মরুর ফুল ১৪
রাসূল (সাঃ) যখন মদীনায় আসেন তখন মদীনায় ২০ টার মত ইহুদী গোত্র ছিল। এদের মাঝে উল্লেখযোগ্য হল বনু কোরায়জা, বনু নাদীরা, বনু কায়নুকা, বনু মোস্তালাক, বনু যানবা, বনু আওফ, বনু আন-নাজ্জার, বনু ছালাবা ইত্যাদি। ইসলাম পূর্ব যুগে মদীনার ইহুদীরা আওস ও খাযরায গোত্রের সাথে চুক্তিবদ্ধ ছিল। তারপর আওস ও খাযরায গোত্রের লোকেরা যখন ১ম বায়াতে আকাবা ও ২য় বায়াতে আকাবার মাধ্যমে রাসুল (সাঃ) কে মদীনার নিরুংকুশ ক্ষমতা দিল তখন রাসুল (সাঃ) মদীনায় আগমন করলেন একজন রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে। রাসূল (সাঃ) মদিনাতে আসার পরে মুসলিম, ইহুদী ও পৌত্তলিকদের নিয়ে এক অভিনব সাধারণতন্ত্র গড়ে তোলেন। বিপরীত চিন্তা, রুচি ও ধর্মাভাব সম্পন্ন মুসলিম, ইহুদী ও পৌত্তলিকদের দেশের সাধারণ স্বার্থরক্ষা ও মঙ্গলের জন্যে একটি রাজনৈতিক জাতিতে পরিণত করার জন্যে তিনি একটি সনদ তৈরী করেন। সনদে তিন পক্ষই স্বাক্ষর করেন। এই অভিনব ও অশ্রুতপূর্ব চুক্তি বা সনদ যেটা ইতিহাসে মদীনা সনদ নামে পরিচিত এর কিছু ধারা নীচে দেয়া হলো-১। ইহুদী ও মুসলিম ও পৌত্তলিকরা এক জাতি (রাষ্ট্রীক কাঠামোর মধ্যে বসবাসকারী ‘জাতি’)।২। এই সনদের অন্তর্ভূক্ত কোন গোত্র শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে সবার সমবেত শক্তি নিয়ে তা প্রতিহত করতেহবে।
৩। কেউ কোরাইশদের সাথে কোনো রকমের গোপন সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হতে পারবে না ও কোরাইশদের কে কোন সামরিক দিক দিয়ে সাহায্য করবে না।
৪। মদিনা আক্রান্ত হলে দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্যে সবাই মিলে যুদ্ধ করবে এবং সম্প্রদায়গুলো নিজেদের যুদ্ধ ব্যয় নিজেরা বহন করবে।
৫। ইহুদী-মুসলিম সহ চুক্তিবদ্ধ সকল সম্প্রদায় স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্মকর্ম পালন করবে, কেউ কারুর ধর্ম-স্বাধীনতায়
মদিনার সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলে চুক্তি/সন্ধি অনুসারে সব ইহুদী গোত্র প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল যে তারা মুসলমানদের কোন শত্রুকে কোনরকম সাহায্য সহযোগিতা করবেনা। কোন বহিঃশত্রু মদিনা আক্রমণ করলে তারাও মুসলমানদের মতো স্বদেশ রক্ষার্থে নিজেদের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করবে। কিন্তু সন্ধির শর্ত ও মদীনার স্বাধীনতা ও সম্মানকে উপেক্ষা করে বনু কুরাইযা সহ বাকী ইহুদী গোত্র একাধিকবার কোরাইশদের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।
ইহুদীদের বনু কাইনুকা এই গোত্রটি পেশায় ছিলো কর্মকার, স্বর্ণকার ও থালা বাটি নির্মাতা। বদর যুদ্ধের কিছুদিন পরেই তাদের বাজারে এক মুসলিম মেয়ে এক ইহুদী স্বর্নের দোকানে একটি কাজে গিয়েছিল। ঐ মুসলিম মহিলা যখন বনু কায়নুকা গোত্রের ঐ স্বর্ণের দোকানে গিয়েছিলেন তখন ঐ ইহুদী কর্মচারী ঐ মুসলিম মহিলার মুখ খুলতে বলে। কিন্তু ঐ মুসলিম মহিলা উনার মুখ খুলতে রাজী না হওয়ায় ঐ মুসলিম মহিলাটি যখন ঐ ইহুদী স্বর্নের দোকানের একটি চেয়ারে বসে তারপর ঐ ইহুদী কর্মচারী ঐ মুসলিম মেয়েটির পোশাকে পেরেক মেরে চেয়ারের সাথে আটকে দিলে, উঠতে গিয়ে ঐ মুসলিম মেয়েটির জামা ছিঁড়ে উনার সারা শরীর অনাবৃত হয়ে যায়। মুসলিম মেয়েটির আর্তনাদ শুনে এক মুসলিম পথচারী এটা দেখে খেপে গিয়ে ঐ ইহুদী কর্মচারীকে কতল করলে, তারপর ইহুদী কর্মচারীর পক্ষের লোকেরা সবাই মিলে ঐ মুসলমানকে হত্যা করে ফেলে। এরপর রাসূল (সাঃ) বনু কাইনুকা গোত্র কে অবরোধ করলে তারা ১৫ দিন পর মুসলমানদের নিকট আত্মসমর্পন করে। রাসূল (সাঃ) বনু কাইনুকা গোত্রের সকল ইহুদীকে এই শর্তে ক্ষমা করে দেন যে তারা মদীনা থেকে বের হয়ে অন্যত্র চলে যাবে। যদিও বনু কায়নুকা গোত্র তাদের বিদ্রোহ ও প্রতিজ্ঞা ভঙ্গের কারনে তাদের কিতাব তাওরাত অনুযায়ী মৃত্যুদন্ডের অপেক্ষা করছিল কিন্তু শুধুমাত্র রাসুল(সাঃ) মহানুভবতার কারনেই বনু কায়নুকা গোত্র নিরাপদে ইয়াসরিব (মদীনা) ত্যাগ করতে পারে। রাসূল (সাঃ) মদীনায় আসার পর মদীনার নাম হয় মদীনাতুর রাসূল বা রাসূলের শহর মদীনা।
বনু নাদের ছিলো মদীনার ইহুদীদের মাঝে সবচেয়ে বড় গোত্র। তাদের মূল ব্যবসা ছিলো খেজুর উৎপাদন। একটা সংঘর্ষে মুসলমান এবং ইহুদি বনু নাদের গোত্রের উভয়পক্ষের লোকজনের দ্বারা বনু কেলাব গোত্রের দুইজনের নিহত হবার ঘটনায় ক্ষতিপূরণের একটা অংশ বনু নাদেরেরও বহন করা উচিৎ এই দাবী নিয়ে রাসূল(সাঃ) বনু নাদির গোত্রের গোত্র পতিদের কাছে আলোচনা করার জন্য গেলে বনু নাদের গোত্রের লোকজন রাসূল (সাঃ) কে বলে আপনি কিছুক্ষন অপেক্ষা করুন, আমরা নিজেরা আলোচনা করে তারপর আপনাকে জানাচ্ছি। রাসূল (সাঃ) তখন তাদের একটি ঘরের দেওয়াল সংলগ্ন জায়গায় বসে ছিলেন। সেই সময় বনু নাদির গোত্রের ইহুদীরা ঐ ঘরের ছাদ থেকে একটি বড় পাথর ফেলে রাসূল (সাঃ) কে হত্যা করার পরিকল্পনা করে। ঠিক সেই সময় হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সাল্লাম রাসূল (সাঃ) কে বনু নাদীর গোত্রের এই পরিকল্পনা জানিয়ে দেয়। রাসূল (সাঃ) সাথে সাথে সেখান থেকে উঠে গিয়ে পরে মদীনায় চলে যান। তারপর একটানা ৬ দিন ৬ রাত অবরোধ করে রাখার পর বনু নাদিরা গোত্রের ইহুদীরা রাসূল (সাঃ) এর কাছে ক্ষমা চায়। বনু কায়নুকা গোত্রের মত বনু নাদিরা গোত্রের সকল ইহুদীদেরকে রাসূল (সাঃ) এই শর্তে ক্ষমা করে দেন যে তারা মদীনা থেকে বের হয়ে অন্যত্র চলে যাবে। বনু নাদিরের এই ঘটনাটি ৪র্থ হিজরির রবিউল আউয়াল মাস মোতাবেক ৬২৫ খৃষ্টাব্দের ৪ আগস্ট সংঘটিত হয়েছিল। বনু নাদিরার ঘটনার পুরা বর্ননা সূরা হাশরে রয়েছে।
নিজেদের বাস্তুভিটা ত্যাগ করে যাওয়ার সময় এই ২ টি ইহুদী গোত্রের মধ্যে ২ টি বিষয় ঘুরপাক খাচ্ছিল। তারা কি মুসলমানদের উপর কোন প্রকার প্রতিশোধ নেয়া ছাড়াই তাদের পূর্ব পুরুষের জন্মভূমি বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে চলে যাবে, না যে করেই হোক আরব গোত্রগুলোকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহন করবে। ইহুদীরা শেষোক্ত বিষয়টি বেছে নেয়। আর এ ব্যাপারে বনূ নাযীরই ছিল অগ্রগ্রামী। মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুরাইশদের উত্তেজিত করার উদ্দেশ্যে বনু নাযিররা তাদের একটি প্রতিনিধিদল মক্কায় পাঠায়। এই প্রতিনিধিদলে বনূ নাযীর গোত্রের হুয়াই ইবনে আখতাব ছিলেন। মক্কাবাসীরা হুয়াই ইবনে আখতাবকে বনূ নাযীরের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জিজ্ঞাস করে। হুয়াই বলল, ” আমরা মদীনা ও খায়বারের মাঝখানে শিবির স্থাপন করে তোমাদের পথ চেয়ে তাকিয়ে আছে। তারা তোমাদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে হযরত মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীদের উপর আক্রমন করার জন্য অধীরভাবে প্রতিক্ষা করছে। এরপর কুরাইশরা বনু কোরায়জা সম্পর্কে জিজ্ঞাস করলে হুয়াই ইবনে আখতাব বলেন বনু কোরায়জা এখনো মদীনায় অবস্থান করছে। তারা সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে। হুয়াই ইবনে আখতাবের নেতৃত্ত্বে ইহুদী প্রতিনিধিদল কুরাইশ ছাড়াও আরবের অন্যান্য গোত্রকেও মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য উত্তেজিত করে তুলে। ইহুদীরা প্রতিটা গোত্রে এ ব্যাপারে প্রচারাভিযান চালায়। এসব গোত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বনু গাতফান বনু মুররাহ, বনু ফাযারাহ গোত্র। বিশেষ করে যেইসব গোত্রের কোন লোক মুসলমানদের হাতে নিহত হয়েছিল, ইহুদীরা সেইসব গোত্রকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবার জন্য খুব উত্তেজিত করে তোলে। মক্কায় বনু নাযীরের এই প্রচারাভিযান অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়। চারিদিকে রণ-দামামা বেজে উঠে। কুরাইশরা ছাড়াও মক্কার আর অন্যান্য যেইসব গোত্র খন্দকের যুদ্ধ করার জন্য মদীনা অভিমুখে আসে তারা হল ফাযারা, আশজা ও মুররা, বনী সাআদ ও বনী আসাদ। মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য কাফেররা চারদিক থেকে দলে দলে বেরিয়ে পড়ে। মক্কা থেকে আবু সুফিয়ান ৪০০০ সৈন্য নিয়ে বের হন। তাতে ৩০০ সৈন্য ছিল অশ্বারোহী। দ্রুতগামী উট ছিল দের হাজার।
মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সম্মিলিত কাফির বাহিনীর সংখ্যা ছিল প্রায় দশ হাজার। তাদের প্রধান সেনাপতি নির্বাচিত হন আবূ সুফিয়ান। মধীনার মুসলমানরা তাদের বিরুদ্ধে এই বিরাট বাহিনী এগিয়ে আসার খবর পায়। মুসলমানরা পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, এবার খোলা ময়দানে যাওয়া যাবে না। শহরে থেকেই প্রতিরোধ করতে হবে। হযরত সালমান ফার্সী (রাঃ) এমন কিছু রণকৌশল জানতেন যার সাথে আরবরা সম্পৃর্ণ অপরিচিত ছিল। মুসলমানদের এই নাযুক পরিস্থিতিতে তিনি পরামর্শ দিলেন, আভ্যন্তরীণ শক্তি সুসংহত করে শহরের চারদিকে খন্দক বা পরিখা খনন করতে হবে। হযরত সালমান ফার্সীর পরামর্শ অনুযায়ী পরিখা খনন করা শুরু হয়। রাসূল (সাঃ) তাতে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনিও মাটিভর্তি টুকরী বহন করতেন। এই দৃশ্য সাহাবীদের পরিখা খননে সীমাহীন প্রেরণার সঞ্ঝার করে। ইহুদী বনূ কোরায়যা গোত্র তখনো মদীনায় অবস্থান করছিল। তাদের সাথে মুসলমানদের মৈত্রী চুক্তি তখনো বলবত ছিল। বনু কোরায়জার নিকট পরীখা খনন করার জন্য কোদাল শাবল টুকরী প্রভৃতি মাটি কাটার উপকরণ সংগ্রহ করা হয়। ৬ দিনে পরিখা খনন সম্পন্ন হয়। যেসব বাড়ি শত্রুর আক্রমণের আওতায় ছিল, এ সময় সেগুলো মেরামত করা হয়। নারী ও শিশুদের সংক্ষিপ্ত ও নিরাপদ এক বাসস্থানে স্থানান্তরিত করা হয়। প্রয়োজনের সময় শত্রুর উপর পাথর নিক্ষেপ করার জন্য পরিখার ভিতর প্রান্তে অঢেল পাথরের টুকরো জমা করে রাখা হয়। কুরাইশরা মক্কা থেকে বের হওয়ার সময় এই আশা নিয়ে এসেছিল যে, গত যুদ্ধের মতো এবারও উহুদেই বোঝাপড়া হবে। এই আশায় তারা উহুদ ময়দানে এসে শিবির স্থাপন করে। সেখানে কাউকে দেখতে না পেয়ে অবশেষে তারা মদীনার দিকে অগ্রসর হয়। মদীনার উপকন্ঠে এসে পরিখা দেখে তারা বিস্মিত হয়ে পড়ে। এই রণকৌশলের সাথে তারা সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিল। তারা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে এবং বলতে থাকে, ” এটা কি যুদ্ধের কোন পদ্ধতি হলো ? এ তো কাপুরুষতা ছাড়া আর কিছুই নয়। ” কুরাইশ ও তার সহযোগীরা ভাবল, পরীখা অতিক্রম করা হবে মৃত্যুর নামান্তর। তারা পরিখা অতিক্রম করার দুঃসাহস না করে তীর নিক্ষেপ শুরু করল। মুসলমানরাও তীর বর্ষণের মাধ্যমে প্রতি-উত্তর দেয়া আরম্ভ করল। সে সময় মদীনায় প্রচন্ড শীত পড়েছিল। সেই সঙ্গে ছিল রক্ত জমাট করে দেওয়ার মত কনকনে বাতাস। তার উপর বৃষ্টিপাতের আশংকা। কাফেরদের প্রতিটা লোক মনে করছিল, তাদের মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসছে। কুরাইশ ও বনু গাতফানরা নিজেদের বাড়িঘরে এ ধরনের তীব্র শীত সহ্য করতে পারত। কিন্তু মদীনার মুক্ত প্রান্তরে সামান্য তাঁবুতে এরুপ তীব্র শীত সহ্য করা তাদের পক্ষে কিছুতেই সম্ভবপর ছিল না। তারা ভাবছিল, এরুপ হাড়-কাঁপানো শীতের মধ্যে যদি আবার বৃষ্টিপাত হয়, তাহলে মদীনার এসব তাঁবুতে তারা কিছুতেই বাঁচতে পারবে না। মৃত্যু তাদের অবধারিত। এইসব যুদ্ধবাজ কুরাইশ এই আশা নিয়ে এসেছিল যে, উহুদের মত একই দিনে যুদ্ধ জয় করে ফেলবে। এরপর নিহত মুসলমানদের মাল-সামান নিয়ে বিজয়ের গান গাইতে গাইতে নিজেদের বাড়িঘরে ফিরে যাবে। বনূ নাযীর গোত্রের ইহুদীরা বনূ গাতফানদের সাথে এই ওয়াদা করেছিল, যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারলে খায়বারের বাগানগুলোর এক মওসুমের পুরো ফল তাদেরকে দেওয়া হবে। একদিকে ছিল এইসব পাওয়ার আশা, অপরদিকে সামনে ছিল পরিখা। কাফেররা কিছুতেই এই পরিখা অতিক্রম করার সাহস পাচ্ছিল না। কাফেররা তাদের ব্যর্থতা সম্পর্কে অনেকটা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। বনূ নাযীররা আশংকা করছিল, কুরাইশরা যদি শীতের দাপটে অতিষ্ঠ হয়ে মক্কায় চলে যায় তাইলে আমাদের কি অবস্থা দাঁড়াবে। ঠিক সেই সময়ে বনূ নাযীর গোত্রের ইহূদী নেতা হুয়াই ইবনে আখতাব তার শেষ চালটি চালে। সে আরব বাহিনীকে বলে, মদীনায় বসবাসরত বনূ কোরায়যা গোত্রকে আমি মুসলমানদের সাথে চুক্তি ভংগ করার জন্য সম্মত করার চেষ্টা করছি। হুয়াই ইবনে আখতাবের এই পরিকল্পনার কথা শুনে কুরাইশ ও বনু গাতফানরা অত্যন্ত উল্লেসিত হয়ে উঠে। মদীনায় বনূ কোরায়যাদের নেতা ছিল কাব ইবনে আসাদ। হুয়াইয়ের এই পরিকল্পনার কথা কাআব ও শুনতে পায়। হুয়াই ইবনে আখতাব তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য কাআবের নিকট রওয়ানা দেয়। কিন্তু হুয়াইয়ের পৌঁছার আগেই কাআব তার দূর্গের দরজা বন্ধ করে দেয়। হুয়াই ইবনে আখতাবের পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত কাআবকে তার দূর্গের দরজা খুলতে হয়। হুয়াই বলে, ” হে কাআব তোমার কি হয়েছে ! আমি সারা আরবের প্রখ্যাত লোকদের কে একত্র করেছি। তারা চুক্তি করে এসেছে মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীদের পর্যুদস্ত না করা পর্যন্ত এক পাও পিছে হটবে না। কিন্তু কাআব তখনো দ্বিধা দ্বন্দে ছিল। তখন হুয়াই বলল যদি পরিখাটি আমাদের সামনে প্রতিবন্ধক না হতো, তাইলে কবেই না আমরা মুসলমানদের কে গুঁড়িয়ে ফেলতাম ! ” হুয়াই ইবনে আখতাবের এসব কথায় কাআব অনেকটা প্রভাবিত হয়ে পড়ে। সে হুয়াইকে বললো, ” হানাদার বাহিনী ব্যর্থতাবরণ করে ফিরে গেলে আমাদের নিরাপত্তার কি ব্যবস্থা হবে ? জবাবে হুয়াই বললো, ” এরূপ পরিস্থিতির উদ্ভব হলে আমরাও তোমাদের দূর্গে এসে অবস্থান গ্রহণ করবো। তোমাদের সাথে সুখে- দুঃখে শরীক হবো। ” এবার কাআবের মধ্যে বিশ্বাসঘাতকতার ইহূদী মনোভাব মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। সে তার ইহুদী ভাই হুয়াই ইবনে আখতাবের হাতে হাত রেখে মুসলমানদের সাথে সম্পাদিত চুক্তিভঙ্গের কথা ঘোষণা করে। বনূ কোরায়জাদের চুক্তিভঙ্গ মহানবীকে বেশ ভাবিয়ে তোলে। হুয়াই ও কাআবের মধ্যে যে চুক্তি সম্পাদিত হয়, তাতে বনূ কোরায়যারা আরব গোত্রগুলির নিকট দশ দিন সময় চেয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, এ সময়ের মধ্যে তারা যুদ্ধের জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করে তুলবে। কিন্তু তাতে শর্ত আরোপ করা হয়েছিল, আরব বাহিনী এই সময়ে মুসলমানদের উপর আঘাত হানবে এবং তা অব্যাহত রাখবে। কাফেররা মুসলমানদের উপর আঘাত হানার জন্য তাদের বাহিনীকে ৩ ভাগে বিভক্ত করে। মদীনায় অবরুদ্ধ মুসলমানদের চরম বিপদ চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। সাহাবীরা বনূ কোরায়যাদের চুক্তিভঙ্গের কারণে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হচ্ছিলেন। তারা দাঁতে দাঁত কামড়ে বলছিলেন, ” হে ইহুদীগণ ! তোমাদের উপর আল্লাহর গযব পড়ুক। মহানবী যদি বনূ নাযীরদের নির্বাসন না দিয়ে হত্যা করে ফেলতেন, তাহলে আজ আমাদের এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখতে হতো না। হে হুয়াই ইবনে আখতাব, মহানবী তোমাকে জীবিত ছেড়ে দিয়েছিলেন, যার জন্য তুমি আজ কুরাইশ ও আরব গোত্রগুলিকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছ। যে ভূমিতে মুসলমানরা আজ পরিখা খনন করে নিজেদের আত্মরক্ষায় লিপ্ত, মদীনার সে স্থানটিতে যদি হুয়াই ইবনে আখতাব ও তার সঙ্গীদের রক্ত বইয়ে দেয়া হতো, তাহলে সেখানে মুসলমানদের রক্ত বওয়ার কোন উদ্যোগই অবশিষ্ট থাকত না। এই বিরাট বিপদ থেকে একমাত্র আল্লাহর সাহায্যই আমাদের কে রক্ষা করতে পারে। এর ২ রাত পরেই বনূ কোরায়যার ইহুদী যুবকরা বাসস্থান থেকে বেরিয়ে মদীনা শহরে ঘোরাফেরা শুরু করে।
মদীনায় তখন পুরুষ সাহাবী ছিল শুধু হাসসান বিন সাবেত (রাঃ)। ঠিক এমন একটি কঠিন মুহূর্তে বনী কুরায়জা গোত্রের প্রধান সর্দার ইহুদী কাব ইবনে আসাদ মক্কার কাফেরদের মিত্র বনী নাযীরের সর্দার হুয়াই ইবনে আখতাবের প্ররোচনায় মদীনা সনদ ভঙ্গ করে। রাসুল (সাঃ) যখন ওহীর মাধ্যমে এ খবর পান তখন বনী কুরায়জা গোত্রের সর্বশেষ অবস্থা জানার জন্য হযরত সাদ ইবনে মুয়ায (রাঃ), হযরত সাদ ইবনে উবাদা (রাঃ) এবং আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রাঃ) কে বনী কুরায়জা গোত্রের কাছে প্রেরন করলেন এবং বলে দিলেন যদি চুক্তি ভঙ্গের কথা সত্য হয় তাইলে ইশারা ইঙ্গিতে আমাকে কথাটা বলবে যাতে অন্যরা চুক্তি ভঙ্গের কথা জানতে না পারে। আর যদি তারা চুক্তিতে অটল থাকার ইচ্ছা পোষন করে তাইলে খুলাখুলি সব কথা বর্ণনা করতে কোন বাধা নাই। কারন রাসুল (রাঃ) খুব ভয় পাচ্ছিলেন যে মদীনা এখন অরক্ষিত। যদি সবাই জানতে পারে যে বনী কোরাইজা গোত্র মদীনা সনদ ভঙ্গ করে ফেলেছে আর এখন পিছন থেকে আক্রমন করবে এবং আমাদের নারী ও শিশুদের কে অপহরন করবে তাইলে যুদ্ধের মোড় পরিবর্তন হয়ে যাবে। সাহাবীরা খন্দকের যুদ্ধ পরিত্যাগ করে এখন তাদের ঘরে ফিরে যেতে চাইবে। যাই হোক ঐ ৩ জন সাহাবী বনী কোরায়জা গোত্রের সর্দার কাব ইবনে আসাদের কাছে গেল এবং তাকে চুক্তির ব্যাপারে স্মরন করিয়ে দিল। কাব তখন বলে চুক্তি কিসের আর মোহাম্মদ কে? আমরা তাকে চিনি না। আমরা কোনো সন্ধিপত্রের ধার ধারি না। তোমরা চলে যাও।” সাহাবীরা ফিরে এসে রাসুল (সাঃ) এর কাছে শুধু বলল “আযল ওয়া কারা ” অর্থ্যাৎ আযল ও কারা নামক গোত্রদ্বয় যেমন সাহাবী হযরত খুবায়ের (রাঃ) এর সাথে গাদ্দারী করে উনাকে হত্যা করেছিল ঠিক তেমনি বনী কোরায়জা গোত্রের ইহুদীরাও মদীনা সনদ ভঙ্গ করে ফেলেছে। কিন্তু এই চুক্তি ভঙ্গের খবরটি বেশিক্ষন গোপন থাকল না। মুনাফিকরা তা শুনে যুদ্ধ পরিত্যাগ করে মদীনা ফিরে যেতে চাইল। রাসুল (সাঃ) মদীনার সকল নারী ও শিশুদের কে একটি দূর্গে নিরাপদে রেখে এসেছিলেন। বনী কোরায়জা গোত্রের এক ইহুদী দূর্গের আশপাশে ঘোরাফেরা করছিল। তখন রাসুল (সাঃ) এর ফুফু হযরত সাফিয়া (রাঃ) গোপনে একটি কাঠের টুকরা এনে ঐ ইহুদীর মাথায় এত জোরে আঘাত করলেন যে ইহুদীটা ঐখানেই মারা যায়। অবস্থা তখন এত নাযুক পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে রাসুল (সাঃ) কুরাইশদের মিত্র বনী গাতফান গোত্রের ২ সর্দার উয়াইনা ইবনে হাসান ও হারিস ইবনে আউফের সাথে এ শর্তে সন্ধি করতে চাইলেন যে মদীনার বাগান সমূহে উৎপন্ন ১/
২৫ দিন পর যখন খানাপিনা শেষ হয়ে যায় তখন বনু কোরাইজা গোত্র রাসুল (সাঃ) এর কাছে প্রস্তাব দেয় তাদের মিত্র আওস গোত্রের হযরত সাদ ইবনে মুয়ায (রাঃ) যে ফয়সালা করবেন তাতেই তারা সম্মত আছে। হযরত সাদ ইবনে মুয়ায (রাঃ) ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাতের বিধান মতে যুদ্ধকালীন চুক্তি ভঙ্গের অপরাধে সকল পুরুষ ইহুদিকে হত্যা করা এবং ইহুদি নারীদের কে দাসী হিসাবে বন্দি করা হোক এই রায় দেন। রাসুল (সাঃ) তখন বললেন নিঃসন্দেহে তুমি সঠিক ফয়সালা করেছ। কারন বনূ কোরায়যারা হানাদার কাফের বাহিনীকে মদীনায় ঢোকার পথ করে দিচ্ছিল। যদি কুরাইশ ও গাতফানদের সাথে বনূ কোরায়যাদের মতবিরোধ না হতো, তাহলে তারা নিশ্চয়ই শত্রুদের পথ দেখিয়ে শহরে নিয়ে আসত। আর তখন মুসলমানদের ধবংস ছিল অবধারিত। যদি বনূ কোরায়যারা কামিয়াব হতো, তাহলে এখন মদীনায় একজন মুসলমানকেও খুঁজে পাওয়া যেতো না। এক এক করে প্রত্যেক মুসলমানকে হত্যা করা হতো। এমনকি তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পর্যন্ত বিকৃত করা হতো।
তাওরাত ও ইঞ্জিলের লেখা নিয়ম অনুযায়ী তাদের হত্যার নির্দেশ দেয়া হয়। তাওরাতের ১১-১৩ আয়াতে বলা আছে: “যখন তুমি কোন নগরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতে তাহার নিকটে উপস্থিত হবে, তখন তাহার কাছে সন্ধির কথা ঘোষনা করিবে। তাহাতে যদি সে সন্ধি করিতে সম্মত হইয়া তোমার জন্য দ্বার খুলিয়া দেয় তবে সেই নগরে যে সমস্ত লোক পাওয়া যাবে তাহারা তোমাকে কর দিবে ও তোমার দাস হইবে। কিন্তু যদি সে সন্ধি না করিয়ে তোমার সহিত যুদ্ধ করে, তবে তুমি সেই নগর অবরোধ করিবে। পরে তোমার ঈশ্বর সদাপ্রভু তাহা তোমার হস্তগত করিলে তুমি তাহার সমস্ত পুরুষদের কে খড়গধারে আঘাত করিবে; কিন্তু স্ত্রীলোক, বালক-বালিকা ও পশু প্রভূতি নগরের সর্বস্ব, সমস্ত লুট দ্রব্য আপনার জন্য লুটস্বরুপ গ্রহন করিবে আর তোমার ঈশ্বর প্রদত্ত শত্রুদের লুট ভোগ করিবে” (দ্বিতীয় বিবরণ, অধ্যায় ২০, আয়াত ১০-১৪, পবিত্র বাইবেল, বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি, ঢাকা)
এরপরে বনু কোরাইজা গোত্রের ৪০০ পুরুষ ব্যক্তিকে একই দিনে হত্যা করা হয় এবং নারী ও তাদের সন্তানদের কে দাসি হিসাবে বন্দি করা হয়। বনু কোরাইজা গোত্রের সর্দার কাব ইবনে আসাদ তার মৃত্যুর পূর্বে বলেন – “ বনী ইসরাইল গোত্র নবী ইয়াহিয়া (আঃ) এবং যাকারিয়া (আঃ) কে হত্যা করার শাস্তি আজ পেল। ” বানূ কোরায়যাদের দূর্গ থেকে সাহাবীরা ১৫০০ তলোয়ার, ২০০০ বর্শা, ৩০০ বর্ম এবং ৫০০ ঢাল পান। এগুলি বনূ কোরায়যারা মুসলমানদেরকে হত্যা করার জন্য রেখেছিল। বনূ কোরায়যা গোত্রের ইহুদীদের মাঝে ৪ জন ইসলাম ধর্ম গ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করেন। রাসুল (সাঃ) তাদেরকে ক্ষমা করেন এবং তাদের পরিবার-পরিজন সুরক্ষিত থাকে। বনূ কোরায়যাদের ধন সম্পদ থেকে এক পঞ্চমাংশ রাসুল (সাঃ) নিজের জন্য রেখে বাদবাকী সাহাবীদের মাঝে বন্টন করে দেন। বনূ কোরায়যাদের নারী ও শিশুদের কে যুদ্ধবন্দী হিসাবে নজদ এলাকার অধিবাসীদের কাছে বিক্রি করে দিয়ে সেই অর্থ দিয়ে ঘোড়া ও অস্ত্রশস্ত্র কিনে আনা হয়। খন্দকের যুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে কোন জয় পরাজয়ের যুদ্ধ ছিল না। এ যুদ্ধটা ছিল একটা সিদ্ধান্তমূলক যুদ্ধ। এ যুদ্ধে কাফেরদের মনোবল সম্পূর্ণ ভেঙ্গে গিয়ে স্পষ্ট হয়ে পড়েছিলো আরবের কোন শক্তিই মদীনার বিকাশমান শক্তিকে পরাজিত করতে পারবে না।
বনী কোরাইজা গোত্রের প্রতি এই কঠোর আচরনের ফলে মদীনার অন্যান্য ইহুদীরা আর কোনদিন ইসলামের সাথে শত্রুতা করার সাহস পায়নি। আর যদি এই কঠোর সিদ্ধান্ত রাসুল (সাঃ) ঐ সময়ে না নিতেন তাইলে মদীনার অন্যান্য ইহুদী গোত্ররাও সময় সুযোগ মত আবার মুসলমানদের পিছন থেকে ছুড়ি মারার চেষ্টা করত। বনু কোরায়জা গোত্রের প্রতি তাওরাতের বিধান মতে এই কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারনে আর কোনদিন মদীনার ইহুদীরা বাড়াবাড়ি করার সাহস পায়নি। আরব উপদ্বীপে শিশু ইসলামকে টিকিয়ে রাখতে বনী কোরাইজা গোত্রের সাথে এই কঠোর আচরন করতে রাসুল (সাঃ) বাধ্য হয়েছিলেন। মদীনা থেকে ইহুদীদের নির্বাসন ও নির্মূল করার পর মুসলমানদের শান্তিপূর্ণ জীবন যাপনের নব দিগন্ত উন্মোচিত হয়। খন্দকের যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ও বনূ কোরায়যাদের নির্মূল করার পর সাহাবীদের জীবনে বেশ প্রশান্তি নেমে আসে। বিভিন্ন আরব গোত্র ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। বনু কোরায়জা গোত্রের ইহুদীরা যদি রাসূল (সাঃ) কে বলত যে আপনি আপনার ইচ্ছামত আমাদের প্রতি আচরণ করেন তাইলে কিন্তু রাসূল (সাঃ) ঠিকই বনু কোরায়জা গোত্রের সকল ইহুদীদেরকেই ক্ষমা করে দিতেন।