মরুর ফুল ২০

ষষ্ঠ হিজরীর জমাদিউল উলায় অভিযান হযরত যায়েদ ইবনে হারেছার (রাঃ) নেতৃত্বে কোরাইশদের একটি বাণিজ্য কাফেলার মালামাল মুসলমানদের হাতে আসে। সেই কাফেলায় রাসূল (সাঃ) এর জামাতা হযরত আবুল আসের নেতৃত্বে সফর করছিলো। আবুল আস তখনো ইসলাম গ্রহণ করেননি। তাঁকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। তিনি দ্রুত পলায়ন করে মদীনা এসে স্ত্রী যয়নবের (রা) কাছে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এরপর নিজ স্ত্রীকে অনুরোধ করেন তিনি যেন তাঁর আব্বা রাসূল (সাঃ) কে বলে অধিকৃত কাফেলার মালামালগুলো ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করেন। হযরত যয়নব (রা) আব্বাকে স্বামীর অনুরোধের কথা জানান। হযরত যয়নব (রা)-এর অনুরোধের প্রেক্ষিতে রাসূল (সাঃ) সাহাবাদের মালামাল ফেরত দেয়ার ইঙ্গিত করেন। কোন চাপ সৃষ্টি করেননি। সাহাবায়ে কেরাম সব ধন-সম্পদ ফেরত দেন। এসব মালামালসহ আবুল আস মক্কায় চলে যান এবং কোরাইশদের সব মালামাল তাদের বুঝিয়ে দিয়ে পুনরায় মদীনায় এসে ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসূল (সাঃ) ইতিপূর্বেকার বিবাহ অনুযায়ীই হযরত যয়নবকে (রা) হযরত আবুল আসের হাতে তুলে দেন।
হযরত যায়েদ ইবনে হারেছার (রা) নেতৃত্বে জমাদিউস সানিতে তরফ বা তরক এলাকায় একটি দল পাঠানো হয়। এটি বনু ছালাবা এলাকায় অবস্থিত। হযরত যায়েদ (রা)-এর সাথে পনের জন সাহাবা ছিলেন। বেদুনরা খবর পেয়েই পালিয়ে যায়। তারা আশঙ্কা করছিলো যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আসছেন। হযরত যায়েদ (রা) চারটি উট অধিকার করেন এবং চারদিন পর মদীনায় ফিরে আসেন।
---
কিসরা সম্রাটের খাস কামরা। মদের সোরাহী হাতে দাসী দাঁড়িয়ে আছে। আজ মদও কেমন যেন বিশ্বাস লাগছে। যুদ্ধের পরিস্থিতি ওনার কাছে ভাল ঠেকছে না। এই মুহুর্তে যদি ইরানীরা পিছু হঠতে শুরু করে তাহলে ইতিহাসে তিনি ব্যার্থ সম্রাট হিসেবে চিহ্নিত হবেন। এর চেয়ে বড় কথা বিরোধীরা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহে জনগণকে উস্কে দিবে- কেউ ব্যর্থ সম্রাটকে চায় না। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে খালেকদুন কী করছে? সে কেন কনস্টেন্টিপোল হামলা করছে না? তবে কি দাসী সাবাহ এর কথা সত্যি? উজির হামিদ দরবারে যা বলেছেন তাও কি সত্যি? যদি সত্যিই হয়ে থাকে তাহলে তো গোটা ইরানের জন্য বিপদ। প্রহরী এসে খবর দিল ইয়েমেনের গভর্ণর খাজনা দেয়ার উদ্দেশ্যে মহলে হাজির, তিনি দেখা করতে চান। সম্রাট অনুমতি দিলেন।
ইয়েমেনের গভর্ণরকে আরবের অবস্থা জিজ্ঞেস করলেন। সম্রাট জিজ্ঞেস করলেন “আরবের এক লোক নাকি ইরানীদের বিরুদ্ধে ভবিষ্যৎ বাণী করেছে?”
ইয়েমেনের গভর্ণর বললেন “আমি যখন এই কথা শুনেছি তখন আমি কথাটা হেসে উড়িয়ে দিয়েছি। যে লোক নিজের বাড়ীতে থাকতে পারল না, ইয়াসরিবের পাইয়ে যেতে হল সেই লোকের ভবিষ্যৎ বাণীর কী মূল্য আছে?”
“তুমি আমাকে জানাওনি কেন?” সম্রাট ধমকে উঠলেন।
“গোটা দুনিয়া এক হলেও ইরান সম্রাটের কোন ক্ষতি করতে পারবে এই বিশ্বাস থাকলে আমি আপনাকে জানাতাম।” শংকিত গলায় গভর্ণর বললেন।
সম্রাট মুচকি হাসি হাসলেন “ঐ লোকের ব্যপারে খোঁজ খবর নিয়ে আমাকে জানাবে। শত্রুর সব গতিবিধি পর্যবেক্ষনে রাখতে হয়। সে কি রোমানদের কাছ থেকে সাহায্য পায়?”
“জ্বী না হুজুর, রোমানদের সাথে সেই লোকের কোন সম্পর্ক নেই”
“তুমি এখন বিদেয় হও” সম্রাট আবারো চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তার চিন্তার প্রধান বিষয় খালেকদুন।
শাহজাদী বিলকিস শাহজাদা ফররুখকে তলব করলেন। ফররুখ বুঝে গেছে কেন তাকে তলব করা হয়েছে- নিশ্চয়ই খালেকদুনের মেয়ের সম্মন্ধে কিছু কথা বলবে।
“তোমার জন্য খালেকদুনের মেয়েকেই একমাত্র যোগ্য মনে করছি কিন্তু তোমার পথে কাঁটা আছে।”
“কে আছে আমার পথের কাঁটা? তাকে আমি মাদায়েনের রাস্তায় ফাঁসির দড়িতে ঝুলাব।” শাহজাদা হুঙ্কার ছাড়লেন। বাইরের প্রহরী দরজার ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখল কোন ঝামেলা হল না তো! সম্রাটের নির্দেশ আছে শাহজাদারা নিজেদের মধ্যে লড়াই করলে সাথে সাথে তাদের ধরে সম্রাটের সামনে নিয়ে যেতে। কিছু হয়নি নিশ্চিত হয়ে প্রহরী বাইরে চলে গেল।
“শাহজাদা সোহরাব মেহরিনকে খুব পছন্দ করে। সম্ভবত তার সাথেই মেহরিনের বিয়ে হবে।”
“সোহরাব বেশি বাড়বাড়ি করছে। বাবা তাকে পছন্দ না করলে আমি এখনই তার মাথা কেটে ফেলতাম।”
“মাথা গরম করো না। এইসব পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়। রাণি শিরি বিয়ের ঘটকালী করছে। সে তার ভাইয়ের মেয়ের সাথে সোহরাবের বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। ব্যাপারটা রাজ পরিবারের জন্য চিন্তার কারণ হতে পারে। সেনাপতি আর সোহরাব যদি এক হয়ে যায় তাহলে ক্ষমতা থেকে সোহরাব বেশি দূরে থাকবে না।”
শাহজাদা ফররুখের ক্ষমতা নিয়ে টেনশন নেই। তার চিন্তা শুধু নারী নিয়ে “তার মানে সোহরাবকে পথ থেকে সরাতে পারব না? কারন তার সাথে রাণি শিরি আছে। আমাকে কী করতে হবে বল?”
“তুমি এক কাজ কর, তুমি যে মেহরিনকে পছন্দ করেছ তা সম্রাটকে বলে দাও। সম্রাট চাইলে রাণি শিরির সাধ্য নেই যে নিজের ছেলেকে বাদ দিয়ে সম্রাটের ভাতিজার সাথে খালেকদুনের মেয়েকে বিয়ে দিবেন।”
“আমি আজই বাবার কাছে যাব।”
“আজ যেও না। আজ বাবার মন খারাপ, হিতে বিপরীত হতে পারে। আগামীকাল যেও।”
শাহজাদীর মুখে প্রশান্তির হাসি। যাক, শাহজাদা ফররুখ টোপ গিলেছে। সে বাবার কামরার দিকে এগোল।
---
সম্রাট গোমড়া মুখে বসে আছেন। সামনে শাহজাদী বিলকিস দাঁড়ানো।
“তুমি কী বলতে চাইছ আবার বল” ঝাঁঝালো কন্ঠের সম্রাট বললেন।
“তেমন কিছু না, শুধু সাবধান হতে বলেছি। এর আগেও একবার বলেছিলাম। এখন আবারও বলছি। আমার কাছে খালেকদুনের স্ত্রী ও মেয়ের লক্ষণ ভাল ঠেকছে না। তারা রাজ পরিবারের দিকে হাত বাড়িয়েছে। এটাতে তেমন কোন দোষের কিছু নেই কিন্তু খালেকদুন মনে হয় তার সুন্দরী মেয়েকে দিয়ে আরো কিছু করতে চায়। দুই দিন পরে হয়তো শুনবেন তিনি আমার ভাইদের দিকে নজর দিয়েছেন। তাই একটু সাবধান হতে বললাম আর কি।”
“তুমি এখন যাও। তোমাকে সেনাবাহিনী নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে হবে না। সেটার জন্য লোক আছে।” শাহজাদী চলে গেলে সম্রাট সেনা গোয়েন্দা অফিসারকে ডাকলেন।
“খালেকদুনের ইদানিং কার চাল চলন সম্মন্ধে কিছু জেনে থাকলে জানাও।”
গোয়েন্দা প্রধান বললেন “তেমন কিছুই তো চোখে পড়ে নি। পড়লে অবশ্যই জানাব।” বলে একটু ইতস্তত করল। তাতে সম্রাটের সন্দেহ বেড়ে গেল।
“তুমি মনে হয় কিছু গোপন করতে চাইছ?”
“তেমন কিছুই না জাহাঁপনা”
“যা জান বলে ফেল”
আমতা আমতা করে সেনা গোয়েন্দা বলল “খালেকদুনের একটা সুন্দরী মেয়ে আছে। তাকে সে টোপ হিসেবে ফেলছে বলে সন্দেহ হচ্ছে। তবে আমি শিউর হলে অবশ্যই আপনাকে জানাতাম।”
সম্রাটের চিন্তা বেড়ে গেল।
---
জেলে জায়েদের দিন ভালই কাটছিল। পাদ্রী এখন পুরোপুরি সুস্থ। পাদ্রীর কাছে থাকলে অনেক জ্ঞান অর্জন করা যায়। মাঝে মাঝে সে হারিয়ে যেত ছেলেবেলার সেই দিনগুলিতে যখন আওস খাজরাজ যুদ্ধ করত।
---
পরদিন শাহজাদা ফররুখ যখন সম্রাটকে নিজের বিয়ের কথা বললেন তখন খালেকদুনের প্রতি সম্রাটের সন্দেহ প্রকট হল।
“তুমি মেহরিনকে কীভাবে দেখেছ?”
“মহলে প্রবেশ করার সময়”
সম্রাট ভাবলেন মেহরিন এখন মহলে প্রবেশ করা শুরু করেছে। কয়দিন পরে মসনদ দখলের চেষ্টা করবে। তারা যেহেতু রাণি শিরির আত্মীয় তাই রাণি শিরির অলক্ষ্যে তদন্ত করে দেখতে হবে আসল ঘটবনা কী? তবে সন্দেহের তীর খালেকদুনের দিকেই নিবদ্ধ হচ্ছে। তিনি শাহজাদাকে বললেন “তুমি ভাল প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। বিষয়টা আমি খালেকদুনের সাথে আলোচনা করব।”
শাহজাদা উৎফুল্ল হয়ে কামরা থেকে বের হয়ে গেল। সেই রাতে সম্রাটের হেরেমের সবচেয়ে প্রিয় দাসীর ডিউটি ছিল। সে সম্রাটের মনে খালেকদুনের ব্যপারে যে নিভু নিভু আগুণ ছিল তাতে ছাই দিয়ে তা দাউ দাউ করে জ্বালিয়ে দিল। খালেকদুন সম্রাটের চক্ষুশূলে পরিণত হল। কিন্তু তিনি কোন পদক্ষেপ নিলেন না। বিশ্বস্ত এক দূতকে পাঠালেন খালেকদুনের অবস্থা জানার জন্য।
---
শাহজাদী বিলকিসের কামরা। যে দূতকে সম্রাট খালেকদুনের অবস্থা জানার জন্য যেতে বলেছেন সে এখন শাহজাদীর সামনে।
“আর কতদিন দূতগিরি করবে? তোমার সাথে অনেকে অনেক উচ্চ পদে চাকরি করে”
“শাহজাদীর দৃষ্টি যদি এই অধমের দিকে পড়ত তাহলে আমার পদোন্নতি ঠেকায় কে?”
“তোমাকে একটা কাজ দিব। যদি এই কাজে সফল হও তাহলে তোমার জন্য ভাল বখশিস তো আছেই সাথে তোমার পদোন্নতির ব্যপারে সুপারিশ করব।”
শাহজাদী দূতকে তার কাজ বুঝিয়ে দিল, সাথে অনেক পুরষ্কার।
---
শাহজাদা সোহরাবের মনে আজ বেশ ফুর্তি। সম্রাট তাকে আগের চেয়ে বেশি বিশ্বাস করছেন। নতুন সেনা রিক্রুটের কাজ তাকজে দিয়েছেন। এছাড়া যে মেয়ের ছবি দেখে সে পাগল হয়েছে সেই মেহরিনের সাথে আজ তার দেখা হবে। রাণি শিরি তার কামরায় মেহরিনকে ডেকেছেন। রাণি খালেকদুনের স্ত্রীকে ইশারায় চলে যেতে বললেন। মায়ের সামনে মেয়ে থাকলে সোহরাবের সামনে লজ্জা পাবে। সোহরাব প্রবেশ করল। কক্ষে ঢুকেই সে মেহরিনের দিকে তাকিয়ে রইল। সোহরাবও জীবনে এত সুন্দর মেয়ে দেখেনি। মেহরিন লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে। সোহরাব মেহরিনের বিপরীতে একটা চেয়ার বসল। রাণি উভয়ের মধ্যে পরিচয় করিয়ে দিলেন। মেহরিন অনেক কষ্টে মুখ তুলে তাকাল। কিন্তু এ কী? সোহরাবের দৃষ্টি এমন কেন? সুন্দরী মেয়ে হবার কারণে মেহরিনকে সবাই মুগ্ধ চোখে দেখে কিন্তু সোহরাব তাকে দেখছে লোভীর চোখে। এই ছেলের সাথে তার বিয়ের কথা বার্তা চলছে অথচ সে যে দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে তার সাথে আব্বাসের দৃষ্টির মিল আছে। আব্বাস হলে সেই আরব রোমান সেনা যা জায়েদের সাথে আরবে মেহরিনের নানা বাড়ীতে গিয়েছিল মেহরিনদের কিডন্যাপ করার উদ্দেশ্যে। সোহরাব যেভাবে মেহরিনকে খুঁটে খুঁটে দেখছে তাতে রাণি শিরিও লজ্জা পেল। কিন্তু তিনি কিছু বললেন না।
হঠাত মেহরিনের মনে হল সোহরাবের জায়গায় যদি জায়েদ থাকত তাহলে সে কি এই চোখে দেখত? জায়েদ যদি গরিব ঘরে সন্তান না হয়ে যদি কোন ধনী ইরানীর ছেলে হত তাহলে কি মেহরিন সেদিন জায়েদের সাথে এরকম খারাপ আচরণ করত? মেহরিনের চোখের সামনে জায়েদের মুখ ভাসছে।
রেসিপি দেখুন
No comments :

No comments :

Post a Comment