মরুর ফুল ৩৯
জায়েদ ও মেহরিন অবাক হয়ে মুসলমানদের মক্কা বিজয়ের কাহিনী শুনছিল। তাদের মাথায় কাজ করছিল না কী করে আরবের সবচেয়ে অহংকারী বংশ কোরাইশরা রাসূল (সাঃ) এর প্রতি আণুগত্যা প্রকাশ করল। মক্কা পুরো আরবের কাছে তীর্থ স্থান হিসেবে বিবেচিত। প্রতি বছর এখানে হজ্জ্ব করতে দূর দূরান্ত থেকে লোক জন আসে। মক্কার কাবা শরীফের খাদেম হিসেবে কুরাইশরা আরবের বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ মর্যাদা পায়।জায়েদ দেখেছে এক দল আরেক দলের উপরে বিজয় অর্জন করলে বিজয়ী দল কী করে। রোমান ইরানীদের মধ্যে এই আচরণের কোন পার্থক্য নেই। এমনকি যে মদীনায় একশ বছর ধরে আওস খাজরাজ বংশের মধ্যে যুদ্ধ চলছিল সেইখানেও কী হয় সে জানে। বিজয়ী দল পরাজিত দলের লোকদের ইচ্ছা মত কচুকাটা করে। একজন আরবকে জিজ্ঞেস করল “মুসলমানরা মক্কাবাসীদের সাথে কীরূপ আচরণ করেছে?”
জবাব সেই আরব বললেন “আমি আমার জীবনে এরকম আচরণ দেখিনি, এমনকি কোন গল্পেও শুনিনি। নবীকে যারা কষ্ট দিতেন তাদের সবাইকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে!”
“আর যারা নবীকে মক্কা থেকে বের করে দিয়েছিল?”
“তাদের ক্ষেত্রেও একই আচরণ করা হয়েছে!”
জায়েদ বলল “এমন লোক আসলেই আল্লাহর প্রেরিত নবী। সাধারণ মানুষের পক্ষে এত দয়ালু হওয়া সম্ভব নয়।”
---
মক্কা অভিযানের কারণ
হোদায়বিয়ার সন্ধির একটি ধারা এরূপ ছিলো যে, যে কেউ ইচ্ছা করলে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অথবা কোরাইশদের সাথে মিত্রতায় আবদ্ধ হতে পারবে।
যিনি যে দলে যুক্ত হবেন তিনি সেই দলের অংশ বলেই বিবেচিত হবেন। কেউ যদি হামলা বা অন্য কোন প্রকার বাড়াবাড়ি করে তা সে দলের ওপর হামলা বলে গণ্য হবে।
এই চুক্তির মাধ্যমে বনু খোজাআ গোত্র রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলো। আবু বকর গোত্র আবদ্ধ হয়েছিলো কোরায়শদের মিত্রতার বন্ধনে। এমনি করে উভয় গোত্র পরস্পর থেকে নিরাপদ হয়েছিলো। কিন্তু আইয়ামে জাহেলিয়াতের সময় থেকেই উভয় গোত্রের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে বিবাদ চলে আসছিলো। পরবর্তীকালে ইসলামের আবির্ভাব এবং হোদায়বিয়ার সন্ধির পর বিবদমান উভয় গোত্র পরস্পরের ব্যাপারে নিরাপদ ও নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলো। বনু বকর গোত্র এই চুক্তির সুযোগকে গণীমত মনে করে বনু খোযাআ গোত্রের ওপর থেকে পুরানো শত্রুতার প্রতিশোধ গ্রহণে প্রস্তুত হলো। নওফেল ইবনে মাবিয়া দয়লি বনু বকরের একটি দলের সাথে শাবান মাসের ৮ তারিখে’ বনু খোযাআ গোত্রের ওপর হামলা চালায়। সেই সময় বনু খোযাআ গোত্রের লোকেরা ওয়াতের নামে একটি জলাশয়ের পাশে অবস্থান করছিলো। আকস্মিক হামলায় বনু খোযাআ গোত্রের কয়েকজন লোক মারা যায়। উভয়ের মধ্যে পরে সংঘর্ষ ও হয়। কোরায়শরা এই হামলায় বনু বকর গোত্রকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে। কোরাইশদের কিছু লোক রাতে অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে বনু বকর গোত্রের সাথে মিশে গিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর হামলাও করে। আততায়ীরা বনু খোযাআ গোত্রের লোকদের তাড়িয়ে হরমের কাছাকাছি নিয়ে যায়। সেখানে বনু বকর গোত্রের লোকেরা বললো, হে নওফেল, এবার তো আমরা হরম শরীফে প্রবেশ করবো। তোমদের মাবুদ, তোমাদের ইবাদত। একথার জবাবে নওফেল বললো,‘আজ কোন মাবুদ নেই। তোমাদের প্রতিশোধ নিয়ে নাও। আমার বয়সের কসম তোমরা হরম শরীফে চুরি করতে পারো, তবে কি নিজেদের প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারো না?
এদিকে বনু খোজাআ গ্রোত্রের লোকেরা মক্বায় পৌঁছে বুদায়েল ইবনে ওরাকা, খোযায়ী এবং তার একজন মুক্ত করা ক্রীতদাস রাফের ঘরে আশ্রয় গ্রহণ করলো। আমর ইবনে সালেম খাযায়ী সেখান থেকে বেরিয়ে মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হয়ে এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। সেই সময় তিনি মসজিদে নববীতে সাহাবাদের সঙ্গে অবস্থান করছিলেন। আমর ইবনে সালেম বললেন, ‘হে পরওয়ারদেগার, আমি মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে তাঁর চুক্তি এবং তাঁর পিতার প্রাচীন অঙ্গীকারের (বনু খোজাআ এবং বনু আবদুল মুত্তালবের মধ্যে বহু পূর্ব থেকে চলে আসা অঙ্গীকারের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে) দোহাই দিচ্ছি। হে রসূল, আপনারা ছিলেন সন্তান আর আমর ছিলাম জন্মদানকারী। (এখানে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, আবদে মান্নাফের মা অর্থাৎ কুসাই এর স্ত্রী হাব্বি ছিলেন বুন খোজাআ গোত্রের মেয়ে। এ কারণে সমগ্র নবী পরিবারকে বনু খোজাআ গোত্রের সন্তান বলা হয়েছে।) এরপর আমরা আনুগত্য গ্রহণ করেছি এবং কখনো অবাধ্যতা প্রদর্শন করিনি। আল্লাহ তায়ালা আপনাকে হেদায়াত দান করুন। আপনি সর্বাত্মক সাহায্য করুন, আল্লাহর বান্দাদের ডাকুন, তারা সাহায্যের জন্যে আসবে। এদের মধ্যে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও থাকবেন, উদিত চতুর্দশীর চাঁদের মতো সুন্দর। যদি তাঁর ওপর অত্যাচার করা হয়, তবে তাঁর চেহারা রক্তিম থমথমে হয়ে যায়। আপনি এমন এক দুর্ধর্ষ বাহিনীর মধ্যে যাবেন, যারা ফেনিল উচ্ছ্বাস সমুদ্রের মতো তরঙ্গায়িত থাকবে। নিশ্চিত জেনে রাখুন, কোরাইশরা আপনদের সাথে সম্পাদিত চুক্তির বর খেলাফ করেছে, অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে। তারা আমার জন্যে কোদা নামক জায়গায় ফাঁদ পেতেছে এবং ধারণা করেছে যে, আমি কাউকে সাহায্যের জন্য ডাকব না। অথচ তারা বড়ই কমিনা এবং সংখ্যায় অল্প। তারা আতর নামক জায়গায় রাতের অন্ধকারে হামলা করেছে এবং আমাদেরকে রুকু সেজদারত অবস্থায় হত্যা করেছে। অর্থাৎ আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি, অথচ আমদের হত্যা করা হয়েছে।
রসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই অভিযোগ শোনার পর বললেন, হে আমর ইবনে সালেম, তোমায় সাহায্য করা হয়েছে। এরপর আকাশে এক টুকরো মেঘ দেখ গেলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এই মেঘ বনু কা’ব এর সাহায্যের সুসংবাদ স্বরূপ আবির্ভূত হয়েছে।
এরপর বুদাইল ইবনে ওরাকা খোযায়ীর নেতৃত্বে বনু কোযাআ গোত্রের একটি প্রতিনিধিদল মদীনায় এসে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জানায়, কারা কারা নিহত হয়েছে। তারা আরো জানায় যে, কিভাবে কোরায়শরা বনু বকর গোত্রকে সাহায্য করেছে। এরপর তারা মক্কায় ফিরে যায়।
সন্ধি নবায়নের চেষ্টা
কোরায়শ এবং তার মিত্ররা যা করেছিলো সেটা ছিলো হোদায়বিয়ায় সন্ধির সুস্পষ্ট লংঘন এবং বিশ্বাসঘাতকতা। এর কোন বৈধতার অজুহাত দেখানো যাবে না। কোরায়শরাও সন্ধির বর খেলাফ করার কথা খুব শীঘ্র বুঝতে পেরেছিলো। তারা এই বিশ্বাস ঘাতকতার পরিণাম চিন্তা করে এক পরামর্শ সভা আহ্বান করলো। সেই সভায় সর্ব সম্মত সিদ্ধান্ত হলো যে, তারা তাদের নেতা আবু সুফিয়ানকে হোদায়বিয়ার সন্ধির নবায়নের জন্যে মদীনায় পাঠাবে।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোরায়শদের সন্ধি লংঘন পরবর্তী কার্যক্রম সম্পর্কে সাহাবাদের আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমি যেন দেখতে পাচ্ছি যে, আবু সুফিয়ান সন্ধি পোক্ত এবং মেয়াদ বাড়ানোর জন্যে মদীনায় এসে পৌঁছেছে।
এদিকে আবু সুফিয়ান মদীনার উদ্দেশ্যে ওসফান নামক জায়গায় পৌঁছার পর বুদাইল ইবনে ওরাকার সাথে তার দেখা হলো। বুদাইল মদীনা থেকে মক্বা যাচ্ছিলো।
আবু সুফিয়ান ভেবেছিলো বুদাইল রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে আসছে।
তবুও জিজ্ঞাসা করলো “কোথা থেকে আসছো বুদাইল?”
বুদাইল বললেন “আমি খোযাআর সাথে ওই উপকূলে গিয়েছিলাম।”
আবু সুফিয়ান জিজ্ঞাস করলো, “তুমি কি মোহাম্মদের কাছে যাওনি?”
বুদাইল বললেন “না তো!”
বুদাইল মক্কার পথে যাওয়ার পর আবু সুফিয়ান বললো “বুদাইল যদি মদীনায় গিয়ে থাকে, তবে তো তার উটকে মদীনার খেজুর খাইয়েছে”
এরপর আবু সুফিয়ান বুদাইলের উট বসানোর জায়গায় গিয়ে উটের পরিত্যক্ত মল ভেঙ্গে সেখানে মদীনার খেজুরের বীচি দেখতে পেলো। এরপর বললো “আমি আল্লাহর কসম করে বলছি যে, বুদাইল মোহাম্মদের কাছে গিয়েছিলো”
মোটকথা আবু সুফিয়ান মদীনায় গেলো এবং তার কন্যা উম্মে হাবিবার ঘরে গিয়ে উঠলো। আবু সুফিয়ান রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিছানায় বসতে যাচ্ছিলো। এটা লক্ষ্য করে হযরত উম্মে হাবিবা (রাঃ) সাথে সাথে বিছানা গুটিয়ে ফেললেন।
আবু সুফিয়ান বললো “মা, তুমি আমাকে এ বিছানার উপযুক্ত মনে করোনি না এ বিছানাকে আমার উপযুক্ত মনে করোনি? আমার কাছ থেকে আসার পর তুমি খারাপ হয়ে গেছো।”
হযরত উম্মে হাবিবা (রাঃ)বললেন “এটি হচ্ছে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিছানা আর আপনি হচ্ছেন একজন নাপাক মোশরেক।”
আবু সুফিয়ান বললেন “খোদার কসম, আমার কাছে থেকে আসার পর তুমি খারাপ হয়ে গেছ।”
এরপর আবু সুফিয়ান সেখান থেকে বেরিযে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে তাঁর সাথে আলোচনা করলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে কোন জবাব দিলেন না।
আবু সুফিয়ান হযরত আবু বকরের কাছে গিয়ে তাকে অনুরোধ করলো, তিনি যেন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাতে আলোচনা করেন। হযরত আবু বকর (রাঃ) অসম্মতি প্রকাশ করলেন। আবু সুফিয়ান হযরত ওমর (রাঃ)-এর কাছে গিয়ে তাকে বললো তিনি যেন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে তাদের ব্যাপারে কথা বলেন। হযরত ওমর (রাঃ) বললেন “আমি কেন তোমাদের জন্য রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে সুপারিশ করবো। আল্লাহর শপথ, যদি আমি কাঠের টুকরো ছাড়া অন্য কিছু নাও পাই তবু ও সেই কাষ্টখন্ড দিয়ে তোমদের সাথে জেহাদ করবো।”
আবু সুফিয়ান এরপর হযরত আলীর (রাঃ) কাছে গেলেন । হযরত ফাতেমা (রাঃ) সেখানে ছিলেন। হযরত হাসানও ছিলেন। তিনি ছিলেন তখন ছোট। হাঁটা চলা করছিলেন। আবু সুফিয়ান বললেন “হে আলী, তোমার সাথে আমার বংশগত সম্পর্ক সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ। আমি একটা প্রয়োজনে এসেছি। হতাশ হয়ে এসেছি, হতাশ হয়ে ফিরে যেতে চাইনা। তুমি আমার জন্যে মোহাম্মদের কাছে একটু সুপারিশ করো।”
হযরত আলী (রাঃ) বললেন “আবু সুফিয়ান, তোমার জন্যে আফসোস হয়। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটা ব্যাপারে সংকল্প করেছেন, এ ব্যাপারে আমরা তাঁর সাথে কোন কথা বলতে পারি না।”
আবু সুফিয়ান বিবি ফাতেমার (রাঃ) প্রতি তাকিয়ে বললেন “তুমি কি তোমার এ সন্তানকে এ মর্মে আদেশ করতে পারো যে, সে লোকদের মধ্যে আশ্রয়দানের ঘোষণা দিয়ে সব সময়ের জন্য আরবদের সর্দার হবে?”
হযরত ফাতেমা (রাঃ) বললেন “আল্লাহর শপথ, আমার সন্তান লোকদের মধ্যে নেতা হওয়ার মতো ঘোষণা দেয়ার যোগ্য হয়নি। তাছাড়া রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপস্থিতিতে কেউ আশ্রয় দিতে পারে না।”
সকল চেষ্টার ব্যর্থতার পর আবু সুফিয়ানের দু’চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে গেলো। তিনি সংশয় দোলায়িত চিত্তে কম্পিত কন্ঠে হযরত আলীকে (রা.) বললেন “আবুল হাসান আমি লক্ষ্য করছি যে, বিষয়টা জটিল হয়ে পড়েছে। কাজেই আমাকে একটা উপায় বলে দাও।”
হযরত আলী (রা.) বললেন “আল্লাহর শপথ, আমি তোমার জন্যে কল্যাণকর কিছু জানি না। তুমি বনু কেনানা গোত্রের নেতা। তুমি দাঁড়িয়ে লোকদের মধ্যে নিরাপত্তার কথা ঘোষণা করে দাও, এরপর নিজের দেশে ফিরে যাও।”
আবু সুফিয়ান বললেন “তুমি কি মনে করো যে, এটা আমার জন্যে কল্যাণকর হবে?”
হযরত আলী (রা,) বললেন “না, আমি তা মনে করি না। তবে, এছাড়া অন্য কোন উপায়ও আছে বলে মনে হয় না।”
এরপর আবু সুফিয়ান মসজিদে নববীতে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন, “হে লোক সকল, আমি তোমাদের মধ্যে নিরাপত্তার কথা ঘোষণা করছি।” এরপর নিজের উটের পিঠে চড়ে মক্কায় চলে গেলেন।
কোরাইশদের কাছে গেলে তারা তাকে ঘিরে ধরে এবং মদীনার খবর জানতে চাইল। আবু সুফিয়ান বললেন “কথা বলেছি কিন্তু তিনি কোন জবাব দেননি। আবু কোহাফার পুত্রের কছে গেছি তার মধ্যে ভাল কিছু পাইনি। ওমর ইবনে খাত্তাবের কাছে গেছি, তাকে মনে হয়েছে সবচেয়ে কট্টর দুশমন। আলীর কাছে গেলাম, তাকে সবচেয়ে নরম মনে হলো। তিনি আমাকে একটা পরামর্শ দিলেন আমি সে অনুযায়ী কাজ করলাম। জানিনা সেটা কল্যাণকর হবে কিনা?”
লোকেরা জানতে চাইল “সেটা কি?”
আবু সুফিয়ান বললেন “আলী পরামর্শ দিলেন আমি যেন নিরাপত্তার কথা ঘোষণা করি। অবশেষে আমি তাই করলাম।”
কোরাইশরা বললো “মোহাম্মদ কি তোমার নিরাপত্তার ঘোষণাকে কার্যকর বলে ঘোষণা করেছে?”
আবু সুফিয়ান বললো “না তা করেনি”
“তোমার সর্বনাশ হোক” কোরাইয়শরা বলল “আলী তোমার সাথে স্রেফ রসিকতা করেছে।”
আবু সুফিয়ান বললো “আল্লাহর শপথ, এছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না।”
কোরাইশদের বিশ্বাসঘাতকতার খবর আসার তিনদিন আগেই রসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আয়েশা (রা.) –কে তাঁর সাজ-সরঞ্জাম প্রস্তুত করতে বলেছিলেন। তবে বিষয়টি গোপন রাখার জন্য তিনি পরামর্শ দেন। এরপর হযরত আবু বকর (রা.) হযরত আয়েশার (রা.) কাছে বললেন, “মা এ প্রস্তুতি কিসের?” হযরত আয়েশা (রা.) বললেন “আমি জানি না আব্বা”
হযরত আবু বকর বললেন “এটাতো রোমানদের সাথে যুদ্ধের সময় নয়। তাহলে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন দিকে যাওয়ার ইচ্ছা করেছেন?”
হযরত আয়েশা (রা.) বললেন “আমি জানিনা আব্বা”
তৃতীয় দিন সকালে হযরত আমর ইবনে সালেম খাযায়ী ৪০ জন সওয়ারসহ এসে পৌঁছলেন। তিনি কয়েক লাইন কবিতা আবৃতি করলেন। এতে শ্রোতারা বুঝতে পারলেন যে, কোরায়শরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এরপর বুদাইল এলেন। এরপর এলো আবু সুফিয়ান। এর ফলে সাহাবারা পরিস্থিতি উপলব্ধি করলেন। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের বললেন “মক্কায় যেতে হবে” সাথে সাথে এ দোয়া করলেন “হে আল্লাহ তায়ালা গোয়েন্দা এবং কোরায়শদের কাছে আমাদের যাওয়ার খবর যেন পৌঁছাতে না পারে, তুমি তার ব্যবস্থা করো। আমরা যেন মক্কাবাসীদের কাছাকাছি যাওয়ার আগে তারা যেন বুঝতে না পারে, জানতেও না পারে।”
গোপনীয়তা রক্ষার জন্যে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অষ্টম হিজরীর রমজান মাসে হযরত আবু কাতাদা ইবনে রাবঈর নেতৃত্বে আটজন সাহাবীকে এক অভিযানে বাতনে আযাম নামক জায়গায় প্রেরণ করেন। এই জায়গা যি-খাশাব এবং যিল মাররার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। এর দূরত্ব মদীনা থেকে ৩৬ মাইল।
এই ক্ষুদ্র সেনাদল প্রেরণের উদ্দেশ্য ছিলো এই যে, যারা বোঝার তার বুঝবে যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উল্লিখিত জায়গায় যাবেন। চারিদিকে এই খবরই ছড়িয়ে পড়বে। এ ক্ষুদ্র সেনাদল উল্লিখিত জায়গায় পৌঁছার পর খবর পেলো যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা অভিমুকে রওয়ানা হয়ে গেছেন। এ খবর পাওয়ার পর তারাও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে কাফেলার সাথে গিয়ে মিলিত হলো। এটি সেই অভিযান যার সাথে আমের ইবনে আজবাতের সাক্ষাৎ হয়েছিল। আমের ইসলামী রীতি অনুযায়ী সালাম করেছিলেন। কিন্তু পূর্বতন কোন শত্রুতার কারণে মাহলাম ইবনে জাশামা আমেরকে হত্যা করেন এবং তার উট ও অন্যান্য জিনিস আত্মসাৎ করেন। এরপর কোরআনের এই আয়াত নাযিল হয়, ‘যে তোমাকে সালাম করে, তাকে বলো না যে, তুমি মোমেন নও।’ এরপর সাহবায়ে কেরাম আল্লাহর রসূলের কাছে মাহলাম ইবনে জাশামের মাগফেরাতের দোয়া করার আবেদন জানান। আল্লাহর রসূলের কাছে মাহলাম ইবনে জাশামের নাগফেরাতের দোয়া করার আবেদন জানান। আল্লাহর রসূলের সামনে মাহলাম হাযির হলে তিনি বলেন “হে আল্লাহ পাক, মাহলাম যেন ক্ষমা না পায়” তিনি এ কথা তিনবার উচ্চারণ করেন। এ কথা শুনে মাহলাম কাপড়ে চোখ মুছে উঠে পড়েন। মাহলামের গোত্রের লোকেরা বলেছে, পরবর্তীকালে আল্লাহর রসূল মাহলামের জন্য মাগফেরাতের দোয়া করেছিলেন।
এদিকে হাতেব ইবনে আবু বালতাআ কোরায়শদের এক খানি চিঠি লিখে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা জানানোর চেষ্টা করেন। সেই চিঠি মক্কায় কোরায়শদের হাতে পৌঁছানোর জন্য অর্থের বিনিময়ে একজন মহিলাকে নিয়োগ করেন। সেই মহিলা খোঁপার ভেতর চিঠিখানি লুকিয়ে মক্কায় রওয়ানা হন। এদিকে আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় রসূলকে এ খবর জানিয়ে দেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আলী, হযরত মেকদাদ, হযরত যোবায়ের এবং হযরত আবু মারছাদ গুনুবিকে ডেকে বলেন, তোমরা চারজন রওজা খাখ-এ যাও। সেখানে উঠের পিঠে আরোহণকারিনী একজন মহিলাকে পাবে। তার কাছে একখানি চিঠি পাবে। সেই চিঠি কোরায়শদের কাছে পাঠানো হয়েছে। চারজন সাহাবী রওযা খাখ-এ পৌঁছে সেই মহিলাকে পেলেন।
মহিলাকে জিজ্ঞাসা করা হলো “তোমার কাছে কি কোন চিঠি আছে?” মহিলা অস্বীকার করলো। সাহবারা উটের হাওদায় খুঁজে দেখলেন কিন্তু চিঠি পেলেন না।
এরপর হযরত আলী (রা.) বললেন “আমি আল্লাহর নামে কসম করে বলছি, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-ও মিথ্যা বলেননি, আমরা ও মিথ্যা বলছি না। তুমি হয়তো চিঠি দাও, না হয় আমরা তোমাকে উলঙ্গ করবো।”
একথা শুনে মহিলা বললো “আচ্ছা আপনারা একটু ঘুরে দাঁড়ান।”
সাহাবার ঘুরে দাঁড়ালে মহিলা তার খোঁপা খুলে চিঠি বের করে সাহাবদের হাতে দিলেন। তারা চিঠি নিয়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গেলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চিঠিখানা পড়িয়ে দেখলেনে যে, ‘ওতে লেখা রয়েছে, হাতেব ইবনে আবু বালতাআর পক্ষ থোকে কোরায়শদের প্রতি।’ এতে কোরায়শদেরকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মক্কা অভিযানের খবর দেয়া হয়েছিল। চিঠিতে লেখা ছিলঃ
আম্মা বাদ, হে কোরায়শরা, আল্লাহর রসূল তোমাদের উদ্দেশ্যে সৈন্যসহ হাযির হচ্ছেন। যদি তিনি একাও হাযির হন তবে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে সাহায্যে করবেন এবং তাঁকে দেয়া ওয়াদা পূরণ করবেন। কাজেই তোমরা নিজেদের ব্যাপারে চিন্তা করো। ওয়াসসালাম।
ওয়াকেদী লিখেছেন, হাতেব সোহায়েল ইবনে আমর সফওয়ান ইবনে উমাইয়া এবং একরামার কাছে একথা লিখেছেন যে, আল্লাহর রসূল লোকদের মধ্যে যুদ্ধের কথা ঘোষণা করেছেন। বুঝতে পরি না তোমাদের উদ্দেশ্যে যাবেন, নাকি অন্য কোথাও। আমি চাই যে, তোমাদের প্রতি এটা আমার এহসান হিসাবে গণ্য হবে।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন “হাতেব, এটা কি?”
হাতেব বললেন “আমার ব্যাপারে তাড়াহুড়া করবেন না। আল্লাহর কসম, আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর ররসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর আমার ঈমান রয়েছে। আমি মুরতাদ হয়ে যাইনি বা আমার মধ্যে কোন পরিবর্তনও আসেনি। কথা হচ্ছে যে, আমি কোরাইশ বংশের লোক নই। আমি তাদের মধ্যে আত্মগোপন করেছিলাম। বর্তমানে আমার পরিবার-পরিজন তাদের কাছে রয়েছে। কোরাইশদের সাথে আমার এমন কোন আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই, যে কারণে তারা আমার পরিবার পরিজনের তত্ত্বাবধান করবে। তাই আমি চিন্তা করলাম যে, তাদের একটা উপকার করবো এর ফলে তারা আমার পরিবার-পরিজনের হেফাজত করবে। আমি ছাড়া আপনার সঙ্গে অন্য যারা রয়েছেন মক্কায় তাদরে প্রত্যেকেরই আত্মীয়-স্বজন রয়েছেন। সেসব আত্মীয়-স্বজন তাদের পরিবার-পরিজনের হেফাজত করবেন।"
হযরত ওমর (রা.) হযরত হাতেবের কথা শুনে বললেন “হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আপনি অনুমতি দিন, আমি তার শিরশ্চেদ করবো। এই লোকটি আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেয়ানত করেছে। সে মোনাফেক হয়ে গেছে।”
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লম বললেন “দেখো, সে বদরের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছে। হে ওমর (রা.) তুমি কি করে জানবে, এমনও হতে পারে যে, আল্লাহ তায়ালা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের
একথা শুনে হযরত ওমরের (রা.) দু’চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠলো। তিনি বললেন আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রসূলই ভালো জানেন।
এমনি করে আল্লাহ তায়ালা রব্বুল আলামীন গুপ্তচরদের ধরিয়ে দিলেন। ফলে মুসলমানদের যুদ্ধ প্রস্তুতির কোন খবরই কোরাইশদের কাছে পৌঁছুতে পারেনি।
Subscribe to:
Post Comments
(
Atom
)
No comments :
Post a Comment