মরুর ফুল ২৫
খালেকদুনের কাছে সম্রাটের পাঠানো সেই দূত রাজ প্রাসাদে ফিরে এসেছে। দূত সেই পাঁচ জন সিনিয়ার অফিসার ও সহ-সেনাপতির চিঠি নিয়ে এসেছে যেই চিঠিগুলো সহ-সেনাপতি বদলে দিয়েছেন। যাতে খালেকদুনের বিরুদ্ধে মিথঅ্যা তথ্য দেয়া আছে। চিঠি পেয়ে সম্রাটের মাথা পুরোই গরম হয়ে গেল। তিনি দরবারেই রাণি শিরিকে ডাকলেন। দরবারে তখন শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ দরবারীরাই উপস্থিত ছিল। সবার সামনে তিনি চিঠিগুলো শব্দ করে পড়লেন “দেখেছ তোমার ভাই আমার বিরুদ্ধে কী ষড়যন্ত্র করছে? সে সোহরাবের সাথে জোট বেঁধে আঁতাত করছে। তাতে শুনলাম তোমারও সায় রয়েছে।” তিনি রাণির কোন কথা শুনলেন না। ঘোষনা করলেন “আমি দুটি ঘোষনা দিচ্ছি। এক- সেনাপতির পদ থেকে খালেকদুনকে অব্যহতি দিলাম। তার বিরুদ্ধে আপাতত কোন কোন ব্যবস্থা নিচ্ছি না তবে রাণিকে সকল প্রকার রাজকীয় কার্য কলাপ থেকে মুক্ত রাখার নির্দেশ দিলাম। রাণি শিরি এখন থেকে নজর বন্দী থাকবে।”দরবার থমথমে পরিবেশ সৃষ্টি হল। সেনা প্রহরায় রাণি চোখের পানি নিয়ে দরবার থেকে বের হলেন। রাণি বের হয়ে যাবার পরে দূতকে ডাকলেন “এখনই তুমি আমার চিঠি নিয়ে সহ-সেনাপতির কাছে যাবে। প্রতি কেল্লায় গিয়ে ঘোড়া পরিবর্তন করবে। দিন রাত বিশ্রাম নিবে না। এই চিঠি আর কাউকে দেখানো যাবে না। তিনি সহ-সেনাপতিকে একটা চিঠি লিখলেন “খালেকদুনের মাথা কেটে তা এই দূতের মাধ্যমে আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়ে তুমি সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ কর”
---
জায়েদের ফাঁসির আদেশের খবর পুরো মাদায়েনে মুহুর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল। কে সেই আরব যুবক যে রোমান গোয়েন্দা হিসেবে খালেকদুনের সেনা দ্বারা গ্রেফতার হয়েছিল এবং পরে মাদায়েনে এসে রাজকীয় সেনা হত্যা করে এবং শাহজাদা সোহরাবের সহায়তায় মাদায়েনের কারাগারে লুকিয়ে ছিল? যে পরে প্রধান কারারক্ষীকে হত্যা করে? বিশেষ করে রাজকীয় সেনা অফিসাররা তাদের কাছের লোকের খুনীকে ধরার ব্যপারে খুশি হয়েছে। কেউ কেউ বলাবলি করতে লাগল “মাদায়েনের নতুন গভর্ণর শাহজাদা ফররুখ এসেই চমক দেখিয়ে দিলেন!”
কেউ কেউ আড়ালে আবডালে বলতে লাগল “ফররুখের মাথায় নারী ছাড়া আর কিছুই নেই। তার পক্ষে কিভাবে এই কাজ সম্ভব?” তবে সামনা সামনি কেউ কিছু বলল না।
খালেকদুনের স্ত্রীর কানে যখন জায়েদের গ্রেফতারের ও সম্রাট কতৃক তার ফাঁসির আদেশের খবর পৌঁছে তখন মেহরিন রীতিমত কাঁদতে শুরু করল “তিনি দুইবার আমার জবন বাঁচিয়েছেন। আমরা কি ওনার জন্য কিছুই করতে পারব না?” খালেকদুনের স্ত্রী মেয়ের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন-মেয়ে একটা চাকরের জন্য এভাবে কাঁছে কেন? অন্য পরিস্থিতি হলে তিনি মেহরিনকে এ ব্যপারে প্রশ্ন করতেন কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতি নেই।
কাঁদতে কাঁদতে মেহরিন বলল “শাহজাদা সোহরাব যদি আমাদের বসিয়ে না রেখে সাথে সাথে কারাগারে লোক পাঠাতেন তাহলে আজ এই ঘটনা ঘটত না। আমাদের বাইরে বসিয়ে রেখে উনি মেয়ে নিয়ে মৌজ ফুর্তিতে ব্যস্ত ছিলেন।”
“শাহজাদারা এমনই হয়” মেহরিনের মা ক্লান্ত গলায় বললেন।
“তার মানে জেনেশুনে তোমরা আমাকে এমন একটা ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চাচ্ছ?”
“দুনিয়াটাই এমন। তুমি তো দুনিয়ার এখনো কিছুই দেখনি।”
“লাগবে না আমার এমন দুনিয়া। অর্ধেক দুনিয়ার সম্রাটের ছেলে সাথে বিয়ে না দিয়ে আমাকে নিঃস্ব কারো সাথে বিয়ে দাও আমি তাও মেনে নিব।”
মেহরিনের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে তিনি কিছুই বললেন না। এখন দ্রুত রাণির কাছে যাওয়া প্রয়োজন। এখন রাত হয়ে গেছে, রাজ প্রাসাদে এখন বাইরের লোকের প্রবেশ নিষেধ। এছাড়া রাতের বেলায় মহিলাদের বাইরে যাওয়াও বিপদ। খালেকদুনের স্ত্রী যখন রাজ প্রাসাদে যাবে কিনা যাবে না বলে ইতস্তত করছিল ততক্ষনে মেহরিনে রাজ প্রাসাদে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। মেয়ের কান্ড দেখে মা অবাক হলেন।
“ভয় নেই মা, দু চার জন সেনার বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকার মত প্রশিক্ষন আমার আছে” বলে তলোয়ারের বাটে হাত বুলাল। মেহরিনের মা জানেন মাদায়েনে তলোয়ারের শক্তি কোন শক্তিই না। এখানে চক্রান্ত ষড়যন্ত্র হিংসা বিদ্বেষই বড় অস্ত্র। ওরা রাজ প্রাসাদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল।
---
জায়েদের জন্য আজকের দিনটা খুব খারাপ। শরীরের উপরে অনেক ধকল গিয়েছে। সকালে একবার তার হাত পা মুখ বেঁধে নিয়ে বস্তায় ভরে কোথাও নেয়া হল। বিকালে আবার রাজকীয় সেনা সদস্যরা তাকে গ্রেফতার করল। তাকে কোন কথা বলার সুযোগ দিল না। জায়েদ বুঝতে পেরেছে সে অনেক বড় ষড়যন্ত্রের শিকার। আর এর অন্যতম ভুক্তভোগী হল খালেকদুনের পরিবার। তাকে আবারো কারাগারে আনা হল। এবার অবশ্য তাকে নতুন একটা কক্ষে বন্দী করা হল।
যে কক্ষে সকালে জায়েদ বন্দি ছিল সেই কক্ষে শাহজাদা সোহরাবকে বন্দী করা হয়েছে। কক্ষের দুই ইরানী বন্দী কক্ষের দরজা দরজা ও প্রধান ফটক খোলা পেয়ে সুযোগ বুঝে পালিয়েছে। কক্ষে শুধু সেই খ্রিস্টান পাদ্রী রয়েছে। পাদ্রী শাহজাদা সোহরাবকে দেখে আকাশ থেকে পড়ল “আপনি না সকালে আমাকে জেরা করেছেন?”
“তখন আমি মাদায়েনের গভর্ণর ছিলাম। সেই সুবাদে আমি এই কারাগারের কর্তা ছিলাম।”
পাদ্রী বিদ্রূপের হাসি হেসে বলল “অথচ বিকালে আপনি সেই কারাগারেই বন্দী!” খোঁচাটা সোহরাব গায়ে মাখাল না। সে জানে হাতি গর্তে পড়লে চামচিকাও লাথি মারে।
সোহরাব রাজকীয় পরিবেশে বড় হয়েছে। কারাগারের এই পরিবেশ তার কাছে অসহ্য মনে হল। এভাবে দুই দিন থাকলে সে মনে হয় মরে যাবে। তার বাবা ভাইয়েরা ও রাণি নিশ্চয়ই তার মুক্তির জন্য চেষ্টা করছেন। দেখা যাক কতদিন পরে সে মুক্তি পায়। সোহরাবের মনে হল পাদ্রী থেকে সে কিছু তথ্য নিতে পারবে। সে পাদ্রীর সাথে আলাপ জুড়ে দিল। পাদ্রীর সাথে দীর্ঘ আলাপ চারিতায় সোহরাব একটা জিনিসই পরিষ্কার বুঝতে পারল- জায়েদ মেহরিনকে ভালোবাসে।
---
রাজ প্রাসাদের সদর দরজা বন্ধ। বাইরে আট দশ জন প্রহরী মেহরিন ও তার মাকে কোন মতেই ভেতরে প্রবেশ করতে দিবে না। এমনকি রাণির কাছেও কেউ তাদের আসার খবর দেয়া নিষেধ। রাতে রাজা বাদশাহরা বিশ্রাম নেন, আমোদ ফুর্তি করেন, ভেতরে মদের আসর চলছে। এই মুহুর্তে কেউ ভেতরে বিরক্ত করতে গেলে তার চরম শাস্তি হবে। শুধুমাত্র যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে আসা দূতদের জন্য ছাড় আছে। মেহরিন ও তার মা সদর দরজার সামনে অনেক ক্ষণ দাঁড়িয়ে রক্ষীদের অনুনয় বিনয় করল কিন্তু কেউ ভ্রূক্ষেপ করল না।
দূর থেকে ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ শোনা গেল। পাঁচ সাত জনের আওয়াজ। গেইটের রক্ষীরা সাবধান হয়ে গেল। পাশের উঁচু দেয়াল থেকে একজন বলল “শাহজাদা ফররুখ আসছেন, গেইট খোল”
গেইটের ভেতরে থাকা রক্ষীরা গেইট খুলে দিল। এই বিশাল গেইট খুলতেও দশ বারো জন লোক লাগে। ফররুখ গেইটের বাইরে দুইজন নারী দেখে ঘোড়া থামাল। মশালের আলোতে মেহরিনকে অপূর্ব লাগছে যদিও তার মনের অবস্থা এখন ভাল না। মেহরিনের দিকে চেয়ে বলল “আমার কী সৌভাগ্য? আমাদের বাড়ীতে মেহামান এসেছে।”
ফররুখের কথা শুনে মেহরিনের গা জ্বলে উঠল। ফররুখের কথা শুনে যে কেউ বুঝবে সে মদ খেয়ে টাল হয়ে রয়েছে। ফররুখকে দেখে খালেকদুনের স্ত্রী বললেন “বাবা, আমরা একটা জরুরী কাজে রাণি শিরি কাছে এসেছি। রক্ষীরা আমাদের ভেতরে যেতে দিচ্ছে না এমনকি রাণির কাছে আমাদের সংবাদ পৌঁছাচ্ছেও না। আপনি যদি একবার রাণিকে আমাদের খবর দিতেন.....”
“সে আবার এমন কী কাজ? আপনারা আমার সাথে ভিতরে আসুন” বলে ফররুখ ঘোড়া থেকে নেমে সামনে হেঁটে চলল। এক রক্ষী ফররুখের ঘোড়া নিয়ে পিছে পিছে আসল। ফররুখ সেই রক্ষীকে দূরে থাকাস ইশারা দিল। রক্ষী দূরে সরে গেল। আরেক রক্ষী এসে মেহরিনকে বলল “আপনার হাতের অস্ত্রটা জমা দিন। যাওয়ার সময় ফেরত নিয়ে যাবেন।” মেহরিন তলোয়ারটা ফেরত দিল। কিছু দূর এগিয়ে যাবার পরে ফররুখ মেহরিনের কাছে চলে এলো। মেহরিনের মা দুই জনের মাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। ফররুখ নাছোড়বান্দা, সে দূরে যাচ্ছে না। সে পারলে মেহরিনের গা ঘেঁষে ঘেঁষে চলছে। তার মুখ থেকে মদের গন্ধ বেরোচ্ছে। সেই গন্ধে মেহরিনের বমি চলে আসছে।
আরেকটু দূরেই প্রাসাদ, আরো একশ কদম হাঁটতে হবে। মাঝখানের জায়গাটার মশালের আলো নিভে গেছে। হালকা অন্ধকার। এই স্থান দিয়ে ফররুখে গা ঘেঁষে মেহরিনের ইচ্ছে হল না। সামনে গিয়েই ফররুখ মেহরিনের হাত ধরল। মেহরিন চিৎকার করে উঠল। খালেকদুনের স্ত্রী ধাক্কা দিয়ে ফররুখকে সরিয়ে দিলেন “আমি তোমার বাবাকে তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করব”
“হাহাহা, আপনি বাবাকে অভিযোগ করবেন? আপনি দুই দিন পরে আমার শাশুড়ী হচ্ছেন। হবু জামিয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে আপনার কোন লাভ আছে? তার চেয়ে মেয়ের সুখের চিন্তা করেন।” ইতি মধ্যে মেহরিনের চিৎকার শুনে গেইট থেকে দুই জন রক্ষী এদিকে দৌড় দিল। তারা ঘটনা বুঝতে পারে নাই।
“আমার মেয়ের দিকে নজর দিয়েছ কেন? তোমার কি মেয়ের অভাব পড়েছে?”
“আমার সংগ্রহে সব দেশের মেয়েই আছে শুধু মাদায়েন সুন্দরী নেই। ও কাছে থাকলে সেই অভাবও পূরণ হবে” বলে মেহরিনের দিকে হাত বাড়াল। জবাবে মেহরিন শাহজাদাকে একটা থাপ্পড় দিল।
চড় খেয়ে শাহজাদার মাথা গরম হয়ে গেল। সে চিৎকার করে বলতে লাগল “এত বড় সাহস! তুই ইরানের শাহজাদার গায়ে হাত তুলেছিস যাদের রাজ্য চীন, খোরাসান থেকে শুরু করে মিশর পর্যন্ত বিস্তৃত। আমার হেরেমে তোর মত অনেক মেয়ে আছে। তুই নিজেকে কী মনে করেছিস? তোকে আমার হেরেমে দাসী হিসেবে রাখব। তোর বাপ কী করতে পারে দেখে নিস।” শাহজাদা হিংস্র হয়ে আবার মেহরিনের দিকে চড়াও হল। এবার মেহরিন ঘুষি দিয়ে ফররুখকে সরিয়ে দিল। সেই দুই জন রক্ষী ইতি মধ্যে কাছে চলে এসেছে। তারা এসে তামাশা দেখতে লাগল। রাজ প্রাসাদে এসব তামাশা মামুলী ব্যপার। শাহজাদার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সে রক্ষীদের বলল “দাঁড়িয়ে কী দেখছিস? বুড়ীটাকে ধরে রাখ” তারা খালেদকুনের স্ত্রীকে দরে ফেলল। মাকে উদ্ধারের জন্য মেহরিন রক্ষীদের দিকে এগিয়ে যেতেই পেছন থেকে ফররুখ মেহরিনকে জড়িয়ে ধরল। ফররুখের দুই হাত মেহরিনের পেট চেপে ধরেছে। মেহরিন হাত দিয়ে ফররুখের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু ফররুকের হাতে অনেক শক্তি, হাতের বাঁধন একটুও আলগা করতে পারল না। ফররুখের হাত যদি মেহরিনের মুখের কাছেও থাকত তাহলে কামড়ে দিত। কিন্তু তাও সম্ভব নয়। এই মুহুর্তে তার বেশি মনে পড়ছে জায়েদের কথা। জায়েদ এর আগে দুইবার তার জীবন বাঁচিয়েছে। এই পরিস্থিতি হলে জায়েদ তার জীবন দিয়ে হলেও মেহরিনকে বাঁচাতো। মেহরিনের হাতে কাছে এক জন রক্ষী ছিল। রক্ষীর কোমরে একটা ছুরি ঝুলে আছে। মেহরিন সেই ছুরি টান দিয়ে ফররুখের হাত কোপ দিল। সাথে সাথে ফররুখ চিৎকার দিয়ে হাত ছেড়ে দিল। চেচামেচি চিৎকার শুনে সেখানে রাজ প্রাসাদ থেকেও আট দশ জন রক্ষী চলে এসেছে। তারা মশাল নিয়ে এসেছে। শাহজাদার হাতে রক্ত আর মেহরিনের হাতে ছুরি দেখে তারা যা বোঝার বুঝে নিল। রক্ষীরা মেহরিন ও তার মাকে গ্রেফতার করল। ফররুখ নির্দেশ দিল “এই মেয়েকে রাজ প্রাসাদে বন্দী করা হোক। আমি একে আমার দাসী বানাব।”
Subscribe to:
Post Comments
(
Atom
)
No comments :
Post a Comment