মরুর ফুল ৩১

শাহাজাদা ফররুখের লাশ সৎকারের উদ্দেশ্যে তার কক্ষ থেকে বাইরে নেয়া হবে সেই প্রস্তুতি চলছে। ইতিমধ্যে রাজ প্রাসাদের হেকিম ও তার ছয় সাথী এসে হাজির। হেকিম সাহেব এসে ফররুখের চোখের মণি দেখলেন, জিহবা দেখলেন। তারপরে তাকালেন পাশে থাকা ঔষধের বাটির দিকে। বাটির গন্ধ শুঁকলেন। সন্দেহ হলে তিনি ওনার এক সাথীকে ডাকলেন। তাকে এই বাটিটা দিয়ে বললেন “আমার কাছে এই ঔষধ আরো আছে। আজ সকালে বানিয়েছি। তার সাথে মিলিয়ে দেখ কোন পার্থক্য পাও কিনা। তবে ভুলেও পরীক্ষা করার আগে এই ঔষধ মুখে দিবে না। আমার একটা সন্দেহ হচ্ছে। শাহজাদার যে অসুখ হয়েছে সেই অসুখ দুই তিন দিন পরে সেরে যেত। এই অসুখে মানুষ মারা যায় না।” ভীড়ের মাঝে ও শোরগোলের কারণে কেউ হেকিমের দিকে নজর দিচ্ছে না শুধু দুই জন ছাড়া- একজন শাহজাদী বিলকিস আরেকজন শাহজাদা শেরওয়া। কারণ এই দুই জনই জানে শাহজাদা ফররুখের মৃত্যুর আসল কারণ সেই ঔষধের বাটিতেই রয়েছে। হেকিমের সাথী ঔষধের বাটি নিয়ে বাইরে যেতেই শাহজাদী বিলকিস দ্রুত তার কক্ষে প্রবেশ করল। মাসউদ সেখানে আগে থেকেই লুকিয়ে আছে।
“ঔষধের বাটি পরীক্ষা করলেই সব ধরা পড়ে যাবে। তখন সন্দেহ মেহরিনকে না করে রাজ প্রাসাদের কারো উপরে পড়বে। তার আগেই মেহরিন ও তার মাকে হত্যা করতে হবে।”
“সৎকার না করে সম্রাট দরবারে ফিরবেন না। আর সম্রাট বলেছেন তাদেরকে নিজ হাতে হত্যা করবেন। তা না হলে আমি নিজেই গিয়ে তাদেরকে হত্যা করতাম।”
“এই তো বুদ্ধিমানের মত কথা বলেছ। তুমিই তাদের হত্যা করবে। তুমি এখান থেকে বেরিয়েই সোজা ওদের কয়েদখানায় চলে যাবে। ওদের হত্যা করে বলবে-তুমি সম্রাটের আদেশ শুনে ওদের ধরে আনতে গিয়েছিলে। ওরা তোমাকে বাঁধা দেয়। তোমার ছুরি কেড়ে নিয়ে তোমাকেই আক্রমণ করে বসে। তখন তুমি আত্মরক্ষার্থে ওদেরকে হত্যা কর। এতে সম্রাট অখুশী হবেন না। কারণ এমনিতেই আজ ওদেরকে মেরে ফেলা হত।”
“কিন্তু শাহজাদী, এক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন জাগতে পারে। কারণ যেখানে খালেকদুনের স্ত্রীকে বন্দী রাখা হয়েছে সেখানে আমার প্রবেশ নিষেধ। সেই এলাকায় শুধু সিনিয়ার অফিসাররাই যেতে পারেন
----
শাহজাদা শেরওয়া ফররুখের কক্ষ থেকে বেরিয়ে দ্রুত নিজের কক্ষে প্রবেশ করলেন। জায়েদ তার জন্য অপেক্ষা করছে।
শেরওয়া “যা হবার তাই হয়েছে। রাজ প্রাসাদের এক শাহজাদী মেহরিনকে দোষারোপ করে। তা শুনে সম্রাট মেহরিন ও তার মায়ের মাথা নিজেই কাটবেন বলে ঘোষনা দিয়েছেন। ফররুখের সৎকার হলেই তিনি এই কাজ করবেন। ওদেরকে দরবারে ধরে আনতে বলা হয়েছে।”
জায়েদ চোখে মুখে অন্ধকার দেখছে। এতদিন শুনেছে মেহরিন কারাবন্দী, তাকে ফররুখের দাসী বানানো হবে। এখন শুনছে কিছুক্ষণের মধ্যে মেহরিনের মৃত্যু দন্ড কার্যকর করা হবে। সে কী করবে বুঝতে পারছে না। তার কোন কিছু করার ক্ষমতাও নেই। বিশ্বের সবচেয়ে বড় সম্রাজ্য ইরানের সম্রাট যেখান মেহরিনের মৃত্যুদন্ডের হুকুম দিয়েছে সেখানে জায়েদ নগণ্য একজন লোক হয়ে কী করবে?
জায়েদের চেহারা দেখে শেওরয়া বলল “এখনো ওদের বাঁচানোর সুযোগ আছে। যদিও সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। যদি মেহরিনদের এখনই পালানোর ব্যবস্থা করা যায় তাহলে ওরা বেঁচে গেল।”
“কিন্তু আপনি বলেছেন সম্রাট ওদেরকে দরবারে নিয়ে যেতে বলেছেন”
“দরবারে অবশ্যই নিয়ে যাবেন। তার আগে সম্রাট ফররুখের শেষ কৃত্য পালন করবেন। ফররুখ সম্রাটের অত্যন্ত প্রিয় সন্তান ছিল। তার মাথায় যদি বুদ্ধি থাকত তাহলে তাকে পরবর্তী সম্রাট হিসেবে ঘোষনা দেয়া হত। শেষ কৃত্য এই প্রহরের মধ্যেই হবে। হাতে তুমি অল্প সময় পাবে। সেক্ষেত্রে তোমাকে আমার একটা কাজ করে দিতে হবে। যে কাজ করার জন্য তোমাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে আর তার বিনিময়ে মেহরিন ও তার মাকে মুক্তির ব্যবস্থা করার কথা দিয়েছিলাম।”
জায়েদের মনে পড়ল তাকে দুইটি কাজ দেয়া হয়েছিল- শাহাজাদা ফররুখ ও প্রধান পূজারী মাকানকে হত্যা করার বিনিময়ে তার ইচ্ছা পূরণ করা হবে। জায়েদ বলল “মাকানকে কোথায় পাওয়া যাবে?
শেরওয়া উত্তর দিলেন “এই মুহুর্তে হয়তো সম্রাটের কাছাকাছি”
জায়েদ হতভম্ভ হয়ে রইল। সম্রাটের এত সিপাই, এত পাহারার মধ্যে মাকানের কাছেই যেখানে যাওয়া কষ্টকর সেখানে তাকে কীভাবে হত্যা করবে। জায়েদের মনে হঠাত প্রশ্ন জাগল শেরওয়া জায়েদকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিয়ে পরে অস্বীকার করবেন না তো? যে তার সৎ ভাইকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছে, প্রধান পুজারীকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছে তাকে বিশ্বাস করা কি ঠিক হবে? কিন্তু জায়েদের এই মুহুর্তে করার কিছুই নেই। জায়েদ জিজ্ঞেস করল আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলুন। শেরওয়া বললেন “তুমি আমার পাশে পাশে থাকবে। তুমি গায়ে পূজারীর পোষাক পরে নাও। আমার আশেপাশে অনেক পূজারী থাকবে। প্রধান পূজারীকে আমাদের দলের মধ্যে ঢোকাতে পারলেই হল। ব্যাস, তুমি তোমার কাজ সেরে ফেলবে।
---
খালেকদুনের সেনা ছাউনিতে সম্রাটের যে দূত সহ-সেনাপতির উদ্দেশ্যে গিয়েছিল সে রাজ প্রাসাদ থেকে বের হবার পরে নদীর ওপাড়ে তাকে একদল সশস্ত্র লোক আটকায়। তার কাছ থেকে চিঠি নিয়ে পড়ে। এরপরে তাকে বলা হয় এই চিঠি নিয়ে তুমি খালেকদুনের কাছে দিবে। তার বিনিময়ে তুমি এই স্বর্ণমুদ্রাগুল
ো পাবে বলে তাকে অনেক স্বর্ণ মুদ্রা দেয়া হয়। এরপরে তকে এও বলা হয় যে সে যদি ভুলেও এই চিঠি সহ-সেনাপতির কাছে দেয় তাহলে মাদায়েনের অবস্থিত তার পরিবারের কেউ বেঁচে থাকবে না। দূত এমনিতেই স্বর্ণ মুদ্রা পেয়ে খুশী, হুমকি না দিলেও চলত। তারা দূতকে আরেকটি চিঠি দিল তাও খালেকদুনের হাতে পৌঁছে দিতে হবে। দূত খালেকদুনের কাছে চিঠি দিল। খালেকদুন চিঠি পেয়ে কী করবেন বুঝতে পারলেন না। চিঠিতে সহ-সেনাপতির উদ্দেশ্যে সম্রাট লিখেছেন-
খালেকদুনের মাথা কেটে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও আর তুমি সেনাপতির দায়িত্বভার গ্রহন কর।
তারপরে তিনি সহ-সেনাপতি সহ পাঁচশ ইরানী সেনা অফিসারকে ডাকলেন। সবার সামনে সম্রাটের চিঠি পড়ে শোনালেন। সহ-সেনাপতি মাথা নিচু করে চুপ করে থাকলেন। বাকী সেনারা গর্জে উঠল- তারা সম্রাটের এই অন্যায় আদেশের বিপক্ষে। দুই একজন সহ-সেনাপতির বিরুদ্ধে শ্লোগান দিল। এরপরে খালেকদুন সহ-সেনাপতিকে জিজ্ঞেস করলেন “তুমি কি এই পাঁচশ অফিসার ও দুই লক্ষ সেনার মাথা কাটতে চাও?”
সহ-সেনাপতি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন “আমি আপনার সাথে আছি”
খালেকদুন বাকী চিঠিটা পড়ে দেখলেন। সিনিয়র সেনা অফিসারকে চিঠিটা পড়ে শোনালেন। শাহজাদা শেরওয়ার পক্ষে সকল ইরাণী সেনা অফিসারদের উদ্দেশ্যে চিঠি। তাতে লেখা-
আপনারা যুদ্ধ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছেন। এ যুদ্ধ কখনো শেষ হবার নয়। সম্রাট খসরু পারভেজের অযোগ্যতায় আজ আমরা আমাদের প্রিয় শহর আরমিয়া হারিয়েছি, ইরানের সাবেক রাজধানী দস্তরগীদ হারিয়েছি। ইরানের সবচেয়ে জৌলুশ জাঁক জমকপুর্ণ শহর বন্দর হারিয়েছি। যুদ্ধে আমাদের লক্ষ লক্ষ ভাই মারা গেছেন। আমাদের অনেকের বোন অনেকের মেয়ে অনেকের স্ত্রী আজ রোমানদের হেরেমে অমানবিক জীবন যাপন করছে। তাদের জন্য দায়ী এই সম্রাট। এই ব্যর্থ সম্রাট নিজে তো দেশের ক্ষতি করেছেনই এরপরে দেশের আরো ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে তার সবচেয়ে যুদ্ধ বাজ ছেলে শাহজাদা মারোজাকে তার উত্তর সূরী ঘোষনা করেছেন। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি মারোজার হাতে ক্ষমতা তুলে দিবেন। মারোজা ক্ষমতায় থাকা আর খসরু পারভেজের ক্ষমতায় থাকা একই কথা। এতে সেনাদের কোন উন্নতি হবে না। আপনারা যদি আমার সাথে থাকেন, আপনারা যদি আমাদকে ক্ষমতায় বসাতে পারেন তাহলে আমার প্রথম কাজ হবে রোমানদের সাথে শান্তি চুক্তি করে যুদ্ধ বন্ধ করা। এ যুদ্ধ বন্ধ করতে হলে আমার হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে হবে। আপনারা চাইলে এখনই অবরোধের ছাউনি গুটিয়ে রোমান সম্রাটকে আমার কথা জানিয়ে মাদায়েনে চলে আসতে পারেন। আমি আপনাদের অপেক্ষায় রয়েছি। আমি কথা দিচ্ছি, আমি সব সেনা অফিসারদের বেতন বাড়িয়ে দিব।
শাহজাদা শেরওয়ার চিঠি সেনা অফিসারদের মনের মধ্যে একটা শান্তির স্রোত বইয়ে দিল। গত তিরিশ বছর ধরে তারা যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত। এখন মান সম্মানের ও জনের ভয়ে যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারছে না। এখন যেহেতু রাজ পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে যুদ্ধ বিরোধী বক্তব্য এসেছে তাহলে তো অনেক ভালই। যে যার বাড়ীতে ফিরে যেতে পারবে। কত বছর যে সেনারা বাড়ী যাচ্ছে না! এছাড়া বেতন বাড়ানোর বিষয়টাও অনেক গুরুত্বপুর্ণ। সবাই সিদ্ধান্ত নিল তারা আজই এই এলাকা ছেড়ে দিবে। বসফরার প্রণালীর অপর প্রান্তে বসে রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াস দেখছিলেন ইরানীরা ছাউনি গুটিয়ে নিচ্ছে। কিছুক্ষণ পরেই তার কাছে ইরানী দূত এল। খালেকদুন জানিয়েছে- তারা ছাউনি গুটিয়ে মাদায়েনে চলে যাচ্ছে। ইরানের পরবর্তী সম্রাট হচ্ছেন শেরওয়া। তিনি কথা দিচ্ছেন তিনি ক্ষমতায় গেলে সবার আগে যুদ্ধ বন্ধের উদোগ্য নিবেন। হিরাক্লিয়াস সেই দূতের মাধ্যমেই উত্তর দিলেন- ইরানে যদি এ ধরনের কোন বিপ্লব আসে তাহলে আমি শেরওয়াকে সমর্থন দিব। আমি নিজেও যুদ্ধ চাই না।
খালেকদুনের পক্ষ থেকেই সিরিয়া ইরাক মিশর পশ্চিম এশিয়া পূর্ব ইউরোপের সকল স্থানে যেখানে যেখানে ইরানী ছাউনি রয়েছে সেখানে শেরওয়ার বক্তব্য পাঠিয়ে দূত পাঠানো হল। তাদের সবাই সম্রাট হিসেবে শেরওয়াকে সমর্থন দিলেন। খালেকদুন সমর্থন পেয়ে মাদায়েনের দিকে রওনা হলেন।
রেসিপি দেখুন
No comments :

No comments :

Post a Comment