মরুর ফুল ৩৫
ইরানের সাবেক সম্রাট খসরু পারভেজকে জেলের অন্ধকার কুঠরিতে রাখা হল। তিনি নিস্তার চাইছেন। নতুন সম্রাট শেরওয়াও তাকে নিস্তার দিতে চাইলেন। মাদায়েন খুঁজে একজনকে পেলেন যার নাম কোব্বাদ। কোব্বাদের পিতাকে খসরু পারভেজ হত্যা করেছিল। শেরওয়া তাকে ডাকলেন। কারাগারের চাবি ও তলোয়ার কোব্বাদের হাতে দিয়ে তাকে বলল “তুমি তোমার পিতা হত্যার প্রতিশোধ নিতে পার”কোব্বাদ কারাগারে প্রবেশ করল। কিছুক্ষন পরে শোনা গেল খসরু পারভেজের আর্ত চিৎকার। কোব্বাদ শেরওয়ার কাছে তলোয়ার ও চাবি ফিরিয়ে দিতে দিতে বলল “এই নিন আপনার জিনিস”
শেরওয়া ক্রুর হাসি হেসে বলল “তুমি তোমার পিতা হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছে। এবার আমার পালা।”
কোব্বাদ অবাক হয়ে বলল “জাহাঁপনা আমি আপনার আদেশ মেনেছি মাত্র”
শেরওয়ার ইশারা পেয়ে কোব্বাদের চারিদিকে থাকা রক্ষীরা কোব্বাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
সব ঘটনা জায়েদের চোখের সামনে ঘটল। সে ভাবছে কোনদিন না তাকে আবার প্রধান পূজারী হত্যাকারী হিসেবে মৃত্যু দন্ড দেয়া হয়। সে দ্রুত মাদায়েন থেকে পালাতে চাইছে। নতুন সম্রাট শেরওয়া তার পিতার চাইতে খারাপ। না জানি কখন কোন নির্দেশ দিয়ে বসেন।
---
শেরওয়া জায়েদকে বলল “তুমি আমার অনেক উপকার করেছ। বল তোমার জন্য কী করতে পারি?”
জায়েদ বলল “আমি মদীনায় ফিরে যেতে চাই। সেখানে আমার আত্মীয় স্বজন আমার জন্য অপেক্ষা করছে।”
শাহজাদা সোহরাব পাশেই ছিল। তিনি বললেন “তার বিয়ের ব্যবস্থাও করা দরকার। মেহরিন ও জায়েদ পরষ্পরকে পছন্দ করে।”
শেরওয়া হাসলেন “ঠিক আছে তাই হবে। তুমি যেহেতু আরবে যেতে চাচ্ছ তাহলে আমার একটা কাজ করে দাও। খ্রিস্টানদের পবিত্র শহর জেরুজালেম যখন ইরানীরা দখল করেছে তখন বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে খ্রিস্টানদের পবিত্র ক্রুশ ইরানী সৈন্যরা মাদায়েনে নিয়ে আসে। এখন যেহেতু রোমানদের সাথে আমরা শান্তি চুক্তি করতে যাচ্ছি তাই আমাদের উচিত ওদের ক্রুশ ফেরত দেয়া। তুমি জেরুজালেমের সম্রাটের সাথে দেখা করে ওনার হাতে ক্রুশ ফেরত দিবে ও আমার পক্ষ থেকে উপঢৌকন দিবে। চুক্তি করার জন্য আমি ইতি মধ্যে আমাদের দুই জন মন্ত্রীকে পাঠিয়ে দিয়েছি।”
জায়েদের কোন সরকারী দায়িত্ব নেয়ার ইচ্ছা ছিল না কিন্তু এখন তার কিছুই করার নেই। এই মুহুর্তে এখান থেকে পালাতে পারলেই হয়। এদিকে শেরওয়া ক্ষমতা পেয়ে খালেকদুনকে চিঠি লিখে তাকেও জেরুজালেমে রোমান সম্রাটের সাথে দেখা করতে বললেন। খালেকদুন আর মাত্র কিছুদিন পরেই পুরো বাহিনী নিয়ে মাদায়েন পৌঁছুতেন। নতুন সম্রাটের চিঠি পেয়ে তিনি যাত্রা পথ পরিবর্তন করলেন। খালেকদুন দূর মারফত শেরওয়াকে জানালেন “মেহরিন ও তার মাকে জেরুজালেমে পাঠানো হোক। তাদের সাথে খালেকদুনের অনেক দিন দেখা সাক্ষাত হয় না।”
তিন দিন পরে ইরানী সেনা দলের পাঁচশ জনের একটা বাহিনী মাদায়েন থেকে জেরুজালেমের উদ্দেশ্যে রওনা হল। এই বাহিনীতে জায়েদ, মেহরিন ও তার মা ছাড়াও নতুন সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী, গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন সেনা অফিসার ও রোমান সম্রাটের জন্য অনেকগুলো দামী দামী উপহার নেয়া হয়েছে।
---
ইয়েমেনের গভর্ণর বাজানের দরবার বসেছে। দরবারে সরকারী কর্ম কর্তা ছাড়াও হাজির হয়েছে কয়েকজন সেনা অফিসার ও স্থানীয় আরব ও ইহুদী সর্দার।
এক ফৌজি অফিসার ভেতরে ঢুকে মসনদের কাছে এসে বলল “জনাব, মদীনা থেকে আমাদের দূত ফিরে এসেছে। ওরা আপনার খেদমতে হাজির হবার অনুমতি চাইছে।”
বাজান চঞ্চল হয়ে ওদের ভেতরে নিয়ে আসতে বললেন।
অফিসার বেরিয়ে গিয়ে সেই দূতদের সঙ্গে করে নিয়ে এল। দূত দুজনের একজনের নাম বাবুইয়া অন্যজন খসরু। ওদের চেহারা দেখেই বুঝলেন ওদের অভিযান ব্যর্থ হয়েছে।
বাজান “তোমরা কি নবীকে সাথে করে আনো নি?”
“না জনাব, আমরা নবীকে আনতে পারিনি। ধমকে কাজ না হলে আপনি আমাদের শক্তি প্রয়োগ করতে নিষেধ করেছিলেন। তাই কিছু করিনি।”
“তোমরা কি বলনি মহামান্য শাহানশাওর নির্দেশে তোমরা তাকে ধরতে গিয়েছ?”
“বলেছি জনাব, আমরা এও বলেছি সম্রাটের নির্দেশ অমান্য করলে গোটা আরব ধুলায় মিশিয়ে দেয়া হবে”
“তারপর ওরা কী বলল?”
ওরা যা বলল আপনার এ গোলাম ভরা জলসায় সে কথা মুখে আনতে পারবে না”
“আমি সেই কথা শুনতে চাই” বাজানের কন্ঠ ঝাঁজালো শোনাল।
বাবুইয়া সসংকোচে বলল “জনাব, তিনি বললেন, খুব শীঘ্রই মুসলমানদের হুকুমাত কিসরার রাজ দরবার পর্যন্ত পৌঁছুবে।”
বিস্ময়ে থ হয়ে রইল দরবারীরা। কক্ষে নেমে এলো নিরবতা। এরপরে পরষ্পরের ফিসফিসানির শব্দের সাথে ওদের ঠোঁটে ফুটে উঠল বিদ্রূপের হাসি। ধীরে ধীরে তা অট্টহাসিতে পরণত হল।
কিন্তু বাজান গম্ভীর চোখে দূতের দিকে তাকিয়ে রইল। তার শীতল দৃষ্টি দরবারীদের থামিয়ে দিল। দরবারে আবার নিরবতা নেমে এলো।
“তোমরা মদীনার সর্দারদের বলনি ইরান সম্রাটকে ক্ষেপালে তার পরীনতি ভয়াবহ হবে?”
“জনাব, নবীকে যারা বিশ্বাস করেছে তারা এই কথায় কর্ণপাতও করেনি। তাদের রাষ্ট্রের সীমানা ইরান পর্যন্ত পৌঁছুবে এ জন্য তারা আনন্দিত। আমরা আশ্চর্য হয়েছি এ কারণে যে, ভরা জলসায় নবী যখন এ ঘোষনা দিলেন তখন কেউ টু শব্দটি করল না। কেউ জিজ্ঞেস করল না কী দিয়ে তারা এত বড় সম্রাজ্যকে পরাজিত করবে? আমাদের তখন মনে হয়েছে, তিনি যদি বলেন আকাশের সব তারা এনে তোমাদের হাত তুলে দেব তখন কেউ তাঁকে প্রশ্ন করবে না কী করে ওনার হাত সেই পর্যন্ত পৌঁছুবে।
আমরা ওদেরকে ভয় দেখানোর জন্য আমাদের লক্ষ লক্ষ সৈন্য ও অসংখ্য হাতীর কথা উল্লেখ করেছি। কিন্তু তাদের কথা শুনে মনে হল এগুলোকে ওরা ভেড়া বকরীর চেয়ে বেশি কিছু মনে করে না।”
ওদের শিশু কিশোর যুবক বৃদ্ধ সবার কন্ঠে একটাই শ্লোগান “খোদার জমীনে আমরা দ্বীন কায়েম করবই। এজন্যই আমাদেরকে পয়দা করা হয়েছে। আমাদের নেতা যখন আমাদেরকে জিহাদের হুকুম দিবেন পৃথিবীর কোন শক্তিই আমাদের মোকাবিল করতে পারবে না।”
বাজান জিজ্ঞেস করলেন “মুসলমানদের জিজ্ঞেস করলে না যে তোমাদের হাতী ঘোড়া কতগুলো? আর ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মত তোমাদের সেনাবাহিনী কোথায়?”
দূত “তার আর দরকার ছিল না। আমি নিজ চোখে ওদের অসহায়ত্ব দেখেছি। ওরা যে কত নিঃস্ব। ওদের নবী খেজুর পাতার চাটাইতে বসে বিশ্রাম নেয়। শুনেছি মক্কার লোকদের সাথে যুদ্ধে ওদের দারুণ ক্ষতি হয়েছে। করাইশদের সাথে আরবের আরো কয়েকটা বংশ এক হয়ে গেলে ওরা আরবেই থাকতে পারবে না।
তায়েফের পথে আসার সমউয় বুঝেছি লোকজনোদের প্রতি কতটা ক্ষ্যাপা। ওদের বুক ক্রোধের আগুন জ্বলছে যে তা মুসলমানদের ঘর পর্যন্ত পৌঁছুতে দেরি হবে না। আমরা মদীনার ইহুদীদের সাথে কথা বলেছি। মুসলমানদের বের করে দেয়ার জন্য এই ইহুদীরাই যথেষ্ঠ।”
“আরেকটা প্রশ্ন- মুসলমানদের নবীকে গ্রেফতার করার উদ্দেশ্যে মদীনায় ক’জন সেপাই পাঠালে কেমন হবে?”
“আমার বিশ্বাস পথের সকল গোত্র, বংশ আমাদের পক্ষে থাকবে কিন্তু যারা ঐ নবীকে বিশ্বাস করেছে তারা তাদের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে নবীর জন্য যুদ্ধ করবে।”
“তার মানে আমাদের শক্তি দেখলেও ওরা ভয় পাবে না?”
“জনাব, ওরা খোদাকে ছাড়া কাউকে ভয় পায় না”
এক ইহুদী বলল “জনাব, একটা কথা বলতে চাই”
বাজান “বলো”
ইহুদী “আমার কাছে এসব কথা উপহাসের মত লাগছে। মদীনায় ক’জন সিপাহী পাঠিয়েই দেখুন না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কোন বুদ্ধিমান মানুষ এ কাজে বাঁধা দেবে না। মক্কা থেকে তারা যেমন রিক্ত হস্তে বেরিয়েছে তার চেয়ে অসহায় হয়ে ওরা মদীনা থেকে বেরিয়ে যাবে।”
আক আরব গোত্রপতি বললেন “জনাব, মুসলমানদের তাদের নিজের অবস্থায় ছেড়ে দিলেও বিপদের কারণ হবে না। এই মুহুর্তে আমরা রোমানদের পরাজয় ও ইরানীদের জয় নিয়ে ভাবছি। নিনোয়ার যুদ্ধের পরে আমাদের গোত্রের লোকজন হতাশ হয়ে পড়েছে। আমাদের গোত্রের হাজার খানেক যুবক ইরানীদের পক্ষে যুদ্ধে গেছে।”
“আপনি প্রজাদের এ আশ্বাস দিতে পারেন যে হেরাক্লিয়াস যদি আর এক পা এগোয় তাহলে সে মৃত্যুর দিকে হেঁটে যাবে। দস্তরগীদ রক্ষার জন্য দুই লক্ষ ইরানী সেনা রয়েছে”
বাবুইয়া বলল “জনাব, নয় বছর পার হয়ে যাবার পরেও মুসলমানরা সেই ভবিষ্যতবাণী বিশ্বাস করেছে। ওদের ধারনা শেষ তক হেরাক্লিয়াসই বিজয়ী হবেন। আমরা যখন তাদের সামনে আমাদের সেনাপতির কথা বলছিলাম তখন ওরা সবাই বলল- সেই ভবিষ্যৎবানী পূর্ন হবার সময় হয়েছে।”
এক সেনা অফিসার গরম চোখে বাবুইয়ার দিকে তাকাল। পরিস্থিতি সামলানোর জন্য বাজান বললেন যুদ্ধের ফয়সালা যদি তলোয়ারে লেখা হয় তবে রোমানদের ভাগ্যের ফয়সালা করবে ইরানীরা। কিন্তু কোন অদৃশ্য শক্তি যদি আমাদের বিরুদ্ধে ময়দানে এসে যায় তাহলে আমি কিছুই বলতে পারছি না।”
এক ইহুদী বলল “যে নবী নিজের ছাড়া সেই নবী কথায় আমরা কেন গুরুত্ব দিচ্ছি?”
দূত বললেন “আরেকটা কথা নবী বলেছিলেন, সেই কথা শোনার পরে ওনাকে পাগল মনে হয়েছিল। উনি বললেন, তুমি আমাদেরকে যে সম্রাটের ভয় দেখাচ্ছ সেই সম্রাট বেঁচে নেই!”
বাজান কিছু বলতে চাইছিল। এমন সময় হন্ত দন্ত হয়ে এক রক্ষী এসে হাজির “জনাব, মাদায়েন থেকে সম্রাটের দূত এসেছে। তারা আপনার সাথে দেখা করতে চায়।”
অনুমতি দেয়ার পরে মাদায়েনের দূত প্রবেশ করল। দূতের পোষাক আষাক দেখে মনে হল এরা কোথাও বিশ্রাম নেয় নি।
দূতদের একজন বলল “জনাব মাদায়েন থেকে অনেক গুরুত্বপুর্ন খবর নিয়ে এসেছি। এই চিঠি পড়ে দেখুন।”
বাজান কাঁপা হাতে চিঠি খুললেন। চিঠি পড়তে পড়তে ওনার মুখ মলিন হয়ে গেল। চিঠি শেষ করে দরবারীদের বললেন “মুসলমানদের নবীর ভবিষ্যৎবানী পূর্ণ হয়েছে। ইরান পরাজিত হয়েছে। ইরান সম্রাট খসরু পারভেজ নিহত হয়েছেন। ইরানের নতুন সম্রাটের নাম শেরওয়া। নতুন সম্রাট আমাদের চিঠি দিয়ে মুসলমানদের ব্যপারে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন।”
Subscribe to:
Post Comments
(
Atom
)
No comments :
Post a Comment