রাজধানী মাদায়েনে নিয়ে আস। এখানে তোমার জন্য রয়েছে অফুরন্ত সম্ভাবনা। আমি জানি তুমি সোহরাবের চরিত্র নিয়ে ভাবছ। মেহরিনকে মাদায়েনে নিয়ে আসলে প্রয়োজনে আমি সোহরাবের চাইতে আরো ভাল ছেলে যোগাড় করব। এমনও হতে পার তুমি সম্রাটের বেয়াইও হয়ে যেতে পার! তুমি ওদেরকে আনার জন্য আজই লোক পাঠিয়ে দাও”
শিরির চিঠি পড়ে খালেকদুনের চোখ চকচক করে উঠল। বিশেষ করে “এমনও হতে পার তুমি সম্রাটের বেয়াইও হয়ে যেতে পার” এই বাক্যটা তার লোভ বাড়িয়ে দিল। খালেকদুন ভাবল ইরানের রাজা বাদশাহ ক্ষমতার জন্য নিজের মেয়েকে বিক্রি করে দেয়। রোমান সম্রাট নিজের স্বার্থে তার সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েকে জঙ্গীদের হাত তুলে দেয় আর খালেকদুন তো তার মেয়েকে বিয়ে দিচ্ছে মাত্র! কেবল মাত্র অপেক্ষার পালা কার সাথে মেয়ের বিয়ে হবে। তবে রাণি শিরি চাইলে সম্রাটের যেকোন ছেলের সাথেও বিয়ে দিতে পারেন। তখন তার প্রধান উজির হওয়া ঠেকায় কে? তিনি তখনই একজন দূত ও ছয় জন সেনা পাঠালেন আরবের উদ্দেশ্যে। সেই দূত যে রোমানদের হাতে বন্দী হয়েছে এবং তার স্থলে রোমানরা জায়েদকে পাঠায় মেহরিন ও তার পরিবারকে ধরে আনার জন্য।
-------------
ঘটনার আকস্বিকতায় সবাই অবাক হয়ে গেল। জায়েদ অবাক হয়ে ভাবল, খালেকদুন আসলেই অনেক চালাক, জায়েদের ব্যাপারটা ধরে ফেলেছে। খালেকদুনের স্ত্রী ব্যাপারটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। এলাকায় ইরানী সেনাদলের আগমন দেখে পুরো গ্রাম বাসী মেহরিনদের বাড়ী চলে এল। এলাকার সবাই জানে এই বাড়ী খালেকদুনের শশুরবাড়ী। এখানে প্রায়ই সেনা সদস্য আসে। কিন্তু তারা যুদ্ধের পোষাকে আসে না। তারা মূলত দূতের কাজ করে ও সিরিয়া দামেস্ক জেরুজালেম থেকে বিভিন্ন জিনিস পত্র নিয়ে আসে। কিন্তু এই প্রথম একশ সেনা নিয়ে যুদ্ধের পোষাকে ঢাল তলোয়ার উঁচিয়ে গ্রামে ইরানী সেনা ঢুকল। আশেপাশে কৌতুহলী জনতা ভীড় করেছে। মেহরিনের এখনো নেশা কাটেনি। চেতনা নাশক ঔষধটা অনেকটা নেশার মত। এই চেতনা নাশক ঔষধ কাপড়ে মেখে মুখের সাথে চেপে ধরতে হয়। মুহুর্তেই শরীর অবশ হয়ে যায়। আহত ব্যাক্তি কথা বলতে পারে না, শরীর নাড়া চড়া করতে পারে না তবে সে আশেপাশের ঘটনা বুঝতে পারে, সব শুনতে পারে, অনেকটা স্লিপিং প্যারালাইসিস এর মত আমরা যাকে ঘুমন্ত অবস্থায় ‘বোবায় ধরা’ বলি। জায়েদ এই ঔষধের ব্যবহার যেমন জানে তেমনি এই ঔষধের প্রতিকারও জানে। মুখে পানি ছিটানো ছাড়াও একটা গাছের ডাল বেটে রোগীর মুখে দিতে হয়। রাতে সে সেই গাছের ডাল বেটে মেহরিনের মুখে দিয়েছিল। এতে ধীরে ধীরে চেতনা ফিরেছে। এই ঔষধ অনেকটা মাদকের মত কাজ করে এবং এর প্রভাব দুই তিন দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। নেশা ধরা কন্ঠে সে ইরানী সেনাদের কথার প্রতিবাদ করল “আপনারা ভুল বুঝছেন, উনি দুইবার আমাদের জীবন বাঁচিয়েছেন।” ইরানী সেনারা মেহরিন ও তার মায়ের কোন যুক্তিই শুনল না। এবার এলাকাবাসী এগিয়ে এল। একজন বললেন “আপনাদের যদি খালেকদুন না পাঠাতো তাহলে এখানে আপনাদের লাশ পড়ত। আমাদের সম্মানিত মেহামানকে আপনারা অসম্মান করছেন। এই ছেলে গত রাতে কী করছে তা মানুষ শুধু নিজের পরিবারের জন্যই করে। ও নিজের জীবন বাজী রেখে মেহরিনকে বাঁচিয়েছে।” ইরানী অফিসার কনফিউজড হয়ে পড়ল, তার হিসাব নিকাশ মিলছে না। অপরদিকে খালেকদুনের আদেশ না আনলে ইরানের চাকরিটা হারাতে হবে এমনকি জানও যেতে পারে। ইরানী অফিসার মেহরিনের মাকে বললেন “এখানে অনেক ভীড়, আমি আপনার সাথে আলাদা কথা বলতে চাই” মেহরিনের মা ইরানী অফিসারের সাথে কথা বলার জন্য একটা রুমে ঢুকলেন। পারলে পুরো গ্রাম বাসী সেই রুমে গিয়ে ঢুকে। সবাই সেদিকে চলে গেল।
“সাবাই কি পাগল হয়ে গেছে?” এই পরিস্থিতিতেও মেহরিনের কন্ঠ যেন জায়েদের কানে মধু ঢালল। মেহরিনের উস্কুখুস্কু চেহারাই বলে দিচ্ছে তার নেশা এখনো কাটেনি “আপনি চুপ করে আছেন কেন? মা আপনার পক্ষে কথা বলছে, এলাকাবাসী আপনার পক্ষে কথা বলছে, আপনি চুপ করে থাকলে তো সবাই সন্দেহ করবে।”
“ইরানী সেনারা মিথ্যা অভিযোগ করেনি” জায়েদের কথায় মেহরিনের মাথায় যেন বাজ পড়ল।
“কী বলছেন আপনি? আপনিও তো পাগল হয়ে গেছেন দেখছি। আপনি কি গত রাতে বেশি মদ গিলেছেন? নাকি আমার মত ওরাও আপনার মুখে ঔষধ মেখে দিয়েছে” মেহরিনের কন্ঠে অবিশ্বাস।
“আমি সত্যি বলছি” জায়েদের নির্লিপ্ত কন্ঠ স্বর।
“আচ্ছা মানলান আপনি সত্য বলছেন। আপনি আমাদের ধরে নিয়ে রোমানদের হাতে তুলে দিতেন। তাহলে ধরে নিয়ে যান নি কেন?”
জায়েদ চুপ করে রইল।
“আপনি চুপ করে রয়েছেন কেন? আরেকটা কথার উত্তর দেন- মনে করলাম আপনি সত্যি বলছেন কিন্তু এর পরিণতি কী হবে আপনি ভেবে দেখেছেন? মেহরিনের কন্ঠে অনুযোগ।
“আমাদের নবী সত্যি কথা বলার আদেশ দিয়েছেন” জায়েদের কন্ঠে মৃদু হাসি।
“আমাদের নবী? মানে? আপনি কি মদীনার সেই নবীর কথা বলছেন যাকে তার চরম শত্রুরাও আল-আমীন বা সত্য বাদী বলে ডাকেন? তিনি আপনার নবী হলেন কবে?” মেহরিনের কণ্ঠে বিস্ময়।
“গতকাল আপনাদের গ্রামের আজীজের সাথে অনেক ক্ষন কথা বলেছি। তিনি বললেন, ইসলামের নবী সবাইকে সত্য কথা বলার আদেশ করেন, আমানত রক্ষা করার কথা বলেন, নারীদের ইজ্জত দিতে বলেন। এমন ভাল লোকের কথা আমি কোথাও শুনিনি। আমি রোমানদের পাদ্রী দেখেছি, মাজুসী (ইরানের ধর্ম গুরু) পূজারীদের দেখেছি কিন্তু সেই নবীর মত কারো প্রশংসা শুনিনি। আজীজকে দেখার পরে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি মদীনায় যাব। নবীর অনুসরণ করব। আমি জেনে শুনে এক নারীর ক্ষতি হতে দিতে পারি না।”
“আপনি আসলেই পাগল হয়ে গেছেন। আপনি ভুল শিকার করছেন, আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিলাম কারণ আপনি আমাকে দুইবার জীবন বাঁচিয়েছেন। আপনি নবীর পথে অনুসরণ করবেন তাই আপনি সত্য কথা বলছেন, ভাল কথা কিন্তু কী কারণে আপনি নিজের জবন বাজী রেখে এবার বাঁচালেন? ছয় জন প্রশিক্ষিত রোমান সেনার বিরুদ্ধে একা একাই বা কেন গেলেন? নাকি আমি ধরে নিব আপনিও ওদের সাথে গিয়েছিলেন কিন্তু পরে বণিবনা হয় নি বলে ওদের সাথে লড়াই করেছেন!”
জায়েদের কপালে ঘাম ছুটল। মেহরিন তাকে সন্দেহ করছে! সন্দেহ করারই তো কথা, রোমানদের পক্ষ হয়ে সে এসেছে তাকে বিশ্বাস করার কোন কারণই নেই। জায়েদ মুখ খুলল “আমি তোমার ক্ষতি চাইনা......”
“তাই বলে একাই ছয় জনের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়েছেন কেন? আপনার কী স্বার্থ রয়েছে?” মেহরিনের কন্ঠ শক্ত হয়ে যাচ্ছে।
“সে কথা তোমাকে বলতে পারব না”
“আপনাকে বলতেই হবে”
“এসব কথা শুনে লাভ নেই। তুমি ইরানী রাজকণ্যা আর আমি একজন সামান্য চাকর বাকর মাত্র।”
“চাকর হয়ে আপনি চাঁদের দিকে তাকাতে গেলেন কেন? আপনার এত সাহস কোথা থেকে হল?” মেহরিন সব বুঝে ফেলেছে “গতকাল আব্বাস যখন আপনার সাথে কথা বলছিল তখন আমার হুশ ছিল। আমি আপনাদের সব কথা শুনে ফেলেছি। আপনার কী করে সাহস হল আমার মত মেয়েকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন। আরবের মরুচারী হয়ে আপনি সর্বোচ্চ মায়মুনার স্বন দেখতে পারেন কিন্তু যাদের পাশের দাঁড়ানোর যোগ্যতা আপনার নেই তাকে নিয়ে ভাবেন কী করে? আমি দুই দিন পরে ইরানের শাহজাদাকে বিয়ে করব। আমার ব্যপারে চিন্তা ভাবনা করে নিজের বিপদ ডেকে আনবেন না। আপনি আমার জীব বাঁচিয়েছেন বলে আপনাকে কোন শাস্তি দিচ্ছি না। নইলে এতক্ষনে আপনার রক্ত ঝরত।” কথাটা বলেই মেহরিন মনে করল সে ভুল করেছে, তার নজর জায়েদের কব্জির দিকে পড়ল, গতকাল মেহরিনকে বাঁচানোর জন্য সে আহত হয়েছে, অনেক রক্ত ঝরেছে। মেহরিন চোখ মুখ লাল করে চলে গেল।
খালেকদুনের স্ত্রী ইরানী অফিসারকে বোঝাতে ব্যার্থ হলেন। তারা তাদের সিদ্ধান্তে অটল, জায়েদকে গ্রেফতার করে নিয়েই যাবে। অফিসার নিজেই একটা পরামর্শ দিলেন “আপনি এক কাজ করেন, সেনাপতির উদ্দেশ্যে একটা চিঠি লেখেন। আমি কথা দিচ্ছি আমি জায়েদকে বসফরাস প্রাণলী পর্যন্ত নিরাপদে নিয়ে যাব। খালেকদুনের স্ত্রী খালেকদুনের উদ্দেশ্যে একটা চিঠি লিখলেন যেখানে জায়েদকে মুক্তি দেয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। জায়েদ তার মেয়েকে বাঁচানোর জন্য যা যা করেছে তার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। অফিসার সেই চিঠি সহ জায়েদকে নিয়ে যাবে। আর কিছু সেনা খালেকদুনের পরিবারকে মাদায়েন নিয় যাবে। মেহরিনকে যে জায়েদ পছন্দ করে সেটা শুধু মেহরিনই জানে আর কেউ জানতে পারল না। পরদিন জায়েদ ও মেহরিনের পরিবার সহ ইরানী সেনারা সিরিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হল। খালেকদুনের স্ত্রীর অনুরোধে জায়েদকে বাঁধা হল না। সে মুক্ত ভাবেই চারিদিকে বিশ জন সেনা প্রহরায় দলের সাথে এগোল। সিরিয়া গিয়ে এরা দুই দলে ভাগ হয়ে যাবে। একদল মাদায়েন আরেক দল অবরোধের এলাকায়।
সিরিয়ার কাছাকাছি এসে তারা শোনে রোমানরা সিরিয়া জয় করেছে। সিরিয়ার গাসসানী বংশকে সিরিয়ার শাসন কর্তা নিয়োগ করেছে রোমান সরকার। খ্রিস্টান গাসসানীরা ইরানীদের চীর শত্রু। সুতরাং সিরিয়ার দিকে আগানো যাবে না। ঘুর পথে তাদের ইরাক হয়ে যেতে হবে। দলটা এবার দুই ভাগে ভাগ হল না। সবাই মিলে ইরাক হয়ে মাদায়েনের পথে রওনা হল।
মাদায়েনের পথে যেতে যেতে মেহরিন ভাবছে সে ইরানের শাহজাদী হতে যাচ্ছে।
খালেকদুনের স্ত্রী ভাবছে, নিরাপরাধ জায়েদকে মাদায়েন গিয়েই মুক্তি দেবার ব্যবস্থা করবেন। অবশ্য জায়েদের চেয়ে তার মেয়ের বিয়ে নিয়ে বেশি উত্তেজিত অবস্থায় আছেন। ইরানী শাহজাদার সাথে তার মেয়ের বিয়ে হবে! খালেকদুনের অন্য স্ত্রীরা তখন তাকে সম্মানের চোখে দেখবে!
জায়েদ ভাবছে, ইশ, মদীনায় যাওয়া হল না। মাদায়েন গেলে তদন্ত হলে তার ফাঁসি নিশ্চিন্ত। সব জেনে গেলে খালেকদুনের স্ত্রীও তার বিপক্ষে চলে যাবেন। সবাই যখন এই সব ভাবনা ভাবছে ইরানের রাজ প্রাসাদে চলছে তখন নতুন কুটচাল এবং সেটা মেহরিনকে নিয়ে।
একদিকে ইরানী সেনাদের কাফেলা চলছে মাদায়েনের পথে অপরদিকে মদীনায় মহানবী (সাঃ) প্রস্তুতি নিচ্ছেন আরব ইহুদীদের চক্রান্তের কেন্দ্র বিন্দু বনু কুরায়যা অভিযানের জন্য।