মরুর ফুল ৩৪
রোম আর ইরানের রাজনৈতিক অবস্থার কোন পার্থক্য ছিল না। খ্রিস্টবাদ সুন্দরের শিক্ষা দিলেও সে এসব সম্রাটদের মানসিকতার পরিবর্তনে অক্ষম ছিল যারা চোখ মেলেছিল প্রাচীন গ্রীক সভ্যতায়। সিরিয়া এবং ফিলিস্তিন শত শত বছর থেকে প্রাচ্য পাশ্চাত্যের ঝড়ের দাপট সয়ে যাচ্ছিল। খ্রিস্টবাদের শিক্ষা এসব নিপীড়িত মানুষের জন্য ছিল শান্তির পয়গাম। স্বাভাবিক কারণেই এখানে খ্রিস্টবাদের আল ফুটে উঠেছিল। কিন্তু প্রজাদের মনের এ পরিবর্তন শাসকদের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। প্রায় তিন শতাব্দী পর্যন্ত খ্রিস্টানদের উপরে চলল অমানুষিক নির্যাতন। এরপর যখন পূর্ব ইউরোপের জনগণ যখন এ ধর্ম গ্রহন করতে লাগল নমনীয় হতে লাগল সরকার। চতুর্থ শতাব্দীর শুরুতে সম্রাট কনস্টেনটাইন খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহ্ন করল। কিন্তু তিনি শুধু বাহ্যিক বেশ ভূষাই পরিবর্তন করলেন। স্বভাব প্রকৃতির কোন পরিবর্তন হল না। এতদিন রোমান সম্রাটদের মাথায় মুকুট পরাতো ব্রাক্ষণ ঠাকুর, এবার সে দায়িত্ব পেল খ্রিস্টান পাদ্রীরা। আগে শত্রুদের উপর হামলা চালানোর আগে দেবতাদের সাহায্য চাওয়া হত, আর এখন তরবারী তোলার সময়ে ক্রুশকে চুমু খাওয়া হয়। তরবারী একই শুধুমাত্র বদলাল তরবারীর খাপ।প্রতিটা গীর্জা ছিল একটা রাষ্ট্র। এখানেও ছোট পাদ্রীরা বড় পাদ্রীদের হুকুম মানতে বাধ্য ছিল। গীর্জা ছিল অঢেল সম্পদের মালিক। সামর্থ অনুযায়ী সবাই এখানে সাহায্য করত।
প্রচন্ড শক্তিশালী হয়েও রোমান সম্রাট গীর্জার ব্যপারে হস্তক্ষেপ করত না। সম্রাট ও গীর্জা ছাড়া তৃতীয় শক্তি ছিল সিনেট। এরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দায়িত্বে ছিল। শাসকের মর্জির উপরেই এরা রাজকীয় ব্যপারে হস্তক্ষেপ করত। দুর্বল শাসক হত সিনেটের হাতের পুতুল। কিন্তু কোন শক্তিশালী সম্রাট তার কাজে সিনেটের সামান্যতম হস্তক্ষেপও সহ্য করত না।
এ পর্যন্ত বলে কিছুক্ষনের জন্য থামলেন খালেকদুনের স্ত্রী। জায়েদের দিকে চেয়ে বললেন “আসলে রোম ইরানের এত ইতিহাস যে তোমাকে বলে শেষ করা যাবে না। এবার সব কাহিনী বাদ দিয়ে তিরিশ বছর আগের কাহিনীতে ফিরে যাই।”
আজ থেকে তিরিশ বছর আগের কথা। তখন রোম-ইরানের মধ্যে শান্তি বজায় ছিল। শান্তি বলতে কিছুদিনের জন্য যুদ্ধ বিরতি। সেই বিরতির বর্তমান সম্রাট খসরু পারভেজ যুবক বয়সে ক্ষমতায় আরহন করেন। অন্যান্য শাহজাদাদের চক্রান্তের কারণে তৎকালীন সেনাপতি বাহরাম সেনা অভ্যুত্থান করেন। সম্রাট খসরু পারভেজ মাদায়েন থেকে রাতের আঁধারে পালিয়ে যান। দ্রুত তিনি আশ্রয় নেন ইরান সীমান্তের এক কেল্লায় যেখানে খালেকদুন সহ সম্রাটের ছোট বেলার বন্ধুরা ইরানী সামরিক অফিসার হিসেবে কর্ম রত ছিলেন। সম্রাট তাদেরকে নিজের দুঃখের কথা বলেন। তারাও ভেবে পেলেন না কীভাবে এত শক্তিশালী সেনাপতির বিরুদ্ধে তারা যুদ্ধে নামবেন? সীমান্তবর্তী কেল্লা থেকে পাশ্ববর্তী রোমান কেল্লায় খসরু পারভেজের চিঠি দেয়া হল। দুই দিন পরে সেই কেল্লা থেকে চিঠির উত্তর আসল। সম্রাট নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোমানদের কেল্লায় গেলেন। এদিকে রোমানদের কেল্লা থেকে রোমান সম্রাটকে চিঠি লেখা হল- ইরান সম্রাট এখন আমাদের কজায়। তাকে কি হত্যা করব? নাকি সসম্মনাএ আপনার কাছে পাঠিয়ে দিব?
রোমান সম্রাট সময় বাহরাম নামের এক সেনাপতি সেন আভ্যুত্থান করে নিজেই মুকুট মাথায় পরিধান করেন। অন্যান্য শাহজাদারা চেয়েছিলেন বাহরাম খসরু পারভেজকে ক্ষমতাচ্যুত করে কোন এক শাহজাদাকে মুকুট পরিয়ে দিবেন। কিন্তু তাদের সে আশায় গুড়ে বালি যখন বাহরাম নিজেই মুকুট পরল। এর পর থেকে শাহজাদারা বাহরামের প্রতি চক্রান্ত শুরু করল। এদিকে রোমান সম্রাট ছিলেন অত্যন্ত ধুরন্ধর। তিনি ইরানের পদচ্যুত সম্রাটকে নিজের দরবারে ডেকে নিলেন। তাকে বিদেশী ক্ষমতাসীন সম্রাটদের মতই লাল গালিচা সংবর্ধনা দিলেন। খসরু পারভেজ এতে দারুণ খুশী হল। এমনকি তিনি তার সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েকে খসরু পারভেজের সাথে বিয়ে দেন। কিছুদিন পরে খসরু পারভেজ রোমান সম্রাটের সহযোগীতায় লাখ খানেক রোমান সৈন্য নিয়ে মাদায়েন আক্রমণ করেন। মাদায়েন দখল করতে অবশ্য খসরু পারভেজের তেমন কোন বেগ পেতে হয় নি। প্রধান অগ্নিপূজারী বাহরামের মাথায় মুকুট পরাতে অস্বীকার করায় তাকে জেলে পুরে রাখা হয়েছিল। খসরু পারভেজ আগে কারাগার আক্রমণ করে প্রধান অগ্নিপূজারীকে মুক্ত করলেন। অগ্নি পূজারীকে মুক্ত অবস্থায় দেখে মাদায়েনের জনগণই বাহরামের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠে। এছাড়া শাহজাদাদের চক্রান্ত্র তো ছিলই। শেষ মেষ দেখা গেল ব্যাক্তিগত দেহ রক্ষীরাই বাহরামকে হত্যা করে তার মাথা খসরু পারভেজের হাতে তুলে দিয়ে নিজেদের পদ অক্ষুন্ন রাখে। খসরু পারভেজ আবার ইরান সম্রাট হয়। এভাবে বেশ কিছুদিন ভালই চলছিল কিন্তু রোমান সম্রাজ্যে ক্যু ঘটল। কিছুদিন পরে খবর আসল রোমান যে সম্রাট যিনি খসরু পারভেজকে অনুগ্রহ করে ইরানের ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন তিনি নিহত। তার এক ছেলে তাকে হত্যা করে ক্ষমতায় বসেন। তার সামনেই তার অন্য পাঁচ ছেলেকে হত্যা করা হয়।
প্রতিশোধের উছিলায় ইরান সম্রাট খসরু পারভেজ রোমান সম্রাজ্যে হামলা করল। শেষ হল কয়েক বছরের যুদ্ধ বিরতি। এরপরের ইতিহাস তোমার জানা। পারভেজ একে একে গুরুত্বপূর্ণ রোমান শহর দখল করতে করতে এগিয়ে যায়। পরে তোমাদের আরবের সেই নবী ভবিষ্যদ্বানী অনুযায়ী খসরু পারভেজ একে একে বিভিন্ন এলাকায় পরাজয় বরণ করতে থাকে। এখন খসরু পারভেজের হাতে মিশর ছাড়া আর কোন দখলকৃত এলাকা নেই। কিছুদিনের মধ্যে হয়তো মিশরও তার হাত ছাড়া হয়ে যেতে পারে।
আরেকটা কথা, মেহরিনের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে জায়েদকে বললেন “এখান থেকে মুক্তি পেয়েই মাদায়েন ছেড়ে আমরা দূরে চলে যাব। সম্ভবত আরবেই ফিরে যাব। সেখানে গিয়েই তোমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করব।”
মায়ের কথা শুনে মেহরিনের গাল লজ্জায় লাল হয়ে গেল কিন্তু জায়েদের দৃষ্টি অন্য দিকে। তার মনে হয় এই কথায় কোন আগ্রহ নেই। জায়েদের দৃষ্টির বরাবর খালেকদুনের স্ত্রী তাকাল- সন্ধ্যার অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে দূরে নদীর ধারে দুই তিনটা মশাল জ্বলছে। কিছুক্ষন পর পর মশালগুলো অবস্থান পরিবর্তন করছে। ব্যপারটা কিছুক্ষন পরে জায়েদ খেয়াল করল। জায়েদ অনেকদিন গোয়েন্দা বিভাগে চাকরি করেছে। সে আলোর মাধ্যমে দেয়া সংকেতের মানে সে বোঝে। এ মশালের আলর মাধ্যমে জায়েদকে একটা সংকেত দেয়া হচ্ছে। শাহজাদার শেরওয়া এ সংকেত দিচ্ছে। সংকেত অনুযায়ী কিছুক্ষনের মধ্যে এখানে একজন সেনা প্রবেশ করবে।
জায়েদ মেহরিন ও তার মাকে বলল “আমাকে একটা কাজ করতে হবে” কী কাজ তা তাদেরকে বুঝিয়ে বলল।
---
ধুরন্ধর সম্রাট যখন টের পেলেন পরিস্থিতি খালেকদুনের পরিবারের পক্ষে তাই তিনি খালেকদুনের স্ত্রী ও কণ্যাকে এমন এক স্থানে রাখলেন যেখান সাধারণত বিদেশী রাজকীয় অতিথি থাকে। বাইরে থেকে এই অতিথীর কক্ষ দেখা যায়। জায়েদ, খালেকদুনের স্ত্রী ও মেহরিনকে ভাল ভাল খাবার দেয়া হয়েছে। তাদের আদর সমাদর আপ্যায়নের কোন কমতি নেই। যদি কোন রাজকীয় সেনা বাইরে গিয়ে আমীর ওমরাহদের খবর দেয় তারা কেমন আছে তাহলে তারা সন্তোষজনক উত্তর পাবে। সম্রাটের মনে আছে আজ থেকে তিরিশ বছর আগে বাহরাম নামের এক সেনাপতি বিদ্রোহ ঘোষনা করে কিছুদিন রাজ প্রাসাদে অবস্থান করেছিল। তাই সে খালেকদুনকে ভয় পাচ্ছে।
---
অন্ধকার রাত। মাদায়েনের কারাগারের সামনে বিশ জনের একটা ঘোড় সওয়ার দল এসে প্রধান ফটকের চাবি চাইল। ভেতর থেকে চাবি না দিয়ে বরং জিজ্ঞাসা করল “কে তোমরা?”
বাইরে থেকে উত্তর আসল “চাবি দিলে আমরা তোমাদের এখান থেকে নিরাপদে বেরিয়ে যাবার সুযোগ দিব আর না দিলে তোমাদের লাশ শকুনে খাবে।”
বাইরে এতগুলো সশস্ত্র সেনা দেখে প্রধান কারারক্ষী ভয় পেলেন। ইতি মধ্যে বাইরে দাঁড়ানো দুই কারা রক্ষী ওদের সাথে যোগ দিয়েছে। ভেতরের কারারক্ষীরাও তালা খোলার ব্যপারে সম্মতি দিল। তার মানে এদের সবাইকে আগে থেকেই কেনা হয়ে গেছে! ইচ্ছা না থাকা সত্বেও তিনি তালা খুলে দিলেন। মুহুর্তে দশ জন সেনা ভেতরে প্রবেশ করল। কারাগার থেকে তারা তিন জন শাহজাদা, চার জন সিনিয়ার সেনা কর্ম কর্তা, দুই জন বিচারক সহ সম্রাটের বিরোধী মতের বাইশ জনকে উদ্ধার করে নিয়ে গেল।
অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না কারা এদেরকে উদ্ধার করেছে। তবে বোঝা গেল এরা সবাই প্রশিক্ষিত সেনা। একজন জিজ্ঞেস করল “আপনাদের মধ্যে শাহজাদা সোহরবা কে?”
শাহজাদা উত্তর দিলেন “আমি”
সেই লোকটি জবাব দিল “আমার নাম জায়েদ। আপনি আমাকে উদ্ধার করতে গিয়ে নিজেই ফাঁদে পড়েছিলেন।”
“তুমি জায়েদ? এতদিন তুমি কোথায় ছিলে?”
“আপনার সব প্রশ্নের উত্তর পাবেন। আগে আমার সাথে চলুন।” জায়েদ আর কথা বাড়াল না।
তারা মাদায়েন শহরের একটা বাড়ীতে পৌঁছুল। সোহরাব জানে এই বাড়ীটা এক রাজকীয় সেনা কর্ম কর্তার, যে নিজেই এখন কারাগারে বন্দী।
সেই বাড়ী ভেতরে তাদের জন্য অনেক লোক অপেক্ষা করছে। তাদের নেতা শাহজাদা শেরওয়া। শাহজাদা সোহরাবের পিতা সম্রাট খসরু পারভেজের ছোট ভাই আফসার এখানে উপস্থিত। এছাড়া খালেকদুনের খালাতো ভাই মাদায়েন সেনা ছাউনির সাবেক প্রধান সহ দশ বারো জন উজির এখানে হাজির। শাহজাদা সোহরাব এদেরকে এক সাথে দেখে যা বোঝার তা বুঝে নিলেন। এই লোকগুলি যখন যখন নতুন সম্রাট শেরওয়ার পক্ষে গোপনে শপথ নিচ্ছিল জায়েদ তখন অন্য মিশনে চলে গেল। তাকে পথ দেখিয়ে দিল দশ জন রাজকীয় সেনা কর্ম কর্তা ও একজন পূজারী। জায়েদ যেতে যেতে পূজারীকে জিজ্ঞেস করল “একটা প্রশ্নের উত্তর জানতে ইচ্ছে করছে। জিজ্ঞাসা করব?”
পূজারী বলল “আগে প্রশ্ন করে দেখ। উত্তর দেয়া যায় কি না প্রশ্ন শুনে বলব।”
“আপনারা সব সময় প্রধান পূজারীর আশেপাশে থাকেন। অথচ আমাকে দিয়েই প্রধান পূজারীকে কেন মারা হবে?”
“আমরা কেউ দেবতাদের অভিশাপে পড়তে চাই না। আপনি মুর্তি পূজারী আরব। আপনি এই কাজে রাজী হয়েছেন কিন্তু প্রধান পূজারীর জন্ম শত্রুও যদি কোন ইরানী হয়ে থাকে তাহলে দেবতাদের ভয়ে কখনো তিনি প্রধান পুজারীকে হত্যা করার চিন্তাও করবে না।”
---
গভীর রাতে সম্রাটের কাছে খবর এল যে প্রধান অগ্নী পূজারী আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছে। সম্রাট সিপাইদের বলল “দ্রুত মেহামান খানায় গিয়ে দেখ আরব বন্দীটা ঐখানে আছে কিনা”
তারা এসে দেখে জায়েদ বিশাল কক্ষের এক পাশে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। কক্ষের আরেক প্রান্তে মেহরিন ও তার মা ঘুমাচ্ছে।
সম্রাটকে এ কথা বলা মাত্র তিনি ক্ষেপে উঠলেন। ঐখানে যত প্রহরী ছিল তাদের বদলে দাও। ওরা সবাই এই কাজে জড়িত। আজকাল প্রহরীরাও সম্রাটের আদেশ পালন করতে দেরী করছেন। অবশ্য পরাজিত সম্রাটের ইচ্ছা অনিচ্ছার দাম কারো কাছেই নেই। তার পরিবারের লোকজনই চায় না তিনি মসনদে থাকুন। দ্রুত মারোজার হাতে ক্ষমতা দিতে পারলেই তিনি বাঁচেন।
---
পরদিন সকালে গোটা মাদায়েন ছড়িয়ে গেল- সম্রাটের কড়া পাহারার মধ্যেও প্রধান পূজারী নিহত হয়েছে। আর কারাগার থেকে সম্রাটের আত্মীয় স্বজন সব পালিয়েছে। এক চাকরিচ্যুত সেনা কর্মকর্তার নেতৃত্বে মাদায়েনের রাস্তায় সম্রাটের বিরুদ্ধে মিছিল হল- সম্রাট ইচ্ছে করেই সবার দৃষ্টি অন্য দিকে ফেরানোর জন্য প্রধান পূজারীকে হত্যা করেছেন। লোকজনের মধ্যে সম্রাট বিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা হয়ে উঠল। মিছিলে রাজ বংশের কয়েকজন শাহজাদাকে দেখা গেল। এমনিতেই শাহাজদা সোহরাব মাদায়েনের গভর্ণর ছিলেন। সবাই তাকে বীর পুরুষ হিসেবে চেনেন। তার উপরে সম্রাট বিরোধী মিছিলে তাকে দেখার পরে প্রজাদের মনে আশার সঞ্চার হল। প্রজারা যারা এতক্ষনে সেনাদের ভয়ে মিছিলে যোগ দিচ্ছিল না তারা একে একে যোগ দিল। মিছিলটা যখন মাদায়েনের বাজার পার হচ্ছিল তখন সেখানে যোগ দিল মাদায়েন শহর রক্ষী বাহিনীর প্রধান হাশিমি। তাকে মূলত এই মিছিল ঠেকানোর জন্য পাঠানো হয়েছিল।
---
সম্রাটের কানে যখন মিছিলের খবর আসল তখন তিনি হুংকার দিলেন “সবাইকে হত্যা করে মাদায়েনের রাস্তায় ঝুলিয়ে দাও”
কিছুক্ষন পরে সেই রক্ষী আবার এল। মাথা নিচু করে বলল “হুজুর যাকে মিছিল ঠেকাতে পাঠিয়েছিলেন তিনিও মিছিলে যোগ দিয়ে আপনার বিরুদ্ধে শ্লোগান দিচ্ছেন।”
সম্রাট জরুরী দরবার ডাকলেন। দরবারীদের অর্ধেকের বেশি দরবারে যোগ দিলেন না। তারা সম্রাটের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করেছেন। প্রত্যেকেই প্রধান পুজারী হত্যার দায়ে সম্রাটের বিচার চাইছেন। প্রবল প্রতাপশালী সম্রাট নিজেকে আগে কখনো এত অসহায় মনে করেন নি। দরবারে যারা আছেন তারা দেখলেন তারা সংখ্যায় অনেক কম। বিরোধী পক্ষের লোকজনই বেশি। তারাও সুযোগ বুঝে সম্রাটের বিপক্ষে চলে যাওয়া শুরু করলেন। বলা তো যায় না, পরবর্তী সম্রাট কে হন? তার রোষাণলে কে পড়তে চায়? উপস্থি দরবারীরা তর্ক শুরু করল। তর্ক অনেকটা হাতাহাতির পর্যায়ে চলে গেল। তর্কের এক পর্যায়ে সবার পছন্দের ব্যক্তি রাজ্যের প্রধান উজির অবসরের ঘোষনা দিলেন। তার অবসরের ঘোষনা শুনে আরো দুই জন দরবারীও অবসরের ঘোষনা দিলেন।
দরবারের হৈ হুল্লোড়ের মাঝে দরবারে প্রবেশ করলেন সম্রাটের ছোট ভাই আফসার। তিনি সম্রাটকে বললেন “আপনার জন্য বাঁচার একটা সুযোগ এখনো রয়েছে। আপনি ভালোয় ভালোয় শাহজাদা শেরওয়াকে সম্রাট ঘোষনা করুন। গোটা মাদায়েন এখন শেরওয়ার দখলে। তারা সবাই এই দিকেই আসছে। সম্রাট এতক্ষন পরে বুঝতে পারলেন সব কিছুর পেছনে এই শেরওয়াই জড়িত।
সম্রাট জিজ্ঞেস করলেন “শেরওয়া কোথায়? তার মাথা কেটে এখানে নিয়ে আস”
শেরওয়াকে রাজ প্রাসাদের মন্দীরেই পাওয়া গেল। তিনি তখন প্রধান পূজারীর পরের সিরিয়ালে থাকা সিনিয়ার পূজারীদের সাথে আলোচনা করছেন। সকল পূজারীরা এক বাক্যে শেরওয়াকে সম্রাট হিসেবে মেনে নিল। এমন সময় সম্রাটের আদেশ পেয়ে সেখানে শ খানেক রক্ষী হাজির হল। শাহজাদাকে পূজারীদের পোষাকে দেখে কারো সাহস হল না তাকে হত্যা করার। রক্ষীদের মনোভাব বোঝার পরে পূজারীরা রক্ষীদের জিজ্ঞেস করল “তোমরা কি অগ্নি দেবতার অভিশাপে পড়তে চাও?”
কে চায় অগ্নি দেবতার রোষাণলে পড়তে? সবাই না সূচক মাথা নাড়ল।
“তাহলে সবাই এদিকে এসো। সবাই নতুন সম্রাটের হাতে শপথ গ্রহন কর। তিনি তোমাদেরকে যুদ্ধ থেকে বাঁচাবেন বলে কথা দিয়েছে”
সবাই নতুন সম্রাট শেরওয়ার হাতে শপথ নিল।
সুম্রাট এখন প্রায় নিঃসঙ্গ। অল্প কিছু লোক ছাড়া তার পক্ষে আর কেউ নেই। তিনি অল্প[ কিছু দরবারীর সামনে ঘোষনা দিলেন “আমি এখনই শাহজাদা মারোজার মাথায় মুকুট পরাব”
কারো সেদিকে কোন আগ্রহ নেই দেখে সম্রাট নিজেই মারোজার মাথায় মুকুট পরাতে গেলেন। প্রধান অগ্নি পূজারীর লাশ এখনো সৎকার হয় নি। নতুন প্রধান অগ্নি পূজারী এখনো নিয়গ হয় নি। সম্রাট নিজের মাথা থেকে মুকুট খুলে মারোজার মাথায় পরিয়ে দিলেন। দরবারীরা সবাই নিশ্চুপ।
----
ইতি মধ্যে মিছিলের হাজার হাজার লোক সমবেত হয়েছে। তারা রাজ প্রাসাদের প্রধান ফটকে অবস্থান করছে। রাজকীয় বাহিনীর বড় অংশ তাদের পক্ষে চলে গেছে। বিশেষ করে আগের রাতে শেরওয়া যাদের নিয়ে মিটিং করেছেন তারাই মিছিলের অগ্রভাগে রয়েছেন।
শাহজাদা শেরওয়া রাজ দরবারে প্রবেশ করলেন। মারোজার মাথায় মুকুট দেখে বললেন “ইরানীদের নিয়ম কানুন ঐতিহ্য সব কি ধুলোয়ে মিশে গেছে? হাজার বছরের ঐতিহ্য অনুসারে সম্রাটের মাথায় মুকুট পরাবে প্রধান অগ্নি পূজারী”
“তাকে তোমরা মেরে ফেলেছ” সম্রাট হিসহিস করছে।
“নতুন অগ্নি পূজারী আমার মাথায় আজ মুকুট পরাবেন” বলে শেরওয়া নতুন প্রধান পগ্নি পূজারীর সাথে সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ওনাকে কারো সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে না। এই লোককে সবাই চেনে। রাজ প্রাসাদে গত বিশ বছর ধরে অগ্নি পূজা করছেন।
সম্রাট জিজ্ঞেস করলেন “কে তাকে প্রধান অগ্নি পূজারী বানিয়েছে? এ ঘোষনা তো সম্রাটে দেয়।”
শেরুওয়া বললেন “ইরানের নতুন সম্রাটে শেরওয়া তাকে প্রধান অগ্নি পূজারী হিসেবে ঘোষনা দিয়েছেন”
প্রধান অগ্নি পূজারী বললেন “মুকুট তো আরেকজনের মাথায়”
শেরওয়া আদেশ দিলেন “সেই মাথা কেটে ফেল”
সম্রাটের আর্ত চিৎকার কেউ শুনল না। তার সামনেই মারোজার মাথা পড়ে গেল। মুকুট পরানো হল শেরওয়ার মাথায়। শেরওয়া ছিলেন পিতার চাইতেও নিষ্ঠুর। তিনি একে একে সম্রাটের আঠারো জন ছেলেকে সম্রাটের সামনেই হত্যা করলেন। সম্রাট পালাতে চাইলে তাকে গ্রেফতার করলেন।
----
যে সময় ইরানের রাজধানী মাদায়েনে এই ঘটনা ঘটছে ঠিক সেই সময় ইরান সম্রাট খসরু পারভেজের আদেশ অনুযায়ী ইয়েমেনের গভর্নর বাজান দুই জন সরকারী অফিসারকে মদীনায় পাঠালেন। তারা যেয়ে মদীনাবাসীদের সম্রাটের আদেশ পড়ে শোনালেন- হে মদীনাবাসী মহা পরাক্রমশালী খসরু পারভেজের পক্ষ থেকে আদেশ হল তোমরা তোমাদের নবীকে আমাদের হাতে তুলে দাও। তিনি ইরানের বিরুদ্ধে ভবিষ্যৎবানী করেছেন। তোমরা যদি আমাদের কথা না শোন তাহলে সমগ্র আরব ধুলোর সাথে মিশিয়ে দেয়া হবে।
Subscribe to:
Post Comments
(
Atom
)
No comments :
Post a Comment