মরুর ফুল ২৮
নাজ্জাশীর প্রকৃত নাম ছিলো আসহাম ইবনে আলজাবার। আল্লাহর রসূল চিঠি লেখানে পর আমর ইবনে উমাইয়া জামরির হাতে ষষ্ঠ হিজরীর শেষে বা সপ্তম হিজরীর শুরুতে এটি প্রেরণ করেন। চিঠিটি নিম্ন রূপঃআল্লাহর রসূল মোহাম্মদ (সাঃ) এর পক্ষ থেকে হাবশার নাজ্জাশী আযরেমের প্রতি। সালাম সেই ব্যক্তির ওপর যিনি হেদায়াতে অনুসরণ করেন। আমি আপনার কাছে মহান আল্লাহর প্রশংসা করছি যিনি ব্যতীত কোন মাবুদ নেই। যিনি কুদ্দুস, যিনি সালাম, যিনি নিরাপত্তা ও শান্তি দেন, যিনি হেফাযতকারী ও ত্ত্বাবধায়নকারী
নাজ্জাশী সেই চিঠি চোখে লাগান এবং সিংহাসন ছেড়ে নীচে নেমে আসেন। এরপর হযরত জাফর ইবনে আবু তালেবের হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসূল (সাঃ) এর প্রেরিত চিঠির জবাবে তিনি একখানি চিঠি মদীনায় প্রেরণ করেন। সেই চিঠির বক্তব্য নিম্নরূপঃ
পরম করুণাময় ও অতি দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।
আল্লাহর রসূল মোহাম্মদ (সাঃ) এর নামে নাজ্জাশী আসহামার পক্ষ থেকে।
হে আল্লাহর নবী, আপনার উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে ছালাম, তাঁর রহমত ও বরকত নাযিল হোক। সেই আল্লাহর পক্ষ থেকে, যিনি ব্যতীত এবাদাতের উপযুক্ত কেউ নেই। অতপর, হে আল্লাহর রসূল, আপনার চিঠি আমার হাতে পৌছেছে। এ চিঠিতে আপনি হযরত ঈসা (রা) সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। আসমান ও যমিনে মালিক আল্লাহর শপথ, আপনি যা কিছু উল্লেখ করেছেন হযরত ঈসা (আ) এর চেয়ে বেশী কিছু ছিলেন না। তিনি সেইরূপ ছিলেন আপনি যেরূপ উল্লেখ করেছেন। আপনি আমার কাছে যা কিচু লিখে পাঠিয়েছেন, আমি তা জেনেছি এবং আপনার চাচাতো ভাই এবং আপনার সাহাবাদের মেহমানদারী করছি। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি আল্লাহর সত্য ও খাঁটি রসূল। আমি আপনার কাছে বাইয়াত করছি, আপনার চাচাতো ভাইয়ের বাইয়াত করছি এবং তাঁর হাতে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের জন্যে ইসলাম কবুল করেছি।
রাসূল (সাঃ) নাজ্জাশীর কাছে একথাও দাবী করেছেন, তিনি যেন হযরত জাফর এবং হাবশায় অন্যান্য মোহাজেরদের পাঠিয়ে দেন। সেই অনুযায়ী নাজ্জাশী হযরত আমর ইবনে উমাইয়া জামরির সাথে দু’টি কিসতিতে করে সাহাবাদের দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। একটি কিসতিতে হযরত জাফর, হযরত আবু মূসা আশয়রী এবং অন্য কয়েকজন সাহাবা ছিলেন। তাঁরা প্রথমে খয়বরে পৌঁছে সেখান থেকে মদীনায় হাযির হন। অন্য একটি কিসতিতে অধিকাংশ ছিলো শিশু-কিশোর, তারা হাবশা থেকে সরাসরি মদীনায় পৌঁছে।
উল্লেখ্য, নাজ্জাশী তবুক যুদ্ধের পর নবম হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। আল্লাহর রসূল নাজ্জাশীর ইন্তেকালের তারিখেই তার মৃত্যু সংবাদ সাহাবাদের জানান এবং গায়েবানা জানাযার ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীতে নাজ্জাশীর স্থলাভিষিক্ত বাদশাহর কাছেও রাসূল (সাঃ) একটা চিঠি লিখেছিলেন, কিন্তু তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন কিনা, সেটা জানা যায়নি।
মিসরের বাদশাহ মুকাওকিসের নামে-
রাসূল (সাঃ) মিসর ও আলেকজান্দ্রিয়ার
“পরম করুণাময় ও অতি দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।
আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রসূল মোহাম্মদের পক্ষ থেকে মুকাওকিস আযম কিবতের নামে। তাঁর প্রতি সালাম, যিনি হেদায়াতের আনুগত্য করেন।
আমি আপনাকে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছি। ইসলাম গ্রহণ করুন, শান্তিতে থাকবেন। ইসলাম গ্রহণ করলে আল্লাহ তায়ালা আপনাকে দু’টি পুরস্কার দেবেন। আর যদি ইসলাম গ্রহণ না করেন, তবে কিবতের অধিবাসীদের পাপও আপনা ওপর বর্তাবে। হে কিবতিরা, ‘এমন একটি বিষয়ের প্রতি এসো যা আমাদের এবং তোমাদের জন্যে সমান। সেটি এই যে, আমরা আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত অন্য কারো এবাদাত করবো না এবং তাঁর সাথে কাউকে শরিক করবো না। আমদের মধ্যে কেউ যেন আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত অন্য কাউকে প্রভু হিসাবে না মানে।’ যদি কেউ এই দাওয়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে, তবে বলে দাও, সাক্ষী থাকো, আমরা মুসলমান।”
এই চিঠি পৌঁছানোর জন্যে হযরত হাতেব ইবনে আবি বালতাআকে মনোনীত করা হয়। তিনি মোকাওকিসের দরবারে পৌঁছার পর বলেছিলেন, এই যমিনে আপনার আগেও একজন শাসনকর্তা ছিলেন, যে নিজেকে রব্বে আ’লা মনে করতো। আল্লাহ তায়ালা তাকে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী লোকদের জন্যে দৃষ্টান্ত করেছেন। প্রথমে তার দ্বারা অন্য লোকদের ওপর প্রতিশোধ নেয়া হয়েছে এরপর তাকে প্রতিশোধের লক্ষ্যস্থল করা হয়েছে। কাজেই অন্যের ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুন। এমন যেন না হয় যে, অন্যরা আপনার ঘটনা থেকে শিক্ষা লাভ করবে।’
মুতাওকিস জবাবে বললেন, আমাদের একটি ধর্ম-বিশ্বাস রয়েছে সেই ধর্ম বিশ্বাস আমরা পরিত্যাগ করতে পারি না। যক্ষণ পর্যন্ত তার চেয়ে উত্তম কোন ধর্ম –বিশ্বাস পাওয়া না যায়।
হযরত হাতেব (রা) বলেন, আমি আপনাকে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছি। এই দ্বীনকে আল্লাহ তায়ালা পূর্ববর্তী সকল দ্বীনের পরিবর্তে যথেষ্ট মনে করেছেন। ইসলামের অর্থাৎ আল্লাহর মনোনীত দ্বীনের নবী মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার পর তার বিরুদ্ধে কোরায়শরা প্রধান শত্রু হয়ে দাঁড়ায়। ইহুদীরাও শত্রুতা ও ষড়যন্ত্র শুরু করে। নাছারারা ছিলো কাছে কাছে। আল্লাহর শপথ, হযরত মূসা (আ) যেমন হযরত ঈসা (আ) সম্পর্কে সুসংবাদ দিয়েছিলেন একই নিয়মে আমরা আপনাকে কোরআনের দাওয়াত দিচ্ছি, যেমন আপনারা তাওরাতের অনুসারীদের ইঞ্জিলের দাওয়াদ দিয়ে থাকেন। যে নবী যে কওমের জন্যে অত্যাবশ্যক হয়ে থাকে।
আপনারা নবাগত নবীর যমানা পেয়েছেন, কাজেই তাঁর আনুগত্য করুন। আপনাক আমরা দ্বীনে মসীহ থেকে ফিরে আসতে বলছি না, বরং আমরা মূলত সেই দ্বীনের দাওয়াতই দিচ্ছি।
মুকাওকিস বলেন, সেই নবী সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিয়ে আমি শুনেছি যে, তিনি কোন অপছন্দনীয় কাজের আদেশ দেন না এবং পছন্দনীয় কোন কাজ করতে নিষেধ করেন না। তিনি পথভ্রষ্ট যাদুকর নান, নিথ্যাবাদীন জ্যোতিষী নন। বরং আমি দেখেছি যে, তার সাথে নবুয়তের এ নিশানা রয়েছে যে, তিনি গোপনীয় বিষয়কে প্রকাশ করেন এবং অপ্রকাশ্য জিনিস সম্পর্কে খবর দেন। আমি তার দাওয়াত সম্পর্কে আরো চিন্তা-ভাবনা করবো।
মুকাওকিস আল্লাহর রসূলের চিঠি নিয়ে হাতীর দাঁতের একটি কৌটোয় রাখেন এরপর মুখ বন্ধ করে সীল লাগিয়ে তার এক দাসীর হাতে দেন। এরপর আরবী ভাষার কাতেবকে ডেকে রাসূল (সাঃ) এর কাছে নিম্নোক্ত চিঠি লেখেন।
‘পরম করুণাময় ও অতি দয়ালুয আল্লাহর নাম শুরু করছি। মোহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহর নামে মুকাওকিস আযিম কিবত-এর পক্ষ থেকে। আপনার প্রতি সালাম। আপনরার চিঠি পাঠ করেছি। আপনার চিঠির বক্তব্য এবং দাওয়াত আমি বুঝেছি। আমি জানি যে, এখনো এখনো একজন নবী আসার বাকি রয়েছে। আমি ধারণা করেছিলাম যে, তিনি সিরিয়া থেকে আবির্ভূত হবেন। আমি আপনার দূতকে সম্মান করেছি। আপনার খেদমতে দুইজন দাসী পাঠাচ্ছি। আপনার সওয়ারীর জন্যে একটি খচ্চরও হাদিয়া স্বরূপ পাঠাচ্ছি। আপনার প্রতি সালাম।
মুকাওকিস আর কোন কথা লেখেননি। তিনি ইসলামও গ্রহণ করেননি। তাঁর প্রেরিত দাসীদের নাম ছিলো মারিয়া বিতিয়া এবং শিরিন। খচ্চরটির নাম ছিলো দুলদুল। এটি মুয়াবিয়ার (রা) সময় পর্যন্ত জীবিত ছিলো। রাসূল (সাঃ) মারিয়াকে নিজের কাছে রেখেছিলেন। মারিয়ার গর্ভ থেকেই রাসূল (সাঃ) এর পুত্র ইবরাহীম জন্ম গ্রহণ করেন। শিরিনকে কবি হাস্সান ইবনে ছাবেত আনসারীকে দান করা হয়।
মুসযের ইবনে ছাদির নামে-
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহা আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুনযের ইবনে ছাদির কাছে একখানি চিঠি লিখে তাকেও ইসলামের দাওয়াত দেন। মুনযের ছিলেন ছিলেন বাহরাইনের শাসনকর্তা। এ চিঠি হযরত আলা ইবনে হাযরামির হাতে প্রেরণ করা হয়েছিলো। জবাবে মুনযের আল্লাহর রসূলকে লিখেছিলেন, হে আল্লাহর রসূল, আপনার চিঠি আমি বাহরাইনের অধিবাসীদের পড়ে শুনিয়েছি। কিছু লোক ইসলামকে পছন্দ করেছেন ও পবিত্রতার দৃষ্টিতে দেখেছেন এবং ইসলাম গ্রহণ করেছেন, আবার অনেকে পছন্দ করেননি। এখানে ইহুদী এবং অগ্নি উপাসকও রয়েছে। আপনি ওদের ব্যাপারে আমাকে নির্দেশ দিন। এর জবাবে রসূল (সাঃ) যে চিঠি লিখেছেন, তা নিম্নরূপ।
“পরম করুণাময় ও অতি দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।
আল্লাহর রসূল মোহাম্মদের পক্ষ থেকে মুসযের ইবনে ছাদির নামে। আপনার প্রতি সালাম। আমি আপনার কাছে আল্লাহর প্রশংসা করছি যিনি ব্যতীত এবাদাত পাওয়া উপযুক্ত কেউ নেই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মোহাম্মদ আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রসূল।
অতপর আমি আপনাকে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। মনে রাখবেন, যে ব্যক্তি ভালো কাজ করবেন, তিনি নিজের জন্যেই সেসব করবেন। যে ব্যক্তি আমার দূতদের আনুগত্য করবে এবং তাদের আদেশ মান্য করবে, সে ব্যক্তি আমারই আনুগত্য করেছে বলে মনে করা হবে। যারা আমার দূতদের সাথে ভালো ব্যবহার করবে তারা আমার সাথে ভালো ব্যবহার করেছে বলে মনে করা হবে। আমার দূতরা আপনার প্রশংসা করেছেন। আপনার জাতি সম্পর্কে আপনার সুপারিশ আমি গ্রহণ করেছি। কাজেই মুসলমান যে অবস্থায় ঈমান আনে, তাদের সেই অবস্থায় ছেড়ে দিন। আমি দোষীদের ক্ষমা করে দিয়েছি, আপনিও ওদের ক্ষমা করুন। আপনি যতদিন সঠিক পথ অনুসরণ করবেন, ততোদিন আপনাকে আমি বরখাস্ত করবো না। যারা ইহুদী ধর্ম-বিশ্বাসের ওপর রয়েছে এবং যারা অগ্নি উপাসনা করছে, তাদের জিযিয়া দিতে হবে।”
ইয়ামামার শাসনকর্তার নামে-
রাসূল (সাঃ) ইয়ামামার শাসনকর্তা হাওজা ইবনে আলীর কাছে নিম্নোক্ত চিঠি প্রেরণ করেন।
“পরম করুণাময় ও অতি দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।
আল্লাহর রসূল মোহাম্মদের পক্ষ থেকে হাওজা ইবনে আলীর কাছে চিঠি।
সেই ব্যক্তির ওপর সালাম, যিনি হেদায়েতের অনুসরণ করেন। আপনার জানা থাকা উচিত যে, আমার দ্বীন উট ও ঘোড়ার গন্তব্যস্থল পর্যন্ত প্রসার লাভ করবে। কাজেই ইসলাম গ্রহণ করুন, শান্তিতে থাকবেন। আপনার অধীনে যা কিচু রয়েছে, যে সবকে আপনার জন্যে অক্ষূণ্ণ রাখা হবে।”
এ চিঠি পৌঁছানোর জন্যে দূত হিসাবে সালীত ইবনে আমর আমেরিকে মনোনীত করা হয়। হযরত ছালীত সীলমোহর লাগানো এই চিঠি নিয়ে ইয়ামামার শাসনকর্তা হওযার দরবারে পৌছেন। হওযা তাকে নিজের মেহমান হিসাবে গ্রহণ করে মোবারকবাদ দেন। হযরত ছালিত চিঠিখানি শাসনকর্তাকে পড়ে শোনান। তিনি মাঝামাঝি ধরনের জবাব দেন। এরপর আল্লাহর রসূলের কাছে লিখিত জবাব দেন। জবাব নিম্নরূপ।
‘আপনি যে জিনিসের দাওয়াত দিচ্ছেন, তার কল্যাণময়তা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রশ্নাতীত। আরবদের ওপর আমার প্রভাব রয়েছে। কাজেই আপনি আমাকে কিছু কাজের দায়িত্ব দিন, আমি আপনার আনুগত্য করবো।’
শাসনকর্তা হওযা আল্লাহর রসূলের দূতকে কিছু উপঢৌকনও প্রদান করেন। মূল্যবান পোশাকও সেই উপঢৌকনের মধ্যে ছিলো। হযরত ছালীত সেইসব সামগ্রী নিয়ে আল্লাহর রসূলের দরবারে আসেন এবং তাঁকে সবকিছু অবহিত করেন।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহা আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ চিঠি পাঠ শেষে মন্তব্য করেন যে, সে যদি এক টুকরো জমিও আমার কাছে চায়, তবু আমি তাকে দেব না। সে নিজেও ধ্বংস হবে এবং যা কিছু তহার হতে রয়েছে, সেসবও ধ্বংস হবে।
রাসূল (সাঃ) মক্কা বিজয় থেকে ফিরে আসার পর হযরত জিবরাঈল (আ) তাঁকে খবর দিলেন যে, হাওযা মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে।
দামেশকের শাসনকর্তা গাসসানির নামে-
রাসূল (সাঃ) দামেশকের শাসনকর্তা হারেছ ইবনে আবু শিমার গাসসানির কাছে নিম্নোক্ত চিঠি প্রেরণ করেন।
“পরম করুণাময় ও অতি দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।
আল্লাহর সূল মোহাম্মদের পক্ষ থেকে হারেছ ইবনে আবু শিমারের নামে।
সেই ব্যক্তির প্রতি সালাম, যিনি হেদায়াতে অনুসরণ করেন, ঈমান আনেন এবং সত্যতা স্বীকার করেন। আপনাকে আমি আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপনের দাওয়াত দিচ্ছি, যিনি এক ও অদ্বিতীয় যাঁর কোন শরিক নেই। ইসলারেম দাওয়াত কবুল করুন। আপনার জন্যে আপনার রাজত্ব স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকবে।”
এই চিঠি আছাদ ইবনে খোজায়মা গোত্রের সাথে সম্পর্কি সাহাবী হযরত সুজা ইবনে ওয়াহাবের হাতে প্রেরণ করা হয়। হারেছের হাতে এ চিঠি দেয়ার পর তিনি বলেন, আমার বাদশাহী আমার কাছ থেকে কে ছিনিয়ে নিতে পারে? শীঘ্রই আমি তার বিরুদ্ধে হামলা করতে যাচ্ছি। এই বদনসী ইসলাম গ্রহণ করেনি।
আম্মানের বাদশাহের নামে
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহা আলাইহি ওয়া সাল্লাম আম্মানের বাদশাহ যেফার এবং তার ভাই আবদের নামেও একখানা চিঠি লিখেন। তাদের পিতার নাম ছিলো জলনদি। চিঠির বক্তব্য নিম্নরূপ-
“পরম করুণাময় ও অতি দয়ালূ আল্লাহর নামে শুরু করছি,
আবদুল্লাহর পুত্র মোহাম্মদের পক্ষ থেকে জলনদির দু্ই পুত্র যেফার ও আবদের নামে।
সালাম সেই ব্যক্তির ওপর, যিনি হেদায়াতের অনুসরণ করেন । অতপর আমি আপনাদের উভয়কে ইসলামের দাওয়াদ দিচ্ছি। ইসলাম গ্রহণ করুন, শান্তিতে থাকবেন। কেননা আমি সকল মানুসের প্রতি আল্লাহর রসুল। যারা জীবিত আছে, তারেদ পরিণামের ভয় দেকানো এবং কাফেরদের জন্যে আল্লাহর কথার সত্যতা প্রমাণের জন্যেই আমি কাজ করছি। আপনার উভয়ে ইসলাম গ্রহণ করলে আপনাদেরকেই শাসন ক্ষমতা অধিষ্টিত রাখা হবে। যদি অস্বীকৃত জানান, তবে আপনার বাদশাহী শেষ হয়ে যাবে। আপনাদের ভূখন্ড ঘোড়ার খুরের নিচে যাবে। আপনারেদ বাদশাহীর ওপর নবুয়ত বিজয়ী হবে।”
এ চিঠি পৌঁছানোর জন্যে হযরত আমর ইবনুল আসকে মনোনীত করা হয়। তিনি রওয়ানা হয়ে আম্মান গেলেন এবং আবদের সাথে সাক্ষাৎ করলেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে আবদ ছিলেন নরম মেযাজের। তাকে বললেন, আমি আপনার এবং আপনার ভাইয়ের কাছে রাসূল (সাঃ) এর কাছ থেকে দূত হিসাবে এসেছি। তিনি উত্তর দিলেন “আমার ভাই বয়স এবং বাদশাহী উভয় দিক থেকেই আমার চেয়ে বড় এবং অগ্রগণ্য। কাজেই আমি আপনাকে তার কাছে পৌছে দিচ্ছি, তিনি নিজেই আপনার আনীত চিঠি পড়বেন” একথার পর আবদ বললেন “আচ্ছা আপনার কিসের দাওয়াত দিয়ে থাকেন?”
আমর “আমরা আল্লাহর দিকে দাওয়াত দিয়ে থাকি। তিনি এক ও অদ্বিতীয়। তাঁ কোন শরীক নেই। আমরা বলে থাকি যে, আল্লাহ ব্যতীত যার এবাদত করা হয়, তাকে ছেড়ে দিন এবং এ সাক্ষ্য দিন যে, মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহা আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রসূল।”
আবদ “হে আমর, আপনি আপনার কওমের সর্দারের পু্ত্র। বলুন, আপনার পিতা কি করেছিলেন? আপনার পিতার কর্মপদ্ধতি আমাদের জন্যে অনুসরণযোগ্য হবে?”
আমর “তিনি মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর বিশ্বাস স্থাপনের আগেই ইন্তেকাল করেছেন। আমার খুবই আফসোস হচ্ছে, যদি তিনি ইসলাম গ্রহণ এবং আল্লাহর রাসূলের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতেন, কি যে ভালো হতো। আমি নিজেও অবিশ্বাসী ছিলাম। কিন্তু আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাকে ইসলামের হেদায়াত দিয়েছেন।”
আবদ “আপনি কবে থেকে তাঁর অনুসরণ শুরু করেছেন?”
আমর “বেশী দিন হয়নি”
আবদ “আপানি কোথায় ইসলাম গ্রহণ করেছেন?”
আমর “নাজ্জাশীর সামনে। নাজ্জাশীও মুসলমান হয়েছিল”
আবদ “তার স্বজাতীয়দের ইসলাম গ্রহণের পর তার বাদশাহীর কি করেছে?”
আমর “অক্ষুন্ন রেখেছে এবং অন্যরাও অনুসরণ করেছে”
আবদ “গীর্জার পাদ্রী ও অন্যরাও অনুসরণ করেছে?”
আমর “হ্যাঁ, সবাই করেছে”
আবদ “হে আমর, ভেবে দেখুন, আপনি কি বলছেন। মনে রাখবেন, মিথ্যার চেয়ে বদগুণ একজন মানুষের জন্য কিন্তু আর কিছুই হতে পারে না”
আমর “আমি মিথ্যা বলছি না। মিথ্যা বলা আমরা বৈধও মনে করি না”
আবদ “আমি মনে করি, সম্রাট হেরাক্লিয়াস নাজ্জাশীর ইসলাম গ্রহণের কথা জানেন না”
আমর “অবশ্যই জানেন”
আবদ “আপনি বুঝলেন কি করে?”
আমর “নাজ্জাশী হেরাক্লিয়াসকে আয়কর পরিশোধ করতেন, কিন্তু ইসলামের মাধ্যমে তিনি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সত্যতা মেনে নেয়ার পর বললেন, আল্লাহর শপথ, এখন থেকে হেরাক্লিয়াস যদি আমার কাছে একটি দিরহামও চান তবু আমি তাকে দেব না। এ খবর হেরাক্লিায়াসের দরবারে পৌছার পর তার ভাই ইয়ানাক তাকে বলেছিলো, আপনি কি খারাজ দিতে নারাজ আপনার এমন ভৃত্যকে ছেড়ে দেবেন? আপনার ধর্ম বিশ্বাস ত্যাগ করে অন্য একজনের ধর্ম বিশ্বাস গ্রহণ করবে, এটাও কি আপনি মেনে নেবেন? হেরাক্লিয়াস বললেন, এই লোক একটি ধর্ম বিশ্বাস পছন্দ করেছে এবং তা গ্রহণ করেছে, আমি তাকে কি করতে পারি? খোদার কসম, রাজত্বের লোভে না হলে আমি নিজেও তাই করতাম, নাজ্জাশী যা করেছেন”
আবদ “আমর ভেবে দেখুন, আপনি কি বলছেন?”
আমর “আল্লাহর শপথ, আমি সত্য কথাই বলছি”
আবদ “আচ্ছা বলুন, তিনি কি কাজের আদেশ দেন আর কি কাজ করতে নিষেধ করেন?”
আমর “আল্লাহ তায়ালা এর আনুগত্যের আদেশ প্রদান করেন এবং তাঁর নাফরমানী করতে নিষেধ করেন। নেকী করার এবং আত্মীয় স্বজনদের সাথে ভালো ব্যবহার করার আদেশ প্রদান করেন। যুলুম, অত্যাচার, বাড়াবাড়ি, ব্যাভিচার, মদ পান, পাথর, মূর্তি এবং ক্রশ-এর উপাসনা করতে নিষেধ করেন।”
আবদ “তিনি যেসব কাজের আদেশ করেন এর সবই তো ভালো কাজ। আমার ভাই যদি আমার অনুসরণ করবে বলে ভরসা পেতাম, তবে আমরা সওয়ার হয়ে মদীনায় ছুটে যেতাম এবং মোহাম্মদ (সা) এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতাম। কিন্তু আমার ভাই এর রাজত্বের ওপর প্রবল লোভ, তিনি রাজত্ব হারানোর ভয়ে অন্য কারো আনুগত্য মেনে নেবেন কিনা, সন্দেহ রয়েছে।”
আমর “যদি তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন, তবে আল্লাহর রাসূল তাকেই বাদশাহীতে বহাল রাখবেন। তবে তাকে একটা কাজ করতে হবে যে, ধনীদের কাছ থেকে সদকা আদায় করে গরীবদের মধ্যে বিতরণ করতে হবে।”
আবদ “এটাতো বড় ভলো কাজ। আচ্ছা বলুনতো, সদকা কি জিনিস?”
এরপর আমর (রাঃ) বিভিন্ন দ্রব্যের উপর আল্লাহর রাসূলের নির্ধারণ করা সদকার বিবরণ উল্লেখ করলেন। উটের প্রসঙ্গ এলে তিনি বললেন, হে আমর, আমাদের ওসব পশুপাল থেকেও কি সদকা নেয়া হবে, যারা নিজেরাই চারণ ভূমিতে চরে বেড়ায়?
আমর- হাঁ।
আবদ -আল্লাহর শপথ আমি জানি না, আমাদের দেশের মানুষ দেশের বিশালতা এবং উটের সংখ্যাধিক্যের কথা ভেবে এটা মেনে নেবে কি না।
আমর ইবনুল আস (রাঃ) রাজ দরবারের দেউড়িতে কয়েক দিন কাটালেন। আবদ তাঁর ভাইয়ের কাছে গিয়ে আমরের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করলেন। একদিন আমরকে ডাকলেন, আমর ভেতরে প্রবেশ করলেন। প্রহরীরা আমরকে বাহু আঁকড়ে ধরলো। আবদ বললেন, ছেড়ে দাও, ওরা তখন আমরকে ছেড়ে দিলো। আমর (রাঃ) বসতে চাইলে প্রহরীরা ওনাকে বসতে দিলো না। তিনি বাদশাহর দিকে তাকালে তিনি বললেন, বলুন, কি করতে চান? আমর (রাঃ) মুখবন্ধ খামের চিঠি তার হাতে তুলে দিলাম। তিনি খামের মুখ ছিঁড়ে চিঠিখানা পড়লেন। সব পড়ার পর তার ভাইয়ের হাতে দিলেন। আমি লক্ষ্য করলাম যে, বাদশাহর চেয়ে তার ভাই আবদ অপেক্ষাকৃত নরম মেজাজের মানুষ।
বাদশাহ জিজ্ঞাস করলেন, কোরায়শ কি ধরণের ব্যবহার করেছিলো, বলুন।
আমর -সবাই তার আনুগত্য মেনে নিয়েছে। কেউ দ্বীনের প্রতি ভালবাসার কারণে, আবার দু‘একজন তলোয়ারের ভয়ে।
বাদশাহ- তাঁর সাথে কি ধরণের লোক রয়েছে?
আমি -সব ধরনের লোকই রয়েছে। তারা ইসলামকে আগ্রহের সাথে গ্রহণ করেছে। ইসলামকে অন্য সকল ধর্ম বিশ্বাসের ওপর প্রাধান্য দিয়েছে। আল্লাহর হেদায়াত এবং বিবেকের পথ-নির্দেশনায় তারা বুঝতে পেরেছে যে, এ যাবত তারা ছিলো পথভ্রষ্ট। আমার জানামতে এই এলাকায় আপনিই শুধু এখনো ইসলাম গ্রহণ করেননি। আপনি যদি ইসলাম গ্রহণ না করেন এবং মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ না করেন, তবে ঘোড়া ও উটের পিঠে সওয়ার হয়ে আসা লোকেরা আপনাকে তছনছ করে দেবে। আপনার সজীবতা নিশ্চিহ্ন করে দেবে। কাজেই ইসলাম গ্রহণ করুন, শান্তিতে থাকবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপনাকেই আপনার কওমের শাসনকর্তা হিসেবে বহাল রাখবেন। আপনার এলাকায় কোন হামলাকারী প্রবেশ করবেন না।
বাদশাহ বললেন, আপনি, আগামীকাল আমার সাথে দেখা করুন।
এরপর আমর বাদশাহর ভাইয়ের কাছ ফিরে গেলেন।
আবদ বললেন, আমর, আমার ধারণা, বাদশাহীর লোভ প্রবল না হলে আমার ভাই ইসলাম গ্রহণ করবেন।
পরদিন পুনরায় বাদশাহর কাছে যেতে চাইলেন। কিন্তু ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিলেন না। ফিরে এসে তার ভাইকে সে কথা জানালাম। তার ভাই আমাকে তার কাছে পৌছে দিলো। বাদশাহ বললেন, আপনার উপস্থাপিত দাওয়াত সম্পর্কে আমি ভেবে দেখেছি। আমি যদি বাদশাহী এমন একজনের কাছে ন্যস্ত করি, যার সেনাদল এখনো পৌছেইনি, তবে আমি আরবের সবচেয়ে দুর্বল এবং ভীরু বলে পরিচিত হবো। যদি তার সৈন্যরা এখানে এসেই পড়ে, তবে আমরা তাদের যুদ্ধের সাধ মিটিয়ে দেব।
আমি বললাম, ঠিক আছে, আমি আগামীকাল ফিরে যাচ্ছি।
আমরের যাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর বাদশাহ তার ভাইয়ের সাথে নির্জনে মতবিনিময় করলেন। বাদশাহ তার ভাইকে বললেন, এই পয়গাম্বর যাদের ওপর বিজয়ী হয়েছে, তাদের তুলনায় আমরা কিছুই না। তিনি যার কাছেই পয়গাম পাঠিয়েছেন তিনিই দাওয়াত কবুল করেছেন।
পরদিন সকালে পুনরায় আমরকে বাদশাহের দরবারে ডাকা হলো। বাদশাহ এবং তার ভাই উভয়েই ইসলাম গ্রহণ করলেন। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করলেন। সদকা আদায় এবং বাদী বিবাদীর মধ্যে ফয়সালা করতে আমর (রাঃ) কে দায়িত্ব দেয়া হলো। এ ব্যাপারে তারা আমর (রাঃ) কে যথেষ্ট সাহায্য সহযোগিতা করলেন।
এ ঘটনার বিবরণ ও প্রকৃতি দেখে মনে হয়, অন্যান্য বাদশাহের পরে উভয়ের কাছে আল্লাহর রাসূল চিঠি প্রেরণ করেছিলেন। সম্ভবত মক্কা বিজয়ের পর এ চিঠি প্রেরণ করা হয়।
এ সকল চিঠির মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম বিশ্বে অধিকাংশ এলাকায় তাঁর দাওয়াত পৌছে দিয়েছিলেন। জবাবে কেউ ঈমান এনেছে, কেউ কুফুরীর ওপরই অটল থেকেছে। তবে এ সকল চিঠির প্রভাব এটুকু হয়েছে যে, যারা কুফুরী করেছে তাদের মনোযোগও এ দিকে আকৃষ্ট হয়েছে এবং তাদের কাছে আল্লাহর রাসূলের নাম এবং তাঁর প্রচারিত দ্বীন একটি পরিচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
Subscribe to:
Post Comments
(
Atom
)
No comments :
Post a Comment