মরুর ফুল ২৯

শাহজাদা ফররুখের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। রাজকীয় সেনা যার কাছ থেকে ছুরি নিয়ে মেহরিন শাহজাদার হাতে কোপ দিয়েছে তার কাছ থেকে জানা গেছে সেই ছুরিতে মরিচা ছিল। শাহজাদার আহত হয়েছে আজ দু’দিন হল। এই দু’দিনের মধ্যে মেহরিনদের সাথে কেউ দেখা করতে এল না। তৃতীয় দিনে এক রাজকীয় সেনা ভেতরে প্রবেশ করল। ভেতর থেকে কিছু জিনিস পত্র নেয়ার ফাঁকে খালেকদুনের স্ত্রীকে একটা কাগজ ধরিয়ে দিল। সৈন্যটা ইশারায় কাগজটাকে গোপন রাখতে বলল। সেনা চলে গেলে খালেকদুনের স্ত্রী কাগজটা খুলল। এটা একটা চিঠি। চিঠিতে লেখা আছেঃ
জায়েদ ভাল আছে। তাকে মাদায়েনের কারাগার থেকে গোপনের বের করে বাইরে নিরাপদ স্থানে রাখা হয়েছে। খালেকদুনের সামনে অনেক বিপদ। সম্রাট তার মাথা কাটার ঘোষনা দিয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রে একজন দূত পাঠিয়েছেন। আমি সেই দূতকে থামানোর ব্যবস্থা করছি। খালেকদুনের জীবন বাঁচানোর বিনিময়ে আমি আপনার সমর্থন চাই। আমি ক্ষমতায় আরোহন করে সবার আগে খালেকদুনের সেনাপতির পদ ফিরিয়ে দিয়ে মাদায়েনে নিয়ে আসব। আর আপনাদের কিছুদিন বন্দী অবস্থায় থাকতে হবে। এটাই আপনাদের জন্য নিরাপদ। আরেকটা কথা, আপনি খালেকদুনকে একটা চিঠি লিখে আপনাদের বিপদের কথা জানান। টেবিলের নিচে কাগজ কলম রাখা আছে। দুপুরের দিকে এক সেনা এসে চিঠি নিয়ে যাবে।
চিঠির শেষে কোন নাম ঠিকানা নেই। কাকে সমর্থন দিতে হবে, কেনই বা সমর্থন দিতে হবে কিছুই বোঝা গেল না। তবে এটা বোঝা গেল রাজ প্রাসাদের কেউ বিদ্রোহ করবে। এই বিদ্রোহীকে সমর্থন দিতে হবে। সেনাপতি খালেকদুনের স্ত্রী হিসেবে তার সেনাপতিকে ম্যানেজ করার দায়িত্ব পড়েছে। খালেকদুনের স্ত্রী এই দুই দিন কোন আশার আলো দেখতে পান নি। শাহজাদাকে ‘হত্যা চেষ্টায়’ তাদেরকে বন্দী করে রাখা হয়েছে। বিচার হল- ফররুখ সুস্থ হলে মেহরিন তার দাসী হবে আর খালেকদুনের স্ত্রী সম্ভবত রাজ প্রাসাদের ঝি এর কাজ করবে। অচেনা বিদ্রোহীর কাছ থেকে চিঠি পেয়ে তিনি এখন আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন। বিদ্রোহী যেই হোক না কেন এই সুযোগে যদি এখান থেকে পালানো যায় তাহলে তিনি সোজা আরবে চলে যাবেন। তিনি চিঠি লিখলেনঃ
শাহজাদা ফররুখকে হত্যা চেষ্টার অভিযোগে আমাকে ও মেহরিনকে রাজ প্রাসাদে বন্দী করে রাখা হয়েছে। তোমার স্ত্রী ও কণ্যার জীবন বাঁচাতে চাইলে পত্রবাহকের কথা অনুযায়ী লোককে ‘সম্রাট’ সমর্থন দিতে হবে।
স্ত্রী হাতের লেখা খালেকদুন ভাল করেই চিনেন। কারণ প্রতি মাসেই খালেকদুন স্ত্রী কাছ থেকে চিঠি পেতেন। দুপুরে সেই সেনা এসে চিঠিটি নিয়ে গেল।
---
রোমান সম্রাট ইস্কান্দারিয়া জয় করে ইরানের দিকে এগিয়ে গেলেন। এমনিতেই মিশর ছাড়া অন্যান্য হারানো ভূমি ইতিমধ্যেই তিনি জয় করে ফেলেছেন। অগ্নিপূজারীদের পবিত্র শহর আরমিয়া পতনের পরে ইরানীরা মূলত মনের তাদের মানসিক শক্তি হারিয়ে ফেলে। এরপরে দ্রুত বিভিন্ন দখলীকৃত এলাকা থেকে তারা তাদের সৈন্য সরিয়ে নেয়। ইরানীদের পিছু হটার কারণে ও যুদ্ধে অসংখ্য সৈন্যের মৃত্যুর কারণে মাদায়েনে সম্রাটের প্রতি অসন্তোষ সৃষ্টি হল। সবাই মনে করতে লাগল খসরু পারভেজ একজন অথর্ব সম্রাট। তিনি আগে যুদ্ধ শুরু করেছেন। এখন তিনিই যুদ্ধে পরাজিত হওয়া শুরু করলেন। মাদায়েনবাসীদের এই অসন্তোষের আগুণে ঘি ঢালছেন মূলত সম্রাটের পুত্র শেরওয়া। তিনি পূজারী হওয়ায় বিভিন্ন মন্দীরে তার অবাধ যাতায়াত ছিল। বিভিন্ন স্থানে লোকদের তিনি শান্তির ভাষন শোনাতেন। যুদ্ধ করলে যে হাজার হাজার লোক মারা যায় তার বর্ণনা করতেন। লোকজন দেখল তার কথাই সত্যি কারণ যুদ্ধে কারো বাপ কারো ভাই মারা গেছেন। শান্তির পথে থাকলে কেউ মারা যেতেন না। সবাই সুখে একত্রে বাস করতে পারতেন। মাদায়েনবাসীদের মনে আশার সঞ্চার হল। তারা মনে করতে লাগল- যাক খসরু পারভেজের একটি ছেলে অন্তত শান্তি চায়। অনেকে আফসোস করতে লাগল-ইশ আমরা যদি এমন বাদশাহ পেতাম। কিন্তু তারা এমন এক বাদশাহ পেতে যাচ্ছে সে নিজেও যুদ্ধবাজ। তার নাম মারোজা। শান্তির বাণী শোনাতে গিয়ে শেরওয়ার প্রথম শত্রু হলেন প্রধান পূজারী মাকান। প্রধান পুজারীই সম্রাটের মাথায় মুকুট পরিয়ে দেন, শপথ করান। রাজ পরিবারে তার গুরুত্ব অসীম। তিনি সম্রাটের বন্ধু। শেরওয়ার ‘শান্তির বাণীর’ বিষয়টা তিনি সম্রাটের কাছে তুলে ধরেন। সম্রাট শেরওয়াকে ডেকে বললেন “তুমি কি মাদায়েনে থাকতে চাও?”
---
জায়েদের কাছে এক লোক এল। এই লোককে জায়েদ সেই রাতেও দেখেছিল যেই রাতে জায়েদকে কারাগার থেকে মুক্ত করে এখানে আনা হয়। ইনিই ওদের দল নেতা। জায়েদকে এসে জানালেন “খালেকদুনের পরিবার রাজ প্রাসাদে বন্দী রয়েছে। খালেকদুনের মেয়ে তোমার কারণে বন্দী হল। সে তোমার মুক্তির জন্য আমার মায়ের কাছে (রাণি শিরি) যেতে চেয়েছিল। কিন্তু শাহজাদা ফররুখ তার সাথে খারাপ আচরণ করে। বাধ্য হয়ে মেহরিন ফররুখকে আঘাত করে। শ্রীঘ্রই সে শাহজাদা ফররুখের দাসী হবে।”
অনেকদিন পরে মেহরিনের কথা শুনে জায়েদের মনে হল এই বন্দী দশার মধেও একটু হিমেল হাওয়ার পরশ পেল। “এখন ওরা কেমন আছেন” জায়েদ খুব আগ্রহের সাথে জানতে চাইল। “ওরা মেহরিনের কোন ক্ষতি করেনি তো?”
আগুন্তক স্মিত হেসে বলল “ভালই তো দেখছি, দুই জন দুই জনের প্রেমে পড়েছ। এক সামান্য আরব হয়ে রাজকণ্যার মনের গভীরে গেলে কীভাবে?”
“আপনি ভুল বুঝেছেন। আমি একাই মেহরিনকে ভালবাসি। মেহরিন আমাকে ঘৃণা করে। আমি তাদের তুলনায় চাকর বাকর পর্যায়ের।”
“চাকরের জন্য নিজের জীবনের রিস্ক নিয়ে রাতে রাজ প্রাসাদে যে যায় সেই মেয়ে তোমাকে ভালবাসে না এটা বিশ্বাস করতে বল? অবশ্য তোমাদের বয়স কম, এই বয়সে কখন যে কাকে ভাল লাগে তা বলা মুশকিল।”
জায়েদ নিজের কানকেই বিশ্বাস করছে না। এটা কী করে সম্ভব? ইরান সেনাপতির মেয়ে তাকে ভালোবাসে? উনি মনে হয় জায়েদের সাথে রসিকতা করছে “আপনি আমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিচ্ছেন। আমি মুক্তি পেলে সোজা আরবে চলে যাব। যুদ্ধ বিগ্রহ আর ভাল লাগে না। মেহরিন যদি সত্যি আমাকে ভালোবাসে তাহলে কী হবে? সমাজ মেনে নেবে না। সে অনেক ধনীর মেয়ে আর চাল চুলা কিছুই নেই...”
“তোমার সব ব্যবস্থা আমি করব। শুনেছি তুমি এক সময় রোমান গোয়েন্দা ছিলে। নিশ্চয়ই তুমি অনেক গোপন অভিযানে অংশগ্রহন করেছ? আমি তোমাকে ইরানী বাহিনীর বড় পদে বসাব।”
“মেহরিন যদি সত্যি আমাকে ভালোবাসে তাহলে আমি তাকে নিয়েই আরবে চলে যাব” ইরানের পদ নিয়ে তার কোন মাথা ব্যাথা নেই। তার চিন্তা শুধু মেহরিনকে নিয়েই।
“তোমরা দুই জন দুই জনের জন্য। এবার আমার জন্য একটা কাজ করে দিতে হবে। এই কাজ মনে কর মেহরিনের জন্য। আমি মেহরিন ও তার মাকে রাজ প্রাসাদ থেকে বের করার ব্যবস্থা করে দিব। তুমি আমার জন্য কয়েকটা কাজ করে দিবে।”
“কি কাজ?” জায়েদের কাছ কোন বিকল্প উপায় নেই।
“দুই জন মানুষকে খুন করতে হবে”
“কী বলেন? মানুষ খুন?”
“তাহলে মেহরিনকে পাবে না। আর এমন ভাব দেখাচ্ছ যে তুমি কখনো মানুষ খুন করনি? যুদ্ধে তাহলে কী করেছ?”
“যুদ্ধ আলাদা কথা......”
“এটা একটা যুদ্ধ। এই যুদ্ধে হারলে মেহরিন হবে ফররুখের দাসী আর জিতলে হবে তোমার। তুমি কি রাজী? আমার এত সময় নেই। আমার কাজ করার মত অনেক লোক মাদায়ানে আছে।”
“আমি কী করে বুঝব আপনি সত্যি কথা বলছেন? মেহরিনরা কি আসলেই বন্দী কি না.............
“আমি তোমাদের দেখা করার ব্যবস্থা করব”
“কীভাবে?” জায়েদ আকাশ থেকে পড়ল “তারা না এখন রাজ প্রাসাদে বন্দী?” এই লোক কি জায়দের সাথে দুষ্টুমি করছে?
“তোমাকে রাজকীয় সেনা সদস্য সাজিয়ে রাজ প্রাসাদে প্রবেশ করিয়ে দিব। মেহরিন অ তার মা কোথায় আছে সেই কামরায় ঢোকার ব্যবস্থা করব।”
“পাগল নাকি? আমাকে রাজকীয় সেনারা যেখান খুঁজছে সেখানে আমি রাজকীয় সেনা সদস্য কীভাবে সাজব? আমি ধরা পড়ব। এছাড়া আমাকে ওরা চিনে না। না চিনলে রাজ প্রাসাদে ঢুকতে দিবে?”
“তুমি কীভাবে রাজ প্রাসাদে ঢুকবে সেটা আমি দেখব। আগে বল তুমি আমার কাজ করতে রাজী কি না? আমার এত ..”
“ঠিক আছে। আমি আপনার প্রস্তাবে রাজী। এখন বলুন কখন কীভাবে আপনি আমাকে রাজ প্রাসাদে নিয়ে যাবেন? আরেকটা কথা, যারা আমাকে গ্রেফতার করেছে তারা আমাকে চিনে। তারা যদি আমাকে দেখে ফেলে?”
“তাদের কেউ রাজ প্রাসাদে ডিউটি করে না”
“সবই মানলাম, বলুন কখন যেতে হবে”
“এখন”
“এখন? রাজকীয় সেনার পোষাক কোথায়?”
লোকটি হাত তালি দিতেই এক সেনা পোষাক নিয়ে আসল।
---
জায়েদ এখন ইরান সম্রাজ্যের রাজ প্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে। প্রাসাদের উজ্জ্বলতা তার চোখ ধাঁধিয়ে দিল। দূর থেকে এর মিনার দেখা যায়। বিশাল এই প্রাসাদের এ মাথা থেকে ও মাথা দেখা যায় না। আশে পাশে ছোট খাট প্রাসাদও অনেক রয়েছে। জায়েদের দল প্রধান ফটক থেকে অল্প দূরে। তাদের দলের নেতৃত্বে রয়েছে সেই আগুন্তক যিনি জায়েদকে দুই জন মানুষ খুনের প্রস্তাব দিয়েছেন। সেই আগুন্তুক পূজারীদের পোষাক পরিধান করেছেন। ওনার চারিদিকে রাজকীয় সেনা পাহারা রয়েছে। পনের বিশ জনের সেনা দলের একজন জায়েদ। সামনে গেইটের উপরে দাঁড়ানো প্রহরী উচ্চ স্বরে বলল “শাহজাদা শেরওয়া আসছেন। দরজা খোল।”
রেসিপি দেখুন
No comments :

No comments :

Post a Comment