মরুর ফুল ১৯
মাদায়েনে আসার পর মেহরিন এই প্রথম বাড়ীর বাইরে বের হল, উদ্দেশ্য রাজ প্রাসাদ। মেহরিনের মা এবার মাদায়েনে আসার পরে কয়েকবার প্রাসাদে গিয়েছে। বড় হওয়ার পরে মেহরিন এই প্রথম রাজ প্রাসাদে এসেছে। এর আগে ছোট কালে যখন মাদায়েনে থাকত তখন নিয়মিত আসত। অবশ্য তখন রাজ প্রাসাদ কী জিনিস সেটা সে বুঝত না। অনেকদিন পরে প্রাসাদে এসে প্রাসাদের চাক চিক্য দেখে সে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। অনেক দূর থেকেই প্রাসাদের মিনার দেখা যায়, যেটা ইরানীদের গর্ব। প্রাসাদে ঢোকার মুহুর্তে ইরানী অগ্নিপূজারীদের পবিত্র আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। মায়ের সাথে মেহরিন প্রাসাদে প্রবেশ করল। বিশাল প্রাসাদের সামনে বিশাল বাগান। আশে পাশে রাজ কর্ম চারীদের অফিস। রাজকীয় সেনা কর্মকর্তাদের অনেকের বাসা ভিতরে। সেগুলোও দেখার মত। মেহরিন ভাবছে এত দামী দামী বাসা থাকতে তারা কেন এতদিন আরবের একটা গ্রামে অবস্থা করেছে? প্রাসাদের সদর দরজা থেকে মূল প্রাসাদে হেঁটে যেতে অনেক সময় লাগে। প্রাসাদের ভিতরে রাজ পরিবারের লোকজন ও গুরুত্বপুর্ণ কয়েকজন লোক ছাড়া আর কারো ঘোড়ায় চড়ার অনুমতি নেই। প্রাসাদের ও রাজ পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে এই ব্যবস্থা! হাঁটতে হাঁটতে মেহরিন ও তার মা যখন প্রাসাদে প্রবেশ করতে যাবে তখন এক ঘোড় সওয়ার মেহরিনের পাশ দিয়ে গেল। লোকটি যাওয়ার সময় পেছনে ফিরে মেহরিনের দিকে তাকাল। কিছু দূর গিয়ে সে ঘোড়া থামাল। বোঝা গেল সে মেহরিনের আসার অপেক্ষা করছে। মেহরিন সাবধানী হয়ে হেঁটে সামনে এগোল। মেহরিনের মা সামনে এগিয়ে রয়েছে, মেহরিন পিছনে।“আপনাদের পরিচয়?” মেহরিনের দিকে আড় চোখে চেয়ে খালেকদুনের স্ত্রীকে প্রশ্ন করলেন সেই লোক। চেহারা ও বেশ ভুষা দেখে মনে হয় এই লোক রাজ পরিবারের গুরুত্বপুর্ণ কেউ হবে।
মেহরিনের মনে হল এই লোক মেহরিনকে একা পেলে কী করত তা ভেবে… লোকটির চাহনি ভাল ঠেকছে না।
“আমি ইরান সেনাপতির স্ত্রী। আপনি?” খালেকদুনের স্ত্রীও লোকটির সম্মন্ধে ইতিমধ্যে খারাপ ধারনা করে ফেলেছে। তাই একটু কড়া ভাষায় বলল।
“আপনার স্বামী যার গোলামী করছে আমি সেই সম্রাটের ছেলে ফররুখ” ঘোড়া ঘুরিয়ে সে সামনে এগোল। যেতে যেতে বলল “রাজ প্রাসাদে স্বাগতম। আবার দেখা হবে।” কিছুদূর এগিয়ে আবার মেহরিনের দিকে শকুনের দৃষ্টিতে তাকাল।
প্রাসাদে ঢুকে মেহরিন ও তার মা সরাসরি রাণি শিরির দরবারে প্রবেশ করলেন। কিন্তু ঐদিকে শোরগোল শুরু হয়ে গেছে। কিছুক্ষন আগে দূত খবর নিয়ে এসেছে গুরুত্বপূর্ণ ইরানী শহর আরমিয়ার পতন হয়েছে। রোমান বাহিনী তাদের পবিত্র অগ্নি নিভিয়ে ফেলেছে। আরমিয়া ছিল জরদশতের জন্মস্থান যিনি ছিলেন মূলত অগ্নিপূজারীদের নেতা। তার জন্ম যিশু খ্রিস্টের আগে হয়েছিল। খ্রিস্টান ইহুদীদের কাছে জেরুজালেমের যে মর্যাদা ঠিক তেমনি ইরানীদের কাছে আরমিয়ার সেই রকম মর্যাদা রয়েছে। আরমিয়া পতনের পরে পুরো ইরানে শোকের ছায়া নেমে গেল। বিশেষ করে সেনাবাহিনীর যে আত্মবিশ্বাস ছিল তা মুহুর্তেই কর্পূরের মত উবে গেল। কয়দিন আগে যে সেনাবাহিনীর ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দাম্ভিক সেই সেনাবাহিনীর আত্মবিশ্বাস এখন অনেক কম। আরমিয়ার পতনের পরে সম্রাট জরুরী মিটিং ডাকলেন। মেহরিনরা যেই সময়ে রাজ প্রাসাদে প্রবেশ করেছে ঠিক সেই সময়ে দরবার শুরু হল। রাণি শিরিও সেখানে উপস্থিত ছিল। সভায় অনেক আলোচনা সমালোচনা হল। অনেকে সেনা অফিসারদের দায়ী করলেন। অনেকে নতুন সেনা মোতায়েনের পরামর্শ দিলেন। সুযোগ পেয়ে পরবর্তী প্রধান উজির পদের অন্যতম দাবীবার হামিদ সম্রাটকে বললেন “গোস্তাখী মাফ করলে হুজুরের কাছে একটা বিষয়ে কথা বলতাম। তবে ভয়ে মুখ খোলার সাহস করছি না।”
দরবারীদের সবার চোখ গেল হামিদের উপর। এই সেই হামিদ যাকে শাহজাদী বিলকিস প্রধান উজির হবার লোভ দেখিয়েছিল। সম্রাটের অনুমতি নিয়ে হামিদ বললেন “আমি ভেবে কুল পাচ্ছি না রোমানদের রাজধানী খালেকদুনের নেতৃত্বে অবরোধে থাকার পরেও কেন তিনি কনস্টেন্টিপোলে হামলা করছে না। রোমানদের রাজধাণী আক্রান্ত হলে দুনিয়ার সকল স্থান থেকে রোমান বাহিনী রাজধানী রক্ষায় ফিরে যেত। আর এই সুযোগে আমরা জেরুজালেম দখল করতাম। জেরুজালেম দখল করলে খ্রিস্টান রোমানদের মনোবল কমে যেত। এই মুহুর্তে খালেকদুনের অধীনে দুই লক্ষ সেনা বসফরাস প্রাণলীতে রয়েছে। আমি খালেদকদুনের ব্যর্থতা দেখতে পাচ্ছি।”
গোটা দরবার চুপসে গেল, সবাই সম্রাটের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সবাই জানে খালেকদুন সম্রাটের ছেলেবেলার বন্ধু। বন্ধুর বিরুদ্ধে কথা বলে কেউ নিজের মাথা হারাতে চাইবে না। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। আরমিয়ার পতনের পরে ইরান সম্রাট অনেক চাপে রয়েছে। এই মুহুর্তে ঘুরে দাঁড়াতে না পারলে সম্রাটে কপালে খারাবি আছে। কেউ এই অথর্ব সম্রাটকে ক্ষমতায় দেখতে চাইবে না। ইরান রাজ মুকুটের প্রতি ঘরে বাইরে যাদের লোভ রয়েছে তারা জনগনকে বিদ্রোহে উসে দিতে পারে। এছাড়া হামিদ মাদায়েন শহরের অনেক প্রভাবশালী বংশের নেতা। অন্য সময় হলে সম্রাট কিছু একটা করতেন কিন্তু এবার সম্রাট কিছুই বললেন না। উনি অন্য প্রসংস উঠিয়ে কথার মোড় ঘুরিয়ে ফেললেন। তবে সম্রাটের মনে কথাগুলো গেঁথে গেল। তার মনে হতে লাগল কিছুদিন আগে এক রাতে তার হেরেমের সবচেয়ে সুন্দরী দাসী সাবাহ খালেকদুনের স্ত্রী কণ্যার কথা বলেছিল। সত্যি কি খালেকদুন এখন মেয়ের বিয়ে নিয়ে ভাবছে? তার কি যুদ্ধের প্রতি মনযোগ নেই? দরবার শেষ হলে যে যার স্থানে চলে গেল। রাণি শিরি মুখ গম্ভবীর করে তার কামরায় গেলেন। সম্রাট দাসীদের বললেন “যুদ্ধ চলছে তো কী হয়েছে? নাচ গান বন্ধ কেন?” নর্তকীদের দল প্রস্তুত ছিল। তারা গানের সূরের সাথে তাল মিলিয়ে নাচা শুরু করল। সম্রাট মদের পেয়ালা হাতে নিলেন। দরবারে শাহজাদী বিলকিস প্রবেশ করে সম্রাটকে কুর্ণিশ করল।
“শুনেছি জাঁহাপনার মন খারাপ” যুদ্ধে হেরে গেলে পাগলেরও মন খারাপ থাকে। সম্রাট জিজ্ঞেস করল “কী বলবে?”
“আমি আপনাকে খালেকদুন সম্মন্ধে সাবধান করতে এসেছি”
---
শাহজাদা ফররুখ ছিল নারী লোভী। সম্রাট এ ধরনের ছেলেদের বেশি পছন্দ করতেন কারণ এদের দ্বারা সম্রাটের কোন ক্ষতি হবার সম্ভাবনা নেই। এদের ক্ষমতার প্রতি লোভ নেই, লোভ আছে শুধু নারীর প্রতি।
শাহজাদী বিলকিসের কামরা। তার সামনে সেনা গোয়েন্দা অফিসার দাঁড়িয়ে।
“আপনার জন্য একটা খবর আছে শাহজাদী”
“কী খবর?”
“খালেকদুনের স্ত্রী তার মেয়েকে নিয়ে আজ আগে মহলে প্রবেশ করেছিল”
“তার মানে সোহরাবও যে কোন সময় মহলে প্রবেশ করতে পারে”
“না, শাহজাদা সোহরাব আজ দরবারে উপস্থিত ছিলেন। ওনার উপরে নতুন সেনা রিক্রুটের দায়িত্ব দেয়া হয়। উনি দরবার শেষ করেই মহল থেকে বের হয়ে যান। তবে আপনাকে আরেকটা খবর দিতে পারি। শাহজাদা ফররুখ মেহরিনকে দেখেছে!”
বিলকিসের মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল। এবার খেলা জমবে। ফররুখে চরিত্র সম্মন্ধে পুরো মাদায়েনবাসী অবগত। সে যা চায় তা না এনে দিলে তোলপাড় করে দেয়। বিলকিস এবার নতুন চাল চালার সুযোগ পেল। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হবে। সে ফররুখের কামরায় গেল। কামরার ভেতর থেকে বন্ধ। বাইরে থেকে পাহারাদার জানাল বসরা থেকে এক নতুন সুন্দরী ইরাকী দাসী এসেছে। ফররুখ এখন সেই দাসীর সাথে ‘ব্যস্ত’ রয়েছে। পাহারাদারকে বিলকিসের সাথে ‘ব্যস্ততা’ শেষে দেখা করার কথা জানিয়ে বিলকিস তার কামরায় ফররুখের অপেক্কায় রইল। অনেক ক্ষন পরে ফররুখ এল “হঠাত তলব?”
“আমি কি হঠাত করেই ভাইয়ের খবর নেই?” এই কথাটা ফররুখ বিশ্বাস করল না। রাজ প্রাসাদে কোন কিছুর অভাব নেই। কেউ কোন উদ্দেশ্য ছাড়া কাউকে ডাকে না।
“তোমার তো বিয়ের বয়স হয়েছে। বিয়ে সাদী কি করবে না?”
“দুনিয়ায় এত কিছু থাকতে বিয়ের কথা কেন? এই তো বেশ আছি। বিয়ে করা মানে ঝামেলা। যুদ্ধের যে অবস্থা তাতে কখন যে কোন এলাকায় থাকতে হয়……
শাহজাদী বিলকিসের হা হা হো হো হাসির শব্দে ফররুখের কথা থেমে গেল “তুমি যুদ্ধে যাবে? তুমি কখনো সেনা প্রশিক্ষন নিয়েছ?” শাহজাদা ভ্যাবাচ্যাকা খেল। সে নারী আর মদ ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। ঐটাই তার কাছে যুদ্ধ।
“তোমার জন্য আমি একটা মেয়ে পছন্দ করেছি। তুমি যদি মত দাও তাহলে আমি এগোতে পারি।”
“না না আমি বিয়ে করব না। এই তো বেশ আছি।”
“শুনেছি খালেকদুনের একটা সুন্দরী মেয়ে আছে। তাকে বিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যেই মাদায়েনে আনা হয়েছে। কার কপালে যে এত সুন্দরী মেয়ে আছে? আমি অবশ্য তাকে দেখিনি। তবে ওর রূপের প্রশংসা শুনেছি।”
খালেকদুনের মেয়ের কথা শুনে ফররুখ থমকে গেল। আজ সকালে সে খালেকদুনের স্ত্রীকে মহলে দেখেছে। তার সাথে এক পরীর মত মেয়ে ছিল। দুই জনের চেহারা দেখেই বোঝা যায় এরা মা মেয়ে। ফররুখ জীবনে অনেক সুন্দরী মেয়ে দেখেছে। তার কাজই ছিল বিভিন্ন দেশ থেকে সুন্দরী নারী সংগ্রহ করা। কিন্তু জীবনে সে এত সুন্দরী মেয়ে দেখেনি। বিলকিসের কথায় ফররুখের চাহনি বদলে গেল। সে বলল “খালেকদুন বাবার বন্ধু না হলে আমি এই মেয়েকে আজই মহলে রেখে দিতাম। মাদায়েনে সুন্দরী মেয়ে থাকবে আর আমি……
“তুমি ভাল চিন্তা করছ না কেন? সে সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে। তার বাবা রাণি শিরির চাচাতো ভাই। এমনিতেই তাদের সাথে আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে। তুমি চাইলে তাকে বিয়ে করতে পার। আমি কি চেষ্টা করে দেখব?”
খালেকদুনের মেয়ের চেহারা তার চোখে ভাসতে লাগল। তার এটা মনে হল না যে শাহজাদী গত কয়েক বছরে তার খবর নেয় নি সে কেন আজ তাকে বিয়ে দিতে চাইছে।
শাহজাদা ফররুখ বলল “তুমি বিয়ের ব্যবস্থা করলে করতে পার। আমি খুশি হয়ে তাকে বিয়ে করব।”
Subscribe to:
Post Comments
(
Atom
)
No comments :
Post a Comment