মরুর ফুল ৩৮
জায়েদ প্রথমে পালাতে চাইছিল না কিন্তু মেহরিনের বিভিন্ন কথায় জায়েদ শেষমেষ রাজী হল। এর কারণ গুলি নিম্নরূপঃএক, ইরান সম্রাট জায়েদকে হত্যা করার আদেশ দিয়েছেন। খালেকদুন সে আদেশ মানতে বাধ্য। সেনাপতি এই আদেশ পালন না করে তাহলে সেনাপতির মাথা কাটা যাবে।
দুই, জায়েদ পালিয়ে গেলে কারো কিছু বলার নেই। সেক্ষেত্রে ইরান সম্রাট বিষয়টা মেনে নিতে পারেন।
তিন, জায়েদের সাথে মেহরিনের বিয়ের বিষয়টাতে খালেকদুনের মত নেই। জায়েদ যেহেতু মেহরিনদের জীবন বাঁচিয়েছে তাই খালেকদুন জায়েদকে বাঁচার একটা সুযোগ দিতে চাইছে। কিন্তু বিয়ে নয়।
এখন জায়েদ যদি একা পালিয়ে যায় তাহলে মেহরিন ও তার পরিবার কয়েকদিনের মধ্যে মাদায়েনের পথ ধরবে। মাদায়েনে গেলে মেহরিনকে পাওয়া জায়েদের জন্য অসম্ভব। কারণ জায়েদ দিনের বেলায় মাদায়েনের রাস্তা ঘাটে চলতে পারবে না। তাকে এখন অনেকেই চিনে। নতুন সম্রাটের লোকজন তো চেনেই এছাড়া সম্রাটের বিরোধী লোকজনও জায়েদকে চেনে। সম্রাটের বিরোধী লোকজন জানে জায়েদ সম্রাটের প্রিয় পাত্র। অর্থাৎ সম্রাট বিরোধী লোকদের কাছে জায়েদ নিরাপদ নয়। আবার সম্রাট নিজে জায়েদের হত্যার আদেশ দিয়েছেন। রাজকীয় বাহিনীর প্রায় সবাই এবং প্রায় সব দরবারী এখন জায়েদকে চিনে। যদি তাকে মাদায়েনে দেখা যায় তাহলে অবশ্যই তার ব্যপারে সন্দেহ করবে কারন জায়েদ সরকারী উঁচু পদের চাকরির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল আরবে চলে যাবে বলে। এখন সে মাদায়েনে কী করছে? অর্থাৎ জায়েদ এখন ইরানের দুই পক্ষের লোকজনের কাছেই অনিরাপদ। তাই মেহরিনকে ছেড়ে পালিয়ে চলে গেলে জীবনে আর মেহরিনের সাথে দেখা হবে না। তাই জায়েদ-মেহরিন দুই জনই সিদ্ধান্ত নিল তারা পরদিন পালিয়ে যাবে।
---
পরদিন সকালে মেহরিনকে যখন পাওয়া যাচ্ছে না তখন কেউ সন্দেহ করেনি। সবাই মনে করেছিল হয়তো সে জেরুজালেম দেখতে গিয়েছে। এই এলাকা মেহরিন ভাল করেই চিনে। দুপুর পেরিয়ে বিকাল হয়ে যাবার পরে সন্দেহ শুরু হল। খালেকদুনের কাছে যখন এই খবর পৌঁছাল তখন তিনি চারিদিকে লোক পাঠিয়ে জায়েদের খবর নেয়ার চেষ্টা করলেন। জায়েদকে যখন কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না তখন সবার সন্দেহ হল তারা নিশ্চয়ই একত্রে পালিয়েছে। সন্ধ্যার দিকে খালেকদুন রোমান সম্রাটের সাথে দেখা করার অনুমতি চাইলেন। সম্রাটের অনুমতি পাওয়ার পরে তিনি সম্রাটকে বললেন “ইরান থেকে যে কাফেলা পবিত্র ক্রুশ নিয়ে এসেছিল তাতে এক আরব খ্রিস্টান ছেলে ছিল। সেই ছেলেটি আমার মেয়েকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে। আপনি যদি দয়া করে আপনার লোকদের বলে দিতেন তাহলে তারা ছেলেটিকে গ্রেফতার ও আমার মেয়েকে উদ্ধার করে দিতে পারেন।”
“তারা পালিয়ে কোথায় যেতে পারে বলে মনে করছেন?” সম্রাটের প্রশ্ন।
“আমি যতদূর জানি ছেলেটার বাড়ী মদীনায়। ছেলেটা প্রায়ই বলত সে মদীনায় ফিরে যাবে। আমার মনে হচ্ছে ওরা মদীনায়ই ফিরে যাবে। এছাড়া ওদের যাওয়ার আর কোন জায়গা নেই।”
“ঠিক আছে আমি আমার লোকদের বলে দিচ্ছি মদীনার পথের সকল গ্রামে যেন দুই জনের খোঁজ লাগায়।” বলে রোমান সম্রাট তার সেনা অফিসারকে সেই অনুযায়ী আদেশ দিলেন। খালেকদুন তার মেয়ের একটা ছবি এনেছিলেন যাতে উদ্ধারকারী সৈন্যরা মেয়েটাকে দেখে চিনতে পারে। রোমান সম্রাটের আদেশে একজন চিত্রকর এসে সেই ছবিটার আরো অনেকগুলো কপি করালেন। এরপরে সেনা অফিসারদের হাতে হাতে ছবিটা দিয়ে জেরুজালেম থেকে আরবের পথে যাওয়ার সম্ভাব্য সকল স্থানে সেনা ছাউনি, গ্রাম, শহর সব জায়গায় লোক পাঠিয়ে দিলেন আর এদেরকে ধরিয়ে দিলে ভাল পুরষ্কারের ঘোষনা দিলেন। রোমান সম্রাট খালেকদুনকে অনেক পছন্দ করেন মূলত একটা কারণে, তিনি মনে করেন এই খালেকদুনের কারণেই মূল যুদ্ধটা শেষ হয়েছে। তা নাহলে এতদিন রোমানদের রাজধানী অবরোধ করা থাকলে কী যে হত!
---
জেরুজালেম থেকে মদীনা পূর্ব-দক্ষিণ দিকে। রোমান ও ইরানী সেনারা সেনারা সেখানে জায়েদ-মেহরিনকে তন্ন তন্ন করে খুঁজছে। আর এদিকে জায়েদ-মেহরিন জেরুজালেম থেকে পালিয়ে পশ্চিমে তীরের দিকে যাচ্ছিল। সেখান থেকে সমুদ্র পথে তারা কনস্টেন্টিপোলে যাবে।
পরদিন তারা জেরুজালেমের এক গ্রামে গিয়ে পৌঁছুল। সেই গ্রামে একটা গীর্জা আছে। ইরানীরা সেই গীর্জাকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে। ভাঙ্গা গীর্জার সামনে গিয়ে তারা থামল। তারা গত রাতে একটানা পথ চলেছে। পথে ঘোড়াগুলোকে বিশ্রাম না দিলে হয়তো আর সামনে এগোতে পারত। জেরুজালেমের এই এলাকাটা শষ্য শ্যামল। জায়েদের সৈনিক জীবনে অনেকবার একটানা পথ চলেছে। কিন্তু মেহরিনের সেই অভিজ্ঞতা নেই। জায়েদ খেয়াল করল, মেহরিন অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। যদিও সে মুখে কিছুই বলছে না।
মেহরিন “থামলেন কেন?”
“তোমার অবস্থা ভাল না দেখছি। রাতে তো ঘুমাতে পারনি। এই গ্রামে একটা আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে একদিন থেকে যাই।”
“যদি আমাদের ধরে ফেলে?”
“ধুর, এখানে আমাদের ধরবে কে?”
“বলা তো যায় না!” মেহরিন একটু থেমে বলল “আরেকটা কথা, মানুষ যখন আমার আপনার পরিচয় জিজ্ঞেস করবে তখন কী উত্তর দিবেন?”
জায়েদ দ্রুত উত্তর দিল “আমরা যা তাই বলব। বলব এই মেয়েটি আমার……… জায়েদের মুখ বন্ধ হয়ে গেল
মেহরিন হেসে বলল “আমরা পালিয়ে এসেছি তো বিয়ে করার জন্য, তাই না?”
“জ্বী”
“তাহলে সেই কাজটা আগে সেরে নিচ্ছি না কেন?”
“আমি ভেবেছিলাম আমরা মদীনা গিয়ে নবীর কাছ থেকে ওনার দ্বীন গ্রহণ করে তারপরে……….
“কিন্তু সেটা তো সম্ভব না। কারণ আমরা এখন কন্সটেন্টিপোল যাচ্ছি। সেখানে যেতে আসতে কম হলেও দুই তিন মাস লেগে যাবে। এই দুই তিন মাস একটা যুবক ছেলে একটা যুবতী মেয়ে এক সাথে কী করে থাকবে?”
জায়েদ দেখল মেহরিনের কথায় যুক্তি রয়েছে। সে দিনই তারা সেই গ্রামের গীর্জায় খ্রিস্টান ধর্মীয় রীতিতে বিয়ে করে। বাসর রাতটা কাটায় এক কৃষকে ঝুপড়িতে।
বিয়ের পরে এই প্রথম জায়েদ বুঝল মেহরিন তাকে কতটা ভালবাসে। জায়েদও বুঝল এভাবে দিনের পরে দিন বাইরে কাটানো ঠিক না। সপ্তাহ খানেক পরে তারা জাহাজে উঠল।
মাস খানেক পরে তারা পাদ্রী ম্যাথিউসের সাথে দেখা করল। ম্যাথিউস প্রচন্ড অসুস্থ, জায়েদকে দেখে অনেক খুশী হল।
“তুমি এসেছ? আমি অনেকদিন ধরে তোমার অপেক্ষায় আছি।” শারিরীক খারাপ অবস্থার মধ্যে অনেক কষ্টে কথাগুলো বললেন।
পাদ্রীর অবস্থা দেখে জায়েদের চোখে পানি চলে এল। এই পাদ্রী জায়েদের বিপদের দিনে অনেক উপকার করেছেন। বলা যায় জায়েদকে নতুন জীবন দান করেছেন। মেহরিনকে দেখে পাদ্রী বললেন “তোমার পছন্দ অনেক ভাল। খোদার কাছে প্রার্থনা করি তুমি সুখী হও।” কিছুক্ষণ থেমে তিনি আরো বললেন “আমার সময় শেষ হয়ে এসেছে। শরীর আর চলছে না। যদি শরীর চলত তাহলে তোমার সাথে মদীনায় চলে যেতাম। সেই নবীর কদমে হাত ছুঁয়ে তার কাছ থেকে তার দ্বীন গ্রহণ করতাম!”
একজন উঁচু মানের খ্রিস্টান পাদ্রীর মুখ থেকে এই কথা শুনে জায়েদ হতভম্ভ হয়ে গেল। জায়েদের মুখের ভাব দেখে পাদ্রী বললেন “বাইবেলে যে শেষ নবীর কথা বর্ণনা করা হয়েছে আরবের নবী দাবীদারের সাথে বাইবেলের বর্ণনার হুবুহু মিল আছে। আমি ভাল করে বাইবেলের সেই সব অধ্যায় পড়েছি। আরবের নবীর সাথে মিলিয়ে দেখেছি। আমার যদি শক্তি থাকত তাহলে আমি সেই নবীর কাছে যেতাম। তোমার সাথে যদি নবীর দেখা হয় তাহলে আমার পক্ষ থেকে ওনাকে সালাম জানাবে।”
জায়েদের মুখ দিয়ে কোন কথা বেরোচ্ছিল না। পাদ্রীর কথা শুনে জায়েদের চোখ দিয়ে পানি বেরোচ্ছিল। পাদ্রী আবারো বলতে লাগল “ইসলামের নবীর পথে কেউ বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। যে রোম ইরান সম্রাজ্য অনেক শক্তিশালী তারা একদিন ইসলামের কাছে পরাভূত হবে। দলে দলে অগ্নীপূজারী, ইহুদী, খ্রিস্টান সবাই ইসলামের কাতারে যোগ দিবে। ইশ, আমি যদি আর কিছুদিন বেঁচে থাকতাম তাহলে এখানে বসেই সেই নবীর উম্মতের অপেক্ষায় থাকতাম।”
জায়েদের মাথায় কিছুই ঢুকছিল না “এখানে বসেই” শব্দগুলি শুনে। পাদ্রী ব্যখ্যা করলেন “একদিন রোম-ইরান সম্রাজ্য মুসলমানদের অধীনে চলে যাবে। এখন যে মন্দীর থেকে অগুন পূজা করা হয়ে সেই মন্দীর থেকে তখন আযান দেয়া হবে। এখন যে গীর্জা থেকে যীশুর নামে প্রার্থনা করা হয় তখন সেই গীর্জায় এক আল্লাহর নাম নেয়া হবে।” পাদ্রী কিছুক্ষনের জন্য থামলেন “এসব আমার মুখের কথা না। এসব কথা বাইবেলে লেখা রয়েছে। খ্রিস্টান সম্রাটের আশা ছিল এই নবী জন্ম নিবেন জেরুজালেমের কোন এক স্থান থেকে কিন্তু তাদের শায় গুড়ে বালি দিয়ে নবুয়্যত এল আরবে। শুধু সেই কারণেই খ্রিস্টান রোমান সম্রাট নবীকে মেনে নিচ্ছে না অথচ খেয়াল করলে দেখা যায় আরবের ছোট খাট খ্রিস্টান রাজ বাদশাহরা ঠিকই ইসলামের নবীর দাওয়াত কবুল করেছে। তারা বিনা দ্বিধায় এক চাল চুলোহীন নবীর কতৃত্ব মেনে নিচ্ছেন। কারণ একটাই, সেই সব রাজ বাদশাহরা জানেন, এই নবী সত্য।”
জায়েদ মন্ত্রমুগ্ধের মত পাদ্রীর কথা শুনছিল। সে ভুলেই গেছে সে কী কারণে এখানে এসেছে। পাদ্রী নিজেই সেই কথা বললেন “আমি জানি তুমি এখানে কী কারণে এসেছে। তিন বছর আগে আমি সিরিয়ার একটি শহরে গিয়েছিলাম। সেখানে এক আরব রোমান সেনা অফিসারের সাথে দেখা হয়েছি। তার নাম ইউসুফ, সম্ভবত আবিসিনিয়ায় তার বাড়ী। তার সাথে আমার অনেক কথা হল। বিশেষ করে যখন জানতে পারলাম সে এক কালে কিছুদিন মদীনায় অবস্থান করেছিল তখন তার প্রতি আগ্রহ বেড়ে গেল। এক সময় সে তার জীবন কাহিনী বলল। তখন জানতে পারলাম সেই ইউসুফ তোমার বোনের স্বামী। ইউসুফ তখন সিরিয়ার দুম্মাতুল জন্দলে রোমান গভর্ণর অফিসে চাকরি করত। তুমি দুম্মাতুল জন্দলে গিয়ে ওর খোঁজ নিবে। সে তোমার বোন রুকাইয়া সহ সেখানকার এক পল্লীতে থাকে। তাদের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে আছে। আমি ওদের বাড়ী গিয়েছি। তোমার বোন তোমার কথা শুনে অনেক কাঁদল।”
বোনের কথা শুনে জায়েদও কাঁদল। পাদ্রীর আতিথিয়েতা গ্রহন করে দুই দিন সেখানে থেকে তৃতীয় দিন তারা জাহাজে উঠল। এবার তারা ইস্কান্দারিয়া বন্দরে নামল। জেরুজালেমের পথে তারা যাবে না কারণ খালেকদুন নিশ্চয়ই রোমান সেনাদের সাহায্য নিয়ে তাদের খোঁজাখোজি করেছে। সুতরাং এই পথ পরিহার করে তারা সরাসরি তাবুকের পথ ধরল। তাবুকের নিকটবর্তী শহর হল দুম্মাতুল জন্দল।
আরবের পথে যাওয়ায় সময় তারা একদিন একটা বাজার পার হচ্ছিল। এটা আরব-মিশরীয়দের ব্যবসা কেন্দ্র। জায়েদ সেই বাজার পার হওয়ার সময় শুনতে পেল সেখানকার ব্যবসায়ীদের আলোচনার মূল বিষয় হল ‘মক্কা বিজয়’। ব্যপারটা জায়েদ প্রথম বুঝল না। পরে যখন বুঝল তখন তার আগ্রহ বেড়ে গেল- মুসলমানরা আরবের কেন্দ্র বিন্দু মক্কা দখল করেছে!
Subscribe to:
Post Comments
(
Atom
)
Casino Bonus Code - JamBase
ReplyDeleteLearn how to use our casino bonus code. If 경산 출장마사지 you want to get real money for 김포 출장샵 just $10 과천 출장샵 and get $60 you can 문경 출장샵 win real 여주 출장안마 money.