মরুর ফুল ১৭
শাহজাদী বিলকিস হিসাব করছেন, রাণি শিরির সবচেয়ে বড় শক্তি হল সম্রাট নিজেই। বুদ্ধি মত্তার দিক দিয়ে অন্য রাণিদের চেয়ে এগিয়ে বলেই সম্রাট শিরিকে দরবারী কাজে জড়িত করেছে। রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত রাণি শিরির পরামর্শে হয়। যেভাবেই হোক রাণি শিরি নিজেকে সম্রাটের কাছে ‘নির্লোভ’ বলে প্রমাণ করতে পেরেছেন যার উদাহরণ হিসেবে সম্রাট যখন রাণি শিরিকে জিজ্ঞাসা করলেন “পরবর্তী সম্রাট হিসেবে তুমি কাকে ভাল লাগে?” জবাবে রাণি নিজের ছেলের নাম না বলে সম্রাটের দ্বিতীয় স্ত্রীর বড় ছেলের নাম বলেছেন। শিরি যে এখানে বড় চালাকি করেছেন তা শুধু মাত্র বিলকিসই ধরতে পেরেছে। কারণ ঐ ছেলেকে সম্রাট যোগ্য মনে করেন। ঐ যোগ্য ছেলের নাম না বলে অন্য ছেলের নাম বলে রাণি শিরি নিজেকে সম্রাটের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিতে চাইবেন না। রাণি শিরি সম্রাটকে বুঝিয়ে শুনিয়ে শিরির চাচাতো ভাই ও সম্রাটের ছোট কালের বন্ধু খালেকদুনকে সেনাপতি বানিয়েছে যদিও সেনাপতি হবার দৌড়ে তিনি কখনোই ছিলেন না। যার এখন সেনাপতি হবার কথা তিনি এখন খালেকদুনের অধীনে যুদ্ধক্ষেত্রে আছেন। খালেকদুন হল রাণি শিরির দ্বিতীয় বড় শক্তি। সেনাপতি হওয়ার পরে স্বাভাবিক ভাবেই খালেকদুন মাদায়েন চলে আসার কথা ছিল কারণ সেনাপতি সব সময় রাজার চোখের সামনে সামনে থাকতে হয়। এই খালেকদুন যদি মাদায়েনে চলে আসত তাহলে শিরির শক্তি আরো বেড়ে যেত। ধীরে ধীরে শিরি গোটা দরবার দখল করে ফেলত কিন্তু তাতে বাধ সাধে শাহজাদী বিলকিস। তিনি দরবারীদের ম্যানেজ করলেন, তাদের বিভিন্ন উচ্চ পদের লোভ দেখালেন আর এটাও বোঝালেন- খালেকদুন আসলে তোমাদের প্রত্যেকের অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। তাই যে করেই হোক না কেন খালেকদুনকে ঠেকাও। সে সেনাপতি হয়েছে ভাল কথা কিন্তু তাকে মাদায়েনের বাইরে রাখ। সেই দরবারীরা সম্রাটকে বোঝাতে সমর্থ হলেন আর সম্রাট খালেকদুনকে বসফরার প্রণালিতে অবরোধে পাঠালেন। সেই দরবারীদের একজন হল হামিদ। তিনি অত্যন্ত প্রভাবশালী বংশের প্রধান। মাদায়েন ও আশেপাশের এলাকায় তার বেশ প্রভাব প্রতিপত্তি রয়েছে। তিনি সম্রাটের কাছের লোক। সেই হিসেবে প্রধান উজিরের পদের দাবীদার তিনি। কিন্তু সেই পদে আরো কয়েকজন প্রতিদ্বন্দ্বী রয়েছে। বর্তমান প্রধান উজির যে কোন মুহুর্তে বরখাস্থ হতে পারে। মূলত তার পদের দিকে অন্যান্য প্রধান উজির প্রার্থীরাই তাকে ব্যার্থ বলে প্রমাণ করে ছেড়েছেন। এতে অবশ্য বিভিন্ন শাহজাদা, শাহজাদী ও রাণিদের হাত ছিল। প্রধান উজির সম্রাটের ষষ্ঠ স্ত্রীর চাচা। সুন্দরী ভাতিজীকে সম্রাটের কাছে বিয়ে দিয়ে সম্রাটের সুনজরে এসেছিলেন। প্রথমে উচ্চ পদস্থ রাজ কর্মচারী ও পরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দীর্ঘ দিন কাজ করে বর্তমানে বৃদ্ধ বয়সে প্রধান উজিরের দায়িত্ব পেয়েছেন। এর আগের আগের উজিরের ফাঁসি হয়েছিল রোমানদের সাথে সন্ধী প্রস্তাব নিয়ে সম্রাটকে প্রভাবিত করার অপরাধে। মুলত সেটাও ছিল আরেক ষড়যন্ত্র। সেই ষড়যন্ত্রে যে শাহজাদা জড়িত ছিল পরে তার ফাঁসি হয়েছে। সেই ফাঁসি হওয়া শাহজাদার বোন হল শাহজাদী বিলকিস। বিলকিসের ধারনা রাণি শিরিই প্রথম সম্রাটের কাছে সেই শাহজাদার বিরুদ্ধে কথা বলে সম্রাটকে শাহজাদার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলেন। সেই থেকে বিলকিস বানু রাণি শিরির পিছনে লেগে আছেন। এছাড়া ক্ষমতার লোভ তো আছেই। আপন ভাই সম্রাটের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগে ফাঁসি হওয়ায় তাদের মা ও অন্যান্য ভাই বোনও সম্রাটের রষানলে পড়েছে। শাহজাদী বিলকিস এখন চেষ্টা করেছে কী করে তাদের পথের প্রধান কাঁটা রাণি শিরিকে সম্রাটের মন থেকে মুছে ফেলা যায়। সে জন্য বিলকিস প্রভাবশালী দরবারীদের একজন হামিদকে তার কামরায় ডাকলেন।হামিদ কুর্ণিশ করে দাঁড়িয়ে রইল।
“আপনি দাঁড়িয়ে কেন? আমার কামরায় আসলে আপনাকে কখনো অনুমতি নিয়ে বসতে হবে না” শাহজাদী বিলকিসের কন্ঠে নম্রতা ঝরে পড়ছে।
কিছুক্ষণ তারা যুদ্ধ বিষয়ে আলচনা করল। তারপরে শাহজাদী সরাসরি উজিরকে প্রশ্ন করলেন “আপনি আর কতদিন উজির থাকতে চান?”
“আপনাদের দয়া হলে এই অধম বান্দার দিকে যদি একটু সুনজর দিতেন তাহলে.....” উজিরের কন্ঠে বিনয়ের সূর।
শাহজাদী বিলকিস ফিসফাস করে বলল “আমি আপনাকে প্রধান উজির হিসেবে দেখতে চাই কিন্তু আপনি জানেন আপনার পথের প্রধান কাঁটা কে?”
উজির না জানার ভান করে রইল। উজির ভাল করেই জানে শাহজাদী নিশ্চয়ই রাণি শিরির কথা বলবেন। তবুও ভাব দেখাল কিছুই জানে না।
শাহজাদী নিজেই উত্তর দিল “রাণি শিরি চাচ্ছে তার পছন্দের লোককে প্রধান উজির বানাবে”
উজির “রাণি শিরির পরামর্শেই উজির প্রধান উজির নিয়োগ দেয়া হয়। উনি যদি আমার পথের কাঁতা হন তাহলে অধমের পক্ষে কিছুতেই প্রধান উজির হওয়া সম্ভব না। আপনি যদি একটু সুদৃষ্টি দিতেন.....”
“আপনার যোগ্যতা আপনাকেই অর্জন করতে হবে। আপনি রাণির মুখ বন্ধের ব্যবস্থা করুন। বাবা (সম্রাট) যাতে রাণিকে অবিশ্বাস করতে থাকে সেই ব্যবস্থা করুন।”
“সেটা কি আমাদের পক্ষে করা সম্ভব? আমরা চুনোপুটি মানুষ”
“আপনি চুনোপুটি হলে খালেকদুনকে কীভাবে মাদায়েনে না এনে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়েছেন?” শাহজাদীর কন্ঠে প্রশ্ন বোধক চিহ্ন।
“আমি তো আপনার কথা অনুযায়ীই খালেকদুনকে সরানোর জন্য সম্রাটকে বুঝিয়েছিলাম। সম্রাট যে কথাটার গুরুত্ব দিবে সেটা কখনো কল্পনাই করি নাই।”
“তখন যেভাবে খালেকদুনকে মাদায়েন থেকে সরিয়েছেন ঠিক তেমনি এবার খালেকদুনকে সম্রাটের মন থেকে সরিয়ে দিবেন। পারবেন না? খালেকদুনকে বিশ্বাস ঘাতক প্রমাণ করতে পারলে তাকে ঐ পদে বসানোর জন্য রাণি শিরিও সম্রাটের বিরাগ ভাজন হবেন আর রাণি শিরি সম্রাটের বিরাগ ভাজন হলে প্রধান উজির নিয়োগের সময় তিনি রাণির কথা শুনবেন না।”
উজির ভাল করেই জানে রাণি শিরিকে বিশ্বাস ঘাতক প্রমাণ করতে পারলে সম্রাট শিরিকে মৃত্যুদন্ড দিবেন। এসব ক্ষেত্রে তিনি কাউকে কোন ছাড় দেন না। ওনাদের পূর্ব পুরুষদের মধ্যে এ ধরনের অনেক ঘটনা আছে। তিনি নিজের ছেলেকেও ফাঁসি দিয়েছেন।
উজির কক্ষ থেকে বিদায় নিল। অনুমতি নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করল রাজকীয় বাহিনীর এক কমান্ডার মাসউদ। এই কমান্ডার খুব ধুর্ত। সে মূলত শাহজাদী বিলকিসের পক্ষে আততায়ীর (কিলার) কাজ করে। এই মাসউদই রাজকীয় বাহিনীর আরেক কমান্ডারকে হত্যা করেছিল যে জায়েজকে খালেকদুনের সেনাদের কাছ থেকে কৌশলে নিয়ে আসে। শাহজাদী বিলকিসের কাজের একটা বৈশিষ্ট হল-কারো কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সাহায্য নিলে তাকে সরিয়ে ফেলা যাতে সে কখনো মুখ খুলতে না পারে। মাসউদ এই পর্যন্ত দশ জনকে হত্যা করেছে।
“আপনার হুকুম তামিলের অপেক্ষায় শাহজাদী” কুর্ণিশ করে মাসউদ বলল।
“তুমি তো এই পর্যন্ত অনেকগুলো খুন করেছ। এইবার একজনকে খুন করতে হবে। এই খুন তুমি সরাসরি করবে। অন্য যত খুন করেছে প্রত্যেকটা ছিল গোপনে। তোমার বাহিনীর লোকজন জানতে পারলে তোমাকে কচুকাটা করবে কিন্তু যেই খুন তুমি করতে যাচ্ছ তাতে তোমার সুনাম বেড়ে যাবে, আমারও কাজ হবে। মাদায়েন বাসীও বাহবা দিবে।”
শাহজাদীর কথা মাসউদের মাথায় কিছুই ঢুকছে না। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
শাহজাদী বলল “তোমার এত কিছু জানার প্রয়োজন নেই। আপাতত তুমি মাদায়ানের কারাগারে যাও।” শাহজাদী মাসউদকে একটা কাজ দিলেন।
মাদায়েনের কারাগার। এই কারাগার মূলত করা হয়েছে সম্রাটের বিরাগ ভাজন লোকদের জন্য। গোয়েন্দা রিপোর্টে যদি কারো বিরুদ্ধে তথ্য আসে যে উনি সম্রাটের শাসনে খুশী নন অথবা সম্রাটকে সরিয়ে অন্য কাউকে সম্রাট বানানোর জন্য চক্রান্ত করছে তাহলে তাকে সরাসরি কারাগারে ধরে নিয়ে আসা হয়। অনেক সময় তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় অনেক সময় জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই প্রমাণাদি ছাড়াই ফাঁসি দেয়া হয়। এছাড়া রাজ প্রাসাদের কিংবা ধনী লোকদের বিরুদ্ধে কেউ কোন কথা বললে তাকেও এই কারাগারে ধরে আনা হয়। জায়েদজে প্রায় এক মাস এই কারাগারে বন্দী রাখা হয়েছে। তাকে একটা কক্ষে রাখা হয়েছে। দিন রাত তার কাছে সমান। দরজার বাইরের একজন প্রহরী দিনে তিন বার তাকে খাবার দিয়ে যায়। প্রহরীকে কোন প্রশ্ন করলে উত্তর দেয় না। তবে সে এটা বুঝতে পারছে তাকে অন্যদের থেকে আলাদা রাখা হয়েছে। কারাগারে সে নিশ্চয় একা নয়।
এই মুহুর্তে শাহজাদী বিলকিসের আততায়ী মাসউদ জায়েদের সামনে বসে আছে। জায়েদকে একটা কক্ষে আনা হয়েছে। কক্ষের চেহারা দেখেই বোঝা যায় এই কক্ষে নির্যাতন করা হয়। জায়েদকেও বসতে বলা হল। জায়েদ গোয়েন্দা প্রশিক্ষন প্রাপ্ত সৈনিক। তারাও রোমান বাহিনীর সদস্যদের মাঝে মাঝে বন্দি করত। বন্দীদের সাথে তারা কী আচরণ করত তা ভেবে জায়েদ এখনো শিউরে ওঠে। জায়েদ অবাক হল এরা জায়েদের সাথে তেমন কোন আচরণই করল না। জায়েদকে বসতে বলায় সে আরো অবাক হয়েছে।
“আমি তোমার জন্য মুক্তির পয়গাম নিয়ে এসেছি” মাসউদের কন্ঠ শুনে মুক্তির কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না “তোমাকে শুধু একটা কাজ করতে হবে। কাজটা করতে পারলে কারাগার থেকে মুক্তি নয়তো দুনিয়া থেকে মুক্তি।”
“কী কাজ?”
“একজনকে খুন করতে হবে”
“আমি খুনোখুনিতে নেই। আপনি অন্য কোন উপায় থাকলে বলেন। প্রয়োজনে আজীবন আপনার গোলাম হয়ে থাকব।” এটা জায়েদের গোয়েন্দা প্রশিক্ষনের ফল। জায়েদ জানে তাদের প্রস্তাবে রাজী না হলে তাকে হত্যা করা হবে। আবার যদি সাথে সাথে রাজী হয়ে যায় তাহলে সন্দেহ করবে। সেক্ষত্রে হিতে বিপরীতও হতে পারে। তাই সে প্রথমে রাজী হল না।
“তাহলে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও।”
“এমনিতেই মরে আছি। সারাদিন এক কক্ষে থাকি যেখানে দিন রাত সমান। কারো সাথে কথা বলতে পারি না।”
“আমি তোমার কক্ষ বদলে দিচ্ছি। খবরদার কাউকে তোমার আসল পরিচয় দিতে যাবে না। এক রাজকীয় সেনা অফিসারকে হত্যার অভিযোগে তোমার মাথার দাম ঘোষনা করা হয়েছে। যদি পরিচয় দাও তাহলে তুমি শেষ। এখন বল তুমি কি আমার প্রস্তাবে রাজী হয়েছ?”
“আমাকে কিছুদিন সময় দিত হবে”
“কিছুদিন না, আমি আগামী সপ্তাহে এখানে আসব। হয় তোমাকে নিয়ে ফিরব অথবা তমার মাথা নিয়ে।”
জায়েদকে নতুন কক্ষে নিয়ে আসা হল। এই কক্ষে আলো বাতাস সবই আছে। কক্ষে আরেকজন মধ্য বয়স্ক বন্দি রয়েছে। তিনি অসুস্থ, কোঁকাচ্ছেন। জায়েদ লোকটির দিকে এগোল, গায়ে হাত দিয়ে দেখল লোকটার প্রচন্ড জ্বর। জায়েদ যথা সম্ভব লোকটার সেবা শুশ্রুষা করল। ঐ দিন তার সাথে কোন কথা হল না।
পরদিন লোকটার জ্বর কিছুটা কমে যাওয়ার পরে জায়েদের সাথে কথা বলল। লোকটার যে পরিচয় জায়েদ পেল সেটা হল- তিনি ইরানের এক চার্চের পাদ্রী। চার্চটি আরবের কাছাকাছি। রোমানরা পর পর কয়েকটি এলাকায় জেতার পরে ইরানীরা তাদের এলাকায় অবস্থিত খ্রিস্টানদের নিয়ে নতুন করে ভাবা শুরু করে। তাদের ধারনা যত সব নষ্টের মূল এই পাদ্রীরা। এরা খ্রিস্টান হওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই রোমানদের পক্ষে থাকবে। ইরানীদের ধারনা পাদ্রীরা সাধারণ খ্রিস্টানদের উস্কে দিচ্ছে। তাদেরকে রোমানদের পক্ষে ও ইরানীদের বিপক্ষে যুদ্ধ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করছে। তাই বিভিন্ন এলাকার পাদ্রীদের পাইকারী ভাবে গ্রেফতার করা হল। অনেক পাদ্রী পালিয়ে গেলেন। অনেক ধরা পড়ল। ধরা পড়া পাদ্রীদের এক ফ্রান্সিস যে এখন জায়েদের সাথে একই কক্ষে কারাগারে বন্দী অবস্থায় আছে। তিন চার দিনের মধ্যেই জায়েদের সাথে র পাদ্রীর ভাল খাতির হল। এই পাদ্রী মূলত ইরানী হলেও ছেলেবেলা কেটেছে সিরিয়ার বিভিন্ন শহরে। সেই কারণে তার সাথে জায়েদের সম্পর্ক বেশি হল কারণ জায়েদও সিরিয়ার অনেক স্থান চেনে। জায়েদের কাছ থেকে পাদ্রী যখন শুনলেন তার বারী ইয়াসরিব তখন তিনি জায়েদের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে বললেন “ইয়াসরিবের লোকজন চুরি করে তা বিশ্বাস হয় না। চুরি ডাকাতি রাহাজানি সব কিছুর বিরুদ্ধে তো তোমরাই যুদ্ধ ঘোষনা করেছ।”
জায়েদের মাথায় কিছুই ঢুকল না। পাদ্রী জায়েদের মনের কথা বুঝতে পেরে বললেন “ইয়াসরিবে যে নবী এসেছেন তিনি মানুষকে ভাল কথা বলতে বলেন, ভাল কাজ করতে বলেন, আমানত রক্ষা করতে বলেন।”
“আপনি সেই নবীকে চিনেন?” জায়েদের কন্ঠে উৎসাহ।
“চিনব না? ছোট বেলায় যখন সিরিয়ায় ছিলাম তখন আমি জারজিস নামের এক পাদ্রী অধীনে কিছুদিন ছিলাম। উনিই আমাকে প্রথম নবীর কথা বললেন।”
“উনি কী বললেন?”
“আরবের সেই নবী বার বৎসর বয়সে তাঁর চাচা আবু তালেবের সাথে সিরিয়ার বসরায় গিয়েছিল। জারজিস ছিলেন বসরার সবচেয়ে নাম করা গীর্জা বুহাইরার পাদ্রী। অনেক জ্ঞানের অধিকারি জারজিসের কাছে অন্য এলাকা থেকে পাদ্রীরা জ্ঞান অর্জনের জন্য আসতেন। তোমাদের নবী বসরায় তাঁবু ফেললেন। নবী পাদ্রী জারজিসের নজরে পড়লেন। তিনি তাঁকে অনেক প্রশ্ন করলেন, অনেক কথা বললেন। ইঞ্জিল ও তাওরাত শরীফের মাধ্যমে জানা গেছে যে শেষ নবী ইসমাঈলি বংশ ধ্বর থেকেই হবেন। পাদ্রী এরপরে তাঁকে সিরিয়ার সামনে এগোতে নিষেধ করলেন কারণ সেখানকার খ্রিস্টান ইহুদী পাদ্রীরাও শেষ নবীর আগমনের খবর জানেন। পরে আবুল তালেব নবীকে ভৃত্যের মাধ্যমে আরবে ফেরত পাঠিয়ে দিলেন।” জারজিস কিছুক্ষন বিরতি নিলেন। অসুস্থ হওয়ায় কথা বলতে বলতে তিনি হাঁপিয়ে উঠেছেন। জায়েদের চোখ চকচক করতে লাগল “ইশ, অল্পের জন্য নবীকে মিস করলাম। আর কিছুদিন মদীনায় থেকে গেলে নবীকে দেখতে পেতাম।”
জায়েদের কথা শুনে পাদ্রী বললেন “আমারও ইচ্ছা ছিল নবীর কাছে যাব কিন্তু তার আগেই আমাকে ধরে আনা হয়েছে।”
“আপনি ছোটকালে নবীর কথা শুনেছেন অথচ এতদিন যান নি কেন?”
“এতদিন যাইনি কারণ নবীর নবুয়্যত নিয়ে আমার সন্দেহ ছিল। তিনি যখন বিভিন্ন যুদ্ধে জয়ী হতে শুরু করলেন তখন মানুষ দলে দলে ওনার দলে যোগ দিতে লাগল তখন ওনার নাম আরবে ছড়িয়ে পড়ে। আমি বিভিন্ন কিতাব ঘেঁটে মিলিয়ে দেখলাম শেষ জামানার নবী উনিই হবেন। উনি যখন খন্দকের যুদ্ধে বিজয়ী হলেন তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমি ওনার সাথে দেখা করব।”
জায়েদ দেখল পাদ্রী রাসূল (সাঃ) সম্মন্ধে অনেক কিছু জানেন। জায়েদ পাদ্রীর কাছ থেকে রাসূল (সাঃ) এর বিভিন্ন অভিযান সম্মন্ধে বিস্তারিত জানল। এর মধ্যে একটি ঘটনা হল মক্কায় গম রফতানী বন্ধ করে দেয়ার ঘটনা। ঘটনাটা তিনি যেভাবে শুনেছেন তা হল-
খন্দক ও কোরায়যার যুদ্ধের পর রাসূল (সাঃ) একটি প্রথম সামরিক অভিযান। ত্রিশজন সাহাবার সমন্বয়ে গঠিত একটি দল এই অভিযানে অংশ নেন। নজদের অভ্যন্তরে বাকরাত এলাকার রিয়ায় এই সেনাদল প্রেরণ করা হয়। হিজরীর ১০ই মহররম এই সেনাদল প্রেরিত হয়। যারিয়া এবং মদীনার মধ্যে সাত রাতের দুরত্ব। লক্ষ্য ছিলো বনু বকর ইবনে কেলাব গোত্রের একটি শাখা। মুসলমানরা ধাওয়া করলে শত্রুরা সকলেই পালিয়ে যায়। মুসলমানরা বকরিসহ বেশ কিছু চতুষ্পদ জন্তু অধিকার করে এবং মহররমের একদিন বাকি থাকতেই মদীনায় এস পৌঁছেন। এরা বনু হানিফা গোত্রের সর্দার ছামামা ইবনে আছাল হানাফীকেও গ্রেফতা করে নিয়ে আসেন। ছামামা ভন্ড নবী মোসায়লামা কাযযাববের নির্দেশে ছদ্মবেশ ধারণ করে রসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যা করতে বেরিয়েছিলো।
মুসলমানরা ছামামাকে গ্রেফতার করে মসজিদে নববীর একটি খুঁটির সাথে বেঁধে রাখেন। রাসূল (সাঃ) এসে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ছামামা, তোমার কাছে কি আছে? সে বললো, হে মোহাম্মদ, আমার কাছে আছে কল্যাণ। যদি আপনি আমাকে হত্যা করেন তবে এমন একজন লোককে হত্যা করবেন যার দেহে প্রচুর রক্ত আছে। যদি অনুগ্রহ করেন, তবে এমন একজনকে অনুগ্রহ করবেন যে অকৃতজ্ঞ নয়। যদি ধন-সম্পদ চান, তবে বলুন কি পরিমাণ প্রয়োজন। এসব কথা শোনার পর রাসূল (সাঃ) তাকে সেই অবস্থাই ফেলে রাখলেন, দ্বিতীয়বার এসে তিনি একই প্রশ্ন করলেন এবং ছামামা একই জবাব দিলো। এরপর তৃতীয়বা এসে রাসূল (সাঃ) একই প্রশ্ন করলেন এবং সেই একই জবাব দিলো। রাসূল (সাঃ) এরপর নির্দেশ দিলেন যে, ছামাকে মুক্ত করে দাও। তাকে মুক্ত করে দেয়া হলো। ছামামা তখন মসজিদে নবনীর কাফে একটি খেজুর বাগানে গিয়ে গোসল করে পবিত্র হলো এরপর রাসূল (সাঃ) এর কাছে এসে ইসলাম গ্রহণ করলো। ইসলাম গ্রহণের পর সে বললো, আল্লাহর শপথ, সমগ্র পৃথিবীতে কোন মানুষের চেহারা আমার দৃষ্টিতে আপনার চেহারার চেয়ে অপ্রিয় ছিলো না। কিন্তু আজ কোন মানুষের চেহারা আপনার চেহারার চেয়ে প্রিয় নয়। আল্লাহর শপথ, বিশ্ব জগতে আপনার দ্বীনের চেয়ে অপ্রিয় দ্বীনের চেয়ে প্রিয়। আপনার সওয়াররা আমাকে এমতাবস্থায় প্রেফতা করেছে যে, আমি ওমরাহ পালনের ইচ্ছা করছিলাম। রাসূল (সাঃ) তাকে সুসংবাদ দিলেন এবং পালনের নির্দেশ দিলেন। কোরায়শদের কাছে পৌঁছার পর তারা বললো, ছামামা, তুমি বেদ্বীন হয়ে গেছো। তিনি বললেন, না আমি মোহাম্মদ (সাঃ) হাতে মুসলমান হয়েছি। শোনো, তোমাদের কাছে ইমামার কোনো গম আসবে না যতক্ষণ না রাসূল (সাঃ) অনুমতি প্রদান করেন। ইয়ামামা হচ্ছে মক্কাবাসীদের কাছে ক্ষেতের মতো। হযরত ছামামা (রা) দেশে পৌঁছে মক্কায় গম রফতানী বন্ধ করে দিলেন। এতে কোরায়শারা ভীষণ মুশকিলে পড়ে গেলো। তারা রসূল (সাঃ) নিকটাত্মীয়তার সম্পর্কের দোহাই দিয়ে লিখলো যেন তিনি ছামামাকে মক্কায় গম রফতানির নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার অনুরোধ জানান। দয়াল নবী তাই করলেন।
পাদ্রীর কাছ থেকে এরকম অনেক অসাধারণ ঘটনা শোনার পরে জায়েদের খুব ইচ্ছা হল মদীনায় যাবে। এখান থেকে কোন মতে পালাতে পারলেই সোজা মদীনা। এখন সাত দিন পরে যার আসার কথা তিনি কাকে হত্যা করার প্রস্তাব নিয়ে আসেন তা দেখতে হবে। হত্যা করার উছিলায় এখান থেকে বেরিয়েই সে মাদায়েন থেকে পালিয়ে যাবে। এখন দেখা যাক কাকে হত্যা করতে বলছে?
সাত দিন পরে সেই লোক এলেন। তিনি জায়েদকে বললেন “যাকে তুমি হত্যা করতে যাচ্ছ তার স্ত্রীকে তুমি চেন। আশা করি যারা তোমাকে হত্যার জন্য বসফরাস নিয়ে যাচ্ছিল তাদের লোককে হত্যা করতে তুমি দ্বিধা করবে না।”
জায়েদের বুক কেঁপে উঠল। মাদায়েনে সে একমাত্র খালেকদুনের স্ত্রীকেই চেনে। তবে কি খালেকদুন মাদায়েনে চলে এসেছে? তাকে খুন করতে হবে? ইরানী সেনাপতির এই অবস্তাহ কী করে হল?
এরপরে সে যা শুনল তা শোনার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না।
“তুমি যাকে হত্যা করবে তার নাম সোহরাব। তার স্ত্রী নাম মেহরিন, খালেকদুনের মেয়ে।”
Subscribe to:
Post Comments
(
Atom
)
No comments :
Post a Comment