মরুর ফুল ৩৩

ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই যেন থ হয়ে গেল। দরবারে পর পর কয়েকটি ঘটনা ঘটল।
এক- সবাই জানল শাহজাদা ফররুখকে হত্যা করা হয়েছে।
দুই- হত্যাকারী এক সুন্দরী নারী।
তিন- সেই সুন্দরী মেয়ে ইরান সেনাপতি খালেকদুনের মেয়ে যিনি আবার সম্রাটের এক সময়কার প্রিয় বন্ধু।
চার- কিছুক্ষন পরে কোথা থেকে আরব যুবক হাজির হয়ে বলল হত্যাকারী এক রাজকীয় সেনা সদস্য।
পাঁচ- সেই রাজকীয় সেনার সাথে জড়িত রাজ প্রাসাদে কর্ম রত এক সেনা গোয়েন্দা অফিসার।
ছয়- রাজকীয় সেনা অফিসারের মুখ থেকে জানা গেল শাহজাদা ফররুখের হত্যাকান্ডে শাহজাদী বিলকিস জড়িত।
সাত- সম্রাট শাহজাদী বিলকিসকে সবার সামনে হত্যা করলেন।
আট- এর মধ্যে সম্রাটের মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেল তিনি খালেকদুনের মাথা কাটার জন্য দূত পাঠিয়েছেন যে হয়তো দুই একদিনের মধ্যে খালেকদুনের কাটা মাথা নিয়ে ফিরে আসবে।
নয়- সম্রাট শোরগোলের মাঝেই ঘোষনা দিলেন আগামী সপ্তাহের প্রথম দিনে তার ছেলে মারোজার মাথায় তিনি ইরান সম্রাজ্যের মুকুট পরিয়ে দিবেন।
পর পর এতগুলো ঘটনায় সবাই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। কে কী বলবে বুঝতে পারছিল না। এমন সময় হঠাত প্রধান অগ্নিপূজারী দাঁড়িয়ে বললেন “হবু সম্রাট মারোজার জয়” বলে তিনি ইরানী স্টাইলে উপরে হাত তুললেন।
প্রধান অগ্নিপূজারীকে অসম্মান করে কেউ হাত তুলবে না এমন কোন লোক ইরানে নেই। অগ্নিপূজারীরা বিশ্বাস করে যে কেউ যদি প্রধান অগ্নিপূজারীর বিপক্ষে যায় তবে তার বিরুদ্ধে অগ্নি দেবতারা ক্ষেপে যায়। অতি দ্রুত তার পতন ঘটে। যেহেতু প্রধান অগ্নিপূজারী সম্রাটে বক্তব্য সমর্থন করে শ্লোগান দিচ্ছে তাই তার বিরুদ্ধে যাওয়ার কারো সাহস হল না। দল মত নির্বিশেষে সবাই মারোজার পক্ষে শ্লোগান দিল। দেবতাদের অভিশাপের ভয়ে মারোজার বিপক্ষের লোকজন টু শব্দটি করল না।
---
জায়েদ, মেহরিন ও মেহরিনের মা’কে একটা বড় সড় কক্ষে রাখা হয়েছে। কক্ষটা রাজ বাড়ীর অংশ। হয়তো এখানে কোন শাহজাদা বিশ্রাম নেন। এই কক্ষ থেকে নদী দেখা যায়। কক্ষের চারিদিকে রাজকীয় সেনারা টহল দিচ্ছে। ওদের সাথে আচরণএই বোঝা যায় ওদেরকে ‘সম্মানিত বন্দী’ হিসেবে রাখা হয়েছে। কিছুক্ষন পর পর একজন দাস এসে তাদেরকে জিজ্ঞেস করছে “আপনাদের কি কিছু লাগবে?”
মেহরিনের মা না বোধক মাথা নাড়ল।
অবশ্য কিছু না লাগলেও তাদের সামনে বিভিন্ন ফলের কয়েকটা বিশাল পাত্র রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের পাণীয় ভর্তি জগ রয়েছে। ব্যাপারটা খালেকদুনের স্ত্রী ভাল চোখে দেখছে না। কারণ ইরান সম্রাট হঠাত করে এত ভাল হয়ে যায় নি যে ওদের প্রতি এত কৃপা করবে। আর ওদের প্রতি কৃপা করতে চাইলে ওদেরকে মুক্তি দিলেই পারত।
জায়েদ খালেকদুনের স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করল “একটা ব্যপার বুঝলাম না। রাজ দরবারে সবার সামনে মেহরিন সম্রাটকে বলল রোমান সম্রাট ও খালেকদুনের সহযোগীতা না পেলে খসরু পারভেজ কখনো ক্ষমতায় আসতেন না। আমার কাছে পুরো ব্যাপারটা ঘোলা ঘোলা লাগছে। রোমানরা তো ইরানীদের আজন্ম শত্রু। রোমান সম্রাট কীভাবে ইরানের কাউকে সম্রাট পদে বসাবেন?” প্রশ্নটা মূলত সে মেহরিনকে করেছে। কিন্তু মায়ের সামনে মেহরিনের সাথে কথা বলতে জায়েদের লজ্জা লাগছে। তাই প্রশ্নটা সরাসরি মেহরিনকে না করে তার মাকে করেছে।
জায়েদ মেহরিনের কাছ থেকে উত্তর আশা করছিল কিন্তু মেহরিনও লজ্জায় কথা বলতে পারছিল না।
জায়েদ বলল “আসলে আপনাদের যেমন মন্দীরে শিক্ষা দীক্ষা দেয়া হয় রোমানদের যেমন গির্জায় শিক্ষা দীক্ষা দেয়া হয় তেমনি আমাদের আরবে কোন শিক্ষা দীক্ষার ব্যবস্থা নেই। আমরা বাপ দাদার মুখে ইতিহাস যা জানি সেটা খুবই সামান্য।” সে উত্তরের অপেক্ষায় রইল।
মেহরিনের মা বললেন- সে এক বিশাল ইতিহাস। আজ থেকে প্রায় হাজার বছর আগের কথা-
---
রোম উপ সাগরের যে পূর্ব এলাকা যা কখনো বাবেলের শাসকদের হাতে ও কখনো মিশরীয় ফিরাওনের হাতে ধ্বংস হত- এক হাজার বছর পুর্ব থেকে তা হল ইরান ও তার পশ্চিমা প্রতিদ্বন্দীর শক্তি পরিক্ষার ক্ষেত্র।
যিশু খ্রিস্টের জন্মের সাড়ে পাঁচশো বছর পূর্বে সাইরাসের জন্ম। তার উত্থান প্রাচ্যের ইতিহাসে নতুন সংযোজন করেছিল। এ রাখাল সম্রাট বাবেলকে ধ্বংস স্তুপে পরিণত করেছিল। এরপর বলখ থেকে বসফরাস প্রণালী এবং ভূমধ্য সাগর থেকে তুরে সাইনা পর্যন্ত উড়িয়েছিল বিজয় পতাকা। মাত্র পঁচিশ বছরেই ইরানের সীমানা পাঞ্জাব থেকে গ্রীস পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। তখন মিশর ছিল এ সালতানাতের একটা সূবা মাত্র। এর প্রায় দু’শ বছর পর্যন্ত প্রাচ্য কিঙ্গাব পাশ্চাত্যে ইউরোপে কিংবা এশিয়ায় ইরানীদের কোন প্রতিদ্বন্দী ছিল না। গ্রীস হঠাত মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। মাকদুনিয়া থেকে বেরিয়ে এল এক নওজোয়ান। এশিয়ার ইরানী শাসকদের পদ দলিত করে পৌঁছে গেল পাঞ্জাব পর্যন্ত। এই নওজোয়ানের নাম আলেকজান্ডার, ইতিহাস যাকে আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট নামে পরিচিত করেছে। মিশর বাবেল নিনোয়া ইরান সব তিনি দখল করে নিলেন। আলেকজান্ডারের শক্তি যখন দুর্বল হয়ে গেল তখন ইউরোপে মাথা তুলে দাঁড়াল আরেক আজদাহা। তার হুংকারে কালের দৃষ্টি রোমের দিকে নিবদ্ধ হল। রোমান সৈন্যরা একদিকে প্রাচ্যের ভাঙ্গা পথে দৌড়াচ্ছিল আরেক দিকে ইউরোপের সেই সব দেশ পদানত করছিল যা ছিল সভ্য দুনিয়া বাইরে। যিশু খ্রিস্টের ৬৪ বছর পূর্বে রোমানরা সিরিয়ায় আলেকজান্ডারদের উত্তরসূরীদের পরাজিত করে এশিয়া ইউরোপের শক্তিশালী সম্রাজ্যের অধিকারী হল। কিন্তু অতীতের শাসকদের মত মত এই শাসকও প্রজা নীপিড়ক। জনগণ দেখল শুধুমাত্র ম্নিবের পরিবর্তন হয়েছে। প্রজাদের অবস্থা ঠিক সেই আগের মতই রয়েছে।
খ্রিস্টবাদ অসহায় মানুষের জন্য নিয়ে এসেছিল নউন জীবনের পয়গাম। কিন্তু যেসব শাসক ক্ষুধার্ত সিংহের খাঁচায় নিষ্পাপ কয়েদীদের ছেড়ে দিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়ত তারা খ্রিস্টবাদকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিল। প্রায় তিনশো বছর পর্যন্ত এ ধর্ম শাসকদের মনে কোন প্রভাব বিস্তার করেনি। এ সময় অসহায় দুর্বল খ্রিস্টানরা রোমানদের অত্যাচার সয়েছিল।
চতুর্থ শতাব্দীর শুরুতে সম্রাট কনস্টেন্টিন খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহন করেন। রোমের পরিবর্তে বাইজেন্টাইন ধ্বংস স্তুপের উপর স্থাপন করলেন নতুন রাজধানী কনস্টেন্টিপোলের ভিত্তি। কেবল রোমই নয় প্রাচ্য পাশ্চাত্যের ধ্বংস স্তুপের উপর যেসব শাসকদের উত্থান পতনের যে কাহিনী ঢাকা ছিল- কনস্টেন্টিপোল ভৌগলিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সব দিক দিয়ে সে সব শহরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছিল।
৩৯৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কনস্টেন্টিপোলের ক্ষমতা কখনো সম্রাজ্যকে রোমান ও বাইজেন্টাইন শাসকদের মধ্যে ভাগ করে নিত অথবা কখনো এক হয়ে যেত। সম্রাট থিউডসের মৃত্যুর পরে এ সম্রাজ্য দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। এরপরেই কনস্টেন্সটিপোলে রোমানদের ক্ষমতা বাড়তে থাকে আর রোমে তাদের ক্ষমতা ক্রমেই দুর্বল হয়ে যেতে থাকে। পঞ্চাশ শতকের শেষ দিকে রোমে ইউরোপের জঙ্গীরা ধ্বংস স্তুপে পরিণত করল। ফলে রোমানদের ভবিষ্যতের আশা ভরসার কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হল এই কনস্টেন্টিপোল।
দেড়শো বছরের মধ্যে কনস্টেন্টিপোল হল পৃথিবীর বিশাল ও অপরাজেয় শহর। প্রাচ্যের দিকে এগিয়ে যাবার জন্য আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট যে পথ নিষ্কন্টক করেছিলেন কনস্টেনটাইনের উত্তরসূরীদের জন্য সে পথ উন্মুক্ত হল। কিন্তু যুগ আড়মোড়া দিয়ে জেগে উঠল আরেকবার। ইরানের নিভু নিভু অগ্নিপিন্ড আকস্মাত দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। পুসপিরাস এবং গ্রীসের হাতে যে পতাকা অবনমিত হয়েছিল তা এবার দজলার কিনারে মাদায়েনের পাঁচিলে পাঁচিলে শোভা পাচ্ছিল। ইরানে সাসানী বংশের উত্থান ইতিহাসে নতুন যুগের সূচনা করে। কনস্টেন্টিপোলের শাসকেরা এই প্রথম এশিয়ায় তাদের প্রতিদ্বন্দীর মুখোমুখি হল।
অগ্নি মন্ডপ ছেড়ে বাইরে তাকালে অগ্নি পূজারীদের দৃষ্টিতে ভেসে উঠত খ্রিস্টানদের গীর্জাগুলো। অপরদিকে প্রাচ্যের সীমানা ছাড়িয়ে গেলে গীর্জার পাদ্রীদের নজর পড়ত অগ্নিপূজারীদের মন্দীরের উপর। রক্তের নদী বয়ে যেত কখনো কনস্টেন্টিপোল কখনো মাদায়েনে। সিরিয়া এবং আরমেনিয়ার মানুষগুলো কেবল অসহায়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত। এই যাঁতাকলে পিষ্ট মানুষগুলো শান্তি পেত যখন এই দুই সম্রাজ্য যখন জড়িয়ে পড়ত অভ্যন্তরীণ কোন্দলে।
এখানে কেবল শাসকদের হেফাযতের জন্য তৈরি করা হত যত সব রাজনৈতিক ও নৈতিক নিয়ম নীতি। ক্ষমতার দাবীদারের সংখ্যা সীমা ছিল না। অনেকেই লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত রোম ইরানের মসনদের দিকে। এখানে বসেই একজন মানুষ অন্যের শান্তি এবং স্বস্তি বিনষ্ট করত। ক্ষমতার দ্বন্দে পরাজিত দলকে হত্যা করে উৎসব করা হত দেশ ব্যাপী। কারণ, দেবতাদের দেবতা রাজাধীরাজ দুশমনকে ষড়যন্ত্র ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছেন। সম্রাটের প্রশস্তিগানের প্রতিযোগিতা চলত আমীর ওমরাদের মধ্যে। ধর্মীয় গুরুরা প্রার্থনা করত তাদের জন্যে। আবার কয়দিন পরে এই ষড়যন্ত্রকারীরাই যখন বিজয় লাভ করত তখন সেই আমীর ওমরারাই তাদের প্রশংসা করত। ধর্মীয় গুরুরাও বলতেন “ষড়যন্ত্রকারীদের পতন হয়েছে”
এ পরিবর্তনের প্রভাব শুধুমাত্র আমীর ওমরাহদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত। এদের ছিল প্রজাদের হাড় চিবানোর ক্ষমতা।
ধর্ম ব্যবহৃত হত সম্রাজ্যের রাজাদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য। ধর্মীয় নেতারা সম্পদশালীদের কাতারে চলে গেল। তারাও চাইত শুধুমাত্র ক্ষমতাসীনরাই আজীবন ক্ষমতায় থাকুক তাতে তাদের সম্পদের দিকে কেউ তাকাবে না। কিন্তু গরিব মজলুম জনতার মধ্যে থেকে কেউ যদি ক্ষমতার মসনদে বসে পড়ে তাহলে তার কাছে ধর্মীয় নেতাদের সম্পদের হিসাব নিকাশ দিতে হবে।
রাজ্যের বড় বড় পদ গুলি নির্ধারিত ছিল কয়েকটা বংশের জন্য। বর্ণ হিন্দুরা যেমন ক্ষত্রিয় অথবা ব্রাক্ষণ হতে পারে না তেমনি সাধারণ ইরানীরা রাজ পদ লাভ করতে পারত না। প্রধান ক্ষমতাধর ব্যক্তি ছিলেন সম্রাট নিজেই। এরপরে ক্ষমতা ছিল অঙ্গরাজ্যের সমূহের শাসক বংশের উপর। এরাই পেত বিজিত এলাকার ফৌজি ও গভর্ণরের দায়িত্ব। ক্ষমতায় জমিদারদের স্থান ছিল তৃতীয়। এরা খাজনা আদায়ের জন্য পেত সেনা সাহায্য। জমিদার ও কৃষকদের মাঝে ছিল সরকারী কর্ম কর্তার স্থান। সাধারণ প্রজাদের মনে করা হত দাস দাসীর মত। জমিদারী বিক্রির সাথে সাথে প্রজাদেরও বিক্রি করা হত। ইরানী শাসক কোব্বাদের আমলে জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে এক আন্দোলন মাথা চাড়া দিয়েছিল। দেশী বিদেশী চাপের মুখে সম্রাট এই আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু কয়দিন পরে যখন আন্দোলন কারীরা জমিদারদের ঘর বাড়ী জ্বালিয়ে দেয়া শুরু করল তখন তিনি এর পেছনে সেনা লেলিয়ে দেন। হাজার হাজার আন্দোলনকারীদের হত্যা করা হয়। অগ্নিপীজারীরা ফিরে পায় তাদের হারানো শাসন ক্ষমতা। মূলত তখন থেকেই অগ্নিপূজারীরা নিজেদের প্রয়জোনে সম্রাটকে ও সম্রাট নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে অগ্নিপূজারীদের সমর্থন করা শুরু করল।
রেসিপি দেখুন
No comments :

No comments :

Post a Comment