রিকসাওয়ালাদের প্রেম করতে নাই

কলেজের সামনে শুক্রবার বাদে প্রত্যেকদিন একটা রিকসা দাঁড়িয়ে থাকে । রিকসাটা মিরাজের । কলেজ ছুটি হওয়ার এক ঘন্টা আগেই সে এখানে রিকসা নিয়ে অপেক্ষা করে ।

মিরাজের বয়স খুব বেশি না , বাইশ কি তেইশ । ঘরে বাবা থাকলে আজ লেখাপড়াটা চালিয়ে যেত সে । বাবা নেই , তাই রিকসা চালাচ্ছে । মা এলাকার একটা পতিতাপল্লির সর্দারনি । পতিতাবৃত্তি করে মিরাজ কে বড় করেছেন তিনি । হাজার হাজার খারাপ মানুষের বিছানায় যেতে যেতে ওনার মনেও সেই খারাপের ছিটে লেগে গেছে । মিরাজকে প্রায় সে বলতো তাকে এই কাজে সাহায্য করতে । বিনিময়ে পল্লির নতুন নতুন মেয়েগুলোকে নিয়ে ফুর্তি করুক সে । মাঝে মাঝে নিজের মায়ের মুখে এমন কথা শুনে গা রি রি করে উঠতো মিরাজের । তাই এখন আর সে মায়ের কাছে যায় না ।

কলেজের ঘন্টা বাজতেই মিরাজের চঞ্চলতা বাড়ে । সিটের নিচে থাকা সাবান নিয়ে সে ছুটে । হাত মুখ ভালো করে ধুয়ে মুছে নেয় ।

রিকসার পাশে পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে মিরাজ । মেয়েটা এখনই আসবে । এসেই মিষ্টি করে হেসে বলবে ...

' বাহ ! আজকেও ! ভালো ... '

শান্তির কন্ঠটা শুনলে মিরাজের ভেতরটা কাঁপে । অনেক কষ্টে সে নিজেকে সামলে নেয় । মেয়েটাকে ফাস্ট ইয়ারের সময় থেকে চিনে সে । এবার এইচ এস সি পরীক্ষা দিবে । এতদিনে এই জিনিসটা নিয়ন্ত্রন করতে শিখে গেছে সে ।

শান্তি চুপচাপ রিকসায় উঠে । মিরাজ রিকসায় উঠেই বলে , ' কই যামু আপা ? '

' আজকে চটপটি খাবো । আশেপাশে কোথায় চটপটি বেঁচে , সেখানে নিয়ে যাও । '

' আইচ্ছা ... ' বলে মিরাজ প্যাডেলে পায়ের চাপ ফেলে ।

শান্তি মেয়েটার বাইরে খাওয়ার ভয়ানক বাতিক আছে । সে বাইরের খাবার প্রায় খায় । মিরাজ ওর থেকে কখনোও ভাড়া নেয় না । সেই ভাড়ার টাকা জমিয়ে জমিয়ে এটা সেটা খায় । এখন বাইরের খাবার তো আর সব সময় ভালো হয় না ! তাই কোথায় ভালো চটপটি , ফুচকা বেঁচে , কে বাসি ঘুন্নি দিয়ে ঝালমুড়ি বানায় , এগুলো মিরাজের জানা লাগে । না হলে উলটা পালটা খেয়ে পেটের ব্যামো বাধিয়ে কলেজ কামাই , আর কলেজ কামাই মানে শান্তির সাথে দেখা না হওয়া !

রিকসা গিয়ে একটা চটপটির দোকানের সামনে থামে । শান্তির উচ্ছ্বাস বেড়ে যায় তখনই !

' তিরিশ টাকার চটপটি , ঝাল , টক বেশি করে দিতে বলবেন । '

' আইচ্ছা । '

মিরাজ তিরিশ টাকার চটপটি কিনে আনে । শান্তি যাই খায় , রিকসাতে বসে বসে খায় । বাইরে খায় না । শান্তি তৃপ্তি সহকারে চটপটি খাচ্ছে । বিকেলেও রোদের তাপটা খুব । মিরাজ হুড টা টেনে দেয় । মিরাজের এমন কাজে শান্তি মিরাজের দিকে তাকিয়ে একটু হাসে । মিরাজও লজ্জিত একটা হাসি উপহার দেয় শান্তিকে ।

...............................................................................................................

মিরাজ রিকসা চালাচ্ছে । শুক্রবার খুব একটা লোক পায়নি আজ মিরাজ । মন ওর খারাপ ।

হঠাৎ একটা দৃশ্য দেখে মিরাজের চোখ ছানাবড়া । শান্তি একটা ছেলের হাত ধরে হেঁটে আসছে । ছেলেটা সরাসরি মিরাজের দিকে তাকিয়ে ।

' মামা যাবেন ? '

মিরাজ কিছু বলে না । ও কিছুটা অবাক , কিছুটা স্তব্ধ । যদিও স্তব্ধ হওয়ার অধিকার তার কখনই ছিল না ।

' কি মামা যাবা না ? '

' কই যাইবেন ? '

' মিনি চিড়িয়াখানা । কত নিবা ? '

' দিয়েন যা ইচ্ছা ! '

' পঞ্চাশ দিবো । '

' আইচ্ছা । '

মিরাজের দিকে তাকিয়ে আছে শান্তি । শান্তি আজ খুব সুন্দর করে সেজেছে । নীল রঙের থ্রি পিস পড়েছে সে । চোখে কাজল । ভ্রু টা চিকন চিকন লাগছে আজ ।

শান্তি আর ওই ছেলেটা রিকসায় উঠে । প্যাডেলে পা ফেলতে খুব কষ্ট হচ্ছে মিরাজের । ওর শরীর টা কেমন যেন অবশ হয়ে এসেছে ।

রিকসা চালানোর সময় পেছন থেকে কিছু শব্দ আসে । শব্দগুলোর আসার কারন সে জানে । মিরাজের ইচ্ছে করছে রিকসা থামিয়ে ছেলেটাকে চড় মারতে । কিন্তু এটা করলে শান্তির সম্মান যাবে ।

পুরো রাস্তায় সে কিভাবে রিকসা চালিয়েছে , মিরাজই জানে । ওর হাত কাপছিলো । মাথা বন বন করে ঘুরছিলো ।

' মামা থামেন ! '

ছেলেটা নেমে একশো টাকার একটা নোট মিরাজকে দেয় ।

' যেখান থেকে উঠেছিলাম , ওকে সেখানে দিয়ে আসো । '

মিরাজ হা করে তাকিয়ে থাকে ছেলেটার দিকে । ছেলেটা শিস বাজাতে বাজাতে রাস্তার ওই পাড়ে চলে যায় ।

মিরাজ একটু শান্তির দিকে তাকায় । শান্তি কাঁদছে । চোখের কাজল লেপ্টে গেছে । ঠোট লাল হয়ে আছে খুব । গলায় কামড়ের দাগ ।

মিরাজ রিকসাটা ঘুরায় । খুব জোরে প্যাডেলে পা ফেলে । এখানে সে এক সেকেন্ড থাকতে পারবে না ।

' মিরাজ ভাই ? '

মিরাজ কিছুই বলেনা । সে চুপচাপ রিকসা চালায় । মিরাজ কাঁদছে । বিধাতার খেলা সে কিছুতেই বুঝে না । দুই বছর রিকসায় ঘুরিয়ে আজ পর্যন্ত শান্তির হাত ছুয়ে দেখার সাহস হয় নি । একটা ছেলে একদিন রিকসায় চড়িয়ে কি না করলো শান্তির সাথে ! আসলে ভালোবাসা হতে হয় সমানে সমানে । রিকসাওয়ালাদের প্রেম থাকতে নেই । তার উপর আবার এমন কারোও সাথে , যার সামনে দাড়ানোর ক্ষমতা তার নেই । মিরাজ আর কোনও দিন শান্তির জন্য অপেক্ষা করবে না । মিরাজের বুক ফেটে কান্না আসে । কিন্তু সে কাঁদছে না । কার জন্য কাদবে সে ?

শান্তির জন্য কাঁদার অধিকারও যে মিরাজের নেই ! শুধু শুধু কেদে লাভ নেই ।
রেসিপি দেখুন