আত্মার বাসর আত্মার প্রেম

আমার মামাতো বোন আমাকে একদিন চার ঘন্টা ধরে প্রেম করার মহাত্ম ও গৌরব বুঝালো। আমি একটু সহজ সরল মানুষ, যখন ও আমাকে বুঝাচ্ছিলো তখন ওরই প্রেমে পড়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু সেকথা ওকে বলতে পারি নাই কারণ ওর আগে থেকেই একটা বয়ফ্রেন্ড আছে।

ওইদিন রাতে ঘুমানোর আগে কল্পনার এক অন্যজগতে ভাসতেছিলাম আমি। এতই মোটিভেটেড হয়েছিলাম ওর কথা শুনে, মনে হচ্ছিলো এখনই যদি কোনো মেয়ের সঙ্গে বসে হাত ধরে গল্প করতে পারতাম। ভাবতে ভাবতে ঘুম এসে গেলো। কিন্তু কল্পনার রেশ আমার ঘুমের মধ্যেও কটালো না। জীবিত যতদিন ছিলাম ততদিন কাটেনি। মরার পরেও কটেনি।

ওই রাতেই রুমাকে স্বপ্ন দেখলাম। রুমার সঙ্গে অনেকদিন কথা হয় না। ও আমাকে একবার প্রেম করার কথা বলেছিলো কিন্তু আমি হাবাগোবা ভাব দেখিয়ে চুপ করে ছিলাম। ও আর কিছু বলে নাই পরে। ওই রাতে স্বপ্নে দেখলাম রুমা আর আমি রাণীগঞ্জের হাওরে নৌকায় বসে গোধুলি বেলায় দারুণ সময় কাটাচ্ছি দু'জনে।

সকালে যখন ঘুম ভাঙলো, বারবার রুমার কথা মনে পড়ছিলো৷ কলেজে গিয়ে ওইদিন রুমার সঙ্গে চোখাচোখি করলাম৷ এরকম আগে কোনোদিন করি নাই তাই ও একটা ইঙ্গিত পেলো। কলেজ শেষে ফেরার পথে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, কী ব্যাপার তোমার। আজ বারবার আমাকে দেখছিলে, তোমার আজ মেজাজ ভালো মনে হচ্ছে।

- রুমা, আজকে বিকালে ফ্রি আছো?

- কেন।

- আমার সঙ্গে একটু দেখা করতে পারবে?

- কিছু বলার থাকলে এখন বললেই তো পারো।

- এখন বলা যাবে না।

- কোথায় আসতে হবে?

- নদীর ধারে।

- ঠিক আছে।

- একা আসবে কিন্তু।

- একাই আসবো ভয় নাই তোমার।

ওইদিন ওকে একসেট লাল চুড়ি আর একটা উপন্যাসের বই গিফট দিয়েছিলাম। চুড়ি গুলো পেয়ে ও তো ভীষণ খুশি। এরপর আর সমস্ত প্রেমের গল্পে যা হয় আরকি সেরকমই হলো। ছয় মাস আমাদের প্রেম চললো। প্রায় প্রতিদিনই দেখা করি বিকেলে। এদিকে কলেজের বন্ধুবান্ধব সবাই জানলো আমাদের কথা।

আস্তে আস্তে ওর সঙ্গ পাওয়াটা আমার কাছে নেশার মতো হয়ে গেলো। এর মধ্যে ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো। আমার প্রেমের গল্প যেমন সরল গতিতে আগাচ্ছে ততো সরল না সেটা আমিও প্রথমে বুঝি নাই। কিন্তু দু'জন দু'জনের প্রতি তখন এতই মেতে ছিলাম যে এই বিচ্ছেদ আমাদের সহ্য হচ্ছিলো না। এমনকি সুইসাইড করারও পরিকল্পনা করলাম দু'জনে। পরিকল্পনামতো ওর বিয়ের আগের রাতে গ্রামের দক্ষিণ দিকের পাঁচ তলা যে আশ্রয়কেন্দ্রটা আছে সেটার ছাদে উঠলাম। আমরা সুইসাইড করবো এবিষয়ে আমি নিশ্চিত কিন্তু রুমা তখনও একটু দোটানায় ছিলো।

রাত বারোটার দিকে আশ্রয়কেন্দ্রের ছাদের রেলিঙের উপর দাঁড়িয়েছি আমি, পাশে রুমা দাঁড়িয়ে। রুমা এবার আমাকে জিজ্ঞেস করলো,

- লাফ দেওয়ার আরেকবার ভেবে দেখবে?

- আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না রুমা।

- ঠিক আছে লাফ দাও।

- তুমিও ওঠো একসঙ্গে দেই।

- দে তুই 

বলেই আমাকে ধাক্কা দিলো। পাঁচ তলা থেকে নিচে পড়ার সময় আমার একটা কথা-ই মনে আসলো,

'হায় উচিত কী তব

এ কাজ তোমার প্রিয়া,

পরপারে আমাকে 

দিলে একা ছাড়িয়া!'

( মধুসূদন দত্তের 'মেঘনাদবদ কাব্য' অবলম্বনে তৈরি হওয়া আমার শূন্যে ভাসা অনুভূতি!)

পরের দিনের ঘটনা। আমার শরীর এখন কবরে শুয়ে আছে কিন্তু আমি রুমার আশেপাশেই ঘুরছি। আমি মানে আমার আত্মা ঘুরছে।

সেদিন ওর যথারীতি বিয়ে হয়ে গেলো। স্বামীর সঙ্গে বাসর ঘরে বসে আছে তখন আমি সেখানে হাজির হলাম। ওর অশিক্ষিত স্বামী কোনো কথাবার্তা ছাড়াই হুট করে ঘরের বাতি নিভিয়ে রুমার উপর হামলে পড়লো। আমার তো রাগে মাথা গরম, আমি ওর স্বামী আলতাফের বুকে জোরে একটা লাথি মারলাম। সঙ্গে সঙ্গে উঠে গিয়ে ওর স্বামী ঘরের বাতি জ্বালালো। কিন্তু আমি তো আত্মা হয়ে এ ঘরে বসে আছি, আমাকে তো কেউই দেখতে পাবে না। দ্বিতীয়বার বাতি নিভিয়ে একই কাজ করতে গেলো, আমি আবারও ওর বুকে লাথি মারলাম। এবার বাতি জ্বালিয়ে আলতাফ খাটের নিচে, আলমারির ভেতর সব উল্টেপাল্টে দেখলো কাউকে না পেয়ে রুমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টি দিয়ে তাকালো এরপর বললো, 'এই কাজ কি তুমি করছো? তুমি আর আমি ছাড়া তো আর কেউ নেই এই রুমে।'

আমি যা চাচ্ছিলাম সেটা হয়েছে। ওই রুম থেকে আমি বের হয়ে আসলাম। ওদের মধ্যে আজকে আর কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নাই।

দ্বিতীয় ও তৃতীয় রাতেও ওদের সাথে একই কাজ করলাম। ওর স্বামী ঘরের বাতি নেভালেই আমি বুকে লাথি। কিন্তু এতেও কোনো কাজের কাজ হলো না। কারণ ওর স্বামী যথারীতি দুইবার লাথি খাওয়ার পর বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ে।

চিন্তা করলাম এভাবে হবে না। ভিন্ন কিছু করতে হবে। পরের রাতে আলতাফ রুমাকে কিছুক্ষণ আদর করে বাতি নেভানোর সাথে সাথে রুমার চুল মুঠ পাকিয়ে ধরে দুই তিনটা থাপ্পড় মারলাম। ওর স্বামী বাতি জ্বালিয়ে হা করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে, কারণ থাপ্পড়ের শব্দ দু'জনেই শুনতে পেয়েছে। রুমা এগিয়ে গিয়ে ওর স্বামীর গালে কষে একটা থাপ্পড় মারলো। আলতাফ অবাক চোখে প্রশ্ন করলো,

- আরে আমাকে মারছো কেন?

- নতুন বউকে অন্ধকারে থাপ্পড় মারতে আপনার লজ্জা করে না?

- আরে আমি থাপ্পড় মারবো কেন তোমাকে। 

- ভূত এসে এত জোরে থাপ্পড় মারলো?

- নিশ্চয় অলৌকিক কিছু হচ্ছে আমাদের সঙ্গে। আমিও তো বুকে লাথি খাচ্ছি তিন দিন যাবত।

- নাকি আপনার শারিরীক কোনো দূর্বলতা আছে?

- মানে?

- মানে সারাদিন আপনি ঠিক থাকেন শুধু রাতের বেলায় শরীর উত্তেজিত হয়ে উঠলে তখনই আপনি এইসব শুরু করেন।

- আরে না না। তোমার বিশ্বাস না হলে কালকে দিনের বেলায় আমরা ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত কাটানোর চেষ্টা করে দেখতে পারি।

- আপনি কালকে সকালেই আমাকে আমার বাবার বাড়িতে দিয়ে আসবেন।

- রুমা তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করছো না?

- নিজেই তো দেখলাম আপনার পৌরুষ। যুবতী একটা মেয়েকে ঘরে এনে রেখেছেন আর রাত হলেই কাহিনি শুরু করেন।

- কালকের দিনটা আমাকে সময় দাও। আমি তোমার ভুল ভাঙিয়ে দেবো। দিনের বেলায় পরীক্ষাটা করতে দাও আমাকে।

রুমা কোনো উত্তর না দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। আলতাফও ঘুমালো। দু'জনেই ঘুমাতে গেলো কিন্তু আমার চোখ থেকে ঘুম চলে গেলো। ওদের খাটের পায়া ধরে ফ্লোরে বসে বসে চিন্তা করতে লাগলাম কী করা যায়। দিনের বেলায় তো অলৌকিকত্বটা রুমা নিজের চোখে দেখবে তখন তো ও ওর স্বামীকে আর অবিশ্বাস করবে না। বরং বাড়ি থেকে আত্মা তাড়ানোর জন্য হুজুর ডেকে বাড়ি বন্ধ দেবে, আর আমি মরার পরেও আরেকবার ছ্যাকা খাবো। মরার আগেও ছ্যাকা মরার পরেও ছ্যাকা। এ হতে পারে না। এসব ভাবতে ভাবতে নজর করলাম আলতাফ আস্তে আস্তে নিজের হাতটা রুমার কোমড়ের উপর রাখলো। আলতাফ ভেবেছে শেষ রাতে আত্মারা চোখে দেখে না কিন্তু আমি যে অন্ধকারেও ওর দিকেই তাকিয়ে আছি সেটা তো ও জানে না। অপেক্ষা করতে করতে লাগলাম কখন রুমা জেগে ওঠে। কিছুক্ষণ পর রুমা জেগে উঠেই আলতাফকে জড়িয়ে ধরলো। আমি ভীষণ রেগে গিয়ে রুমার মুখে কষে এক থাপ্পড় মারলাম। রুমা ওর স্বামীকে ছেড়ে দিলো। তারপর চোখের পলকে আলতাফের দুই পায়ের মাঝখানে শুয়ে থেকেই এক লাথি মারলো। আলতাফ অপমানে,দুঃখে ব্যাথার কষ্ট সব বুঝে ওঠার আগেই রুমা ঘর থেকে বের হয়ে গেলো।

এত ব্যাথা পেয়েছে, আলতাফ ওই অবস্থাতেই কাতরাতে কাতরাতে আবার ঘুমিয়ে গিয়েছে। সকালে উঠে শোনে রুমা বাবার বাড়ি চলে গেছে।

সপ্তাহ খানেক এভাবেই কাটলো। রুমা ওর বাবাকে সব খুলে বলেছে৷ ওর বাবা মেয়েকে আর ওই বাড়িতে পাঠাবে না। আলতাফ বাধ্য হয়ে রুমাকে ডিভোর্স দিলো। কিছুদিন পর রুমার আবার বিয়ে হলো। বাসর রাতে আমি আবারও একই কাজ করলাম। কিন্তু রুমার এই স্বামী শিক্ষিত মানুষ। বউ হয়ে স্বামীর বুকে লাথি মেরেছে এটা ওর স্বামী মানতেই পারছে না। প্রথম দিনই অপমান সহ্য করতে না পেরে ওকে বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দিলো। এইবার রুমার পরিবারের লোকজন, পাড়া প্রতিবেশী সবাই ওকে অপমান করতে লাগলো। অপমানের মাত্র এতই তীব্র হলো, ও এক রাতে বাধ্য হলো আশ্রয়কেন্দ্রের ছাদে উঠতে।

এখন আমরা দু'জনেই আত্মা। রুমা আর আমি আত্মার জগতে মিলেমিশে একসঙ্গে আছি। আপনাদেরকে জানাতে চাই, পৃথিবীতে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে যারা মারা যায় তারা প্রকৃত অর্থে কখনো ব্যর্থ হয় না। তারা আত্মার জগতে গিয়ে মিলিত হয়। ঠিক যেমন রোমিও-জুলিয়েট, লায়লী-মজনু, ফরহাদ-শিরী এরা মৃত্যুর পর এখন মহা সুখে আছে। যেমন আছি আমি আর রুমা। এখন আমাদের কোনো দায়িত্ব নেই, আছে শুধু সুখ। দু'জনে আকাশ পাতাল ঘুরে ঘুরে বেড়াই আর যেসমস্ত মেয়েরা তার প্রেমিককে ফাঁকি দিয়ে অন্য জায়গায় বিয়ে করে তাদের বাসর রাতে হাজির হই। আর যথারীতি মুখে থাপ্পড় আর বুকে লাথি।

আত্মার বাসর আত্মার প্রেম

গোলাম কিবরিয়া

রেসিপি দেখুন
No comments :

No comments :

Post a Comment